×

সাময়িকী

অশ্রুডানায় সূর্য খোঁজার পালা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০২০, ০৮:৫৩ পিএম

অশ্রুডানায় সূর্য খোঁজার পালা

বঙ্গবন্ধু

১৫ আগস্টের অনেক কাজ আমরা আলোচনার মধ্যকোণে খুঁজে পেয়েছি। এগুলোর সম্মিলিত সক্রিয়তার ফলে রাষ্ট্রে সমাজে অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও স্বরের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু আয়নায় বাংলাদেশ তার সম্পূর্ণ মুখ দেখার স্তরে এখনো পৌঁছায়নি। এক্ষেত্রে সহায়তা, বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের ছন্দাবরণে কাজ করে যাচ্ছে পুরনো শত্রুরা। দেশের সামাজিক শিক্ষা আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মৌলবাদীদের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমলারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে দেশের সকল রকম নীতিকাঠামো।

পনেরো আগস্ট বাংলাদেশে এক অশ্রুময় দিন। ১৯৭৫ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশে আদিগন্ত শোক-স্তব্ধতা নেমে এসেছিল। অশ্রু হয়ে সেই শোক বহুদিন ধরে জ্বলছে। এখন বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনি, আর এই হত্যাকাণ্ডের নীরব উসকানিদাতারা আকাশে মিলিয়ে গেছে। পথে-ঘাটে, রাজনীতির মঞ্চে কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় ঘাতক এবং তাদের সমর্থকদের রক্ত চক্ষু ইদানীং আর দেখতে হয় না। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পঁচাত্তরের এর অন্ধ গ্রাস থেকে দেশ ক্রামাগত বেরিয়ে আসছে। এদেশে সাধারণ মানুষের কাছে এগুলো বড় রকমের প্রশান্তির বিষয়। বাস্তবতার এই পরিবর্তন অবশ্য ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক পালনের প্রাসঙ্গিকতা কোনোক্রমেই সংকুচিত করে না। অবশ্য যে কোনো যুক্তির ভেতরে এ্যাগোনিজম (Agonism) বা প্রতি-তর্কের পরিসর থেকেই যায়। বাংলাদেশে এখন তিন ধরনের লোক দেখা যাচ্ছে। এক বর্গের লোক বিশ্বাস করে ‘শেখ মুজিবই বাংলাদেশ- শেখ মুজিবই বাঙালি জাতি।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে, এর অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সাথে বঙ্গবন্ধুর সত্তা অবিচ্ছেদ্য। সংবেদনের গভীরতম স্তরে বঙ্গবন্ধু এদের কাছে সেই আর্কিটাইপ (Archetype) বা মূল আদর্শ যা পিতা বা লৌকিক ঈশ্বরের প্রতীক হিসেবে হাজির হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সাথে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর মূল্যবোধ, তাঁর সাহস, সংগ্রাম আর অর্জনের সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নিচ্ছে সে ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন থাকে। দ্বিতীয় বর্গের লোকজন দৃশ্যত : বঙ্গবন্ধুর অনুসারী, মুখে বলে বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা, তিনি বাংলাদেশের সমগ্রতার প্রতীক, তার সোনার বাংলা গড়ার ক্ষেত্রে অগ্রসৈনিক হিসেবে কাজ করতে চাই ইত্যাদি। অন্তর্গতভাবে তারা ভয়ানক এবং ধুরন্ধর। বঙ্গবন্ধুকে এরা ক্ষমতা ও আধিপত্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। রাজনীতিতে মূল্যবোধের ধ্বংস প্যাট্রর্ন-ক্লায়েন্ট (Patron-client) মর্ডেলের জনপ্রিয়তা সাধারণ মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতার অভাব প্রভৃতি কারণে এ ধরনের লোকের সংখ্যা দৃশ্যমানভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর প্রতি এদের সংবেদনশীলতা, আনুগত্য, বঙ্গবন্ধু সংশ্লিষ্ট কাজে এদের সক্রিয়তা এবং অংশগ্রহণ এক ধরনের বিনিয়োগ। এক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে দুটো নতুন প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যেমন অর্থ বিনিয়োগ এবং ধর্মীয় অনুভূতির বিনিয়োগ। শেষোক্ত ব্যাপারটি যদিও এখনো সংজ্ঞায়নযোগ্যভাবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। তৃতীয় বর্গের লোকজন বঙ্গবন্ধুবিরোধী। বঙ্গবন্ধু এদের