×

বিশেষ সংখ্যা

আতাতুর্ক, নাসের ও বঙ্গবন্ধু এবং আদর্শিক রাষ্ট্র গঠন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:৩০ পিএম

আতাতুর্ক, নাসের ও বঙ্গবন্ধু এবং আদর্শিক রাষ্ট্র গঠন
আতাতুর্ক, নাসের ও বঙ্গবন্ধু এবং আদর্শিক রাষ্ট্র গঠন
আতাতুর্ক, নাসের ও বঙ্গবন্ধু এবং আদর্শিক রাষ্ট্র গঠন
প্রজাতান্ত্রিক তুরস্ককে আধুনিক ও জনকল্যাণমুখী একটি রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে মুস্তফা কামাল তাঁর সংস্কারবাদী কার্যক্রম পরিচালনা করেন একদলীয় শাসনব্যবস্থায়। রিপাবলিকান পিপলস পার্টি ছিল মুস্তফা কামালের সময়কালের জাতীয় পরিষদ পরিচালনাকারী একমাত্র দল। তিনি তুরস্কের বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনয়নে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োগ করেন। তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ নীতি তুরস্কের সামাজিক ভিত্তিমূলে আঘাত হেনেছিল। তিনি দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ ছিলেন যে, নব তুরস্ক রাষ্ট্রে কোনো সরকারি ধর্ম থাকবে না এবং রাষ্ট্রীয় নীতি ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হবে না। এছাড়া তিনি বিরোধী মত দমনে আলাদা আইন এবং ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। রাষ্ট্রের স্বার্থ ও নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক যে কোনো ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে এই আইন প্রয়োগ করা হতো। স্বাধীন ট্রাইব্যুনালের সদস্যদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন কামালবাদী। এছাড়া ট্রাইব্যুনালের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করা যেত না এবং রায় ঘোষণার পরের দিন মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতো। এভাবেই মুস্তফা কামাল ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক তুরস্ক গঠন প্রক্রিয়া পরিচালনা করেন। উপনিবেশিক শাসনের কবল থেকে মুক্ত হতে আরবদের মাঝে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিলেন মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দেল নাসের। মিশরকে ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্ত করতে ১৯৫২ সালে যে বিপ্লব সংঘটিত হয় তার নায়ক ছিলেন নাসের। এরপর ১৯৫৩ সালে তিনি মিশরে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে নাসের মিশরে যে নীতি পরিচালনা করেন তা ‘নাসেরবাদ’ নামে পরিচিত। তিনি মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক-এর নীতি দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে নাসেরবাদ দ্বারা এশিয়া ও আফ্রিকার রাষ্ট্রগুলো প্রভাবিত ছিল। বিশেষ করে যেসব রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং জোটনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছিল তাদের কাছে নাসেরবাদ অনুপ্রেরণীয় ছিল। নাসেরবাদের স্তম্ভগুলো ছিল প্রজাতন্ত্র, আরব সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং জোটনিরপেক্ষতা। মিশরীয় জাতীয়তাবাদের স্থলে তিনি সাম্রাজ্যবাদের অবসান, সামন্তবাদের বিলুপ্তি, ধনতন্ত্র বর্জন, আরব সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী এ নীতিগুলো প্রতিষ্ঠা করতে চান। পূর্বতন জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের ‘একলা চল’ নীতির পরিবর্তে নাসের আরব ঐক্যের ওপর জোর দিয়ে মিশরকে আরব বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। নানা কারণে বিচ্ছিন্ন ও পশ্চাৎপদ আরবদের মধ্যে তিনি আশার আলো সঞ্চার করেন। নাসেরের বৈদেশিক নীতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন, জোটনিরপেক্ষতা, ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসন বন্ধ করা, আফ্রিকায় ইসরাইলি অনুপ্রবেশের বিরোধিতা, বর্ণ বৈষম্যের বিরোধিতা, প্যান-আফ্রিকা আন্দোলন এবং আফ্রো-এশীয় সংহতি সমর্থন, ইসলামিক বিশ্বের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা এবং জাতিসংঘের সনদের প্রতি অনুগত থাকা ইত্যাদি। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা পরিচালনায় নাসেরও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করেন। নাসেরের ক্ষমতায় টিকে থাকার পেছনে কয়েকটি বিষয় কার্যকরী ছিল : ১. সেনাবাহিনী, ২. সিকিউরিটি সার্ভিসেস, ৩. সাধারণের প্রতি নাসেরের ক্যারিশমাটিক আবেদন, ৪. আদর্শিক চিন্তাধারা। আর তাঁর অর্জনগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল : আসওয়ান বাঁধ নির্মাণ, সুয়েজখালের ওপর সার্বভৌম নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, আরবদের মধ্যে ঐক্যের মনোভাব সৃষ্টি, আফ্রো-এশিয়ায় নেতৃত্ব প্রদান এবং কিউবা ও এঙ্গোলার স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন দান। নাসেরও আতাতুর্কের মতো বিরোধী মতকে