×

বিশেষ সংখ্যা

বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো সম্পাদনার গৌরব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:৫০ পিএম

বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো সম্পাদনার গৌরব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন
বঙ্গবন্ধুর লেখা বইগুলো সম্পাদনার গৌরব আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম অর্জন
কীভাবে এই কাজের সাথে আমি যুক্ত হলাম সেই বিষয়টা দিয়েই শুরু করি। ২০০২ সালের শেষের দিকের কথা; বেবী মওদুদ (বর্তমানে প্রয়াত) লেখক ও সাংবাদিক, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশিষ্ট বন্ধু, আমাদের খুব প্রিয়ভাজন মানে ছোটো বোনের মতো ছিলেন। বেবী মওদুদ আমাকে বলল, জামান ভাই, বঙ্গবন্ধুর কিছু পাণ্লিডুপি পাওয়া গেছে, বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এটা নিয়ে কাজ করছেন, আমিও এ কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। তিনি চাইছেন এ কাজের সঙ্গে আপনিও যুক্ত থাকুন, শেখ ফজলুল হক মণির সাথে আপনার কলেজ জীবন থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। আপনিও ছাত্রলীগ করতেন। আপনি আমাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক যে অবস্থা ও অবস্থান তা বেশ ভালো বুঝতে পারবেন। সে কারণে আমাদের সাথে আপনিও যুক্ত হয়ে কাজ করলে ভালো হয়। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধুর পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, এটা তো দারুণ খবর। সে বইয়ের সাথে যুক্ত হয়ে কাজ করা গৌরবের। এ সৌভাগ্য কয়জনের হয়? আমি আনন্দের সঙ্গে এ কাজে থাকব। আমি তাঁর কাছে গেলাম বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, তখন ছিলেন বিরোধী দলের নেত্রী। প্রথম গিয়েছিলাম বিরোধী দলের নেতার সরকারি বাড়িতে, তিনি তখন সেখানে ছিলেন। এ বিষয়ে কথাবার্তা হলো। আমি সানন্দে রাজি হলাম। তিনি বললেন, ‘এই পাণ্ডুলিপি এতদিন পর পেয়ে আমরা দুই অসহায় বোন কান্নায় বুক ভাসিয়ে দিয়েছি। পরে ভেবে দেখেছি কান্না করে তো লাভ হবে না। বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া এইসব অতি মূল্যবান সম্পদ যদি তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে জাতির কাছে তুলে ধরতে না পারি, তরুণ প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়ে যেতে না পারি, তাহলে তো তা আমাদের দায়িত্বে অবহেলা বলে গণ্য হবে। সে জন্যই আমরা এই কাজটা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শুরু করেছি। প্রথমে আমরা দুই বোন শুরু করেছি, পরে আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও দায়িত্বশীল লেখক এবং ইতিহাস সচেতন সাংবাদিক বেবী মওদুদকে যুক্ত করেছি। কাজটা আরম্ভ করে আমরা আলাপ-আলোচনা করে ঠিক করি এ কাজ অতি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব; এর ঐতিহাসিক পটভূমি, সামগ্রিকতা এবং যথাযথভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করার জন্য এই কাজে আমরা ঐতিহাসিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীকে উপদেষ্টা হিসেবে যুক্ত করব। আমরা ঠিক করি বাংলাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাহউদ্দীন আহমেদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক শামসুল হুদা হারুনকে উপদেষ্টা করে কাজ শুরু করব। তাঁদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শামসুল হুদা হারুন আমৃত্য নিয়মিতভাবে আমাদের সম্পাদনা পরিষদের সভায় উপস্থিত