খুনিদের ধরতে গোয়েন্দা টিম পাঠান ইন্দিরা গান্ধী
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২০, ০৪:১৯ পিএম
বিনয় চট্টোপাধ্যায়
আগস্টের শোকগাঁথা
স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য ছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’, বুলগেরিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা এবং মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা ‘সিআইএ’সহ একাধিক বিদেশি সংস্থার কাছে। সম্ভাব্য এই ক্যু সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুকে সতর্কও করেছিলেন ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। বুলগেরিয়ান রাষ্ট্রদূতও বঙ্গবন্ধুর কাছে ষড়যন্ত্রের সংবাদ পৌঁছেছিলেন। ষড়যন্ত্র সম্পর্কে শেখ মুজিবকে অবহিত করার জন্য ‘র’-এর তৎকালীন প্রধান রামেশ্বর নাথ কাওকে ঢাকায় পাঠান ইন্দিরা গান্ধী।
বঙ্গবন্ধু হেসেই উড়িয়ে দেন জেনারেল কাওয়ের আশঙ্কা। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সংঘটিত হচ্ছে পঁচাত্তরের মার্চে কাওয়ের কাছে এমন সংবাদ পেয়ে দ্রুত মুজিবকে অবহিত করেন ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ নীরব ভূমিকায় থাকলেও ইন্দিরা গান্ধী, ‘র’ এর সতর্কতাকেই তেমন একটা গুরুত্ব দেননি বঙ্গবন্ধু। সন্তানস্নেহে অন্ধ পিতার মতোই বিশ্বাস করতে পারেননি তিনি। বাংলাদেশের কেউ তার বুকে অস্ত্র তাক করতে পারে এমন কথা তিনি ভাবতেই পারেননি।
পঁচাত্তরের পনের আগস্ট পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের পর নিজেও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী। ‘ইন্দিরা গান্ধী : এ বায়োগ্রাফি’ শীর্ষক বইয়ে ভারতীয় লেখক পুপুল জয়কর লিখেছেন, ‘আমি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে তার (ইন্দিরা গান্ধী) বাসভবনে যাই। আমি দেখতে পাই, তিনি নিজেও নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে মহাআতঙ্কিত। ইন্দিরা গান্ধী আমাকে বলেন, মুজিব হত্যা হচ্ছে ষড়যন্ত্রের প্রথম ঘটনা। এটাই উপমহাদেশকে ডুবিয়ে দেবে। মুজিব ইতোমধ্যেই প্রস্থান করলেন। ইন্দিরা বিভিন্ন প্রমাণ ও যুক্তি দেখিয়ে বলেন, পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু হবেন তিনি নিজেই। মুজিবের শিশু ছেলেকে হত্যার খবর সব ধরনের শুভ চিন্তাকে ধ্বংস করে দেয়। ভয়ভীতিগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। ইন্দিরা বলেন, ‘আমি গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলো অগ্রাহ্য করেছি, কিন্তু তেমনটি আমি আর করতে পারি না’।
মুজিব হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শুধু আতঙ্কিতই ছিলেন না, তাৎক্ষণিকভাবে মুজিবের খুনিদের গ্রেপ্তারে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন গোয়েন্দা টিম। ভোরেই হত্যাকা-ের সংবাদ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই খুনিদের ধরতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে বাংলাদেশে টিম পাঠানোর নির্দেশ দেন। কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চের দক্ষ অফিসার বিনয় চট্টোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ১৫ জন দুঁদে অফিসার ওইদিন বেলা ১১টার দিকে চারটি গাড়ি করে বাংলাদেশে পৌঁছেন। টিমে কলকাতা স্পেশাল ব্রাঞ্চ ছাড়াও ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের অফিসাররা ছিলেন। তারা পাঁচদিন ঢাকায় অবস্থান করেও খুনি মেজর ডালিম, কর্নেল ফারুক, রশীদদের আটক করতে পারেননি। ছয়দিনের দিন খালি হাতে ফিরে যান তারা।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের ধরতে না পারার ব্যর্থতা মৃত্যু পর্যন্ত তাড়িয়ে ফিরেছে চৌকস অফিসার বিনয় চট্টোপাধ্যায়কে। বিনয় চট্টোপাধ্যায়ের বড় ছেলে গৌতম চট্টোপাধ্যায় ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা তখন পুলিশ অফিসারদের কোয়ার্টারে থাকতাম। স্বাধীনতা দিবস উপযাপনের জন্য অনেক রাত পর্যন্ত জেগে কাজ করেছি। ভোরবেলায় আমরা মুজিব হত্যাকা-ের ভয়ংকর দুঃসংবাদটি শুনি। মেজর ডালিমের ঘোষণাটিও শুনতে পাই। সবকিছু যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। এর কিছুক্ষণ পরই বাবা আমাদের কাউকে কিছু না বলে ছোট্ট একটা ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে যান। পরে কোয়ার্টারের অন্য অফিসারদের কাছে শুনেছি, একটি গোয়েন্দা টিম নিয়ে মেজর ডালিমদের ধরতে বাবা ঢাকায় গেছেন।
তিনি বলেন, সেদিন আমরা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করিনি। শেখ মুজিবের প্রতি সম্মান ও শোক জানিয়ে রাইটার্স বিল্ডিং, লালবাজারসহ সব সরকারি অফিসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। বাংলাদেশের জাতির পিতার খুনিদের ধরতে না পারার দুঃখ নিয়ে বাবা মারা গেলেন মন্তব্য করে গৌতম চট্টোপাধ্যায় বলেন, পাঁচ দিন পর বাবা ও তার সহকর্মীরা ফিরে আসেন। কিন্তু শেখ মুজিবের খুনিরা অধরা ছিল। কেন ধরতে পারেনি, সরকারের কাছে দেয়া তাদের রিপোর্ট কি ছিল এসব বিষয়ে বাবা কখনোই মুখ খোলেননি। অফিসের কোনো কথা কখনোই বাবা বাড়িতে বলতেন না। এটি তার নীতিবিরুদ্ধ ছিল। কিন্তু মুজিবের খুনিদের ধরতে না পারার কষ্টটা তাকে খুব পীড়া দিত। পেশাগত জীবনে বাবা কখনোই ব্যর্থ হননি। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ধরতে এসে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। এজন্যই কষ্টটা বেশি ছিল। ২০০৭ সালে বাবা মারা যান। মৃত্যুর আগেও এ নিয়ে খুব আফসোস ছিল তার।