কাছে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বিনষ্টকারী, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আর সম্প্রসারণবাদী ভারতের দালাল। প্রধানত এই বর্গের লোকজন স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত আলবদর, রাজাকার কিংবা ঐসব পরিবারের পরবর্তী প্রজন্ম, বিএনপি ছাত্রশিবির কিংবা বিভিন্ন ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। অতিবাম এবং অতিসাম্প্রতিক সময়ের উগ্র মৌলবাদী ইসলামী নাস্তিকদের অনেকেই এই বর্গভুক্ত। চেতনার মৌলকেন্দ্রে এরা বঙ্গবন্ধু এবং তার রাজনৈতিক মতাদর্শকে ইসলামের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এরা বঙ্গবন্ধুর গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের ধারণা এবং এর ভিত্তি নীতিগুলো জনস্তরে বিস্তার প্রতিরোধ করতে চায়। তাদের মূল সক্রিয়তা বাংলাদেশকে দ্বিজাতিতত্ত¡ ভিত্তিক পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। এই বর্গীকরণের বাইরেও বাংলাদেশে আরো দুজন মানুষ আছেন যারা বঙ্গবন্ধুর জীবন ও জীবন বিশ্বের সম্প্রসারণ। বঙ্গবন্ধু নিজেই একটি প্রতিবেশ বা ইকো সিস্টেম (ecosystem) তিনি নিজেই আকাশ, নিজেই সূর্য, মৃত্তিকা আর নিসর্গ। তাঁর নানা ভাব-প্রতিমায় বা ইমেজ (রসধমব) নিয়ে এসবের নির্মাণ ঘটেছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এদেশের ইতিহাসের ভেতর এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে সাথে এই প্রতিবেশের আবহাওয়া বদলে গেছে। তাঁর জন্ম, তাঁর মৃত্যু; তাঁর অনির্বাণ সংগ্রাম, তার জীবনের প্রতি ঘটনার নিজস্ব স্বর আছে। বাংলাদেশের মানুষ যারা তাকে চৈতন্যের আশ্রয় মনে করে, যারা তাকে নিয়ে আধিপত্যের ব্যবসা করতে চায় কিংবা যারা তার বিরোধিতা করে এই সব স্বর তাদেরও আপন করে নেয়। তিনি যে পিতা, বাংলাদেশের সমগ্রতার প্রতিবিম্ব। দুঃখ শুধু, একটাই বঙ্গবন্ধু সত্তা-বিশ্বের সব অহংকার আর ঐশ্বর্য নিয়েও তাঁর দুটি কন্যা অশ্উ-প্রতীকে রূপান্তরিত হয়। শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানা বাংলাদেশের মর্মরিত ইতিহাসের দুটি অশ্রুকণার নাম।

দুই. অশ্রু শব্দটির ইতিহাস দীর্ঘ। দুরন্ত দুঃখের ভার শব্দটির ভেতরে, বাইরে। প্রত্ন-পৃথিবীর এসিরিয়া, মহাসমুদ্রের লবণ, মেঘের বৃষ্টি সবকিছু মিলে সময়ের খোরায় তৈরি হয়েছে শব্দটি। অশ্রু এক আবেগত সাড়া, অনুভবের গভীরতার দ্যোতক। একটি ভাষা। ভাষা পরিবাহক, বাস্তবতা বহন করে, নতুন বাস্তবতা নির্মাণ করে। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে যেভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যা করা হলো তা কোনো সামরিক অভ্যুত্থান ছিল না। ঘাতকেরা প্রায় সবাই পাকিস্তান ফেরত সামরিক বাহিনীর সদস্য। তাদের কারো হয়তো বঙ্গবন্ধুর প্রতি ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল। কিন্তু শুধু এর কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক, দেশের রাষ্ট্রপতি, সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ককে খুন করা হবে একথা সহজে বিশ্বাস করা যায় না। গত পঁয়তাল্লিশ বছরে জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুবাদন করেছেন দেশী, বিদেশি সাংবাদিক, লেখক, গবেষক এবং রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তাতে দেখা যাচ্ছে পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন-মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী এই তিন অশুভশক্তির বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী আঁতাত স্থানীয় অপশক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধুকে করে। এসবের ভেতরে সম্ভবত বড় কারণটি অনুল্লেখিত থেকে যাচ্ছে। বৈশিক ক্ষমতা কাঠামোর ভেতরে আধিপত্যের নিয়ামক কেন্দ্রটি বাঙালির জাতীয় জাগরণ যায় না। জাতীয় জাগরণ আর জাতীয়তাবোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠন উপনিবেশবাদীরা পছন্দ করে না। বাংলাদেশ ভূখণ্ডের এ পর্যন্ত চার রকমের প্রত্যক্ষ উপনিবেশের অভিজ্ঞতা ঘটেছে, আদিপর্বে হিন্দু উপনিবেশ, মধ্যপূর্বে মুসলিম