×

সারাদেশ

হাওর ও সীমান্ত এলাকায় কাজের জন্য হাহাকার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২০, ০১:০২ পিএম

হাওর ও সীমান্ত এলাকায় কাজের জন্য হাহাকার

যাদুকাটা নদী

হাওর ও সীমান্ত এলাকায় কাজের জন্য হাহাকার

খেটে খাওয়া কিশোরীরা

হাওর ও সীমান্ত এলাকায় কাজের জন্য হাহাকার

বালু-পাথর উত্তোলনে জীবন চলে তাদের।

‘মৎস্য বালি, পাথর, ধান সুনামগঞ্জের প্রাণ’ এ কথাটি যুগ যুগ ধরে চলে এলেও এখন আর বাস্তবে এটি নেই বললেই চলে। গত কয়েক বছর ধরে হাওরে কিছুটা ধান আবাদ হলেও আগের মতো আবাদ এখন আর হয় না।

অতি বৃষ্টি, অকাল বন্যা, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বছরের পর বছর ফসলহানী হওয়ায় অনেক কৃষক এখন আর আগের মতো চাষাবাদ করেন না। কোন রকমে বছরের খোরাকির ফসল ফলান। তাও উপর আল্লাহর উপর নির্ভর করে। ভাগ্য ভাল হলে কোন রকম দুর্যোগ দেখা না দিলে ফসল গোলায় তোলা হয়। আর না হয় কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় নেই।

এই যখন হাওরবাসীর অবস্থা তখন বিকল্প কর্মসংস্থান হিসেবে বালি পাথর উত্তোলন কিংবা ভারত থেকে আমদানী করা কয়লা চুনা পাথর লোড আনলোড করা হাওরবাসীর কর্মসংস্থানের একটি নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে কয়লা চুনা পাথর আমদানী বন্ধ রয়েছে বললেই চলে। বছরে দুতিন মাস আমদানী হলেও বাকি নয় মাসই চলে অনাহারে অর্থাহারে।

এছাড়া তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত নদী যাদুকাটায় প্রতিদিন বালি পাথর উত্তোলন করতো প্রায় ২০ হাজার শ্রমজীবী মানুষ। আর এই পেশার সাথে নৌমালিক, নৌশ্রমিক, বালি পাথর ব্যবসায়ী মিলে লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মাধ্যম ছিল।

কিন্তু গত দুই বছর ধরে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বেলার করা একটি রিটের কারণে উচ্চ আদালত যাদুকাটা নদীতে বালি পাথর উত্তোলন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করায় এই পেশার সাথে জড়িত লক্ষাধিক লোক খেয়ে না খেয়ে অনাহারে অর্থাহারে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যারা ব্যবসায়ী তারা অনত্র গিয়ে ব্যবসা করছেন কিংবা অন কোন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন।

কিন্তু এই পেশার সাথে জড়িত বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ তিন উপজেলার প্রায় ২০ হাজার শ্রমিক পরেছেন বিপাকে। অনেক ব্যবসায়ী আজ ব্যবসা হারিয়ে পথে বসেছেন। এই অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে খেটে খাওয়া মানুষের দাবি তারা কোন রকমের যন্ত্র ছাড়া হাত দিয়ে নদীর মাঝ থেকে যেন বালি পাথর উত্তোলন করতে পারেন। না হয় পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে মরা ছাড়া তাদের আর কোন উপায় নেই।

যাদুকাটা নদীর বালি পাথর উত্তোলনকারী শ্রমিক ৫ সন্তানের জননী মাজেদা বেগমসহ অনেকেই এ প্রতিবেদককে বলেন, গত প্রায় ১ বছর ধরে নদীতে বালি পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকায় আমরা কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে অনাহারে অর্থাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছি যেন দেখার কেউ নেই। অথচ ভোটের সময় এলে নেতাদের কথার কোন শেষ নেই যেন সবকিছু দিয়ে দিবে।

[caption id="attachment_236791" align="aligncenter" width="2560"] খেটে খাওয়া কিশোরীরা[/caption]

অপরদিকে উপজেলার তিন শুল্ক ষ্টেশন বড়ছড়া, চারাগা, বাগলী (বীরেন্দ্রনগর) রয়েছে প্রায় ৬ মাস ধরে বন্ধ। এখানেও কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ২০ হাজার খেটে খাওয়া মানুষ।

কিন্তু স্টেশন তিনটি বন্ধ থাকায় খেটে খাওয়া মানুষ পড়ছে বিপাকে। এছাড়াও কয়েকদফা বন্যায় হাওরপাড়ের শ্রমজীবী মানুষের যেন দুর্ভোগের শেষ নেই। প্রাণঘাতী করোনা মহামারীসহ একের পর এক দুর্যোগ, সবকিছু মিলে হাওর জনপদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন মান আজ বিপন্ন প্রায়। তবে এতো দুর্যোগের পরেও সীমান্ত এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠী একটু আশার আলো দেখেছিল। পাহাড়ী ঢলে ভারতের ওপার থেকে পানির সাথে ভেসে আসা কয়লা পাথর কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহের স্বপ্ন দেখছিল তারা।

