×

জাতীয়

জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ষড়যন্ত্র দেশে-বিদেশে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ০৯:১৭ পিএম

জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ষড়যন্ত্র দেশে-বিদেশে

পিতা, ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম

জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ষড়যন্ত্র দেশে-বিদেশে

আসল নায়কেরা ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হতে শুরু করে

জাতির পিতার হত্যাকাণ্ড ষড়যন্ত্র দেশে-বিদেশে

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: যুক্তরাষ্ট্রের নীবর সমর্থন

জাতীয় শোক দিবসে ভোরের কাগজের বিশেষ সংকলন ‘স্মরণে শ্রদ্ধায় চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু’

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে দেশে ফেরার পর সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সেটা তো তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বাস।’ একই বছরে অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর এনবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক পল নিক্সনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি পেয়েছি কোটি কোটি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস আর ভালোবাসা। যে দিন এই মানুষের জন্যে আমার জীবন দিতে পারবো, সে দিন আমার আশা পূর্ণ হবে, এর চেয়ে বেশি কিছু প্রত্যাশা করি না।’

এই দুই বিদেশি সাংবাদিককে দেয়া দুটি সাক্ষাৎকার শুনলে মনে হয় দেশের জন্যে, দেশের মানুষের জন্যে জীবন দেয়ার এক চরম আত্মত্যাগের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ ২৩ বছর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে। সেই স্বপ্নের সোনার বাংলা যখন অর্জিত হলো, তার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় প্রাণ দিতে হলো তাঁকে। তিনি বিশ্বাস করতেন না, কোনো বাঙালি তাঁকে হত্যা করতে পারে। কিন্তু তিনি জানতেন না, এই বাঙালিদের মধ্যে কারো কারো শরীরে বইছে মীরজাফরের রক্ত। তাই ২৩ বছরের সংগ্রামে অর্জিত স্বাধীন বাংলার মাটিতে তাঁকে জীবন দিতে হলো সেই নব্য মীরজাফরদের হাতে। জাতির পিতার রক্তে রঞ্জিত হলো তাঁরই স্বপ্নের সোনার বাংলা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রচিত হলো সেই বিশ্বাসঘাতকতার কালো ইতিহাস।

তাই বাঙালির জীবনের সবচেয়ে এক অন্ধকারতম দিনের নাম ১৫ আগস্ট। এক নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের নাম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। এক দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মিলিত চক্রান্তের নাম একজন জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের পরিবর্তন। শুধুমাত্র বাঙালির ইতিহাস নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম জঘন্যতম ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। ৩০ লাখ শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত যেই দেশ, সেই যুদ্ধের যে মহানায়ক হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁকেই হত্যা করা হলো তাঁর নিজের বাসভবনে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাঁকে হত্যা করতে সাহস পায়নি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীরা সেই ১৯৭১ সালের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিল মাত্র সাড়ে চার বছরের মাথায়, তাঁকে হত্যা করে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে।

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সুবিধাভোগীরা। রাষ্ট্র চলেছে ১৯৭১ পূর্ববর্তী পাকিস্তানি ভাবধারায়। জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ লুণ্ঠিত হয়েছে এই সুবিধাভোগীদের হাতে। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মুশতাক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল- এই দীর্ঘ ২৩ বছর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে জাতির পিতাকে হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী ও হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সুবিধালাভকারীদের দ্বারা। দীর্ঘ এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াও নিষিদ্ধ ছিল

