ধ্রুবতারা
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২০, ০৭:৫০ পিএম
চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে হয় আরকান রোড ধরে। আরকান রোডের পাশেই সরকারি হামিদিয়া প্রাইমারি স্কুল। আজ সকালে স্কুলে আসার পর রাজু দেখে সামনের মাঠে অনেক মানুষ ভিড় করেছে। যেখানে স্কুলের শিক্ষকরা আছেন যেমনভাবে, তেমনিভাবে এলাকার নেতৃস্থানীয় অনেককে দেখা যাচ্ছে। আজ আরকান রোড দিয়ে বোয়ালখালী যাবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অল্প কিছুদিন আগে ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে পূর্ব বাংলার দক্ষিণ উপক‚ল এলাকায়। তছনছ হয়ে গেছে গোটা জনপদ। বিধ্বস্ত বাড়িঘর এখনো ঠিকঠাক করতে পারেনি বেশিরভাগ মানুষ। প্রিয়জন হারানোর দুঃখ-ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছে এখানকার মানুষজন। চাপা দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে আছে এলাকার আকাশ বাতাস। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য সহযোগিতা করতে এবং সহানুভ‚তি জানাতে আসছেন শেখ সাহেব। ক্ষতিগ্রস্ত অন্যান্য জায়গা পরিদর্শন শেষে কালুরঘাট সেতুর ওপাড়ে কর্ণফুলী নদীর তীর ঘেঁষা আরেক বিধ্বস্ত জনপদ বোয়ালখালী যাবেন তিনি। তাঁর যাওয়ার পথে একনজর তাকে দেখা, যদি সম্ভব হয় গাড়ি থামিয়ে কিছু কথা বলার প্রত্যাশায় এখানকার আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ নেতা, সাধারণ মানুষ ভিড় করেছে। কখন বঙ্গবন্ধু এ পথ দিয়ে যাবেন, তাকে খুব কাছ থেকে একনজর দেখার সাধ অনেকের। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শোষণ-বঞ্চনায় নিপীড়ন নির্যাতনে অতিষ্ঠ পূর্ব বাংলার মানুষ। এভাবে আর তাদের অন্যায় অবিচার শোষণ বঞ্চনা মেনে নেয়া যায় না। বাংলার মানুষ ক্রমেই ফুঁসে উঠেছে। স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে বাঙালিদের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছেন শেখ মুজিব। ছয় দফার আন্দোলনে এদেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ-শ্রেণি নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। শেখ মুজিব বাঙালির অধিকার ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি শোষণ বঞ্চনা নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্ব সবাইকে প্রচণ্ডভাবে আশাবাদী করেছে। আর কিছুদিন বাদেই সাধারণ নির্বাচন। সবাই এই নির্বাচনে নিজের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাবে ভোটের মাধ্যমে। দেশজুড়ে চলেছে ভোটের হাওয়া, প্রচার-প্রচারণা। বাঙালি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে সরকার গঠন করতে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। এখন শুধু ডিসেম্বরের অপেক্ষা। ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনামলে পাকিস্তানে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবার। অক্টোবরে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও বন্যা ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে তা পিছিয়ে গেছে। আগামী ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনী প্রচারণার কাজে ব্যস্ত থাকলেও বঙ্গবন্ধু ১২ নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দক্ষিণ বাংলা এবং চট্টগ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা জানার পর স্থির থাকতে না পেরে ছুটে এসেছেন এখানে। বোয়ালখালীতে কয়েকটি ছোটখাটো জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার কথা রয়েছে তাঁর। সেখানেও তাঁর কথা শোনার জন্য হাজার হাজার সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী জড়ো হয়ে অপেক্ষা করছে। এক সময় স্কুলের মাঠে অপেক্ষমাণ নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু আসছেন এ পথে। তাঁর গাড়ি দেখা যাচ্ছে। হামিদিয়া সরকারি প্রাইমারি স্কুলের ক্লাস ফোরের ছাত্র রাজু এর মধ্যে অন্য সব ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আরকান রোডে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু এ পথে যাওয়ার সময় ছাত্রছাত্রীরা হাত নেড়ে এই মহান নেতাকে শুভেচ্ছা জানাবে- তেমন চিন্তাভাবনা থেকে তাদের রাখা হয়েছে সারি বেঁধে। দেখতে দেখতে শেখ সাহেবকে বহনকারী গাড়িটা এসে যায় স্কুলের সামনের রাস্তায়। জড়ো হওয়া নেতাকর্মীরা তাঁকে দেখে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ে। তখন স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে উপস্থিত সবার মুখে মুখে। ‘জয় বাংলা।’ ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।’ ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা।’ ‘জয় বাংলা।’ ‘জয়ের পথে নৌকা, নৌকা।’ রাস্তার পাশে এত মানুষজন, নেতাকর্মীদের ভিড় দেখে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী গাড়িটা থেমে যায়। গাড়ি থেকে নেমে আসেন তিনি। উপস্থিত সবার মধ্যে আনন্দ উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে যান আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতারা। সবার সঙ্গে হাত মেলান তিনি। দু’হাত উপরে তুলে উপস্থিত সবার আগ্রহ কৌত‚হল উচ্ছ্বাসের জবাব দিতে দিতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের এগিয়ে আসেন তিনি। রাজু এতদিন বঙ্গবন্ধুর কথা শুনে আসছে সবার মুখে। পত্রিকার পাতায় তাঁর ছবি দেখেছে। কিন্তু সামনাসামনি এই মহান নেতাকে দেখার সুযোগ আজই প্রথম হলো। যে মহান নেতার কথা শুনতে শুনতে মনের মধ্যে আলাদা একটি জায়গা দিয়েছে ছোট্ট কিশোর রাজু, তাঁকে প্রথম সামনাসামনি দেখে বিস্ময়ে অভিভ‚ত হলো সে। দীর্ঘদেহী সুপুরুষ মানুষটির চোখে ভারি ফ্রেমের চশমা। ব্যাকব্লাশ করা চুল। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পাজামা, তার ওপর হাতাছাড়া কালো কোট। পত্রিকায় এবং বিভিন্ন পোস্টারে দেখা শেখ মুজিব এবার জীবন্ত হয়ে তার সামনে ধরা দিয়েছেন। হেঁটে আসছেন তার দিকে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখছিল রাজু মানুষটিকে। হঠাৎ বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে পড়লেন তার সামনে। কাছে এসে মাথায় হাত রাখলেন, সস্নেহে জানতে চাইলেন, ‘এই যে খোকা, তোমার নাম কি, কোন ক্লাসে পড়ো তুমি?’ বঙ্গবন্ধু তার নাম জানতে চাইছেন। কোনো ক্লাসে পড়ে সে জানতে প্রশ্ন করেছেন। নিজের কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হয়। সে এখানে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছে নাতো- একবার মনে হয় রাজুর কাছে। পাশে জটলা থেকে কে যেন তাগিদ দেয, ‘অ্যাই রাজু, চুপ করে আছিস কেন, বঙ্গবন্ধু কি জানতে চেয়েছেন বল’। তখন ঘোর কেটে যায় হঠাৎ। কোনোভাবে বলে, ‘জ্বি, আমার নাম রাজু, রাজিবুল ইসলাম রাজু। আমি ক্লাস ফোরে পড়ি।’ বঙ্গবন্ধু রাজুর মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন তার পর বলেন, রাজু, ঠিক মতো পড়াশোনা করছো তো। ভালোভাবে লেখাপড়া করবে। অনেক বড় হতে হবে তোমাদের সবাইকে। তোমরাই তো এদেশের ভবিষ্যৎ। শোষণমুক্ত সমাজ গড়তে হবে তোমাদের, বুঝলে।’ এরপর তিনি এগিয়ে যান আরো সামনে। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে রাস্তায় দাঁড়িয়ে টুকটাক কথা বলেন। এখানকার রাজনীতির হালচাল জানতে চান। সবাই তাঁকে ঘিরে ধরে। তাঁর কথা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকে নীরবে। একসময় কথা শেষ করে বঙ্গবন্ধু গাড়িতে চড়ে বসেন। তাঁকে নিয়ে গাড়িটা আরকান রোড ধরে বোয়ালখালীর দিকে এগিয়ে যায়। রাজু অন্য সবার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। এত বড় একজন মানুষ তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছেন। তার নাম, কোন ক্লাসে পড়ে জানতে চেয়েছেন। এরপর ভালোভাবে লেখাপড়া করতে উপদেশ দিয়েছেন। নিজেকে স্কুলের অন্য সব ছাত্রছাত্রীর মধ্যে সৌভাগ্যবান মনে করে রাজু। মনে মনে শপথ নেয়, মহান এই নেতার আদর্শ অনুসরণ করে ভালোভাবে লেখাপড়া করে নিজেকে অনেক বড় করবে। দেশের সেবায় নিজেকে নিবেদন করবে।
দুই. ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫।