তাহিরপুর উপজেলার সীমান্ত নদী যাদুকাটা, চাঁনপুর নয়াছড়া, বুরুঙ্গাছড়া, রজনীলাইন, লাকমা, লালঘাট, চারাগাও, বাগলী ছড়া দিয়ে পাহাড়ী ঢলের সাথে কয়লা পাথর ভেসে আসায় তারা নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছিল।

প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভিজে রোদে পুড়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে কয়লা পাথর স্তুপ করে রেখেছিল কয়েকমাসে। ভেবেছিল পানি আসলে এগুলি বিক্রি করে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবে তারা। কিন্তু তাতেও বাঁধ সাধেন সীমান্তরক্ষী বিজিবিসহ স্থানীয় প্রশাসন।

গেল মাসে হঠাৎ করে খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এসব কয়লা ও পাথর নিলামের বিজ্ঞপ্তি জারি করে। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবী উপেক্ষা করে নিলামের আয়োজন করে তাহিরপুর উপজেলা প্রশাসন। কার মাল কোথা থেকে আসলো কোন কিছু না বুঝেই তারা নিলামের আয়োজন করে।

[caption id="attachment_236792" align="alignnone" width="2560"] বালু-পাথর উত্তোলনে জীবন চলে তাদের।[/caption]

পরে জেলা প্রশাসকের হস্তক্ষেপে নিলাম কার্যক্রম বন্ধ হয়। যারা দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে এসব বালি, কয়লা ও পাথর উত্তোলন করেছে তাদেরকে কোন প্রকার শ্রমের মূল্য না দিয়ে একটি পাথরখেকো চক্র চেয়েছিল তারা এগুলি নিলামে কমদামে কিনে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে আঙ্গুল ফুলে রাতারাতি কলা গাছ বনে যাবে।

বড়ছড়া শুল্ক ষ্টেশন এলাকার ৪সন্তানের জননী বিধাব খুদেজাবানু অনেকটা ক্ষুব্দ হয়ে এ প্রতিবেদককে বলেন, জীবন বাজি রেখে এসব বালি পাথর ও কয়লা উত্তোলন করেছি। এখন প্রশাসনের ভয়ে কেউ এগুলি কিনছে না। আপনার হয় এসব বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দিয়ে ছেলে মেয়ে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে যান। না হয় বিষ কিনে দিয়ে যান পরিবারের সবাইকে নিয়ে বিষ খেয়ে মরে যাবো। তবুও নাখেয়ে থাকার কষ্ট থেকে মুক্তি পাবো। শুধু খুদেজা আর মাজেদাই নয় নদীতীর ও সীমান্তবর্তী গ্রামগুলির খেটে খাওয়া হাজারো মানুষের কথা একটাই তারা কাজ করে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে চায়।

প্রসঙ্গত, গত ২৬ জুলাই তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ্মাসন সিংহ আন্তর্জাতিক সীমানা রেখার এই বালুপাথর অপসারণের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সেগুলো উন্মুক্ত নিলামের জন্য নোটিশ জারি করেন।

জানা গেছে, গত ৮ জুন খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন বালু-পাথর মহাল ইজারা, খাশ কালেকশন প্রদান বন্ধসহ পাথর কোয়ারিতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এর প্রেক্ষিতে তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পদ্মাসন সিংহ আন্তর্জাতিক সীমানারেখার বালু-পাথরকে স্তুপিকৃত পাথর দেখিয়ে সেগুলো উন্মুক্ত নিলামদানের অনুমতির জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বরাবরে পত্র প্রেরণ করেন। এই পত্রের আলোকে জেলা প্রশাসক অনুমতি না দিয়ে বিভাগীয় কমিশনারের পরামর্শে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোকে যাছাইপূর্বব ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পত্র দেন। গত ২২ জুলাই চিঠি দেবার একদিনের মধ্যেই খনিজসম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর মহাপরিচালক উন্মুক্ত নিলামে এগুলো বিক্রির জন্য তাদের দুইজন প্রতিনিধির নাম উল্লেখ করে চিঠি দেন।

উপজেলা প্রশাসনের দায়সারা হিসেবে ২১ লাখ’ ৯৬ হাজার’ ৫৮৪ ঘনফুট বালু, ২৬ হাজার’ ২৫০ ঘনফুট’ পাথর এবং ১ হাজার ২২১ ঘনফুট চুনাপাথর রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। এগুলো স্থানীয় দিনমজুর ও শ্রমিকরা সংগ্রহ করে জড়ো করে রেখেছেন।

তড়িগড়ি করে আন্তর্জাতিক সীমানা রেখার সম্পত্তি নিলামের বিষয়টি খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের নজরে আনা হলে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে সংশ্লিষ্টদের নিলাম স্থগিত করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনা পেয়ে নিলাম স্থগিত করা হয় বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে এই কাজগুলো দ্রুততার সঙ্গে করিয়ে নেয় স্থানীয় একটি বালু ও পাথর খেকো সিন্ডিকেট।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App