১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সুবিধাভোগীরা। রাষ্ট্র চলেছে ১৯৭১ পূর্ববর্তী পাকিস্তানি ভাবধারায়। জাতির পিতার স্বপ্নের দেশ লুণ্ঠিত হয়েছে এই সুবিধাভোগীদের হাতে। বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মুশতাক, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং পরবর্তী সময়ে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্ত্রী তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামল এই দীর্ঘ ২৩ বছর বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে জাতির পিতাকে হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রকারী ও হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সুবিধালাভকারীদের দ্বারা। দীর্ঘ এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর নাম নেয়াও নিষিদ্ধ ছিল। ইতিহাস থেকে জাতির পিতার নাম নিশানা মুছে ফেলার সুপরিকল্পিত নানা অপচেষ্টা করা হয়েছে। কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করা হয়েছে। ১৫ আগস্টের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু নয়, হত্যা করা হয়- বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেল, শেখ আবু নাসের, সুলতানা কামাল খুকু, পারভীন জামাল রোজী, আবদুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ ফজলুল হক মনি, বেগম আরজু মনি, কর্নেল জামিলউদ্দিন আহমেদ, আবদুল নঈম খান রিন্টু, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, শহীদ সেরনিয়াবাত ও সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবুকে। জাতির পিতা থেকে ১০ বছরে শিশু কেউ বাদ যায়নি এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড থেকে। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ইতিহাসের মহানায়ক’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, ‘যে নেতার বুকভরা ছিল গভীর ভালোবাসা, বাংলার মানুষ বাংলার আকাশ বাতাস, মাটিকে যিনি গভীর ভালোবাসায় সিক্ত করেছিলেন, সেই বাংলার মাটি তার বুকের রক্তে ভিজে গেল কয়েকজন ঘাতক ও বেইমানের চক্রান্তে।’ বঙ্গবন্ধু কখনো বিশ্বাস করতেন না- এই বাঙালি তাঁকে কখনো হত্যা করতে পারে। তাই দেশের রাষ্ট্রনায়ক হয়েও সাদামাটা নিরাপত্তাহীন এক বাসভবনে তিনি বসবাস করতেন। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি এখন বঙ্গবন্ধুর উদার চিন্তা আর ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের কালরাত্রির সাক্ষী হয়ে আছে। এই বাড়ির সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েছে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত জাতির পিতার লাশ। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর হওয়া এই বাড়িটি ঘাতকদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন ও নৃশংসতার উদাহরণ হিসেবেই থাকবে আগামী সময়।

১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬- দীর্ঘ ২৩ বছরের নানা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে বাঙালির ইতিহাসের এই মহানায়ককে মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা অপচেষ্টাই ছিল মাত্র। যে বাংলার মাটিতে মিশে আছে বঙ্গবন্ধুর প্রাণ, সেই মাটির গন্ধ তো আর বদলে দেয়া সম্ভব নয়। তাই টুঙ্গিপাড়ার মাটিতে শুয়ে থেকেও তিনি জাগ্রত ছিলেন এবং এখনো আছেন বাঙালির অন্তরের আলো হয়ে। তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের মনে চেতনার বাতিঘর হিসেবে তিনি জাগ্রত আছেন। তাই তিনি থেকেও ছিলেন আলোকবর্তিকার মতো, না থেকেও আছেন বাঙালির হৃদয়জুড়ে।

হত্যাকাণ্ডের বিচার: অন্ধকার ভেঙে আলোর পথে যাত্রা ১৯৯৬ সালে ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার করা। জিয়াউর রহমানের শাসনামলের তার পূর্বসুরি খন্দকার মুশতাকের করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে যে সংসদীয় বৈধতা দেয়া হয়েছিল, তা উপড়ে ফেলে বিচারের পথ উন্মুক্ত করা। এই অধ্যাদেশটি জারি হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত সবাইকে দায়মুক্তি দিয়ে। ১৯৭৯ সালের জেনারেল জিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের পর এই অধ্যাদেশকে আইনের বৈধতা দেয়া হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে ২১ বছর পর এই কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল আইন পাস হয় সংসদে বিচারের পথ উন্মুক্ত হয়। এই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মুহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে ধানমন্ডি থানায় ২৪ জনকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ১৯৯৮ সালে ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালে ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেয়। ২০০১ সালে ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে আরেকজন আসামি আপিল করেন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর দীর্ঘ ছয় বছর আপিল শুনানি না হওয়ার আটকে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়ায় এই মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হয়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে আপিল বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করে। দীর্ঘ ১ বছর পর ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চূড়ান্ত রায় দেয় আপিল বিভাগ। ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। এরা হলেন- ১. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, ২. কর্নেল বজলুল হুদা, ৩. ল্যান্সার মহিউদ্দিন আহমেদ, ৪. আর্টিলারি মুহিউদ্দিন ও ৫. সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান। বাকি সাত আসামি সে সময়ে পলাতক ছিল। এ বছরের ১২ এপ্রিল রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার হওয়া আরেক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর হয়। এখনো পলাতক ৬ আসামির মধ্যে খন্দকার বজলুর রশিদ ও মেজর শরিফুল হক ডালিম পাকিস্তানে, এম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে, এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী কানাডায় এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ভারতে পলাতক বলে খবর রয়েছে। অন্য এক আসামি আবদুল আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানা যায়।

[caption id="attachment_237224" align="aligncenter" width="725"] আসল নায়কেরা ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হতে শুরু করে[/caption]

