×

জাতীয়

আত্মসমর্পণের আড়ালেও হাতিয়ে নেন কোটি টাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:৫৭ এএম

মরণনেশা ইয়াবার লাগাম টানতে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এর কারবারিদের ‘আত্মসমর্পণ’ করার সুযোগ দেয়া হলেও বন্ধ হয়নি এ ব্যবসা! মিয়ানমার সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এখনো আসছে ইয়াবার চালান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে প্রতিদিন মিলছে লাখ লাখ পিস ইয়াবা। মূলত আত্মসমর্পণের আড়ালে আরেক গল্প লুকিয়ে থাকায় অনেক কারবারি এখনো আছেন বহালে।

টেকনাফ থানার বিতর্কিত সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাসের ‘সাজানো ক্রসফায়ার’ থেকে প্রাণ বাঁচাতে অনেকে বিভিন্ন মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে প্রাণ নিয়ে এখন কারাগারে আছেন বলে তাদের পরিবার ও স্বজনরা দাাবি করেছেন। আত্মসমর্পণ করা ১০২ জনের মধ্যে একজন কারাগারে মারা গেছেন। বাকিরা এখনো আছেন কারাগারে।

অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপের অপকীর্তি এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। টেকনাফে মূর্তিমান আতঙ্ক প্রদীপ লোকজনকে ইয়াবার মামলায় আটক ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার। সিন্ডিকেট করে টাকা তুলে নিজের নামে, স্ত্রী নামে ও বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।

জানা গেছে, কক্সবাজারের মহেশখালী থানা থেকে ২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবরে টেকনাফ থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন প্রদীপ কুমার দাশ। তার সাজানো ছকে ২০১৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে টেকনাফ পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ১০২ জন ইয়াবা কারবারি আত্মসমর্পণ করেন। আত্মসমর্পণকারী ১০২ জনের মধ্যে ২৪ জন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তালিকায় ‘গডফাদার’ হিসেবে চিহ্নিত ছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির তিন ভাইসহ পরিবারের ৮ জন সদস্য ইয়াবা কারবারি হিসেবে আত্মসমর্পণ করেন। এ সময় বড় বড় ইয়াবা কারবারিরা আত্মসমর্পণ করলেও তাদের অনুচর ও ছোট ছোট কারবারিরা বাইরেই রয়ে যায়। টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদিকে নিয়ে বিতর্ক থাকায় তাকে অতিথি হিসেবে আত্মসমর্পণের ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, টেকনাফের উত্তর লম্বরী গ্রাামের জহির আহমেদের ছেলে মো. তৈয়ব ৭ বছর সৌদী আরবে থেকে দেশে ফিরেন। তৈয়বের স্ত্রী রোজিনা আক্তারের অভিযোগ, স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে বিরোধের জের ধরে পুলিশ তাদের বাড়িতে হানা দেয়। টাকা না পেয়ে বাড়িতে ভাংচুর চালায়। প্রাণভয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার স্বামী ইয়াবা কারবারি না হয়েও আত্মসমর্পণ করে এখন কারাগারে আছেন। তৈয়ব কারাগারে যাওয়ার পরও পুলিশ তার বাড়িতে হানা দিয়ে ঘরবাড়ি ভাংচুরের ভয় দেখিয়ে ১১ হাজার টাকা নিয়েছে। বিজিবি সিনেমা হলের সামনের আজিজ রহমানের ছেলে মো. কামাল হোসেন (৩৫)। কামালের ভাই ফারুকের অভিযোগ ইয়াবা ব্যবসা না করেও প্রাণভয়ে তার ভাই বিভিন্ন মাধ্যমে পুলিশকে এক লাখ টাকা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে আছেন। জেলেপাড়ার সিরাজ মিয়ার স্বজনদের দাবি, এক লাখ টাকা পুলিশকে দিয়ে তাকে আত্মসমর্পণের খাতায় নাম লেখাতে হয়েছে। নাজিরপাড়ার এনামুল হক মেম্বার আত্মসমর্পণের আগে কয়েক দফায় পুলিশকে দিয়েছেন ২-৩ লাখ টাকা। মৌলভীপাড়ার একরাম হোসেন একইভাবে দফায় দফায় টাকা দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়ে আত্মসমর্পণ করে এখন করাগারে বলে তাদের স্বজনরা দাবি করছেন।

টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর চৌধুরীর অভিযোগ, সাবেক এমপি বদির চার ভাই আত্মসমর্পণ করে জেলে থাকলেও মুজিবুর রহমানসহ অনেকেই প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। প্রকাশ্যে ঘুরছে বদির স্বজন আবু সৈয়দ মেম্বার ও তার ছেলে আব্দুল্লাহ। বদির ফুফাতো বোনের স্বামী হায়দার আলী ওসি প্রদীপের হয়ে ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন প্রকাশ্যে।

টেকনাফ কাটাবনিয়া এলাকার ওই সময়ে আত্মসমর্পণকারী শওকত আলমের পিতা আব্দুল মাজেদ জানান, শওকত আলম দেড় বছর ধরে আত্মসমর্পণের পর কারাগারে রয়েছে। বড় ছেলে মো. আলমগীরকে আমার চিংড়ি প্রজেক্ট থেকে ওসি প্রদীপসহ একদল পুলিশ আটক করে ‘ক্রসফায়ার’ দেয়ার জন্য নিয়ে যায়। পরে ৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ছেলে জানে রক্ষা পেলেও ১ হাজার পিস ইয়াবা দিয়ে আদালতে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দীর্ঘদিন জেল খেটে আমার বড় ছেলে বর্তমানে এলাকায় রয়েছে। আমার ছেলে কোনোভাবে ইয়াবা কারবারের সঙ্গে জড়িত নয়। শওকত এখনো কারাগারে রয়েছে।

টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের ডেইলপাড়া গ্রামের সাবেক ইউপি মেম্বার সুলতান আহমদ বলেন, আমার পরিবার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা রয়েছে। এমনকি আমার বিরুদ্ধেও ১৯টি মামলা রয়েছে। সে সুযোগে ওসি প্রদীপ প্রতিনিয়ত ‘ক্রসফায়ার’ দেয়ার হুমকি দিত। এ কারণে গত বছর আমার ভাই জাফর আলম আত্মসমর্পণ করে।

সুলতান আহমদ অভিযোগ করেন, ওসি প্রদীপ স্থানীয় দফাদার আলী আহমদের সহায়তায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। টেকনাফ কচুবুনিয়া এলাকার সৈয়দ নুর আত্মসমর্পণ করে এখনো জেলে। তার ভাই আবুল কালাম জানান, আমার ভাই ইয়াবা কারবারি নয়। এটি পুলিশের সাজানো নাটক। যারা প্রকৃতপক্ষে ইয়াবা কারবারি, পুলিশ তাদের ধরে না। প্রতিদিন ইয়াবা কারবারিরা সীমান্তপথে ইয়াবার কারবার এখনো করছে। আরেক আত্মসমর্পণকারী মো. বশরের বাবা সৈয়দুল ইসলাম বলেন, ‘আমার নিরীহ ছেলে এখনো কারাগারে। অভাবের কারণে গত ১০ মাস ধরে ছেলেকে কারাগারে দেখার সুযোগ হয়নি। আমার ছেলে মাছ ধরে জীবনযাপন করত। এলাকায় বশর নামে এক ইয়াবা কারবারি ছিলেন। তার জায়গায় আমার ছেলে বশরকে ফাঁসানো হয়েছে। মূলত সেখানকার এক ইউপি সদস্যের ছেলে মেরিন ড্রাইভ থেকে মাদক পাচার করত। তাদের সঙ্গে ইয়াবা কারবারি বশরের সম্পর্ক ছিল। তাদের কাছ থেকে পুলিশ মোটা অঙ্কের ঘুষ নিয়ে আমার ছেলেকে মিথ্যা মামলা দিয়ে পলাতক আসামি করে।

প্রসঙ্গত, গত ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৯টার দিকে টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ৫ আগস্ট ওসি প্রদীপ ও দায়িত্বরত পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ ৯ জনকে আসামি করে সিনহার বোন কক্সবাজার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ মামলায় আসামি ৭ পুলিশ সদস্যকেই বরখাস্ত করা হয়। মামলাটি তদন্ত করছে কক্সবাজার র‌্যাব-১৫। ওই মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৩ জনকে ৭ দিনের রিমান্ড ও অন্য আসামিদের দুদিন করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের আদেশ দেন আদালত। ওসি প্রদীপসহ ৭ আসামি এখনো কারাগারে রয়েছে। পুলিশের সাজানো মামলার তিন সাক্ষীও এখন সিনহা হত্যা মামলায় কারাগারে রয়েছে। একই ঘটনায় পুলিশের দায়ের করা মামলায় ৯ আগস্ট সিনহার সহযোগী শিপ্রা দেবনাথ ও ১০ আগস্ট সাহেদুল ইসলাম সিফাত জামিনে কারাগার থেকে মুক্তি পান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App