রাজু এখন নবম শ্রেণির ছাত্র। পড়ছে চট্টগ্রাম শহরের ভালো একটি স্কুলে। এই স্কুলের ছাত্রদের রেজাল্ট বরাবরই ভালো। চার মাস পরই তার বার্ষিক পরীক্ষা। লেখাপড়ায় সারা বছরেই সিরিয়াস সে। প্রাইমারি এবং জুনিয়র বৃত্তি পাওয়া ছাত্র হিসেবে সব পরীক্ষাতে ভালো রেজাল্ট করার লক্ষ্য নিয়ে পড়াশোনা করছে। ভালোভাবে পড়াশোনা করে তাকে একজন বড় মানুষ হতে হবে। সেই কবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তার মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। প্রিয় মানুষটিকে সেদিন কথা দিয়েছিল রাজু ভালোভাবে লেখাপড়া করে একজন বড় মানুষ হবে, দেশের জন্য নিজেকে নিবেদন করবে। রাজু তার দেয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলতে পারে না। সেটা পালন করে নিজেকে একজন বড় মানুষ হিসেবে গড়তে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সকালে ঘুম থেকে ওঠে হাত মুখ ধুয়ে অন্যদিনের মতো পড়তে বসেছে রাজু। ক্লাসে পড়া রেডি করছে সে। স্কুলে পড়া রেডি না করে গেলে স্যারদের বকুনি খেতে হবে, এটা ভালো করেই জানে সে। রান্নাঘরে মা সকালের নাস্তা তৈরিতে ব্যস্ত। ছোট ভাইবোনেরা ঘুম থেকে ওঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসেছে। সপ্তাহের অন্যদিনগুলোর মতো প্রাত্যহিক কাজকর্মে ব্যস্ত বাড়ির সবাই। বাবা ডাক্তার রাকিব উদ্দিন সামনের ঘরে রোগী দেখছেন অন্যদিনের মতো। এমন সময় হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো একটি ঘটনা ঘটলো। যার জন্য এ বাড়ির কেউ কোনোভাবেই প্রস্তুত ছিল না। বাইরে থেকে কেউ একজন হন্তদন্ত হয়ে বাবার কাছে ছুটে এসেছেন, উত্তেজনায় আবেগে তার সারা শরীর কাঁপছে। মুখ দিয়ে সহজ স্বাভাবিকভাবে কথা বেরোচ্ছে না। তার মুখের কথাগুলো জড়িয়ে যাচ্ছে। ‘আপনারা কী খবর শুনেছেন? সর্বনাশ হয়েছে! বঙ্গবন্ধুকে পুরো পরিবারসহ হত্যা করেছে একদল আর্মি। সারাদেশে মার্শাল ল’ জারি করা হয়েছে। শহরে আর্মি নেমেছে। আবার যেন একাত্তরের পঁচিশের মার্চের পরবর্তী অবস্থা ফিরে এসেছে দেশে। চারদিকে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। ভয়ে আতঙ্কে কেউ ঘর থেকে বের হতে চাইছে না। ধরপাকড় শুরু করেছে আর্মির লোকেরা। কখন যে কাকে আটক করে নিয়ে যায়-’ এরকম একটি ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ সকাল বেলা শুনতে হবে বাংলাদেশের কোনো দেশপ্রেমিক বিবেকবান সুস্থ চিন্তার মানুষ ভাবতে পারেনি। রাজুর বাবা ডাক্তার রাকিব রোগী দেখা বাদ দিয়ে উত্তেজনা ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। ‘ইট ইমপসিবল! আই ডোন্ট বিলিভ, বঙ্গবন্ধুকে কারা হত্যা করেছে? তার ফ্যামিলির সবাইকে এক সঙ্গে কারা হত্যা করেছে? কার এত দুঃসাহস! এত বড় নির্মম কাণ্ড কোনো সুস্থ দেশপ্রেমিক বাঙালি করতে পারে না।’ বাইরের ঘরে চিৎকার উত্তেজনা শোরগোল শুনে রাজু পড়া বাদ দিয়ে ছুটে আসে। এসেই উপস্থিত সবার থমথমে গম্ভীর মুখগুলো দেখতে পায়। তখনও সে জানে না বাংলাদেশের কত বড় সর্বনাশ হয়েছে, বাঙালি তাদের অবিসংবাদিত প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে ফেলেছে চিরদিনের জন্য। ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে, যেখানে জাতির জনক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে থাকতেন। সেখানে সবাইকে একে একে হত্যা করেছে ঘাতক দল। ছোট্ট কিশোর, বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ সন্তান রাসেলকেও তারা রেহাই দেয়নি। তাদের ছোড়া বুলেটে ছোট্ট রাসেলের শরীরটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে রাজু পুরো ঘটনা জেনে যায়। তার সামনে পুরো পৃথিবীটা যেন হঠাৎ প্রচণ্ডভাবে দুলে ওঠে। তার কাছে মনে হয়, ভয়াবহ ভ‚মিকম্প শুরু হয়েছে। চিৎকার করে ওঠে রাজু, আর্তনাদ করে কাঁদতে শুরু করে ক্লাস নাইনের ছাত্র এই কিশোর। তাকে প্রবোধ দেয়ার মতো ভাষা নেই ঘরের মধ্যে কারো। ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি পরিবারের সবাইকে এতটাই আহত এবং মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করেছে যে রাজুকে প্রবোধ দেয়ার মতো অবস্থা কারো নেই। পুরো বাড়িতে এক ধরনের নীরবতা নেমে আসে কিছুক্ষণের মধ্যে। খুব ঘনিষ্ঠ প্রিয়জন হারানোর বিয়োগ ব্যথায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে সবাই। এরকম শোকাবহ ঘটনার মুখোমুখি হয়নি এর আগে বাংলাদেশের মানুষ।
