×

বিশেষ সংখ্যা

বাকশাল : বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:৩৪ পিএম

বাকশাল : বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন
বাকশাল : বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন
বাকশাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবর্তিত গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের একটি মিশেল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শাসনব্যবস্থার নাম বাকশাল। এ শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের নেতা ও সকল পেশার মানুষের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন করে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশেল সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার করার চিন্তা করা হয়েছিল। তাই এ চিন্তাকে অগ্রসর সমাজতন্ত্র (অফাধহপব ঝড়পরধষরংস) বা অগ্রসর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি বলেও অভিহিত করা যায়। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার মূলনীতি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মুজিববাদ বলা হলেও মূলত এই বাকশাল শাসনব্যবস্থাকেই মুজিববাদ বলে আখ্যায়িত করা যায় বাকশাল কর্মসূচির মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর বিশ্ব-বাচনিকতা ও চিন্তার বিস্তার ঘটেছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার পর তথাকথিত গণতন্ত্রের লেবাসধারী স্বখাতসলিলে অবস্থানকারী কিছু রাজনৈতিক অর্বাচীন বাকশালকে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বলে বিতর্কিত ও কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে। বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ-বিদ্বেষী বিদেশি এজেন্টরা বিদেশি পয়সা নিয়ে বাকশালের বিপক্ষে উল্লম্ফন করেছে। পুঁজিবাদি বিশ্ব ও তাদের সমর্থিত প্রচারযন্ত্রগুলো বিদেশি মদদে বাকশালের বিরুদ্ধে বেধড়ক অপপ্রচার চালিয়েছে। এই সম্মিলিত দুরাচারেরা একসময় বাকশালকে অচ্ছুৎ একটি শব্দ করে তুলেছে। কিন্তু কোনো অর্থেই বাকশালকে এক দলীয় শাসনব্যবস্থা বলা যায় না। এটি ছিল সর্বদলীয় ও সর্বপেশা সমন্বিত সরকার ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন ও সমাজতন্ত্র ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়। এ ঘটনার পর বিশ্বের শোষিত শ্রেণি আশাবাদী হয়ে ওঠে। সমাজবদলের স্বপ্নে তৎকালীন বাংলার তরুণ সমাজও উৎসাহিত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে যে সময় সমাজতন্ত্রের অভিঘাত কলকাতার তরুণ ও সচেতন সমাজে বিদ্রোহী সত্তা হাউই উড়াচ্ছিল, সে সময় ১৯৪৩ সালে বাংলা অঞ্চলে প্রবল খাদ্যাভাব দেখা দেয়। কিন্তু পুঁজিবাদী ব্রিটিশ সরকারের খামখেয়ালিপনা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নীতি ব্যাপক মুদ্রাস্ফীতি ঘটায়, ফটকা ক্রেতা ও মজুদদারদের দৌরাত্ম্যের কারণে বাংলা অঞ্চলে খাদ্যের দাম গরিব মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যায়। ফলে বাংলা অঞ্চলে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ খাদ্য না পেয়ে মারা যেতে থাকে। সে সময় পুঁজিবাদী ব্রিটিশ সরকার ও তাদের সৃষ্ট বেনিয়াদের মজুতদারিত্বের বিষদাঁত ভেঙে দিতে কলকাতার তরুণ ও সচেতন সমাজ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। প্রকৃতঅর্থেই সে সময় শোষিত-বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষদের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কলকাতার তরুণ ও সচেতন মহলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিকব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রবল আকুতি দেখা যায়। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ, খাদ্যপীড়িত জনমানুষের আর্তনাদ-মৃত্যু, পুঁজিবাদী ব্রিটিশ সরকারের অব্যবস্থাপনা ও মজুতদার ও বেনিয়া-পোষণ নীতি বঙ্গবন্ধুকেও বিক্ষুব্ধ করেছিল। তিনিও দুর্ভিক্ষ এবং দুর্ভিক্ষকে পুঁজি করে এ দেশের বেনিয়াশ্রেণির মুনাফালাভের অসহনীয় ও অমানবিক তৎপরতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। সে সময় তিনি প্রচলিত রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার প্রতি তিনি আস্থা হারিয়ে ফেলেন। রাজনীতির সাথে এ সময়ের পূর্বে দৃশ্যত সংযুক্ত হলেও মূলত বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব রাজনৈতিক চিন্তাসূত্রের বিকাশ এ সময় ঘটে। কলকাতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক চলমান তৎকালীন সেই অবস্থা বঙ্গবন্ধুর সে চিন্তাসূত্রকে সমৃদ্ধ করে তোলে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠান পর রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পুঁজিবাদের নগ্ন উল্লম্ফন এবং রাষ্ট্রে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন না দেখে বঙ্গবন্ধু বিচলিত হয়ে ওঠেন। তিনি দেখেছেন, সিস্টেমগত কারণে সামাজিক শোষণ-নিপীড়ন ও দারিদ্র্য-বঞ্চনা সমাজের সিংহভাগ মানুষের নিয়তি হয়ে উঠেছে। দিন-রাত অমানবিক পরিশ্রম করেও কৃষক তার ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারে না। একজন শ্রমিক তার বঞ্চনাময় শ্রমরাজ্যের পরাকাষ্ঠা থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রশাসনিক সিস্টেম খাদ্য-সংকট সৃষ্টি করে পীড়িত করে রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক মানুষকে। প্রতি বছর অনাহারে-অর্ধাহারে রোগে-শোকে মৃত্যুবরণ করে হাজার হাজার মানুষ। অন্যদিকে কলাগাছের মতো প্রতিনিয়ত ফুলে-ফেঁপে ওঠে রাষ্ট্রের স্বল্পসংখ্যক পুঁজি নিয়ন্ত্রক ও ভ‚মি-মালিকেরা। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাদী চক্রও এখানে ছিপ ফেলে তুলে নিয়ে যায় বিপুল অর্থ-সম্পদ। নানা উপায়ে শোষণ চলে সমাজের সর্বত্র। বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই এই বঞ্চনার অবসানের লক্ষ্যে সমাজকাঠামো বদলাতে চেয়েছেন। তবে তথাকথিত সমাজতন্ত্রীদের মতো নানা তত্তে¡র সংশ্লেষণ ঘটিয়ে সমাজের শোষণ-বঞ্চনা অবসানে বঙ্গবন্ধু কখনো অলসচিন্তায় তৎপর হননি। তিনি জানতেন, সমাজের মানুষের চিন্তা-সংলগ্ন না থেকে সমাজ বদলানো যায় না। সমাজ বদলের অপরিহার্য শর্তই হচ্ছে, সাধারণ মানুষের মর্মবোধ উপলব্ধি এবং তার সাথে একাত্ম থেকে অগ্রসর চিন্তার বিস্তার ঘটানো এবং সমাজকে পতিত অবস্থা থেকে তুলে আনা। তাই ধর্মীয় অস্বচ্ছ চিন্তার সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে তৎকালীন সমাজতন্ত্র বিমুখ ও সমাজতন্ত্রে আস্থাহীন সমাজের কাছে তিনি ধর্মীয় বাতাবরণে নিজেকে উন্মোচন করেছেন। তিনি গতিময় সক্রিয়তা নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করে এ সংকট নিরসন করতে চেয়েছেন। সে কারণে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সক্রিয় থেকেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রতি মোহ প্রদর্শন করেছেন। তিনি মনে করেছেন, শোষণ-প্রক্রিয়ার পথ বন্ধের জন্য সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকল্প নেই। তিনি অপকটে তাঁর চিন্তাসূত্রের এই স্বরূপ তুলে ধরে বলেছেন : আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না। পুঁজিপতিরা নিজেদের স্বার্থে বিশ্বযুদ্ধ লাগাতে বদ্ধপরিকর। বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চীনের রাজধানী তৎকালীন পিকিংয়ে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে যান। তিনি সেবার চীনের নানা শিল্প কারখানা, কৃষি ও কৃষকদের অবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, ধর্ম প্রতিপালনসহ নানা বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি চীনাদের উন্নয়ন প্রচেষ্টা-উদ্যোগ এবং বিলাসিতা পরিহারের নমুনা দেখে মুগ্ধ হন। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি বঙ্গবন্ধু তখনই আকৃষ্ট হন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে সমাজতন্ত্রের প্রভাব পািকস্তান শাসনামলে প্রকট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ফলে বঙ্গবন্ধুকে আবার সরকারের রোষানলে পড়তে হয়। তাঁকে সে বছরের ৮ মে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয়। এই গ্রেপ্তার পরবর্তীকালে পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী শেখ মুহাম্মদ শোয়েব খান মার্কিন সরকারকে খুশি করতে পুঁজিবাদীদের তোষণ এবং গরিবদের শোষণনীতিমূলক বাজেট প্রদান করেন। সে বাজেটে শিল্পপতিদের ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘ট্যাক্স হলিডে’ ভোগের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখাসহ একচেটিয়াভাবে পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করার সুযোগ দেয়া হয়। এই বাজেট ও মার্কিন সরকারকে তোয়াজ করার নীতির সমালোচনা করে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বঙ্গবন্ধু লিখছেন : একমাত্র সমাজতন্ত্র কায়েম করলে কারও কাছে এত হেয় হয়ে সাহায্য নিতে হতো না। (কারাগারের রোজনামচা) গণআন্দোলনে বাধ্য হয়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুসহ ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’র সকল আসামিকে মুক্তি দেয় এবং পরবর্তীকালে তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। তবে তিনি পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু ২৮ অক্টোবর রেডিও-টেলিভিশনে ভাষণ দেন। সে ভাষণে তিনি অর্থনৈতিক রূপবদলের প্রতিশ্রুতিপূর্ণ প্রদান করেন, যা ছিল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূলসূত্র। তিনি বলেন : আমাদের বিশ্বাস, শাসনতান্ত্রিক ও কাঠামোর মাধ্যমেই গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব এবং অন্যায়, অবিচার ও শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে। ... অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অংশ নিশ্চিত করার জন্য অর্থনৈতিক কাঠামোতে অবশ্যই আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। জাতীয়করণের মাধ্যমে ব্যাংক ও বিমা কোম্পানিগুলোসহ অর্থনীতির মূল চাবিকাঠিগুলোকে জনগণের মালিকানায় আনা অত্যাবশ্যক বলে আমরা বিশ্বাস করি। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। সে ঘোষণায় তিনি রাষ্ট্রে শোষণ ও অবিচারমুক্ত নতুন সমাজ গড়ার লক্ষ্যে আভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লব ঘটাতে সম্পদের সামাজিকরণ ও জাতীয়করণ করার নির্দেশনা প্রদান করেন। তারপর বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চিন্তাসূত্র বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যুগান্তকারী এক সংবিধান গ্রহণ করেন। সে সংবিধানে তিনি রাষ্ট্রে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংবিধানের মৌলিক স্তম্ভ হিসেবে সমাজতন্ত্রকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। সংবিধানে সমাজতন্ত্রের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে : সমাজতন্ত্র : মানুষের ওপর মানুষের শোষণ থেকে মুক্ত ন্যায়ানুগ সমাজলাভ নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হলো রাষ্ট্রের লক্ষ্য। (অনুচ্ছেদ নং : ১০) ১৯৪৭ সাল থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাসূত্রের মূল উপাদান সমাজতন্ত্র। তবে কমিউনিস্টদের মতো বিদেশ থেকে আমদানি করা তত্তে¡ তিনি বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সমাজতন্ত্রে মূলসূত্র অনুসারে সমাজ থেকে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য নিরসন, মালিক-শ্রমিক ব্যবধান মোচন ও সকল প্রকার শোষণের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের জনমানুষের মুক্তির জন্য বাকশাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ও অর্থনীতি চালু করতে চেয়েছিলেন। বাকশাল কর্মসূচি গ্রহণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যাশা নিয়ে ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। তারপর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু আত্মনিবেদন করেন। যুদ্ধকবলিত মানুষদের খাদ্য সংকট নিরসনে ব্যাপকভিত্তিক রিলিফ কর্মসূচি শুরু হয়। বাসস্থান নির্মাণ সামগ্রী ও কৃষি-উন্নয়নসামগ্রী বিনামূল্যে বিতরণ কর্মসূচি এগিয়ে চলে। কিন্তু দেশের এক শ্রেণির তথাকথিত রাজনীতিবিদ, কর্মকর্তা-কর্মচারী রাষ্ট্রের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, রিলিফ কর্মসূচিসহ সরকারের নানামুখী কর্মপ্রবাহের সুযোগ ব্যবহার করে বৈধ-অবৈধভাবে সম্পদশালী হওয়ার উৎসবে মেতে ওঠে। তারা দুর্নীতি, লুটপাট ও উৎকোচ গ্রহণের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়তে থাকে। আবার এক শ্রেণির বণিক সদ্য গঠিত রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতা ও উন্মুক্ত বর্ডারের সুযোগ ব্যবহার করে সরকারের দেয়া সাহায্যসামগ্রী মজুত ও কালোবাজারি শুরু করে। নতুন রাষ্ট্রে ব্যবসার সুযোগ বুঝে সাম্রাজ্যবাদী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোও এখানে নোঙর ফেলে। ফলে বাঙালি বঙ্গবন্ধু তাবৎ বিশ্ব থেকে ঋণ ও ভিক্ষা করে টাকা ও খাদ্যসামগ্রী আনছিলেন, আর সেই টাকা ও খাদ্যসামগ্রীর একটি অংশ চোর-চাটার-দুর্নীতিবাজ-লুটেরাদের পকেটে চলে যাচ্ছিল। পরবর্তীকালেও দেশের এক শ্রেণির বণিকেরা সরকারের দেয়া সাহায্যসামগ্রীর সাথে দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত খাদ্যসামগ্রী মদুত করে কালোবাজারি ও মোনাফাখোরি অব্যাহত রাখে। আবার লুটেরাদের বাইরে তখন সমাজ-জীবনে চলছিল নানামুখী অস্থিরতা। বেশুমার আগ্নেয়াস্ত্র তখন প্রান্তিক জনপদের তরুণদের হাতে ঝলকে উঠছিল। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর বাংলাদেশ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। এ দুর্ভিক্ষের প্রধান কারণ ছিল বন্যা। আগস্ট মাসে মেঘনা নদীর পানি সর্বকালের রেকর্ড ভেঙে বিপদসীমার পাঁচ ফুট ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। বন্যার কারণে রাজধানীর সাথে চট্টগ্রাম, সিলেটসহ উত্তরবঙ্গের সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তখন বাংলা শ্রাবণ মাসের মাঝামাঝি সময়। মাঠে আউশ ধানের খেতে শিষ বের হচ্ছিল। আমন ধানের গাছ বেড়ে উঠছিল। আকস্মিক বন্যায় দেশের বিপুল পরিমাণ আউশ-আমন ধানখেত ডুবে যায়। ফলে প্রায় ১০ লাখ টন ফসল মার খায়। আবার আকস্মিক বন্যার আক্রমণে কর্মহারা হয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষ। উত্তরবঙ্গের জনপদে ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দেয়। সেই সংকট যুদ্ধোত্তর সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। আবার সেই প্রেক্ষাপটে খাদ্য সংকটকে দেশের অভ্যন্তরীণ ধড়িবাজ বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া চোরাকারবারি, মজুতদার, কালোবাজারি ধনিক-বণিকেরা মুনাফালাভের উপযুক্ত সময় বলে বিবেচনা করে বসে। তারা নীতি-নৈতিকতা-মানবিকতা বিসর্জন দিয়ে অধিক মুনাফার লোভে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুত করে ফেলে এবং অভাবিতভাবে দাম বাড়িয়ে দেয়। সে সময় জাসদ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য গণবাহিনী গঠন করে। দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়ে সরকারকে অজনপ্রিয় করার জন্য দুষ্কৃতকারীরা খাদ্যগুদাম ও পাটগুদামে অগ্নিসংযোগ বাড়িয়ে দেয়। তারা খাদ্য বহনকারী ট্রাক, ট্রেন ও জাহাজ ধ্বংস করার মতো অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ শুরু করে। এ সময় বাংলাদেশের শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু সরকারকে বেকায়দায় ফেলে অসফল প্রমাণ করার জন্য চক্রান্ত করে। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কিউবায় ৫০ লাখ ডলার মূল্যের ৪০ লাখ চটের ব্যাগ বিক্রি করার অজুহাতে মার্কিন খাদ্য সাহায্য আইন পিএল ৪৮০ তুলে ধরে বাংলাদেশ খাদ্য সাহায্যের জন্য যোগ্যতা সম্পন্ন দেশ নয় বলে হঠাৎ করে খাদ্য সাহায্য স্থগিত করে দেয়। ফলে এ দেশের মুনাফালোভী বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া ধনিক-বণিকদের কারসাজি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসহযোগিতার কারণে ১৯৭৪ সালের আগস্ট-অক্টোবরব্যাপী ভয়াবহ দুভিক্ষ দেখা দেয়। সরকারি হিসাবে ২৭ হাজারের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ ও অগণিত মানুষের মৃত্যু বঙ্গবন্ধুকে ভিন্ন মানুষ করে তোলে। তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে ও দৃঢ় প্রত্যয়ে এ দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ দরিদ্র-বঞ্চিত-শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বল্পসংখ্যক বুর্জোয়া-পেটিবুর্জোয়া ধনিক-বণিকদের মজুতদারি, কালোবাজারি, মুনাফাখোরি এবং অসৎ রাজনীতিবিদ-কর্মজীবীদের রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাট ও উৎকোচ গ্রহণ প্রবণতা চিরকালের জন্য বন্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি বাংলাদেশের মতো যুদ্ধোত্তর দেশের দরিদ্র-অসহায় মানুষের শোষণ-বঞ্চনা এবং মুনাফালোভী দুর্নীতিবাজদের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রচলিত গণতন্ত্রের অসহায় রূপ দেখতে পেলেন। ফলে বঙ্গবন্ধু অগ্রসর সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বাকশাল কর্মসূচি গ্রহণ করে দুর্নীতি ও লুটপাটের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ার পথই বন্ধ করে দিতে চাইলেন। বঙ্গবন্ধুর বাকশাল শোষিতের গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্রের অগ্রসর রূপ। রাষ্ট্রশাসনের তিন বছরকাল অতিক্রম করার পর তৎকালীন বিশ্ব-রাজনীতি ও রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কতগুলো বাস্তবতার নিরীখে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাসূত্রে বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। সে প্রয়োজনীয়তার প্রধান কারণগুলো ছিল : ১। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলসমূহকে এক প্লাটফরমে আনয়ন বঙ্গবন্ধু তিন বছরের শাসন অভিজ্ঞতায় রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ ও কৃষিজীবী ও শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র্যদূরীকরণ এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক-ব্যবস্থা গ্রহণ কল্পে নিজ দলীয় নেতাকর্মীদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী ও পেশাজীবীদের সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন। সে লক্ষ্য বাস্তবায়নে বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক দল ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মোজাফফর), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় লীগসহ সকল দলের নেতা, দলনিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক ও শুভবুদ্ধির মানুষদের জাতীয় ঐক্যে ডাক দেন। মওলানা ভাসানী আজীবন কখনো কারো সাথে থাকেননি, নির্বাচন ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণেও তিনি আগ্রহী ছিলেন না, নির্বাচনেও কখনো তাকে পাওয়া যায়নি। কাজেই সরকারে অংশগ্রহণের আহ্বান তিনি গ্রহণ করেননি। তবে তিনি ‘সামরিক শাসনের চেয়ে বাকশাল ভালো’ বলে মন্তব্য করেন এবং বঙ্গবন্ধু ও বাকশাল কর্মসূচির সফলতার জন্য দোয়া করেন। জাসদ নেতৃবৃন্দ সমাজতন্ত্রের পথিক থাকলেও কল্পিত বিপ্লবের ঘোরে এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধচারণ করে ‘অবিরাম বিপ্লব’ অব্যাহত রাখার জন্য বঙ্গবন্ধুর আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর জাতীয় ঐক্যের সরকার গঠনের আহ্বান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ন্যাপ (মোজাফফর), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), জাতীয় লীগের নেতৃবৃন্দসহ দলনিরপেক্ষ দেশপ্রেমিক ও শুভবুদ্ধির মানুষ গ্রহণ করেন। ২। রাষ্ট্র-উন্নয়নে পেশাজীবীদের অংশগ্রহণ ও ভ‚মিকা নিশ্চিত করে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচি গ্রহণ করে প্রচলিত ব্রিটিশ সরকারের চালু করা কেন্দ্রনির্ভর প্রশাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্র্রীয়করণ ও পরিবর্তন করে গণমুখী করতে চেয়েছিলেন। মূলত বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের তৎকালীন সংকট নিরসন ও উন্নয়ন গতিশীল করার লক্ষ্যে বাকশাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইউনিয়ন-থানা-জেলা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল প্রশাসনিক বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কমিটিগুলোর প্রধান হিসেবে জনপ্রতিনিধিদের নিয়োগ প্রদান করে প্রশাসক ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে রাষ্ট্রকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। ৩। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকরণ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে গণনির্বাচনের ব্যবস্থা থাকে না। সেসব রাষ্ট্রে একটি মাত্র দল থাকে। যে দলটি জাতীয় দল নামে পরিচয় হয়। সেই জাতীয় দল (পলিট ব্যুরো) কর্তৃক মনোনীত জাতীয় দলের প্রধান সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার প্রধান হয়ে থাকেন। প্রান্তিক জনপদ পর্যন্ত মনোনীত নেতৃত্ব দ্বারা সরকারব্যবস্থা পরিচালিত হয় এবং এ দলটি রাষ্ট্রকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে সাম্যবাদী রাষ্ট্রে উত্তরণে কাজ করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর বাকশাল কর্মসূচিতে সমাজতন্ত্রের প্রচলিত ব্যবস্থা ভেঙে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচন পদ্ধতি চালু রেখেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রের ইউনিয়ন কাউন্সিল থেকে রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত সকল প্রশাসনিক সেক্টর জাতীয় দলের অভ্যন্তরীণ সমন্বিত দলগুলোর প্রার্থীদের অংশগ্রহণে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালনা করাতে চেয়েছিলেন। কাজেই বঙ্গবন্ধু অগ্রসর সমাজতন্ত্র (Advance Socialism) বা অগ্রসর সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি বাকশাল চালু করলেও তাতে জনগণ কর্তৃক রাষ্ট্রের সকল স্তরের নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি গ্রহণ করেন যা দেশব্যাপী গণতন্ত্রায়নের প্রচেষ্টা ছিল। একে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র বলতে চেয়েছেন। ৪। সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি-শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক মুক্তি বাকশাল কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ব্যাংক, বিমা, কল-কারখানা জাতীয়করণ করেছিলেন। তবে প্রচলিত সমাজতন্ত্রের অর্থনীতির সাথে বঙ্গবন্ধুর বাকশালের অর্থনীতির মূলগত পার্থক্য ছিল। বঙ্গবন্ধু কার্যত ব্যক্তিমালিকানার প্রভাব রহিত করতে চাইলেও সমাজ ও সময়ের চাহিদা বিবেচনা করে তিনি বাহ্যত নির্ধারিত সিলিংয়ের আওতায় ব্যক্তিমালিকানা রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, রাষ্ট্র ও সমাজে ভ‚মিসম্পদ, অর্থসম্পদ সহনীয় পর্যায়ে কারো কম বা বেশি থাকতে পারে, আবাস দুরকম হতে পারে। কিন্তু দেশে দারিদ্র্য থাকতে পারবে না। যার সম্পদ বেশি আছে সে ভালো খাবে, ভালো পরবে, ভালো আবাসে বাস করবে, তাতে রাষ্ট্রের কোনো আপত্তি নেই। তাই বলে গরিবরা না খেয়ে, কাপড় না পরে, মাথা গোঁজার ঠাঁই না পেয়ে পথে থাকবে না। রাষ্ট্রকে যে কোনো মূল্যে তাদের জন্য বিলাসী ব্যঞ্জন না হলেও পেটভরে পুষ্টিকর খাদ্য, মোটা হলেও পরনের কাপড় এবং অট্টালিকা না হলেও মানসম্মত মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে হবে। তাই বঙ্গবন্ধু দেশের সকল অর্থসম্পদ ও ভ‚মিসম্পদ জাতীয়করণ না করে অর্থসম্পদ ও ভ‚মিব্যবস্থাপনাকে নতুন আঙ্গিকে বিন্যাস করতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি অর্থসম্পদের কেউ অধিকারী হতে পারবে না এবং ১০০ বিঘার বেশি কোনো ভ‚মিসম্পদ মালিক থাকবে না। তিনি নির্ধারিত পরিমাণের অতিরিক্ত অর্থসম্পদ ও ১০০ বিঘার অতিরিক্ত ভ‚মি জাতীয়করণ করে ভ‚মিহীন ও গরিবদের মাঝে সুষম বণ্টন করতে চেয়েছিলেন। তিনি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জীবনধারণের জন্য সীমিত মুনাফা অর্জনের সুযোগ বিলুপ্ত করতে চাননি। তিনি মূলত বড় পুঁজির অবাধ ও বেপরোয়া বিকাশকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করে ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট, কালোবাজারি, মজুতদারি ও মুনাফাখোরির মাধ্যমে ব্যক্তিসম্পদের পাহাড় গড়ার প্রবণতা রোধ করে সামাজিক শোষণ-বঞ্চনা চিরতরে বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছোট-বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কলকারখানাসহ উৎপাদনের মাধ্যমসমূহকে রাষ্ট্র ও জনগণের যৌথ মালিকানায় এনে উৎপাদন বৃদ্ধি করে সম্পদের পরিমাণ বাড়াতে এবং ভ‚মিহীন কৃষক ও ভ‚মিমালিকদের বণ্টনবিধিতে এনে কৃষিব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন ও সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে নিয়ে গ্রাম সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন। ৫। ব্যক্তি-সম্পদের সিলিং নির্ধারণ ও ব্যক্তিপর্যায়ে সম্পদের সমতা আনয়ন বুর্জোয়া গণতন্ত্র পুঁজিবাদের অবাধ দৌরাত্ম্যকে অনুমোদন করে। ফলে রাষ্ট্রের সহযোগিতায় গণতান্ত্রিক ছদ্মাবরণে গণতন্ত্রের ছাতা মেলে ধরে আড়ালে বসে চতুর পুঁজিবাদীরা নিজ রাষ্ট্রের ও বিশ্বের জনগণকে বাজার করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ পায়। ফলে আজকের বিশ্বেও শতকরা এক ভাগ মানুষ বিশ্ববাণিজ্য ও সম্পদের প্রায় পুরোটাই কুক্ষিগত করে