থেকেছেন। আমরা কাজটা জোরালো ও নিবিড়ভাবে শুরু করলাম। ইতোমধ্যে মাননীয় বিরোধী দলনেতা শেখ হাসিনা যখন সুধাসদনে ওঠে এলেন তখন কাজ গতি পেল। কাজের শুরুতে আমরা পাণ্ডুলিপি কীভাবে পাওয়া গেল জানতে চাইলাম। নেত্রী পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস বলেন। তাতে দেখা গেল পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস দুই পর্বে বিভক্ত। একটি পাকিস্তান পর্ব বা মুক্তিযুদ্ধ পর্ব। এটা হলো প্রথম পর্ব। প্রথম পর্বের উদ্ধারের ইতিহাস হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বঙ্গবন্ধু পরিবারকে তো ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি কিংবা সামান্য কিছুকাল আগে, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর কজন সেনা বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের কাছে এসে বলে, বাচ্চু লোগো কো সুকুল মে পাঠাও, মানে বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাও। ওরা স্কুলকে, সুকুল বলে। উনি ভাবতে লাগলেন হঠাৎ কেন ওরা এটা বলছে? রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি তো জানেন, রেডিওতে শুনেছেন পত্রিকাতেও দেখেছেন, পাকিস্তানিরা বলতে চাইছে এখানে আর কোনো সমস্যা নেই, স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান। তো স্বাভাবিক অবস্থা দেখানোর জন্য তো স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত এগুলো চালু দেখাতে হয়। আর এজন্যেই বেগম মুজিবের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর তাগিদ দিচ্ছিল। বেগম মুজিব রাজনীতি সচেতন তীক্ষè বুদ্ধির মানুষ ছিলেন। তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব সেই সঙ্গে ছিল। তখন তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ভাবলেন জেলখানায় থাকা অবস্থায় ১৯৬৬-৬৯ সময়ে তাঁর অনুরোধে বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনী লেখা শুরু করেছিলেন এবং তার তিন-চারখানা ছোট ছোট এক্সারসাইজ বুক এবং স্মৃতিকথা, ডায়েরি ও নয়াচীন সফরের পাণ্ডুলিপিগুলো ছিল। ৩২ নম্বর বাড়িতে একটা আলমিরার মাথার ওপরে রাখা আছে। কী অসামান্য কথা, পাকিস্তান আমলে কারাবন্দি অবস্থায় শেখ মুজিব গভীর নিষ্ঠায় এত বইপত্র লিখেছেন। আর কোনো বাঙালি মুসলমান রাজনীতিকের এ ইতিহাস নেই। এ-ও তাঁর অসাধারণত্বের এক পরিচয়চিত্র। এই সব বিষয় মাথায় রেখে বেগম মুজিব বললেন যে, সুকুল মে বাচ্চাদের যে পাঠাব বই তো নেই, বই রয়েছে ৩২ নম্বর বাড়িতে। তখন ওরা বলল, লেআও ওধারছে। ওখান থেকে নিয়ে আসো, অসুবিধার কী? বেগম মুজিব নিজে গেলেন না, তাঁর বড় মেয়ে শেখ হাসিনাকে পাঠালেন। শেখ হাসিনা সে সময় বই আনার জন্য ৩২ নম্বরে গেলেন, অতি সাবধানে বইয়ের সাথে সে খাতাগুলোও কৌশল করে তিনি নিয়ে আসেন ওখান থেকে। এভাবেই বেগম মুজিবের হাতে প্রথমে চারটা খাতা আসে। খাতাগুলো নিয়ে আসার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা ও বেগম মুজিব দুজনই গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখেছেন। বেগম মুজিব জানতেন খাতাগুলো কোথায় আছে এবং এক অস্বাভাবিক জীবন-মরণ অবস্থায়ও তিনি খাতাগুলোর কথাই বিশেষ করে ভেবেছেন এবং তিনিই বললেন খাতাগুলো উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্য; নয়তো জানাই যেত না বঙ্গবন্ধুর এই অমূল্য পাণ্ডুলিপি রয়েছে। বেগম মুজিব উদ্ধার করে আনা খাতাগুলো সম্পর্কে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করলেন কারণ পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা এই