×

জাতীয়

আমি মাইরা দিছি স্যার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ আগস্ট ২০২০, ০৯:৩০ এএম

টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের শামলাপুর চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার ঘটনার একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী রয়েছে। তারা একে একে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীর তালিকায় ঘটনাস্থল ঘেঁষা মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনসহ লামারবাজার গ্রামের একাধিক ব্যক্তি রয়েছেন। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ। একজন প্রত্যক্ষদর্শী ওই গ্রামের রুহুল আমীন জানিয়েছেন, সিনহাকে খুব কাছ থেকে গুলি করে ইন্সপেক্টর লিয়াকত মোবাইল ফোনে অপরপ্রান্তে একজনকে বলেন ‘আমি মাইরা দিছি। তিনটা মারছি স্যার। বায়তুর নূর জামে মসজিদের ইমাম জানান, খুব কাছ থেকে সিনহাকে গুলি করার ১৫-২০ মিনিট পরই ওসি প্রদীপ সেখানে পৌঁছেন।

ঘটনাস্থল ঘেঁষা রাস্তার একেবারে পূর্বপাশে বায়তুর নূর জামে মসজিদ ও রাহমানিয়া তালিমুল কুরআন নুরানী মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানা। এলাকার নাম লামারবাজার। ওই মসজিদের ইমাম হাফেজ শহিদুল ইসলাম ও মোয়াজ্জিন হাফেজ আমির হোসেন। তারা ঘটনার সবচেয়ে কাছের প্রত্যক্ষদর্শী। ঈদের দুদিন পর থেকে আমির হোসেনের খোঁজ নেই। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ইমাম শহিদুল ইসলামের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তিনি ঘটনার বর্ণনা করে বলেন, ওই রাতে এশার নামাজের পর হেফজখানায় রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। মোয়াজ্জেম মাদ্রাসার কয়েকজন ছাত্র নিয়ে মসজিদের ছাদে উঠেন শামলাপুর কেন্দ্রীয় মসজিদের মাইকে পরদিন ঈদ জামাতের সময়সূচি শোনার জন্য।

রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টার দিকে হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে ইমাম দৌড়ে একতলা মসজিদের ছাদে ওঠেন। তিনি দেখতে পান একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কার থেকে দুহাত উঁচু করে ড্রাইভিং সিট থেকে অনেকটা হাঁটু গেরে একজন নামছেন। এরমধ্যে গেঞ্জি পরিহিত একজন (ইন্সপেক্টর লিয়াকত) খুব কাছ থেকে পরপর তিনটি গুলি করেন। চুল বড় আরো একজনকে (সিফাত) ওই গাড়ির পিছনে দুহাত উঁচু করে দাঁড়ানো দেখা যায়। লামারবাজারের একটি দোকানের বাঁশে বাঁধা নাইলনের রশি নিয়ে যান এক পুলিশ সদস্য। গুলিবিদ্ধ লোকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়লে চুল বড় যুবককে গাড়ির সামনে এসে পিঠমোড়া করে নাইলনের রশি দিয়ে দুহাত বাঁধা হয়। এরপর সিফাতকে মাটিতে চেপে ধরে অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে (শালার পুত) কেন সেখানে গিয়েছে জানতে চান লিয়াকত।

[caption id="attachment_235255" align="alignright" width="300"] নিহত অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান।[/caption]

ইমাম শহিদুল ইসলাম বলেন, গুলি করার আগেই লিয়াকত নিশ্চিত হন সিনহা মো. রাশেদের পরিচয়। এরমধ্যে সিনহাকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তার পূর্বপাশে নেয়া হয়। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে সাদা রঙের নোহা মাইক্রোবাসে সেখানে পৌঁছেন টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ বেশ কয়েকজন পুলিশ। তখন সেখানে লোকজন জড়ো হতে থাকলেও পুলিশ প্রথমে তাদের কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। পরে লিয়াকত বলেন, সবাই দেখুক, পাবলিক দেখুক তবে কেউ যাতে ছবি না তোলে ভিডিও না করে।