উপনিবেশ, আধুনিক পর্বে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি উপনিবেশ। এসব উপনিবেশ বাঙালির ঐশ্বর্য, জ্ঞান, বীরত্বের ইতিহাস, আত্মশক্তি আর আত্মসম্মানের বোধ লুণ্ঠন করেছে। বঙ্গবন্ধু বিপনিশেকীরণের মডেল হাজির করেছিলেন। উপনিবেশের নানা আস্তরণের নিচে চাপাপড়া এদেশের মানুষসহ পৃথিবীর সব শোষিত মানুষের মুক্তির রূপরেখা হতে পারতো তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূিচ। তাকে হত্যা করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিবলয় মুক্তিদায়ী আর আধিপত্যভেদী একটি কণ্ঠ স্তব্ধ করতে চেয়েছে। এর সঙ্গে আরো দুটি তথ্যের প্রতি নজর দেয়া যায়। ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকেও আততায়ীর হাতে প্রাণ দিতে হয়েছিল। পৃথিবীতে, মহামতি গৌতম বুদ্ধ আর যীশুখ্রিস্টের পর গান্ধী ছিলেন অহিংস মতবাদের তৃতীয় অবতার। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মহান মানুষটি ছিলেন ভারতের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, জৈন এবং শিখ নিম্ন জনগোষ্ঠীর আস্থার প্রতীক। অসাম্প্রদায়িক চেতনার কারণেই তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুও রাষ্ট্র আর সমাজের সাম্প্রদায়িকতার অবসান চেয়েছিলেন, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মৌলনীতির একটি হিসাবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। দ্বিতীয়, তথ্যটি হলো, মুক্তিযুদ্ধের সময়ের উপমহাদেশের তিন জাতীয় নেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক বাহিনীর ঘাতকের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। উপমহাদেশ সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত মেঘের নিচে ধর্ম-বিবাদ, হিংসা আর মৃত্যু নিয়ে মত্ত থাক এই ইচ্ছে কার? বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ এদেশে চার ভাবে সংঘটিত হয়েছিল। প্রথমত, রাজনৈতিক প্রতিবাদ ১৫ আগস্ট জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদে ঢাকার বাইরে মানুষ পথে নামতে শুরু করেছিল। দ্বিতীয়ত, সশস্ত্র প্রতিবাদ, মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের সাথে এদেশের সাধারণ মানুষ মুশতাক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেছিল। তৃতীয়ত, মেধা ও সৃজনশীলতার মাধ্যমে প্রতিবাদ আর সবশেষ মানুষের ব্যক্তিগত মৌন প্রতিবাদ। এসব প্রতিবাদ প্রতিরোধ করার জন্য জেনারেল জিয়া সামরিক বাহিনী ব্যবহার করেছিলেন। প্রথম পর্বের প্রতিবাদের পরিসর সামরিক নিপীড়নের কারণেই সংক্ষিপ্ত হয়েছিল। কিন্তু এর তাৎপর্য ছিল গভীর। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে বাংলাদেশের মানুষ ব্যথিত হয়নি বলে একটি ধারণা দেশে এবং বিদেশে প্রচার করার অপচেষ্টা করেছিল মুশতাক এবং জিয়ার সরকার। এসব প্রতিবাদের ইতিহাস তা মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল। একইভাবে বঙ্গবন্ধু সত্তার সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রসত্তার সংশ্লেষণের ঐতিহাসিক তাৎপর্য মূল্যায়নে, মিথ্যা আর কুৎসার কুঞ্জটিকা থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাবপ্রতিমা প্রতিরক্ষায় বঙ্গবন্ধু পরিষদ সারা বাংলাদেশে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছে। বঙ্গবন্ধুর জন্ম, মৃত্যু স্মরণ আর তাঁর সংগ্রামী জীবনের মহাকাব্যিক ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা, বক্তৃতা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সামরিক জামানার রাজনৈতিক সংস্কৃতির সমান্তরালে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ, মূল্যবোধ ও উপযোগিতার প্রসঙ্গ বহমান রাখতে সক্ষম হয়েছিল। অকস্মাৎ বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ায় যারা মানসিক অসাড়তার শিকার হয়েছিলেন এবং যারা ভয় পেয়েছিলেন সেইসব গৃহগত শহরে নাগরিকরাও ক্রমাগত বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাথে নানাভাবে নিজেদের যুক্ত করতে শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে আমাদের সৃজনশীল মেধাবী মানুষেরা এদেশের আবহমান সাহস, এবং দীপ্ত দ্রোহের প্রতিনিধিত্ব করেছেন যে ঘাতক শুরু করেছিল খুনি চক্র তা তারা স্লোগানে, কবিতায়, প্রবন্ধে, ছড়ায়, গানে, নাটকে চূর্ণ করে দেন এবং তাদের সমন্বিত স্বর ক্রমাগত ব্যাপ্ত হতে থাকে। এগুলো ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্য বাঙালির চেতনার সত্য ও শুদ্ধ উচ্চারণ যা তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর অহমিকা, ঔদত্য আর বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানানোর স্বপ্ন বিভ্রমে আঘাত করে। তবে একথা সত্যি জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত এসব প্রতিবাদ রাজনীতির সংগঠিত শক্তি হিসেবে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। পিতৃহারা মাতৃহারা ভাই আর স্বজনহারা শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরলেন তখন তিনি এক অশ্রুর প্রতিমূর্তি। এতো বাইরের দেখা। ভেতরে তার আগুনের দীপ্তি। শোক, আর অন্যদেশে আত্মগোপনে থাকার ক্লান্তি ছিল। খুনিদের অপচ্ছায়া থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, পিতৃ হত্যার বিচার করতে হবে এসব প্রতিজ্ঞা ঢেউয়ের মতো বারবার তার কাছে এসেছে। এদেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, বঞ্চনা থেকে মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ এগিয়ে নিতে হবে, এরকম ইচ্ছের চাঞ্চলতাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। সাহস তার শরীরে প্রবাহিত রক্তের উত্তরাধিকার। এই সবটা মিলিয়েই শেখ হাসিনার তখনকার মনোগঠন, পরিণত দৃঢ়, প্রখর এবং সুদূর লক্ষ্যাভিসারি। বঙ্গবন্ধুর মতোই এদেশের আবহমান মনষত্বের এবং মানবিকতার মূল্যবোধ তার হৃদয় গঠনের উপাদান। এদেশের মাটির স্পর্শের মতো তার মমতা, সুজলা নদীর মতো মানুষের কাছ তার দায়বদ্ধতা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যাদের ভেতরে অসহায়ত্ব আর আত্মপরিচয়ের বিপন্নতাবোধ তৈরি হয়েছিল শেখ হাসিনাকে তারা নতুন আশ্রয় হিসেবে গ্রহণ করলেন। রাজনৈতিক জীবনের সেই ক্রান্তিকালে শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুতে নিবেদিত মানুষের সাথে তার শক্তির ভিত্তি খুঁজে পেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে তিনি বঙ্গবন্ধুর বিকল্প নন; বঙ্গবন্ধুর স¤প্রসারণ। ১৯৮৩ সাল থেকেই বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু সত্তা-বিশ্ব অনুসন্ধান, নির্মাণ ও পুনর্নির্ধাণের কাজ এগিয়ে নেয়ার শক্তি ও ডানা তিনিই। বহুকাল কাল আগে হিজরি পঞ্জিকার প্রথম শতাব্দীতে প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ইমাম-আল-সাদিক বলেছিলেন অশ্রু ছাড়া আর সবকিছুর মূল্য আছে। হয়তো চোখের জলের মূল্য অপরিমেয় বলেই তিনি কথাটি এভাবে বলেছেন। কারণ এ বাক্যের সাথেই তিনি যোগ করেছিলেন এক ফোঁটা চোখের জল একটা সমুদ্র জ্বালিয়ে দিতে পারে। শেখ হাসিনা একটি অশ্রু বিন্দু কিন্তু তার অর্ন্তদীপ্ত আগুনে ক্রমশ পুড়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের ষড়যন্ত্রের সমুদ্র। তিন. ‘আমার আবার জন্মদিন কী মৃত দিবসই বা কী? আমার জীবনই বা কী? আমার জনগণই আমার জীবন।’ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৫২তম জন্মদিনে বিদেশি সাংবাদিকের শুভেচ্ছার জবাবে তিনি এই কথাগুলো বলেছিলেন। জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে এই নিরাসক্তি যেন এক শূন্য-সাধক বৌদ্ধ তান্ত্রিকের। তন্ত্র বাঙালির চৈতন্য-চর্চার নিজস্ব ফসল। শুধু তন্ত্র কেন বাঙালির সব চিন্তা তরঙ্গ বঙ্গবন্ধুর ভেতরে এসে মিলেছিল। বঙ্গবন্ধু কী জানতেন তার সত্তার অমরত্বের কথা। মৃত্যুর ব্যাপারে তিনি আমৃত্য নির্ভীক ছিলেন। দেশের জনগণ তো এক অবিরাম প্রবাহ। জনপ্রবাহের ভেতর দিয়ে তার জীবনের অনন্ত যাত্রা। তার জীবনের অবিনশ্বরতার এই ব্যাখ্যা ইতিহাসে সত্য হয়েছে। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশের ইতিহাসে কৃষ্ণ বিবর (Black hole) তৈরি করতে চেয়েছিল ঘাতক চক্র। কৃষ্ণ বিবর মহাবিশ্বের একটি বিন্দু। এর মহাকর্ষীয় শক্তি এত প্রবল যে তার ভেতর থেকে কোনো কিছুই বাইরে আসতে পারে না; এমনকি তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণও। কৃষ্ণ বিবরের ঘটনা-দিগন্ত হচ্ছে প্রত্যাবর্তনের শেষ বিন্দু। নক্ষত্র খেকো এই কৃষ্ণ বিবরের স্পর্ধা হতে পারতো ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুর সত্তা বিশ্বকে গিলে ফেলেছিল; এর খুনি-দিগন্তে ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধু অস্তিত্বের একটি একটি অংশ ছুড়ে দিতে শুরু করেছিল। ঘাতক চক্র সময়ের গতিকে ভেবে নিয়েছিল বড় বেশি একরৈখিক। সময়কে বিপরীতমুখীভাবে ছুটিয়ে ছিল কৃষ্ণ বিবর শ্বেত বিবরে পরিণতি পায়। বিষয়টি উপপ্রমেয়মূলক বা প্রমাণ সাপেক্ষ। কৃষ্ণ বিবর যেমন সবকিছুকে গিলে নেয়, শ্বেত বিবর তেমন সবকিছুকে উদগীরণ করে। মহাকাশ বিজ্ঞানের এই তত্ত্ব অথবা তত্ত্ব-সম্ভাবনাকে সমাজ বিজ্ঞানের স্থাপন করে ১৫ আগস্টের রূপান্তরকে ব্যাখ্যা করা যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কৌশল ও নেতৃত্ব এদেশের কোটি মানুষের বঙ্গবন্ধু সাধনার সাথে মিলে সামাজিক সময়ের অভিগমনের মুখ বদলে দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর যা কিছু গিলে খেয়েছিল তার সব হাহারবে বেরিয়ে আনতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে ১৯৭৫-এর অক্টোবরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দেয়াল লিখনে ঘোষণা করেছিল এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে। ১৯৭৬ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলার ডাক পত্রিকা বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছিল। এই সংখ্যার একটি নিবন্ধে ১৫ আগস্টকে বঙ্গবন্ধুর নতুন জন্মদিন বলে চিহ্নিত করা হয়। মৃত্যুর মাতৃগর্ভ থেকে ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুর নতুন জন্ম, এই যে দেখার নেত্র লেন্সটা বদলে গেল তাতে বঙ্গবন্ধু সত্তা বিশ্বকে নতুনভাবে অনুসন্ধান করার পথ উন্মুক্ত হলো। বাঙালির বহু অভ্যুদয় ও উদ্ভাসনের ভেতরে আমরা বঙ্গবন্ধুকে অবলোকন করলাম। গীত গোবিন্দের দশবতারে যেমন পরমপুরুষের বিবর্তন চক্র দেখানো হয়েছে এই প্রবন্ধে একই ভাবে বলা হয়েছে যুগে যুগে বঙ্গবন্ধু অভ্যুদয় ঘটেছে। কখনো তিনি ঈশা খাঁ কখনো তিনি সিরাজ-উদ-দৌলা কখনো বা তিতুমির। তিসি সূর্যসেন তিনি ক্ষুদিরাম। এই তালিকা থেকে অনিবার্য একটি নাম বাদ দেয়া যাবে না তিনি অগ্নিপুরুষ সুভাষ বোস। শুধু এটুকু নয় গত ৩৫ বছরের সৃজনশীল মাধ্যমের প্রতিটি শাখায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান আর সমাজতান্ত্রিক গবেষণায় বঙ্গবন্ধুকে অসংখ্য অভিধায়, প্রতীকে, বৈশিষ্ট্য ও ব্যক্তিত্বে ব্যক্ত হতে, দেখা গেছে। না পুনরাবৃত্তির ভিড়ে এসব পরিচয় ক্লিন্ন হয়ে ওঠেনি। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বিদেশের পর্যবেক্ষক গবেষক, সাংবাদিকরাও বঙ্গবন্ধু সত্তার নানা উজ্জ্বলতা নানা বিশেষণে বর্ণনা করেছেন। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর ঘোরবিরোধীরাও নতুন নতুন প্রতীকে বঙ্গবন্ধুর পুনর্জাগরণ, বহুকরণ ও ব্যাপ্তকরণ প্রক্রিয়ায় কোনো বাধা তৈরি করেনি। বঙ্গবন্ধুর সত্তার, সৌর্য ও সত্যের কাছে এটি তাদের আরেকটি পরাজয়। নতুন প্রতীকে বঙ্গবন্ধুর এই যে বহু জন্ম, কিংবা নতুন কালে এসেও প্রাসঙ্গিক চরিত্র এবং কণ্ঠ হিসাবে এই যে অভিগমন তার সমাজতত্ত্ব কী? এ প্রশ্নের উত্তর সংক্ষেপে বলাই মুশকিল। বহু স্তরিত উপনিবেশের নিচে চাপাপড়া বাঙালির স্বাধীনতা আর শোষণ মুক্তির যে মৌলিক এবং ক্রমপুঞ্জিত আকাক্সক্ষা, দুবেলা মোটাভাত আর মোটা কাপড়ের তৃষ্ণা তা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। একটি স্বাধীন ভূখণ্ড আর সংবিধান তার সংগ্রামের ফল। দ্বিতীয়ত. এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী সব নেতার অন্তর্গত বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ বঙ্গবন্ধুর