বিষয়ে হয়তো আঁচ করে থাকতে পারে। অতএব, তিনি ভাবলেন খাতাগুলো তাঁর অবরুদ্ধ বাসায় হানাদারদের তীক্ষ্ণ নজরদারির মধ্যে রাখাটা ঠিক হবে না। তখন হাসপাতালে ছিল শেখ ফজলুল হক মণির কোনো আত্মীয়, বেগম মুজিব তাদের সাথে কথা বললেন। তখন আরামবাগে থাকত শেখ মণির মা এবং তাদের পরিবার। তাই পাণ্ডুলিপিগুলো তাঁদের বাড়িতে রাখা হলো এক অদ্ভুত কৌশলে। ঘরের বারান্দার ভেতরের ছাদের সঙ্গে ঝোলানো শিকায় মাটির পাত্রের ভেতরে লুকানো অবস্থায়। আর তার ওপরে একটা ঢাকনা দিয়ে ঢেকে দেয়া হলো, যাতে কেউ বুঝতে না পারে। বেগম মুজিব, শেখ হাসিনা ও শেখ মণির পরিবারের দুঃসাহসিকতায় বঙ্গবন্ধুর অমূল্য পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা সম্ভব হয়। দুই বঙ্গবন্ধুর সাহিত্য কর্মের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। তিনি তখন বিপুল জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী, ব্যস্ততম বিশ্বনেতা। তাই নিজ হাতে লেখার সুযোগ পেতেন না। গণভবনে দুপুরের খাবারের পর বঙ্গবন্ধু যখন বিশ্রাম নিতেন তখন আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এবং তোয়াব খান তাঁর জীবন কথা তাঁর মুখ থেকে তাঁর ভাষায় রেকর্ড করতেন। কিন্তু ১৯৭৫-এ সামরিক বাহিনীর কতিপয় দেশদ্রোহী কর্মকর্তা ও তাদের দেশি-বিদেশি শত্রু পক্ষের যোগসাজশে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর যে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি তাতে বঙ্গবন্ধু লেখাপত্র ও তাঁর পাণ্ডুলিপির বিষয়টি সাময়িকভাবে চাপা পড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এবং ৩২ নম্বর বাড়িটি খুনি মুশতাক সরকার সিলগালা করে দেয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা প্রবাস জীবন থেকে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া তাকে সিলগালা করা বাড়িটি তাঁকে হস্তান্তর করা দূরে থাক, ঢুকতেও দেয়নি। তবে ওই বছরের ১২ জুন সাত্তার সরকার বাড়িটি হস্তান্তর করে। ওই বাড়ি থেকে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথা, ডায়েরি এবং নয়াচীন সফরের খাতাগুলো পান। তখনো আত্মজীবনী পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। ২০০৩-এর পরে বঙ্গভবনের তোশাখানায় পাওয়া যায় দুটি ছোট সুটকেসে রাখা দুটি টেপ। এ দুটি টেপ গণভবনে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও তোয়াব খানের বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী রেকর্ড করা সাক্ষাৎকারের টেপ। একটা পাণ্ডুলিপির অংশ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অদ্ভুতভাবে পেয়েছিলেন একজন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী ঘনিষ্ঠজনের কাছ থেকে। প্রচণ্ড ধূলার স্তূপ থেকে এক মহিলা পুলিশকর্মী উদ্ধার করেন থালাবাটি কম্বল শীর্ষক কারাগারের রোজনামচার খণ্ডিত অংশ। এ পাণ্ডুলিপিতে পুলিশের ঘুষ খাওয়ার কথা থাকায় পাণ্ডুলিপি গোপন স্থানে ফেলে রাখে। সবশেষে, শেখ মণির ভাই শেখ মারুফের কাছ উদ্ধার হয় অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পাণ্ডুলিপি। সম্ভবত শেখ মণি এটি ছাপার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে থাকবেন। এই হলো পা্ণ্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর এই অমূল্য পাণ্ডুলিপিগুলো পাওয়া গেছে এটা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ এবং আমাদের জাতির জন্য পরম সৌভাগ্য। ২০০০ সাল থেকেই শেখ হাসিনা ভাবলেন এগুলো প্রকাশ করা দরকার। এ কাজে প্রথমে যুক্ত করা হয় আমেরিকার জর্জটাউন বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক এনায়েতুর রহিমকে। তিনি তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক কিছুদিন কাজ করার পর তিনি মারা যান। তারপরের বাকি ইতিহাস তো বলেছি, যেভাবে সম্পাদনা পরিষদ গড়ে তোলা হলো ও কাজ করতে হলো। সার্বিকভাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের সাথে থাকলেন। এই পা্ণ্ডুলিপিগুলো যখন এডিটিংয়ের পর্যায়ে এলো তখন আমরা কাজ শুরু করলাম। ছেঁড়া কাগজ, লেখা বোঝা যায় না, ভগ্ন অবস্থায় পাণ্ডুলিপি থেকে সেগুলো টাইপ করা হলো। উনি পাণ্ডুলিপিগুলো যত্নের সঙ্গে টাইপ করার ব্যবস্থা করলেন, কখনো নিজেও টাইপ করলেন। আমরা সপ্তাহের তিন-চার দিন দীর্ঘসময় ধরে কাজ করেছি। শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী তখনো এ ধারা অব্যাহত ছিল। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ক্লান্তিহীন। সাধারণত পাণ্ডুলিপি যেভাবে এডিট করা হয় সেগুলো সেভাবেই করা হয়েছিল বানান ঠিক করা। একই বানানের মধ্যে যদি বৈষম্য থাকে সেটা ঠিক করা। অর্থাৎ একেক জায়গায় একেকভাবে যদি বানান লেখা থাকে সামঞ্জস্য সাধন। অথবা কিছু লেখা বা বাক্য তিনি তাড়াহুড়ো করে লিখেছেন সেখানে ‘না’ হবে সেই ‘না’ এর জায়গায় দন্তন্য-এর (-া) আকারটা পড়েনি, এইগুলো ঠিক করা এই হলো এডিটিংয়ের কাজ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাক্যের ছোটখাটো সম্পাদনা করতে হয়েছে। আত্মজীবনীর ডিকটেশন নেয়া কিছু অংশ ট্রান্সক্রাইব করতে হয়েছে। আমরা যে সকল পৃষ্ঠার এডিট সম্পন্ন করি সেগুলো তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টাইপ করান এবং তিনি নিজের হাতে কিছু টাইপ করেছিলেন। কাউকে দিয়ে নয়। কারণ হলো, এগুলো তাঁর পিতার পাণ্ডুলিপি সেজন্য যত্নটা ছিল একটু বেশি। যাতে কোনোভাবে কোনো প্রকার অসামঞ্জস্য তৈরি না হয় সে ক্ষেত্রে তিনি সতর্ক ছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে তাঁর মধ্যে সাহিত্যের একটা বিশেষ বোধ ছিল। মজার ব্যাপার হলো আমরা যখন এই কাজ করি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক যারা কিছুটা বঙ্গবন্ধুবিরোধী বলতে গেলে, তারা আমাদের সঙ্গে কখনো কখনো ঠাট্টা বলতেন, ‘এটা আপনারা কী তৈরি করছেন?’ তবে মজার ব্যাপার হলো প্রথম খণ্ড প্রকাশের পরে তাঁরা বললেন, আমরা তো ওই সময় সমালোচনা করেছিলাম কিন্তু এখন দেখছি এ লেখা শেখ মুজিব ছাড়া অন্য কারোর পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। এটা পড়েই তা বোঝা যায়, শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব এবং সে সময়ের ঘটনাপ্রবাহ, কথা বলার ধরন ও তাঁর বৈশিষ্ট্য গোটা বিষয়টি এই বইতে এসেছে। যাহোক এইসবের মধ্যেই আমরা কাজ করতে শুরু করি। এক সময় প্রথম খণ্ডটা শেষ করলাম, সে বইটার নাম অসমাপ্ত আত্মজীবনী। অসমাপ্ত আত্মজীবনী যখন সম্পন্ন করলাম, ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলো। নেত্রী গ্রেপ্তার হলেন। বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়ে সতর্কতার কারণে বেবী মওদুদ পাণ্ডুলিপি আমার শ্যামলীর বাড়িতে রাখলেন। এখানেই বেবী আসতেন। আমরা সম্পাদনার কাজ করতাম। আমি তো বলেছি ২০০২ সালের শেষ থেকে কাজ শুরু করেছি তবে আমি কাজটা ২০০৩ সাল থেকে চূড়ান্তভাবে শুরু করেছি। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০০০ সালের শেষ থেকেই কাজ শুরু করেছেন। আমরা প্রথম বইটা প্রকাশ করলাম ২০১২ সালে। নেত্রী গ্রেপ্তার হওয়ায় এতটা দেরি হয়। এছাড়া বইয়ের ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ সময় নিয়েছি ও কাজ সুসম্পন্ন করেছি। বইটির ব্যাপারে আমরা অতি সতর্ক ছিলাম যেন কোথাও কোনো ত্রুটি না হয়। সেই জন্য অতি যত্নের সঙ্গে আমরা এটা সম্পাদনা করে, প্রুফ দেখে বানান-টানান যতদূর সম্ভব সঙ্গতি রক্ষা করে প্রকাশ করেছি। এবং আমরা খুশি হয়েছিলাম বইটা প্রকাশের পর তেমন কোনো সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়নি, বরং প্রত্যেকেই প্রশংসা করেছেন। প্রথম বইটা প্রকাশের পর তুমুল সাড়া পাওয়া গেল, আসলে মানুষ ভাবতেই পারেনি বঙ্গবন্ধুর লেখালেখির এমন অসাধারণ দক্ষতা ছিল। বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে যেমন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন, লেখার ক্ষেত্রেও তেমনি অসামান্যতার ছাপ রেখেছেন। সারাজীবনে তিনি বেঁচে ছিলেন মাত্র ৫৫ বছর। বছরের পর বছর জেল খেটেছেন। তারপরেও এত যত্নও নিষ্ঠায় ইতিহাসের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সাহিত্যগুণসম্পন্ন যে অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও আরো তিন-চার খানা বই লিখে গেছেন, তাতে আমরা নতুন এক বঙ্গবন্ধুকে পেলাম। রাজনীতির সঙ্গে লেখক সত্তার নতুন মাত্রা যুক্ত হওয়ায় রাষ্ট্রনির্মাতা ও সাহিত্য স্রষ্টার সম্মিলনে বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্ব অন্যরকম উচ্চতায় স্থিত হলো। তিন বঙ্গবন্ধুর বই প্রকাশ করার সঙ্গে অনুবাদের বিষয়ও স্থির করা হলো। প্রথম অনুবাদটা শামসুল হুদা হারুন সাহেব করেছিলেন। তাঁর অনুবাদটা ক্লাসিক্যাল ঢঙের ছিল। অনেকেই বলল যে, এখনকার ইংরেজি তো একটু অন্যরকম, সহজ, ঘরোয়া কখনো একটু মজলিশি ধরনের, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিতার স্বাদ যুক্ত। তো অনুবাদটা সেভাবে করলে ভালো হয়। তখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজির সাহিত্যের অধ্যাপক ও রবীন্দ্র অনুবাদক ফকরুল আলমকে অনুরোধ করা হলো, তিনি অনুবাদের কাজটা করলেন। তারপর ২০১২ সালে বইটা ইংরেজিতেও প্রকাশ পেল। এই হলো প্রথম বইটি ইতিহাস। বই প্রকাশের পর প্রকাশনা উৎসব হলো, উৎসবটাও ছিল খুবই আড়ম্বরপূর্ণ। অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি প্রকাশের জন্য দেয়া হয়েছিল ইউপিএল প্রকাশনীর মহিউদ্দিন আহমদকে। তারা মোটামুটি যত্নের সাথে বইটি প্রকাশ করেছিলেন। আমাদের জানামতে ইংরেজ আমল ও পাকিস্তান আমলে বাঙালি মুসলমানের লেখা সর্বাধিক বিক্রীত বই ছিল মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ-সিন্ধু ও মোহাম্মদ নজিবর রহমানের আনোয়ারা। সেসব বই বিক্রির রেকর্ড এখন ভেঙে ফেলেছে বঙ্গবন্ধুর বই। বই বিক্রির ক্ষেত্রে পূর্ববাংলা তথা বাংলাদেশের পূর্বের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে নতুন রেকর্ড গড়েছে এই বইটি। বঙ্গবন্ধুর লেখা বই তুমুল গ্রহণযোগ্যতা পায় গোটা জাতির কাছে। এরপরে আমরা যে পাণ্ডুলিপিটি হাতে পেলাম সেটি হলো কারাগারের রোজনামচা। বঙ্গবন্ধুর তাঁর নির্মোহ বিবরণে কারাগারের কথা, বন্দি ও কারাগারের কর্মী-কর্মকর্তা এবং আশপাশের লোকজনের কথাই ওঠে আসে। আর আসে তার পড়াশোনার কথা এবং বিশেষভাবে দেশে কী হচ্ছে তার জন্য উদ্বেগ। কারাসাহিত্য আমরা যতটা পড়েছি বঙ্গবন্ধুর মতো এতটা অনুপুঙ্খভাবে অন্য কোনো বইয়ে পাইনি। এ বইয়ে দেখা যায় রাজবন্দি ছাড়াও তিনি সাধারণ কয়েদিদের খোঁজখবর নিচ্ছেন নিবিড় অনুসন্ধিৎসায়। বিভিন্ন দাগি আসামির কথা তাদের জীবন কেন এমন হলো, সেটা যত্ন ও সংবেদনশীলতায় বোঝার প্রয়াসও রয়েছে লেখায় গভীরভাবে। কখনো পকেটমারের, কখনো