এরমধ্যে প্রদীপ পুলিশ সুপারকে (এসপি) ফোন করে বিষয়টি জানান। বেশ কয়েকবার প্রদীপের সঙ্গে এসপির কথা হয় প্রকাশ্যে। রাস্তার পাশে পড়ে থাকা সিনহার দেহে প্রদীপ লাথি মেরে উল্টেপাল্টে চেহারা দেখেন। এর প্রায় আধঘণ্টারও বেশি সময় পরে একটি মিনি ট্রাকে (স্থানীয় ভাষায় ছারপোকা) সিনহার দেহ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে তোলা হয়। ঘটনাস্থলে রক্তের ছোপ ছোপ চিহ্ন রয়ে যায়। ওই পথে চলা গাড়িগুলো বিকল্প পথে চলতে বলা হয়। এরমধ্যে সিফাতকে পানি পান করানোর পর অন্যত্র নেয়া হয়। শহিদুল ইসলাম জানান, মারিশবনিয়া যে পাহাড়ে শুটিং করে সিনহা ফিরছিলেন সেখান থেকে চেকপোস্টের দূরত্ব কমপক্ষে ১০-১২ কিলোমিটার দক্ষিণে। আর হিমছড়ি ৩৫ কিলোমিটার উত্তরে নীলিমা রিসোর্ট। সেখানে যাওয়ার পথে তাকে গুলি করা হয়।

ঘটনার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী লামারবাজারের বাসিন্দা নূরুল আমীন। তিনি ঈদের দিন ইমামকে তার বাড়িতে খাওয়ার দাওয়াত দিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে পান দোকান থেকে পান কিনে মুখে দেন। এরপর একটি গুলির শব্দ শুনে দ্রুত মূল রাস্তায় ওঠেন (চেকপোস্ট এলাকাটি চৌরাস্তার পাশে)। নূরুল আমীন জানান, ইন্সপেক্টর লিয়াকত এক ব্যক্তিকে পরপর তিনটি গুলি করে একজনকে ফোন করে জানান, ‘স্যার ওনার কাছে অস্ত্র আছে। আমাকে গুলি করতে চেয়েছিলেন। আমি মাইরা দিছি, তিনটা মারছি স্যার’। এরমধ্যে প্রাইভেটকারের পিছন থেকে পিঠমোড়া করে হাত বেঁধে একজনকে গাড়ির সামনে আনার পর বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে ফোন করে লিয়াকত সব পুলিশ সদস্যকে সেখানে ডাকেন। ওপাশ থেকে কিছু বলায় লিয়াকত মুখ খারাপ করে গালি দিয়ে দ্রুত সেখানে আসতে বলেন। নূরুল আমীনের দাবি, এরমধ্যেই সেখানকার একজন পুলিশ সদস্য অপরপ্রান্তে কাউকে ফোন করে জানান, উনি হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত মেজর বলার পরও মেরে দিছে- আমি আপনার নলেজে দিলাম।

স্থানীয়দের মতে, সকাল থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত লামারবাজার জমজমাট থাকে। ঈদের আগের রাত হওয়ায় একটু আগে সবাই ঘরমুখো হন। চেকপোস্টের পূর্বপাশে বাজারে ঢুকতে প্রথমে আবুল কালামের রেস্টুরেন্ট-কাম টি স্টল। বিপরীত পাশে হাফেজ আহমেদের মাছের আড়ত। ওই রাতে ঘটনার সময় সেসব বন্ধ ছিল। রাস্তার পশ্চিমপাশে শামলাপুর জেলেনৌকার ঘাট। জেলেরা ছিলেন মাছ নিয়ে ব্যস্ত। গুলির শব্দে তারা সেখানে ছুটে আসলেও অনেক সময় মূল সড়কে উঠতে দেয়নি পুলিশ। এরমধ্যে প্রদীপ ও সিনহা মোবাইল ফোনে অবিরত পদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন।

প্রসঙ্গত, ৩১ জুলাই রাতে শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান। এ ঘটনায় শিপ্রা ও সিফাতকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। পুরো ঘটনার রহস্য উদঘাটনে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজ করছে। সিনহার বড় বোনের দায়েরকৃত হত্যা মামলার তদন্ত করছে র‌্যাব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App