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: ষড়যন্ত্র ছিল দেশে ও বিদেশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ঘটনার পর পুরো জাতি যখন হতচকিত, তখন অনেকেই মনে করতেন এই নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিছকই সেনাবাহিনীর একদল উচ্চাভিলাষী জুনিয়র ও মধ্যম স্তরের সেনাসদস্যের কাজ। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপর ক্ষমতাগ্রহণকারী খুনি মুশতাক চক্র এভাবেই একটি ধারণা দেয়ার অপচেষ্টাই করছিলেন অত্যন্ত সুচতুরভাবে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক ও সেনা নেতৃত্বের কোনো যোগসাজশ নেই, কোনো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষয় এটা ছিল না- নিজেদের দায় এড়ানো ও আন্তর্জাতিক সমালোচনাকে সামলানোর লক্ষ্য নিয়ে এই প্রচারণা চালানো হয়েছিল সুকৌশলে। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করা, দেশের মধ্যে যাতে কোনো জনপ্রতিরোধ গড়ে না ওঠে- তা মোকাবিলা করা, সর্বোপরি ষড়যন্ত্রের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রকে আড়াল করার উদ্দেশ্যেই অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে এটা করা হয়েছিল। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তারা পরবর্তী নানা ঘটে যাওয়া ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর থেকে আসল নায়কেরা ক্ষমতার মঞ্চে আবির্ভূত হতে শুরু করে। ক্ষমতার বলয় থেকে ছিটকে পড়ে হত্যাকারীরা যারা এতদিন ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে বঙ্গভবন থেকে পুরো দেশ নিয়ন্ত্রণ করছিল। এরপর অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থানে খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আসল নায়কেরা। ক্ষমতা কেন্দ্রে তখন চলে আসে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদ গং। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত দেশীয় চক্রান্তকারীদের গ্রুপটিও তখন কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকারীদের মূল লক্ষ্য অর্জিত হওয়ায় তারা নিজেরাই চলে যায় আড়ালে। কিন্তু ইতিহাসের নির্মম সত্য হচ্ছে, ইতিহাস চাপা থাকে না। সত্য উন্মোচিত হয় মিথ্যার আড়াল থেকে। এক মনীষী বলেছিলেন, তিনটি জিনিসকে কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায় না। এই তিন জিনিস হলো- চন্দ্র, সূর্য এবং সত্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মিডিয়া, গবেষণা ও নানা লেখালেখিতে উন্মোচিত হতে থাকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ভয়ঙ্কর বিভিন্ন দিক। দেশি ও বিদেশি লেখক, গবেষক ও সাংবাদিকরা এই কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ কথা সত্য যে, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি ষড়যন্ত্রের পথেই চলে। চলতে চলতে খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে আসল চক্র, উন্মোচিত হয় প্রকৃত ঘটনা। ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করে গভীর অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসে আসল সত্য। সেই ইতিহাসের অমোঘ সত্যের বিশ্লেষিত জায়গাগুলো এখন তুলে ধরতে চাই। যার ঘটনা পরস্পর বিশ্লেষণ বঙ্গবন্ধু হত্যার ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্রের অন্ধকার দিকটিকে আলোতে নিয়ে আসে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: যুক্তরাষ্ট্রের নীরব সমর্থন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুজিবনগর সরকারের সময় খন্দকার মুশতাক চক্র কলকাতার মার্কিন কনসুলেটের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু তখন থেকেই। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যখন লড়াইয়ে লিপ্ত, অসংখ্য মানুষের রক্তে যখন রঞ্জিত বাংলার মাটি, মুক্তিকামী মানুষ পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমেদ, পররাষ্ট্র সচিব মাহবুল আলম চাষী, মুশতাকের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা কুমিল্লার এমপি জহুরুল কাইয়ুম ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুর কলকাতায় মার্কিন কনসাল জোসেফ ফারল্যান্ডের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ ঠেকাতে কনফেডারেশনের প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে। তাদের এই তৎপরতা ভারতের গোয়েন্দাদের নজরে আসার পর তাজউদ্দীনের নেতৃত্বাধীন মুজিবনগর সরকারে তাদের নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। ইতিহাসের নির্মম সত্য হচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার এই চক্রান্তের নায়কেরা ১৫ আগস্ট সকালেই সশরীরে উপস্থিত শাহবাগ রেডিও স্টেশনে। বঙ্গবন্ধু সরকারের বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমেদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক মাহবুল আলম চাষী উপস্থিত খুনি চক্রের সাথে। ১৯৭১ সালে তারা যেটা করতে সফল হয়নি, ১৯৭৫ সালে সফল হয় বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। তারপরের ইতিহাস সবার জানা। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজ ও সাংবাদিক কাই বার্ড অনুসন্ধান করে দেখিয়েছিলেন, এই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রক্রিয়ায় কীভাবে ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইউজিন বোস্টার ও সিআইএর স্টেশন চিফ ফিলিপ চেরি জড়িত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে নিউইয়র্কের ডেইলি মেইল পত্রিকায় এই দুই মার্কিন সাংবাদিকের লেখা ‘বাংলাদেশ, এনাটমি অব এ ক্যু’ প্রবন্ধে বিস্তারিত তার বিবরণ আছে। ১৯৭৫ সালে জানুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী ফারুক রশীদ গং মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তাদের বলা হয়, তারা যদি তাদের অভিযানে সফল হয়, তাহলে সমর্থন দেবে। আর ব্যর্থ হলে তারা পুরো বিষয়টাই অস্বীকার করবে।