গোয়েন্দা বাহিনীর লোকেরা অপরাধীদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে কিছু টাকা-পয়সা এদিক-সেদিক করে ভাগাভাগির মাধ্যমে কীভাবে দুষ্কর্মগুলো সেরে নেয় সে কথা। আবার কারাগারে ভুক্তভোগীর একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা, অসহায়ত্ব, পরিবার বিচ্ছিন্নতার মানসিক, মনস্তাতত্ত্বিক বেদনা। এই বই হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার নির্যাতিত মানুষের কারা নির্যাতনের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু শুধু তাঁর নিজের কারা নির্যাতনের কথা বলেননি, পূর্ববাংলার নানা শ্রেণি-পেশার ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নির্যাতনের কথা তাঁর বইয়ে বাক্সময় করে তুলেছেন। কারাগারের রোজনামচায় বলতে কারাগারের ভেতরের খুঁটিনাটি বিষয় রয়েছে। কখনো সেটি রহস্যময়, কখনো সেটি হাসির উদ্রেক করে, কখনো নিষ্ঠুরতার চরম উদাহরণ। এসব বিষয়কে এতটা বাস্তবধর্মী করে, এতটা একনিষ্ঠ মানবিক বোধে তিনি তুলে এনেছেন, যা ভেবে বিস্মিত হতে হয়। কারাগারের ইতিহাসের নানা টেকনিক্যাল পরিভাষা যেমন দফা, যেমন কেষ্টাকল, শয়তানের কল, জলভরি দফা, বন্দুক দফা, ডালচাকি দফা, ছোকরা দফা ইত্যাদি তাঁর বইকে দিয়েছে এক অনন্যতা। এসব অদ্ভুত, বিচিত্র দফার কথা আমরা আগে কেউ জানতাম না এবং এসব দফা বাংলাদেশের জেলেই উদ্ভাবিত। কোনো কোনো দফা নিয়ে হাসি পায়, কোনো কোনো দফা পড়লে মনে হয় কীসব কিম্ভুৎকিমাকার ব্যাপার জেলের ভেতরে। আবার ওখানে পাগলদের জন্য যে সেল রয়েছে সেটার বর্ণনাও দিয়েছেন। তাদের যে চিৎকার, উদ্ভট আচরণ, নানা অদ্ভুত তবে কাণ্ডকারখানা লেখক তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন কখনো মানবিক চেতনায় কখনো মৃদু রসিকতায়। কখনো তাদের জন্য দুঃখ পেয়েছেন। কখনো পাগলদের সেলের পাশেই তাঁর সেল নির্ধারণ করা হয়েছে, ঘুমের কষ্ট হয়েছে ইত্যাদি তিনি যেমন তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে তাঁর পালিত একটা মোরগের কথা আছে। মোগরটা যখন হাঁটছে তখন তাঁর মনে হয়েছে মোরগটা এক রাজকীয় ভঙ্গিতে গৌরবের সঙ্গে ঝুঁটি ফুলিয়ে বীরের মতো হেঁটে যাচ্ছে। তাঁর নির্জন সেলের পাশেই ছিল গাছ, সেই গাছে দুই হলুদ পাখি বসত। পাখি দুটি প্রতিদিন দেখে তিনি আনন্দিত হতেন। পরে পাখি দুটি না আসায় দুঃখ পেয়েছেন। পশু-পাখির প্রতি তাঁর যে প্রেম-ভালোবাসা এটিও চমৎকারভাবে তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে। এছাড়া তিনি বাগান করতে ভালোবাসতেন, ফুলের গাছ লাগাতেন। এতে তাঁর প্রকৃতি গাছ-পালা, পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায়। আবার কখনো দেখা যাচ্ছে, একটা গেছো গিরগিটির সঙ্গে যুদ্ধ হচ্ছে দাঁড়কাকের সেটাকে তিনি প্রতীকীভাবে সামরিক শাসকদের সঙ্গে সাধারণ মানুষদের সংঘর্ষের তুলনা করেছেন। এইসব মিলিয়ে কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ তিনি রাজনীতির সমাজের, দুঃশাসন ও স্বৈরাচারের নানারকম ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। এ বইয়ের নামকরণ করেন শেখ রেহানা। চার বঙ্গবন্ধুর তৃতীয় যে বইটি এ বছরে বাংলা একাডেমির বইমেলায় প্রকাশিত হবে, তার নাম আমার দেখা নয়াচীন। বঙ্গবন্ধু এই বইটির নাম দিয়েছিলেন ‘নয়াচীন’। প্রথমদিকে চিন্তা করা হয়েছিল এই বইটির নাম রাখা হবে ‘চীন-ভ্রমণ’। আমি তখন বলেছিলাম যে, নয়াচীন একটি রাজনৈতিক নতুন অভিধা। সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে গড়া নতুন রাষ্ট্র, তাকে এই ভ্রমণ শিরোনামে চিহ্নিত করলে তাতে এর যে গভীরতা