কঠোর হস্তে দমন করেছেন। নাসেরের রাষ্ট্রব্যবস্থার পেছনে নিরাপত্তা বাহিনীর শক্ত অবস্থান ছিল। অনেক দিক থেকে একে পুলিশি রাষ্ট্র ব্যবস্থাও বলা যায়। আবার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। নাসের তাঁর সহচর্যদের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন এবং অধিকাংশ মিশরীয় তার সিদ্ধান্ত কোনো প্রশ্ন ছাড়াই মেনে নিয়েছেন। এছাড়া নাসের মনে করতেন যে যারা মিশরীয় বিপ্লব বা এর নেতৃবৃন্দের সাথে দ্বিমত পোষণ করে সে বিশ্বাসঘাতক এবং উপনিবেশিক শক্তির দালাল। ১৯৫৪ সালে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হলে তিনি মুসলিম ব্রাদারহুডের আটজন সদস্যকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ওই ঘটনার পর সেনাবাহিনীর মধ্যে নাসেরের বিরুদ্ধে আর কখনো কোনো আওয়াজ ওঠেনি। ভারতবর্ষ ভেঙে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করেছিলেন বাঙালির মুক্তি এই রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে সম্ভব নয়। তাই তিনি নিজেকে এবং পূর্ব বাংলার মানুষকে প্রস্তুত করেছেন মুক্তি সংগ্রামের জন্য। পাকিস্তানি শোষণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে ১৯৬৬ সালে ঘোষণা করেন ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা’। এর মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির মানসজগতে স্বায়ত্তশাসন ও মুক্তির চেতনা দৃঢ় করেন। স্থাপন করেন পাকিস্তান প্রত্যয়ের বিপরীতে বাংলাদেশ প্রত্যয়। তাঁর নির্দেশিত পথেই বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সংগ্রামে। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনী ভাষণে সংগ্রামের পথ এবং তাঁর কাক্সিক্ষত রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা জনগণের মাঝে উপস্থাপন করেন। দীর্ঘসময় ধরে নিজের মানসে লালন করা বাঙালির মুক্তির দিকনির্দেশনাই তিনি দিয়েছিলেন ভাষণগুলোতে। যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি অনুসারেই পথ চলেন। গ্রহণ করেন রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। আর স্বাধীন বাংলাদেশে এই চারটি নীতিকেই বলা হতো মুজিববাদ। স্বাধীনতার প্রথম পর্বে আওয়ামী লীগের অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুজিববাদ প্রতিষ্ঠা করা। স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরেই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন যে, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ এরপর নভেম্বরে তিনি আরো বিস্তারিত করে বলেন যে, ‘সবার আগে আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র : গণতন্ত্রে বিশ্বাসের সাথে সাথে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, শুধু শোষণমুক্ত সমাজেই গণতন্ত্রের বিকাশ সম্ভব। ঠিক এ জন্যই আমি গণতন্ত্রের সাথে সাথে সমাজতন্ত্রের কথা বলি। আমি এও বিশ্বাস করি যে, বাংলাদেশে যত ধর্ম আছে, তার সবগুলোরই সমান অধিকার থাকবে। এর অর্থ আমি বুঝি ধর্মনিরপেক্ষতা, ধর্ম পালনের স্বাধীনতা। শেষত যা মোটেও কম গুর”ত্বপূর্ণ নয়, তা হলো বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা, কৃষ্টি এবং গোটা বাঙালি পরিবেশে অনুপ্রেরণা জোগানোর প্রয়োজনীয়তা। এরও দ্বারা আমি জাতীয়তাবাদ বুঝি।’ স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে জটিলতা বৃদ্ধি পায়। স্বাধীনতার পর জাসদ, ন্যাপ (ভাসানী) ও অন্যান্য চীনপন্থি দলসমূহের সরকারবিরোধী কার্যক্রম মোকাবিলায় সরকারের মধ্যে সংকট সৃষ্টি হয়। অর্থনৈতিক সংকটের ফলশ্রুতিতে রাজনৈতিক সংকট বৃদ্ধি পায়। রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার বিপরীতে চরমপন্থি বিপ্লবী দলগুলো সরকারের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার জন্য ১৯৭৪ সালের মাঝামাঝি জাসদের ‘বিপ্লবী গণবাহিনী’ এবং সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’র জঙ্গি তৎপরতা সরকারকে বিপাকে ফেলে। তাছাড়া বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির একটা দৃঢ় অবস্থান ছিল। রাজনীতিতে তারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেও তাদের প্রভাব সৃষ্টি অব্যাহত ছিল। তাই বঙ্গবন্ধুকে বাম এবং ডান উভয় শক্তির বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছিল। উদ্ভ‚ত বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তিনি এক ডিক্রির মাধ্যমে দেশের সব বৈধ রাজনৈতিক দল ভেঙে দিয়ে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল)’ নামে একটি নতুন একক রাজনৈতিক দল গঠন করেন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আতাতুর্ক, নাসের ও বঙ্গবন্ধুর মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা করলে প্রথমেই যে দিকটি সামনে আসে তা হলো আতাতুর্ক ও নাসের ছিলেন সেনা সদস্য। তাদের দুজনেই রাজনৈতিক মতাদর্শগত চর্চা ক্ষমতায় আসার পূর্বে লালন করেননি। বিপ্লবের পূর্বে তুরস্ক কিংবা মিশরের সাধারণ জনগণের মানসজগৎ সৃষ্টিতে তাদের কোনো ভ‚মিকা নেই। আতাতুর্ক তুরস্কের আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন আর নাসের ‘মুক্ত সেনানী’ গ্রুপের সদস্যদের নিয়ে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। উভয়েই গুপ্ত সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং রাষ্ট্র গঠনে তা বাস্তবায়নের কোনো পরিকল্পনা জনগণের সামনে ছিল না। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তারা রাজনীতি চর্চায় এসেছেন এবং তাদের গৃহীত নীতি রাষ্ট্রে বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছেন। তা করতে গিয়ে উভয়েই ব্যবহার করেছেন সেনাবাহিনীকে। রাজনীতির ক্ষেত্রে বিরোধী মতকে দুজনেই কঠোর হস্তে দমন করেছেন। তুর্কিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে বিরোধিতাকারী খলিফা ও তাঁর সহচরদের মুস্তফা কামাল দেশত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। নাসেরও ১৯৫২ সালের বিপ্লবের পর রাজা ফারুককে দেশত্যাগে বাধ্য করেন এবং ১৯৫৪ সালেই ১৯৪৬-৫২ সাল পর্যন্ত যে সমস্ত আমলা প্রশাসনে নিয়োজিত ছিলেন তাদের বাতিল করেন। মুস্তফা কামাল (১৯২৩-১৯৩৮) এবং নাসের (১৯৫৩-১৯৭০) মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের ডান-বাম রাজনৈতিক গতিধারায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে পূর্ব বাংলার জনগণকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তি সংগ্রামের দিকে ধাবিত করেন। তিনি কখনো গুপ্ত সংগঠন করেননি, নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ধারণা গণমানুষের মানসজগতে স্থাপন করেন। স্বাধীনতার পর তিনি তাঁর মূল আদর্শসমূহ রাষ্ট্র গঠনে কার্যকর করার চেষ্টা করেন। একজন দক্ষ রাজনীতিক হিসেবে তিনি বাংলাদেশকে একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছেন, যেখানে সশস্ত্রের ওপর নিরস্ত্রের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা হবে। সামরিক বাহিনীকে তিনি মতাদর্শ বাস্তবায়নের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেননি। তাছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতা যার ইংরেজি প্রতিশব্দ সেক্যুলারিজমকে তিনি ভিন্নভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। তার ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা মুস্তফা কামালের ধর্মনিরপেক্ষতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। মুস্তফা কামাল ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করে সকল ধর্মীয় দল, প্রতিষ্ঠান এমনকি সুফিদের মাজারও বন্ধ করে দেন। মসজিদের সংখ্যা সীমিত করে আরবির বদলে তুর্কি ভাষায় আজান চালু করেন। পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের অধিকার দেন। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় তাকে চরমভাবে বিরোধী মতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এক্ষেত্রে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুর্বলতা এবং ডান-বাম রাজনৈতিক গোষ্ঠীর কর্মতৎপরতা কার্যকর ছিল। পাশাপাশি বাংলাদেশবিরোধী চেতনা দেশের অভ্যন্তরে ছিল সক্রিয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী চক্র রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও অন্যান্য সংগঠনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কার্যত কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের নিষিদ্ধ করা হলেও দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের রাজনীতির সাথে তাদের সম্পৃক্ততা ছিল। এছাড়া পাকিস্তান আমলের প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনে আত্মীকরণ করায় যারা বাংলাদেশবিরোধী ছিলেন তারা তাদের মতাদর্শ বাস্তবায়নে কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধু নাসেরের নীতির অনুরূপ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে দেশীয় অবস্থার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ব্যবস্থা প্রচলন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে বাংলাদেশ বাকশালের ইতিবাচক প্রভাব অনুধাবন করতেই পারেনি। স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অসুস্থ প্রতিযোগিতা, বাংলাদেশবিরোধীদের চক্রান্ত এবং পারিবারের সদস্য, দলীয় কর্মী বা অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের ভুলের মাসুল দিতে হলো বঙ্গবন্ধুকে জীবন দিয়ে। তাই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া শুরুতেই সংকটের সম্মুখীন হয়। অথচ বিশ শতকের একটি আদর্শিক কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে গড়ে তোলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App