[caption id="attachment_237225" align="aligncenter" width="717"] বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: যুক্তরাষ্ট্রের নীবর সমর্থন[/caption]

আরেক ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টেফার হিছেন তার গবেষণামূলক গ্রন্থ- ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থে তথ্য প্রমাণ দিয়ে লিখেছেন, বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাতের প্রক্রিয়ায় তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সম্মতি ছিল। হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৭৩ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। ১৯৭১ সালেই হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের সামরিক জান্তার জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে আশ্বস্ত করেন যে, ভারতে মুজিবনগর সরকারের একটি অংশ স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করে সমঝোতা করতে আগ্রহী। কয়েক বছর আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের যে গোপন দলিল উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তাতে দেখা যায়, ১৯৭১ সালের ১১ আগস্ট হোয়াইট হাউসে নিক্সন, কিসিঞ্জার ও অন্যদের এক বৈঠকে তৎকালীন মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট জন আরউইনের দেয়া এক রিপোর্টে খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে ভারতের মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা জর্জ গ্রিফিনের এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।

১৯৭১ সালে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মুশতাকের এই আলোচনার কথা তার উপদেষ্টা জি ডব্লিউ চৌধুরীকে জানান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর স্বামী জি ডব্লিউ চৌধুরী বা গোলাম ওয়াদুদ চৌধুরী তার লেখা বই ‘দ্যা লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান’ গ্রন্থে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে যুদ্ধ ছাড়াই সমাধান হবে বলে মার্কিন প্রশাসনের আশ্বস্ত করার খবর উল্লেখ করেন। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন চলাকালে খন্দকার মুশতাকের নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধিদলের যুক্তরাষ্ট্র সফর করার কথা ছিল। এবং নিউইয়র্কে খন্দকার মুশতাকের সঙ্গে মার্কিন ও পাকিস্তানি প্রতিনিধিদলের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে মুশতাকের এই চক্রান্ত ফাঁস হয়ে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন প্রতিনিধিদলে পরিবর্তন আনেন। খন্দকার মুশতাকের পরিবর্তে পরবর্তী সময়ে লন্ডন থেকে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ভিন্ন একটি প্রতিনিধিদলকে নিউইয়র্কে পাঠানো হয়। এরপর থেকে খন্দকার মুশতাককে মুজিবনগর সরকারে একেবারে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়।