রেখেছে। ফলে ক্রমাগত মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত সমাজ ভেঙে নিম্নবিত্তে পরিণত হচ্ছে। নিম্নবিত্ত নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। তারা দৈনন্দিন জীবনচাহিদা পূরণে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে চতুর ধনিক-বণিকেরা রাষ্ট্রযন্ত্রকে যথেচ্ছাচার ব্যবহার করে নামমাত্র ট্যাক্স দিয়ে বা না দিয়ে সম্পদের পাহাড়ে বসে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় সরকারের পুঁজিবাদের লাগাম টেনে ধরার সামর্থ্য না থাকায় সমগ্র বিশ্বের জন্য গণতন্ত্র আজ ক্রমাগত হুমকি হয়ে উঠছে। পুঁজিবাদের অবাধ দৌরাত্ম্য দমনে বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মডেলে দেশের সকল সম্পদ জাতীয়করণ করতে চাননি। তিনি ১০০ বিঘা পর্যন্ত ভূমি-মালিকানা ও ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত শিল্প মালিকানা অনুমোদন করেন। এর অতিরিক্ত সম্পদ জাতীয়করণ করে ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর এ সিদ্ধান্তের ফলে ঘুষ-দুর্নীতি-লুটপাট ও অনিয়ন্ত্রিত মুনাফালাভের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ার সুযোগ রহিত হয়েছিল এবং ব্যক্তিপর্যায়ে সম্পদের সমতা নিশ্চিত করার প্রেক্ষাপট সৃষ্টি হয়েছিল। ৬। পুঁজিবাদী বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের এ দেশীয় এজেন্টদের অবাধ উল্লম্ফন নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধু সরকার গঠনের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে মনোযোগ দেন। ফলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে উন্নয়ন ক্ষেত্রে বিপুল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। আবার যুদ্ধবিধ্বস্ত সর্বস্বহারা দেশবাসীর দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে নানা পণ্য এবং কৃষি-উন্নয়নে নানা সামগ্রী আবশ্যকীয় হয়ে ওঠে। পরবর্তীকালে বিলাসপণ্যের চাহিদা বাড়ে। ফলে বাংলাদেশ পুঁজিবাদী বিশ্বের বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের এ দেশীয় এজেন্টদের অবাধ বাণিজ্য ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। দেশের অর্থ মুষ্টিমেয় বণিকদের হাতে চলে যেতে থাকে। বিদেশে অর্থ পাচারের প্রেক্ষাপটও সৃষ্টি হয়। কিন্তু প্রচলিত গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থায় এই বহুজাতিক কোম্পানি ও তাদের এ দেশীয় এজেন্টসহ অর্থ হাতিয়ে নেয়া বণিকদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল না। ফলে বঙ্গবন্ধু দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের মূলধন সীমিত করে বিপুল অর্থ-সঞ্চয়ের পথ বন্ধ করে দেন। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রথমত তিনি ১৫ লাখ অর্থমূল্যের অধিক মূল্যের কল-কারখানাসহ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের ঘোষণা দেন। পরবর্তীকালে ব্যক্তি বিনিয়োগের সীমা বৃদ্ধি করে ৩ কোটি টাকা করা হয়েছিল। মূলত বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেখেছিলেন, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কীভাবে কত দ্রুত একজন ধনী আরো ধনী হয়ে ওঠে। একজন ভ‚স্বামী কীভাবে ভ‚মি বাড়িয়ে নেয়। একজন চোরাকারবারি, মজুতদার, মুনাফাখোর রক্তচোষার মতো মানুষকে শোষণ করে কীভাবে বিত্তশালী হয়ে ওঠে। অসৎ-দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ ও আমলাশ্রেণি সরকারি কোষাগার কেটে কীভাবে ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ হয়ে ওঠে। তিনি দেখেছিলেন রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও সন্ত্রাস কীভাবে একটি দেশকে খাদে ফেলে দিতে পারে। কিন্তু এদের দমনে প্রচলিত গণতন্ত্রের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা দেখে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন। ফলে একসময় তিনি রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা রক্ষা, দুর্নীতি-কালোবাজারি-মজুতদারি-মুনাফাখোরি-সন্ত্রাস দমন করার মাধ্যমে এবং প্রকৃত জনকল্যাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সমাজতন্ত্রের অগ্রসর রূপ বাকশাল শোষিতের গণতন্ত্র কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ৭। রাজনৈতিক সশস্ত্র সন্ত্রাস ও সংঘাত নিয়ন্ত্রণ ১৯৭২ সালে এসে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগ ভেঙে যায়। সিরাজুল আলম খানের অংশ ‘বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ মাও সে তুংয়ের এমন একটি তত্ত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বিদেশি সহায়তায় ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠন করে এবং বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে। জাসদ নেতৃবৃন্দ দেশব্যাপী অস্থিরতা সৃষ্টির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। তারা ‘গণবাহিনী’র মতো একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তোলে। আবার জাসদের গণবাহিনী ছাড়াও আরো কয়েকটি চীনাপন্থি সশস্ত্র সংগঠন বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করছিল। স্বাধীনতার পরপরই রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে গত শতাব্দির ষাট এবং সত্তর দশকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলনের পুরাধা চারু মজুমদারের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বাম রাজনীতিবিদ আবদুল হক, মোহাম্মদ তোহা, সিরাজ শিকদার, আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন প্রমুখ চীনপন্থি নেতা বাংলাদেশেও শ্রেণিশত্রু খতম করার জন্য সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। হাজার হাজার মেধাবী-তরুণ এই সর্বনাশা ও বিভ্রান্তিকর আন্দোলনে যোগ দেয়। তারা বন্দুক-রাইফেল হাতে তুলে নিয়ে তথাকথিত শ্রেণিশত্রু খতম করার নামে নির্বিচারে মানুষ হত্যায় মেতে ওঠে। জাসদসহ এই সব সশস্ত্র পার্টির সশস্ত্র সদস্যরা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি থেকে ১৯৭৩ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪ হাজার ৯২৫টি গুপ্তহত্যা সংঘটিত করে। রাষ্ট্রে বিচ্ছৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এসব সশস্ত্র অপশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সকল রাজনৈতিক দল ও সামরিক-বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সম্মিলিত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য বাকশাল শোষিতের গণতন্ত্র কর্মসূচি গ্রহণ করেন। ৮। সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থার মাধ্যমে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীদের নির্বাচিতকরণ জেনারেল আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। তবে তাঁর নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনব্যবস্থার অধীনে অনুষ্ঠিত ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে বিরোধী রাজনৈতিক জোট ও দল নির্বাচনী প্রচারে সীমিত সুযোগ পেয়েছিল। তবে ১৯৭০ ও ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে প্রার্থীরা নিজ আধিপত্য নিয়ে নিজ অবস্থান থেকে নিজের সামর্থ্যমতো প্রচারের সুযোগ পেয়েছিলেন। ফলে সে সকল নির্বাচনে ক্ষেত্র বিশেষে প্রার্থীর সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থান, ক্ষমতা ও অর্থ নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে যৎসামান্য প্রভাব সৃষ্টিকারী একটি উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। তাই প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থায় প্রার্থীর ব্যক্তিগত আধিপত্য, ক্ষমতা ও অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ অতিশয়িত হয়ে নির্বাচনের ফলাফলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে এবং পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকেই কলঙ্কিত করে ফেলেছে। প্রচলিত নির্বাচনব্যবস্থায় অনেকক্ষেত্রে প্রার্থীর ব্যক্তিগত আধিপত্য ও অর্থ-ক্ষমতা নির্বাচনের ফলাফলকে বদলে দেয়। অনেকক্ষেত্রে ভোটারকে কিনে নেয়ার প্রতিযোগিতাও চলে। ফলে বঙ্গবন্ধু প্রার্থীর ব্যক্তিগত সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান, ক্ষমতা ও অর্থ প্রদর্শনের সুযোগ রহিত করে বাকশালের নির্বাচনী-কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। সে নির্বাচনব্যবস্থায় নিজ অর্থব্যয়ে ও নিজস্ব লোকদের মাধ্যমে প্রার্থীর ব্যক্তিগত যথেচ্ছা প্রচার-প্রপাগান্ডা চালানোর কোনো সুযোগ ছিল না। বাকশালের নির্বাচন-ব্যবস্থায় একজন প্রার্থীর প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পর সমান সুযোগে সরকারি খরচে ও সরকারের পক্ষ থেকে একই পোস্টারে সকল প্রার্থীর নাম লিখে প্রচারণাসহ জাতীয় প্রচার মাধ্যমেও সর্বমুখী প্রচারের ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়েছিল। ফলে প্রকৃত জনকল্যাণকামী, নিবেদিত-সৎ-যোগ্য সকল শ্রেণি-পেশার বিশেষ করে নিম্নবৃত্ত-দরিদ্র সমাজের প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার এবং তাদের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আসার পথ সুগম হয়েছিল। মূলত বঙ্গবন্ধু বাকশাল কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে এবং একটি ব্যতিক্রমধর্মী নির্বাচনব্যবস্থা চালু করে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে তাদের রাষ্ট্রোন্নয়ে অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। ৯। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশনাব্যবস্থা চালু করে জাতীয় চেতনাবৃদ্ধিকরণ ও মেধার পরিস্ফুটন এক রক্তক্ষয়ী জনযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সীমাহীন উদারতার ছায়ায় কিছু সংখ্যক লেখক-চিন্তাশীল স্বাধীনতাবিরোধী রাষ্ট্রসমূহের ইন্ধনে চক্রান্তমূলক লেখনি ধারণ করেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়ে বিতর্কিত প্রশ্ন তুলে ধোয়াটে করে তোলা, উস্কানিমূলক কলাম লিখে রাষ্ট্রের অগ্রগতি প্রতিহত ও শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট করার পরিকল্পনা করা সর্বোপরি বাংলাদেশকে একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার জন্য কলম হাতে নেন। এই ক্ষুদ্রায়তনের দেশের হাতেগোনা মুষ্টিমেয় পাঠকের জন্য একের পর এক পত্র-পত্রিকা বের হতে থাকে। সে সব পত্র-পত্রিকার অনেকগুলো একেবারে মানসম্মত ছিল না সুড়সুড়িমূলক ছিল এবং অনেকগুলো রাষ্ট্রের বিপক্ষে চক্রান্তমূলক প্রচারণা চালানোর জন্য প্রকাশ করা হয়েছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত ও রাষ্ট্রীয় লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের প্রতি জাতিকে একনিবিষ্ট রাখার উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে দেশের চারটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা রেখে অন্য সব পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দিয়েছিল। এ বিষয়টি ছিল সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রমের অংশ। পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে বাকশাল কর্মসূচির প্রতিপক্ষ পুঁজিবাদের এজেন্টরা রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য এ ব্যবস্থাকে বিবেচনাহীনভাবে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ বলে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছে। পূর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, সমাজতন্ত্র জনগণের জন্য নিবেদিত ও জনগণের জন্য পরিচালিত এবং জনগণের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থাপনা। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কেউ ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য পুঁজির কারবার করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন সকল পুঁজির মালিক সে রাষ্ট্রের জনগণ। সমাজতন্ত্রের ধারণায় যে কোনো ব্যক্তিগত প্রকাশনাসংস্থা একটি ব্যবসা পুঁজি নিয়ন্ত্রণের আধার। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রকাশনাসংস্থার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। আবার সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর বহুমাত্রিক উন্নয়নে শিক্ষা, সংস্কৃতি, সংবাদপত্রকে ব্যবহার করা হয়। কাজেই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংবাদপত্র কেবল সংবাদ প্রচার মাধ্যম নয়, রাষ্ট্রের উন্নয়নে জনশক্তি প্রস্তুত প্রক্রিয়ার অংশও বটে। সমাজতান্ত্রিক দেশে মেধা লালন ও বিকাশে রাষ্ট্র থেকে সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা এবং রাষ্ট্রীয় অর্থে সংবাদপত্রসহ যে কোনো গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেখানে অনেকগুলো পত্রিকা প্রকাশের সুযোগ সরকারের থাকে না। ১০। স্বাধীন বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও রাষ্ট্রের সকল মানুষের ন্যায়-অধিকার নিশ্চিতকরণ ১৯৫৮ সালের ৮ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রের নীতি-প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেন। বিচারব্যবস্থাও তার সরকারের তর্জনি হেলনে পরিচালিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত জীবনে সে বিচারব্যবস্থার স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়েছেন বহুবার। আর বিচারের দীর্ঘসূত্রতা সাধারণ মামলাগুলো দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচারের আশায় বছরের পর বছর ধরে নিভৃত-নিরালায় কাঁদত। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত বিচারব্যবস্থার করুণ অবস্থার কথা এভাবে তুলে ধরেন আর একটি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের বিচার ইংরেজ আমলের বিচার। আল্লাহর মর্জি যদি সিভিল কোর্টে কেস পড়ে, সেই মামলা শেষ হতে লাগে ২০ বছর। আমি যদি উকিল হই আমার জামাইকে উকিল বানিয়ে কেস দিয়ে যাই। ঐ মামলার ফয়সালা হয় না। আর যদি ক্রিমিনাল কেস হয়, তিন বছর, চার বছরের আগে শেষ হয়ে না। এই বিচার বিভাগকে নতুন করে গড়তে হবে। থানায় ট্রাইব্যুনাল করবার চেষ্টা করছি। সেখানে যাতে মানুষ এক বছর, দেড় বছরের মধ্যে বিচার পায়, তার বন্দোবস্ত করছি। আশা করি সেটা হবে। ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতা দূরীকরণে বঙ্গবন্ধু বিচার ব্যবস্থার উন্নয়নের বিষয়টি বাকশাল কর্মসূচিতে অগ্রাধিকার দেন। বাকশাল কর্মসূচিতে স্বাধীন রাখার জন্য বিচারকদের জাতীয় দল বাকশালে অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাকশালের গঠনতন্ত্রের ষষ্ঠ ধারার ১০ উপধারায় বলা হয়েছে : ...তবে দেওয়ানী আদালতে বিচারকার্যে নিযুক্ত কোন কর্মচারী বা বিচারক আদৌ জাতীয় দলের সদস্য প্রার্থী হইতে পারিবেন না। বঙ্গবন্ধু নিজে বাকশালকে ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলেছিলেন। তিনি বাকশালকে ‘শোষিতের গণতন্ত্র’ বলেও আখ্যায়িত করেন। কার্যত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা লাভের মধ্য দিয়ে ঘটেছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক মুক্তি। আর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক মুক্তি। আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নে বাকশাল কর্মসূচি পুনর্বাস্তবায়নের বিকল্প নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App