×

বিশেষ সংখ্যা

প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:৩২ পিএম

প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু
প্রেরণায় বঙ্গবন্ধু
১৭ মার্চ ২০২০ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বর্ষব্যাপী জন্মশতবর্ষ উদযাপনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। তবে এসব আনুষ্ঠানিকতার ভিড়ে মানুষ-মহান শেখ মুজিবুর রহমানকে কতটুকু খুঁজে পাওয়া যাবে? সেই শেখ মুজিব, যিনি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণঅভ্যুত্থানের গণমঞ্চ থেকে বাংলার আপামর জনতা কর্তৃক ‘বঙ্গবন্ধু’ অভিধায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। সত্যি তিনি বন্ধু; ত্রাতা ও নেতার অধিক প্রাণের বন্ধু তিনি বাংলা ও বাঙালির। মাত্র পঞ্চান্ন বছরের জীবদ্দশায় তাঁর আন্দোলন, অভীপ্সা ও অর্জন বিস্ময়-জাগানিয়া। তাঁকে এতদিন আমরা তরুণ প্রজন্ম জেনেছি ইতিহাসের পাতায় কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রকাশ পাওয়া তাঁর দুটো বই অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন প্রকাশের পর আবিষ্কার করছি লেখক হিসেবে তাঁর গভীরতার স্বরূপ। সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুকে এক বৃহৎ দার্শনিক প্রেক্ষিতে বিচারের বিষয়টি লক্ষ করি তাঁর নিরুপম রচনায়। পাকিস্তানি রাজনীতিক দরবারের খাজা-গজা, খানবাহাদুর-নায়েব নাজিমের কবল থেকে রাজনীতিকে তিনি নিয়ে এসেছেন সাধারণ খেটে খাওয়াদের দোরগোড়ায়। প্রান্তিক মানুষের দাবিদাওয়াকে পরিণত করেছেন রাজনীতির কেন্দ্রীয় ইস্যুতে। পেশ করেছেন পূর্ববাংলার মানুষের বাঁচার দাবি ‘ছয় দফা’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অত্যল্পকাল পর থেকেই সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে গৌণ করে দিয়ে জনতার সামনে বাঙালি জাতীয়তার পরিচয়কে প্রধান করে তুলেছেন। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট তাঁর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের পঁয়তাল্লিশ বছর পর ফিরে তাকাই তবে আমাদের অনেক অর্জন সত্তে¡ও হতাশই হতে হবে আসলে। আমরা তাঁর কথা মুখে বলি, তাঁর নামে হাজার প্রতিষ্ঠান গড়ি কিন্তু বাস্তবে তাঁর আদর্শের কতটা অনুগামী আমরা? ৭ মার্চের সেই দুনিয়া-কাঁপানো ভাষণে তিনি যেমন তাঁর জনগোষ্ঠীর ন্যায্য দাবিদাওয়ার কথা বজ্রকণ্ঠে তুলে ধরেছেন তেমনি বলেছিলেন ‘কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনকি তিনি যদি একজনও হন।’ আজ আমরা কী দেখছি! ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্র-বিশ্ব সর্বক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ। ন্যায্য কথা বলার চেয়ে সুযোগ বুঝে সর্বাত্মক সমর্পণকে যে সময়ে প্রধান প্রবণতা হিসেবে দেখা যায় তার পরিণতি কি কখনো শুভকর কিছু হতে পারে? তিনি সে ভাষণে আরো বলেছিলেন ‘বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।’ আমরা কি স্বাধীনতা লাভের এতো বছর পরও বঙ্গবন্ধুর অর্পিত এ দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? মনে হয় না। সমাজের সকল নাগরিককে সমান সুযোগ দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের যেতে হবে আরো বহুদূর। আমরা প্রায়শই সাম্প্রদায়িক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা পরিচালিত হয়ে নাগরিকদের মাঝে সুযোগ ও অধিকারের বৈষম্য তৈরি করি যা কোনোভাবেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের দেশপ্রধানের দায়িত্বভার গ্রহণ করে বিভিন্ন ভাষণ-বক্তৃতায় বলতেন কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ কখনো দুর্নীতি করে না বরং দুর্নীতি করে তথাকথিত শিক্ষিত-সচেতন মানুষ। আজ আমরা দেখি দুর্নীতিগ্রস্ত রাঘব-বোয়ালের দল জমিদখল, নদীদখল, ঋণ খেলাপ করে পার পেয়ে যায় অবলীলায় আর সাধারণ মানুষের বঞ্চনার বৃত্তান্ত বেড়েই চলে দিনকে দিন। বঙ্গবন্ধুকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে দুর্নীতির এই দুষ্টচক্র ভাঙার কোনো বিকল্প নেই। তিনি সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের কথা বলে এসেছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ থেকেই। ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছর পর এক সম্মেলনে চীন ভ্রমণে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে উঠে প্রখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসুর। সে সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধি শেখ মুজিব বাংলায় বক্তৃতা করেছেন যা মনোজ বসুকে মুগ্ধ করে। স্মৃতিচারণে বঙ্গবন্ধু জানাচ্ছেন মনোজ বসুর প্রতিক্রিয়া ‘আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষা বলা কর্তব্য। আমার বক্তৃতার পরে মনোজ বসু ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ভাই মুজিব, আজ আমরা দুই দেশের লোক, কিন্তু আমাদের ভাষাকে ভাগ করতে কেউ পারে না। আর পারবেও না। তোমরা বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা দিতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছ আমরা বাংলা ভাষাভাষী ভারতবর্ষের লোকেরাও তার জন্য গর্ব অনুভব করি।’ জাতিসংঘের অধিবেশনে বাংলায় ভাষণ দিয়ে তিনি বিশ্বসভায় তুলে ধরেছেন বাংলার মর্যাদা কিন্তু আমরা সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন এবং মাতৃভাষার শুদ্ধ ও যথাযথ ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সম্পূর্ণ সফলতা অর্জন করতে পারিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে এক ভ্রমণে গিয়ে নৌপথে আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে ভাটিয়ালি গান শোনার অনুপম অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কলমে ‘নদীতে বসে আব্বাসউদ্দিন সাহেবের ভাটিয়ালি গান তাঁর নিজের গলায় না শুনলে জীবনের একটা দিক অপূর্ণ থেকে যেত। তিনি যখন আস্তে আস্তে গাইতেছিলেন তখন মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলিও যেন তাঁর গান শুনছে।’ নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি তাঁর এই আযৌবন অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত নির্বাচনে, ১৯৭৪ সালে জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন আয়োজনের মধ্য দিয়ে, দেশীয় চলচ্চিত্র, নাটক ও ললিতকলার পৃষ্ঠপোষণায়। কিন্তু আমরা আজ কার্যক্ষেত্রে নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি উদাসীন থেকে প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধুর সংস্কৃতিভাবনার পথ থেকেই সরে এসেছি অনেকটা। ধর্মের নামে রাজনীতিকে তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। সমাজ ও রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইহজাগতিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন কিন্তু আমরা তাঁর প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক-বিজ্ঞানবিরোধী অপশক্তির সঙ্গে আপসের রাস্তা বেছে নিয়েছি প্রায়শই যার পরিণাম কখনোই ইতিবাচক হয়নি। বঙ্গবন্ধু নিজেকে অলৌকিক একক না ভেবে নিজেকে গুণী পরম্পরার সন্তান জ্ঞান করতেন। তাই তাঁর যে কোনো বক্তৃতায় উঠে আসতো মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ বসু, চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ প্রিয় পূর্বজদের কথা। আমরাও আজ বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে যেন ভুলে না যাই তাঁর মহান প্রেক্ষাপটের কথা, তাঁর প্রেরণার মানুষদের কথা। বিরূপ বিশ্বে দাঁড়িয়ে তিনি যেভাবে নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংকল্প উচ্চারণ করেছেন আমরা সেরকম সাহসী জায়গায় থাকতে পারি না বরং ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণের ক্ষেত্রেও সন্ধান করি সমীকরণ। শান্তি তাঁর কাছে কোনো কৌশল ছিল না, ছিল তাঁর প্রিয় মানুষের জন্য আকাক্সিক্ষত অবিকল্প উপচার। আমাদেরও অনুসরণ করতে হবে এই পথ। তিনি তাঁর রচনায় বলেছেন যে কাজ করে সে ভুলও করে আর যে কাজ করে না তার ভুল-শুদ্ধ কোনোটাই হওয়ার সুযোগ নেই। এই কথাটি ভেতর থেকে বিশ্বাস এবং প্রতিপালন করলে যে কোনো দেশের সামনেই আশাবাদী ভবিষ্যৎ ব্যতীত অন্য কিছু অপেক্ষা করার কথা নয়। বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে রবীন্দ্রপ্রেমী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতোই বিশ্বাস করতেন মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। ১৯৭২ সালে তাকে ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘আপনার শক্তি কোথায়’? উত্তরে তিনি বলেছিলেন ‘আমি আমার জনগণকে ভালোবাসি’। তিনি আবার জানতে চেয়েছেন আর আপনার দুর্বল দিকটা কী? তাঁর উত্তর ছিল ‘আমি আমার জনগণকে খুব বেশি ভালোবাসি’। এই ভালোবাসার মূল্য তাঁকে দিতে হয়েছে মাত্র পঞ্চান্ন বছর বয়সে দেশবিরোধী মনুষ্যত্ববিরোধী ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে প্রাণ দিয়ে। তবু আমাদের বিশ্বাস রাখতে হবে বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষকে ভালোবাসার শক্তিতে। তিনি জীবনের এক বড়ো অংশ কাটিয়েছেন পাকিস্তানি জেলখানার অন্ধকারে। জেলখানায় বঙ্গবন্ধু বাগান করতে ভালোবাসতেন। আজ আমরা উন্মুক্ত-স্বাধীন ঘোরাফেরা করেও মানসিকভাবে জেলখানায় বন্দি না থেকে যেন বঙ্গবন্ধুর মতোই মানুষের জীবনে কাম্য সুরভির বাগান তৈরির সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে পারি এই হোক এবারের ১৫ আগস্টের প্রধান প্রত্যয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App