অন্যদিকে মার্কিন কংগ্রেসম্যান স্টিফেন জে সোলার্জ ১৯৮০ সালের ৩ জুন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজকে লেখা এক চিঠিতে জানান, হাউস ফরেন এফেয়ার্স কমিটির এক তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শাসনামলের বিরোধিতাকারীরা ১৯৭৪ সালের নভেম্বর ও ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। লরেন্স লিফসুলজ লিখেছেন, ঢাকায় বাংলাদেশি সামরিক কর্মকর্তাদের দুটি গ্রুপ- জুনিয়র অফিসার যারা হত্যাকাণ্ড ঘটাবে অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের মতো সিনিয়র অফিসার গ্রুপ যারা ভবিষ্যতে নেতৃত্ব নেবে- উভয় গ্রুপই মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। দূতাবাস থেকে বলা হয়, মুজিবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিলে তাদের কোনো সমস্যা নেই।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড: পাকিস্তানের ভূমিকা আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান কারাগারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলেও পাকিস্তান মনেপ্রাণে কখনো বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে পারেনি। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন, কনফেডারেশন জাতীয় কিছু একটা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ঠেকানো যায় কিনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কোনোভাবেই এ ধরনের কোনো উদ্যোগে রাজি করানো যায়নি। ঢাকায় রেসকোর্সে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরোরা ও পাকিস্তানের পূর্ব পাকিস্তান সেনা কমান্ডার জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর মধ্যে পরাজয়ের দলিল স্বাক্ষরের পরও এই চেষ্টা অব্যাহত ছিল। এমনকি ১৯৭৩ সালে প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো যে খসড়া সংবিধান প্রণয়ন করেছিল, তাতে বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান হিসেবে উল্লেখ করে একদিন দখলমুক্ত হয়ে আবার পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের পর বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার জন্যে পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ ছিল চরমে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘ ও সোভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য মিত্র দেশ দিয়ে এই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছিলেন, যাতে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মতো হটকারী সিদ্ধান্ত না নেয়। অনেকের মতে, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মী হত্যা করলেও পাকিস্তানদের হাতে আটক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করার দুটি কারণ ছিল। এক. বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার সমস্ত সম্ভাবনা তখনই শেষ হয়ে যাবে। দুই. মার্কিন প্রশাসন পাকিস্তানকে আশ্বস্ত করেছিল, খন্দকার মুশতাক গং-এর সঙ্গে মুক্তির সংগ্রাম বাদ দিয়ে যুদ্ধবিরতির যে আলোচনা তারা চালাচ্ছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হলে সেই চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবেশিত হবে। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো কিংবা মার্কিন এ শাসকদের এই দুই প্রচেষ্টার কোনোটাই সফল হয়নি বঙ্গবন্ধুর অনঢ় ভূমিকা ও মার্কিন-মুশতাক ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার পূর্ব মুহূর্তে বলেছিলেন, তাঁর জীবনের বড় ভুল ছিল, শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখা। ৮ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধুকে ৪ জানুয়ারি থেকে মিলাওয়ানওয়াল জেল থেকে মুক্ত করে রাওয়ালপিন্ডির একটি গেস্ট হাউসে আনা হয়। এখানে আগে থেকে অবস্থান করেছিলেন ড. কামাল হোসেন। ড. কামাল হোসেন তার বইয়ে লিখেছেন, এই চার দিনে জুলফিকার আলী ভুট্টো কয়েক দফা চেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে যে কোনোভাবে দুই পাকিস্তানের এক সঙ্গে থাকার একটি যৌথ ঘোষণা দেয়া যায় কিনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কোনোভাবে এ ধরনের ঘোষণায় সম্মত করানো সম্ভব হয়নি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন আমি নয় মাস পাকিস্তানে বন্দি, আমি কিছুই জানি না বাংলাদেশে কী ঘটেছে। আমাকে বাংলাদেশে যেতে হবে, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তারপর এ বিষয়ে কথা বলতে পারব। এর মধ্যে ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নেয়ার জন্য ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্সের বিশেষ বিমান এসে উপস্থিত হওয়ায় পাকিস্তানিরা হাল ছেড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।

আন্তর্জাতিক চাপে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তান কারাগারকে মুক্তি দিতে বাধ্য হলেও পাকিস্তান মনেপ্রাণে কখনো বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করতে পারেনি। জেনারেল ইয়াহিয়া খানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছেন, কনফেডারেশন জাতীয় কিছু একটা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ঠেকানো যায় কিনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে কোনোভাবেই এ ধরনের কোনো উদ্যোগে রাজি করানো যায়নি