তিন. আজ ২০১৯ সালের ১৫ আগস্ট।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে রাজিবুল হোসেন সাহেবের। ফজরের নামাজ শেষে মর্নিং ওয়াকে বেরিয়েছেন। আজ অফিস নেই। জাতীয় শোক দিবসের ছুটি। চাকরি জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছেন তিনি। আগামী বছর চাকরি থেকে অবসর নেবেন। একটি সরকারি দপ্তরে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা তিনি। প্রতিবছর ১৫ আগস্ট এলে তার মনটা অনেক ভারি হয়ে ওঠে। পরিবারের কারো সঙ্গে খুব বেশি কথা বলেন না। একাকী নিভৃতে সময় কাটান। বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় তার মন। এই দিনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হঠাৎ করে হারিয়ে ফেলেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মানুষ সেদিন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল। নিজেদের প্রিয় নেতাকে এভাবে কেউ সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে- কেউ কি ভেবেছিল আগে। অথচ সেদিন তেমনি বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটেছিল বাংলাদেশে। সারা বিশ্ব চমকে উঠেছিল এই মহান নেতার অকস্মাৎ মর্মান্তিক বিদায়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল সেদিন। রাজিবুল ইসলাম প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় হঠাৎ করেই মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর মুখোমুখি হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। অল্পকিছু সময়ের জন্য জাতির পিতার সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হয়েছিল তার। হিমালয়সম মহান এই ব্যক্তিটি তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। ভালোভাবে, ঠিকমতো পড়াশোনা করে যোগ্য এবং বড় মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। সেই থেকে নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন রাজিবুল হোসেন। একজন সৎ, নীতিবান, দেশপ্রেমিক, দায়িত্বশীল মানুষ হিসেবে অবদান রেখে গেছেন। দুর্নীতি, অসততা, দায়িত্বহীনতাকে কোনোভাবেই প্রশ্রয় দেননি। মহান নেতার আশীর্বাদ এবং অনুপ্রেরণাকে সঙ্গী করে পথ চলেছেন তাঁর আদর্শে নিজেকে পরিচালিত করেছেন। ব্যক্তিস্বার্থ নয় দেশ ও জাতির স্বার্থটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যদি রাত পোহালে শোনা যেত, বঙ্গবন্ধু মরে নাই। যদি রাজপথে আবার মিছিল হতো, বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাই। সাবিনা ইয়াসমিন তাঁর সুললিত কণ্ঠে গানটি গাইছেন অনেক আবেগ নিয়ে। গানটির প্রতিটি লাইন রাজিবুল ইসলাম ওরফে রাজুর হৃদয়ে অদ্ভুত এক অনুভ‚তি ছড়িয়ে দেয়। সেই অনুভ‚তির আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। যে মানুষটি ধ্রুবতারার মতো আকাশে থেকে তাকে পথ দেখিয়ে আসছেন, লক্ষ্যচ্যুত হতে দেননি, আদর্শ সমুন্নত রাখতে সঠিক পথে সৎভাবে জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ করে যাচ্ছেন। তাঁকে নিজের জীবন থেকে কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন কিংবা অনেক দূরের কেউ ভাবতে পারেন না তিনি। মনে হয়, বঙ্গবন্ধু হারিয়ে যাননি, বিদায় নেননি বাংলাদেশ থেকে। তিনি আছেন প্রতিটি বাঙালির পাশে, একান্ত আপনজন হয়। তিনি আছেন রাজিবুল ইসলামের খুব কাছে, একদম পাশে। এভাবেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মানুষকে সঠিক পথে চলার অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন। যদি কেউ তাঁর আদর্শ অনুসরণ না করে বিপথগামী হয়, দেশের স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করে সে নিজেরই সর্বনাশ ডেকে আনে। সেই মহান নেতার দেখানো পথ ধরে এই দেশটা আরো এগিয়ে যাবে সমৃদ্ধির দিকে- তেমন প্রত্যাশা করেন রাজিবুল ইসলাম।