মননে, চরিত্রে বিভাষিত। তৃতীয়ত. তার সাহস, চারিত্র্যিক দৃঢ়তা, সততা আর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা তাকে মুক্তিমুখী জনতার আশ্রয় হিসেবে প্রতিপন্ন করে। চতুর্থ. দেশ, তার ভাব সম্পদ এবং দেশের মানুষের প্রতি তার অগাধ ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা মানুষের কাছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নহীন রেখেছে। দেশ ও মানুষের মঙ্গলের জন্য তিনি প্রাণ দিতে পারেন একথা কেউ অস্বীকার করেনি। পঞ্চমত. যে কোনো পরিসরে তিনি আদর্শ ভূমিকাটি পালন করার চেষ্টা করেছেন। মানুষের প্রতি তার আন্তরিকতা এবং সংবেদনশীলতা, দয়া ও উদারতা মানুষের গুণ ও প্রজ্ঞাকে সম্মান করা তার চরিত্রকে অনুকরণীয় করে তুলেছে। বস্তুত দেশ ও সময়ের সাথে তার আন্তক্রিয়ার ফলে যে ইতিহাস তৈরি হয়েছে তাঁর অর্থময়তা তাঁর ভাবপ্রতিমার সঙ্গে যুক্ত হয়ে এগুলোকে অর্থময় করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধুর এই যে নতুন জন্ম পুনর্জাগরণ কিংবা বহুকরণের খসড়া চিত্র উপস্থাপন করা হলো সেগুলোকে কী জীবিত বঙ্গবন্ধুর সকল কাজ করতে সক্ষম? উত্তর না তার নতুন জন্ম কিংবা পুনর্জাগরণের প্রার্থনা কোনো কবিতায়, কোনো গানে কোনো প্রবন্ধে উচ্চারিত হতো না। শুধু যে রাজনৈতিক উপযোগিতার চিন্তা করেই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে খুঁজতে হবে ব্যাপারটি এমন নয়। এভাবে অনুসন্ধান বঙ্গবন্ধুকে খণ্ডিতভাবে কাজে লাগানোর প্রলোভন বাড়াবে। তার মানে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে কেবল রাজনৈতিক বুঝাই যথেষ্ট নয়। সমাজতান্ত্রিকভাবেও ১৫ আগস্টকে বোঝা জরুরি হয়ে উঠেছে। চার : বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতিকে হত্যা করার দুরভিসন্ধি- তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতির জনকের রক্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভিন্ন ইতিহাস লিখতে চেয়েছিল খুনিচক্র। সংবিধান থেকে রাষ্ট্রের চার মৌলনীতির অপসারণ, ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম সরিয়ে রাখা, বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ককে ‘খলনায়ক’ হিসেবে বর্ণনা- ১৫ আগস্ট সম্পর্কে খুনিদের নিজস্ব ডিসকোর্স গড়ে তোলার অপচেষ্টা। পাঠ্যবই, ইতিহাস, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় যোগাযোগের কোনো কোনো প্রকরণ ব্যবহার করে জাতির পুঞ্জিত স্মৃতি (collective memory) তে খুনিরা তাদের রাষ্ট্র-স্বপ্নের অনুক‚লে ১৫ আগস্টের অর্থের দিক মাত্রা তৈরি করতে চেয়েছে। কিন্তু ১৫ আগস্টের এই অর্থের নির্বাধ ক্রমবিস্তার সম্ভব ছিল না; দিকবদল ছিল অনিবার্য। প্রধানত দুটো কারণে এক দেশপ্রেম, মানবিকতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় বঙ্গবন্ধুর সূর্য-দীপ্ত অস্তিত্ব যা মৃত্যুঞ্জয়ী। দুই. বাঙালির আবহমান শ্রেয় চেতনা আর ইতিহাসের জরুরি সন্ধিক্ষণে তার জাগরণের অভ্যাস। ১৫ আগস্টের বর্বরতা এবং শোক, বিলম্বিত হলেও ইতিহাসে অন্তরপ্রবাহী ও এই দুই সত্তা ও শক্তিকে একত্রিত করে। বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ এর মধ্য দিয়ে ৭২-এর সংবিধানের মতো ছেঁড়া-বিব্রত বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে জোড়া লাগতে থাকে। খুনিদের সাজিয়ে তোলা প্রতীক, মিথ, মিথ্যে স্মৃতির সরণি এবং ইতিহাস-আয়োজন ভেঙে পড়ে। জাতির মনস্তাত্তি¡ক সমতলে এটি বঙ্গবন্ধু আর মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় বিজয়। দেখা যাচ্ছে স্মরণ আয়োজন থেকে ১৫ আগস্ট ক্রমশ একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। ১৫ আগস্ট শোক দিবসের সাথে এদেশের মানুষের সংযুক্তির বিষয়টি স্থির কোনো প্যার্টানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সময়ের সাথে সাথে এই সংযুক্তির ধরন বিবর্তিত হচ্ছে। মানুষের যে সমস্ত আচরণ ও অনুশীলন এই দিনটিকে ঘিরে পর্যবেক্ষণ যোগ্য তাতে বোঝা যাচ্ছে এটি একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান সামাজিক মূল্যবোধের নির্যাস। পনেরো আগস্টকে ঘিরে এক বিশেষ রাজনৈতিক সংস্কৃতিরত বিকাশ ঘটেছে। যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে এবং সেই ঘৃণিত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করেছে তারা এই প্রতিষ্ঠানে এবং এর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অংশগ্রহণ করবে না। প্রতিষ্ঠান হিসাবে দিনটি বাংলাদেশের সমাজে একটি বিভাজক। কোন মহলের আপোষহীনতার চালচিত্র নিয়ে যতই কাহিনী তৈরি করা হোক না কেন নতুন প্রজন্মের স্মৃতি অঞ্চলে ১৫ আগস্ট নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটিতে ক্রমাগত তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পনেরো আগস্ট কেবল মাত্র সামাজিক প্রতিষ্ঠান নয় একটি স্মৃতি প্রতিষ্ঠানও (memory institution) বটে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহে স্মৃতি প্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে অতীত স্মৃতির সংরক্ষণ ও উজ্জীবন। স্মৃতি আখ্যান (narrative) সংগ্রহ, বাচাই এবং বুনন এসব প্রতিষ্ঠানের কাজ। আমরা লক্ষ করি ১৫ আগস্ট এদেশে স্মৃতি প্রতিষ্ঠান হিসেবেও কাজ করছে। স্মৃতির মধ্যে দুই রকমের শক্তি থাকে। এ দুটো শক্তি দ্বান্দ্বিকভাবে সংস্থিত। একটি শক্তি পুনরাবৃত্তির আরেকটি শক্তি যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার। পনেরো আগস্ট স্মৃতি প্রতিষ্ঠান আবার স্মৃতি আখ্যানও বটে। এই স্মৃতি আখ্যানের ভেতর দিয়ে ঘটনার অর্থ উৎপাদিত এবং পুনরুৎপাদিত হচ্ছে। বহু মাধ্যম বাহিত হয়ে সমাজের এই বর্গের মানুষের মাঝে এই আখ্যানে সহভাগিতা ঘটছে, তৈরি হচ্ছে যৌথ স্মৃতি। মুক্তিযোদ্ধের চেতনা আর বঙ্গবন্ধুর মূল্যবোধের আলোয় জনস্তরে আদর্শিক সংহতি তৈরি করার জন্য যৌথ চৈতন্য সহায়ক হতে পারে। এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয়ের প্রতি নজর দেয়া যেতে পারে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালি জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন হিসেবে অন্যদের সাথে কথা বলছে। এই দিনের নানা রকম অনুষঙ্গ, কালো ব্যাচ, পাঞ্জাবি, দেশাত্মাবোধক গান মুক্তিযোদ্ধের গান, অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, প্রবন্ধ পাঠ, আলোচনা এইগুলো এখন ১৫ আগস্টের নিজস্ব ভাষা। এভাবে দেখলে বলা যায় ১৫ আগস্ট সমাজের সাথে এক ধরনের সংলাপে অংশগ্রহণ করা বা ইন্টেরলকেটর (interlocutor)। পনেরো আগস্ট নিয়ে এক সময়ের প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া স্মৃতিযুদ্ধ শুরু করেছিলেন। দিনটিকে তিনি নিজের জন্মদিন ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য উপমহাদেশীয় স্মৃতি যুদ্ধ হিসেবেই ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার দিনটিকে বেছে নিয়েছিল। পনেরো আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতার উল্লাস উদযাপনের দিনে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে বন্ধুরাষ্ট্র ভারত বেশ কষ্ট পায় সেই উদ্দেশ্য এই নির্বাচন। পনেরো আগস্ট কোনো লাশ ঘর নয়; বঙ্গবন্ধুর চির প্রবহমান জীবনের একটি বিষন্ন বিন্দু। দিনটির ভেতরে প্রত্যেক বছর নতুন জন্মের অপক্ষোয় থাকেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। বাংলাদেশের ইতিহাসে গতিপথ নির্বাচনে তার কথাই চ‚ড়ান্ত, তাঁর হাত ধরে যদি বাংলাদেশ না হাঁটে, বাংলাদেশ বিপন্ন হবে।

পাঁচ: পনেরোই আগস্ট বাংলাদেশের বঙ্গবন্ধুর সত্তা-বিশ্বকে নিঃশেষে ধ্বংস করার পরিকল্পনা ছিল। এগুলো মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিজনকে হত্যা, তার প্রধান অনুসারীদের হত্যা, বাংলাদেশের ইতিহাসকে হত্যা, বাংলাদেশের সংবিধান ও রাষ্ট্র চরিত্র হত্যা ও বাকশাল উৎখাত। এসব হত্যার অভিঘাতে বাংলাদেশ কি হারিয়েছিল তা নির্ণয় করা জরুরি। সবচেয়ে বড় অভিঘাতটি হলো বঙ্গবন্ধুর শূন্যতা। এই শূন্যতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভেতরে চেপে বসল ধর্মান্ধ রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ। দেশের মানবিক মূল্যবোধ নৈতিকতা আর শ্রেয়বোধ বঙ্গবন্ধুর রক্তে ভেসে গেল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার মধ্য দিয়ে মনস্ততাত্তি¡ক সমতলে দেশটা দুভাবে বিভক্ত হলো। আবারো প্রকাশে এলো স্বাধীনতার পক্ষ আর বিপক্ষ শক্তির লড়াই। বাঙালির আত্মপ্রতিষ্ঠার আর অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম ব্যাহত হলো। শুধু তাই নয়, এসব প্রতিষ্ঠানের, গোটা চরিত্রেই বদলে গেল। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর চিন্তায় মানুষ, রাষ্ট্রকাঠামো এবং মানুষের সাথে রাষ্ট্রের সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে স্থান পেয়েছে। তিনি তার ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবে এই তিনের কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। প্রতিনিধিত্বশীল শোষণমূলক গণতন্ত্রের বিপরীতে তার দ্বিতীয় বিপ্লবের কাঠামোগত রূপরেখা মুক্তিদায়ী গণতন্ত্রের মডেল হতে পারত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এসব সম্ভাবনাকে গলাটিপে দেয়া হলো। মানুষ হওয়ার পরিবর্তে ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত হবার প্রতিযোগিতা বেড়ে গেল। গ্রামে নগরে যেখানে শুরু হতে যাচ্ছিল সত্যিকারের আত্মনির্ভরশীল হওয়ার উন্নয়নযাত্রা সেখানে এনজিওদের ভিড় জমে উঠলো, রাষ্ট্রকাঠামো চলে গেল বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের নিয়ন্ত্রণে। পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর এদেশে মুক্তিযোদ্ধা আর সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের ওপর নির্যাতন নেমে আসে। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাদ যাওয়ায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রত্যয়টি সামাজিক ব্যবহারে আবার ফিরে আসে। নিরাপত্তার অভাবে বহু সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী পালাতে থাকে। এই পলায়ন গণতান্ত্রিক সংগ্রামের শক্তিকে দুর্বল করছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে জেনারেল জিয়া নিজের ভাবপ্রতিমাকে বঙ্গবন্ধুর প্রতিদ্ব›দ্বী করে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সত্যি বাংলাদেশের রাজনীতিকে কঠিন (difficult) করে গেছেন। চাপ ও প্রলোভন দিয়ে নীতিচ্যুত বাম রাজনীতিবিদদের তিনি তার দলে ভিড়িয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ’৭১এর ঘাতক দালালদের রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন। কর্নেল তাহেরসহ বহু দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দিয়েছিলেন। এভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধের অহংকার আদর্শ আর সম্ভাবনা শেষ হয়েছিল। স্বাধীন বিবেক আর উদার চিত্ত নিয়ে বাঙালির বিকাশিত হবার পর সংকুচিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস। এককথায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ ছিনতাই করা হয়েছিল। ১৫ আগস্টের অনেক কাজ আমরা আলোচনার মধ্যকোনে খুঁজে পেয়েছি। এগুলোর সম্মিলিত সক্রিয়তার ফলে রাষ্ট্রে, সমাজে অর্থনীতি ও সংস্কৃতিতে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও স্বরের ছায়া পড়তে শুরু করেছে। বঙ্গবন্ধু আয়নায় বাংলাদেশ তার সম্পূর্ণ মুখ দেখার স্তরে এখনো পৌঁছায়নি। এক্ষেত্রে সহায়তা, বন্ধুত্ব ও আনুগত্যের ছন্দাবরনে কাজ করে যাচ্ছে পুরনো শত্রুরা। দেশের সামাজিক শিক্ষা আর সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মৌলবাদীদের চাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমলারা নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছে দেশের সকল রকম নীতিকাঠামো। রাষ্ট্রের ভেতরে এইসব চাপ বঙ্গবন্ধুর জন্য পরিসর ছোট করে দিতে পারে। তবে জাতির আশা এবং ভরসার স্থল দুটি, বঙ্গবন্ধু ছোট হতে জানেন না আর জননেত্রী শেখ হাসিনা তার প্রতিজ্ঞতা থেকে সরে আসেন না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App