৮ জানুয়ারি অপরাহ্নে লন্ডন পৌঁছে বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েও একই কথা বলেন। ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে রেসকোর্স ময়দানে যে বক্তৃতা দেন, তাতে এ বিষয়ে আলোচনার দরজা চিরতরে বন্ধ করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন, ভুট্টো দু’দেশের মধ্যে একটি শিথিল সম্পর্ক রাখার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, এ ব্যাপারে আমি এখন কিছু বলতে পারব না। এখন আমি বলতে চাই, আপনি আপনার দেশ নিয়ে শান্তিতে থাকুন, বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখন যদি কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়, তাহলে সে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যে মুজিব সর্বপ্রথম তাঁর প্রাণ দেবে। ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, পাকিস্তান-মার্কিন ও দেশীয় দোসরদের চক্রান্তে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম অভিনন্দনটি আসে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছ থেকে। বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করার অভিনন্দন জানিয়ে ভুট্টো ইসলামী সংস্থায় সব সদস্য এবং তৃতীয় বিশ্বের সব দেশের প্রতি অনুরূপ আহ্বান জানান। তিনি শুভেচ্ছা হিসেবে ‘বাংলাদেশি মুসলমান ভাইদের’ জন্য ৫০ হাজার টন চাল ও ১০ মিলিয়ন গজ কাপড় পাঠানোর সিদ্ধান্তও দেন। ভুট্টোর এই পদক্ষেপ কি নিছক কূটনৈতিক কার্যক্রম না একাত্তরের পরাজয়ের প্রতিশোধ- তা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশে ঘটল- তাতে ভুট্টো যে শুধুমাত্র নীরব দর্শক ছিলেন না, ১৫ আগস্টের পূর্বাপর ঘটনা তাই প্রমাণ করে। কারণ ১৯৭৫ সালে ১৮ এপ্রিল কাকুলে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে দেয়া এক ভাষণে তিনি বলেছেন, শিগগির এই অঞ্চলে কিছু বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে জুন মাসে ১০৭ সদস্যের প্রতিনিধিদল ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের পর তার সফরসঙ্গী এক সাংবাদিক দেশে ফিরে গিয়ে করাচির ডেইলি নিউজ পত্রিকায় বাংলাদেশে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের সম্ভাবনার কথা লেখেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়ায় বিজ্ঞ দায়রা জজ থেকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ পর্যন্ত মামলা দায়ের ও রায় চূড়ান্ত হওয়ার বিভিন্ন আদালতে মোট ৪টি রায় প্রদান করা হয়েছে। ১৯৯৬ সালে মামলা দায়ের থেকে ২০১০ সালে ফাঁসি কার্যকর পর্যন্ত এই রায়গুলো দিয়েছেন ঢাকা জেলার দায়রা জজ বিচারক কাজী গোলাম রসুল, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানির বিভক্তির রায় দিয়েছেন বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ও বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, পরবর্তীকালে তৃতীয় একক বেঞ্চ বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিমের বেঞ্চের রায় এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি তাফাজ্জল ইসলামের নেতৃত্বে ৫ জন বিচারপতির অভিন্ন ও চূড়ান্ত রায়।

প্রতিটি রায়ের পর্যবেক্ষণ অংশে সপরিবারে দেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনা শুধুমাত্র একটি নিছক হত্যাকাণ্ড ছিল না বলে উল্লেখ করা হয়। এই হত্যাকারীদের বিচারের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য নায়ক ও ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ উন্মোচনের জন্যেও মতামত দেয়া হয়। ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের দিকটি বিবেচ্য ছিল না বিধায় এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্যের সুবিধাভোগী ও ষড়যন্ত্রের নেপথ্যের কুশীলবরা বরাবরের মতো আড়ালেই থেকে গেছে। বিচারকদের পর্যবেক্ষণে পৃথক ও সঠিক অনুসন্ধানের মাধ্যমে এই ষড়যন্ত্রের বিষয়টি উন্মোচনের আহ্বানও জানানো হয়। হত্যা, ক্যু ও অসাংবিধানিক পথে ক্ষমতা দখলের পথ চিরতরে বন্ধ করতে হলে ষড়যন্ত্রের কানাগলিতে ঘুরতে আগ্রহীদের মুখোশ উন্মোচিত হওয়া প্রয়োজন। তাই আজ দাবি উঠেছে, পৃথক একটি ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন গঠন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা, জাতীয় ৪ নেতাকে জেলখানার ভেতরে হত্যার তদন্তের জন্য এক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন গঠন করা এবং কেন্দ্রীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা। অন্যথায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে তার কয়েকজন হত্যাকারীর বিচার হলেও ষড়যন্ত্রের দিকটি উন্মোচিত না হলে তাঁর রক্তের ঋণ আমরা কখনো শোধ করতে পারবো না।

[caption id="attachment_222009" align="aligncenter" width="700"] বিশিষ্ট গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব। ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত[/caption]

শেষ করব ব্রিটিশ সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিছেনের লেখা ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ গ্রন্থের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। হিছেন লিখেছেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণহত্যায় প্রত্যক্ষ ইন্ধন ও ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ঘটনায় পরোক্ষ সম্মতি দিয়ে যে ঘৃণ্য অপরাধ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার করেছেন, তার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে এবং এই প্রমাণ দিয়েই কিসিঞ্জারকে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানো সম্ভব। একজন বিদেশি সাংবাদিক যদি এই দাবি তুলতে পারেন, তাহলে আমরা বাংলাদেশিরা কেন এই দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করে তাদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর দাবি তুলব না?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App