বহন করে, ভ্রমণ নামটিতে তা অনুপস্থিত। কারণ, অনেকেই তো চীন ভ্রমণ করে, তাদের উদ্দেশ্য আনন্দ লাভের জন্য। তাই ‘চীন-ভ্রমণ’ নামটি এটা খুবই সাধারণ শোনায়। ওই শান্তি সম্মেলনে ভারত থেকে বাঙালি লেখক মনোজ বসু গিয়েছিলেন। তিনি বই লেখেন, ‘চীন দেখে এলাম’ নামে। নামটি বিভ্রান্তিকর। কোনো চীন মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত নয়াচীন, না প্রতিবিপ্লবী চিয়াং ফাইসেকের তথাকথিত তাইওয়ান চান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু রাজনীতি ও ইতিহাস সচেতন মানুষ। তিনি ভুল করেননি। তিনি নাম লিখেছেন নয়াচীন। এর তাৎপর্য লক্ষণীয়। অন্য পর্যটকদের মতো তো বঙ্গবন্ধু আনন্দ ভ্রমণের জন্য যাননি। নয়াচীন হলো একটি নব্য রাষ্ট্র ব্যবস্থা। যেখানে সমাজতান্ত্রিক নেতা মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা লংমার্চ করেছে, লড়াই করেছে। জানা যায়, শেষ পর্যন্ত তাঁরা ক্ষুধার কারণে বেল্টের চামড়া খেয়ে জীবন ধারণ করেছে, তাঁরা লড়াই-সংগ্রাম করে একটি নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, যা একটি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। অতএব, সে রাষ্ট্রটা কী রকম তা দেখার জন্য, এর ইতিহাস জানার জন্য, সেখানে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা চালু হওয়ার পরে কী ধরনের পরিবর্তন এসেছে, রাজনৈতিক এই যে পাটপরিবর্তন তা সে দেশের জনগণের জন্য সত্যিকার অর্থে কল্যাণকর কিনা এসব দেখার জন্য তিনি সেখানে গিয়েছেন। তিনি অনুসন্ধানী দৃষ্টি দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে চীনের সকল বিষয়কে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ এটি অসাধারণ এক রচনা তাঁর। ১৯৫২ সালে সেই চীন সফরে পাকিস্তানের পঁচিশ জনের একটি প্রতিনিধি দল সেখানে শান্তি সম্মেলনে গিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সে দলে ছিলেন তৎকালীন তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। আতাউর রহমান খান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস আর গিয়েছিলেন উর্দু কবি ইউসুফ হাসান। ওখানে গিয়ে তিনি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নয়াচীনের সমাজ ব্যবস্থা, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, এছাড়া ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অবস্থা, সব বিষয় তিনি দেখতে চেয়েছেন। তো বঙ্গবন্ধুর এই বইটা আমরা প্রকাশের জন্য প্রস্তুত করেছি। বইটি আমাদের আগামী বইমেলায় প্রকাশ পাবে। আমি বাংলা একাডেমিতে থাকাকালেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলাম, বইটি বাংলা একাডেমিকে দেয়ার জন্য। আমি মহাপরিচালক পদে থাকি বা না থাকি, বইটি যেন এখান থেকেই প্রকাশ হয়। কারণ, বাংলা একাডেমি আমাদের জাতীয় প্রতিষ্ঠান, আমাদের জাতির জনকের বই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ হওয়াই ভালো। তিনি আমার কথা রেখেছেন, বইটি বাংলা একাডেমি থেকেই প্রকাশ পাচ্ছে। কারাগারের রোজনামচা বইটিও আমি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করি। সেটা অতিদ্রুত পাঠকের কাছে বিপুল সাড়া পায়। বাংলা একাডেমির বই বিক্রির ইতিহাসে কারাগারের রোজনামচা নতুন রেকর্ড অর্জন করে। আমি আনন্দিত, আমি অভিভূত। জাতির জনকের এই অমূল্য পাণ্ডুলিপি বই আকারে প্রকাশের কাজে যুক্ত থাকতে পেরে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। বঙ্গবন্ধুর তিনটি বই সম্পাদনের আনন্দ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App