×

জাতীয়

‘ম্যানেজ’ মাস্টার ওসি প্রদীপ দাশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২০, ১১:৩৪ এএম

বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বেশি আলোচিত-সমালোচিত নাম ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। চাকরি জীবনের ২৪ বছরে অঢেল সম্পদ গড়েছেন তিনি। কর্মজীবনে দোর্দ- প্রতাপ দেখিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায় করে শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে নামে বেনামে তার রয়েছে একাধিক বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট। জমি দখল, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি-নির্যাতন, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের কারিগর ছিলেন তিনি। বেশ কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে কয়েকবার সাময়িক বরখাস্ত, প্রত্যাহার, বদলিও করা হয়। তবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে তিনি বারবার পার পেয়েছেন। তিনি ছিলেন ‘ম্যানেজ মাস্টার’।

সম্প্রতি সাবেক সেনা কর্মকর্তা মেজর সিনহা হত্যাকা-ে অভিযুক্ত হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে আসছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা ও স্থানীয়রা জানান, আত্মীয়স্বজনের নামে কক্সবাজারের বিভিন্ন পয়েন্টে জমি কিনে বাড়ি করেছেন প্রদীপ। তার স্ত্রীর নামে চট্টগ্রাম মহানগরে ৬ তলা বাড়ি, প্লট, ফ্ল্যাট, একাধিক গাড়ি ও অন্যান্য সম্পদের তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। নগরীর পাথরঘাটায় দৃষ্টিনন্দন ৬ তলা বাড়ি, মুরাদপুরে কয়েক কোটি টাকা মূল্যের জমি রয়েছে তার। বিদেশেও তার বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি ও অর্থ রয়েছে। এরই মধ্যে তাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ প্রাথমিক অনুসন্ধান শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চট্টগ্রাম কার্যালয়।

১৯৯৫ সালে জোট সরকারের আমলে কক্সবাজারের শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদের ঘনিষ্ঠ কর্মী বলে পরিচিত প্রদীপ পুলিশে উপপরিদর্শক হিসেবে যোগ দেন। পরে পদোন্নতি পেয়ে হন ওসি। ওসি প্রদীপ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের আস্থাভাজন বনে যান প্রদীপ। ২০১৮ সালের মহেশখালী থানার ওসি থাকা অবস্থায় নিজেকে আওয়ামী লীগের মতাদর্শী প্রমাণে উপজেলা কমিটির সভায় নিয়মিত হাজির হতেন প্রদীপ।

বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় নেতাকর্মীরা ছিলেন বিব্রত। তবে ক্ষমতাধর প্রদীপের ভয়ে কেউ আপত্তি করেনি।

ঘুরেফিরে শুধু সিএমপি আর কক্সবাজার জেলায় পোস্টিং নিতেন প্রদীপ। সদ্য কারাগারে যাওয়া ওসি প্রদীপ কুমারের বিরুদ্ধে রয়েছে জমি দখল, ডাকাতের মতোই লুটপাট, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি-নির্যাতন, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, প্রথমে আতঙ্ক তৈরি করে পরে ইয়াবা কারবারি ও জলদস্যুদের সঙ্গে আঁতাত, ছোট ইয়াবা কারবারিদের নির্মূল করে বড় কারবারিদের সুযোগ দিয়েছেন তিনি। কিছু অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত, প্রত্যাহার, বদলিও করা হয়। এরপরও অদৃশ্য ইশারায় পেয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ থানায় ওসির দায়িত্ব।

চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানার ওসি থাকাকালে ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট সুপার রিফাইনারি লিমিটেডের একটি বৈধ তেলবাহী লরি আটকে সিআইপি পদমর্যাদার শিল্পপতি ওই প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আহমেদকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে টাকা আদায়ের চেষ্টা করেন তিনি। পরে সেলিম আহমেদ পুলিশ প্রধানের কাছে হয়রানির অভিযোগ করেন। তদন্ত কমিটির সুপারিশে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করে সিলেট রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। এর আগে ২০১২ সালে আদালতের অনুমতি ছাড়া বন্দরে আসা একটি বিদেশি জাহাজকে তেল সরবরাহে বাধা, বার্জ আটক এবং ১৮ দিন পর বার্জ মালিকসহ ১২ জনের নামে মামলা করেন ওসি প্রদীপ। এ ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তর ও ৩টি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে হয়রানি ও অনৈতিক সুবিধা আদায়ের প্রমাণ মিললে তাকে প্রত্যাহার করা হয়।

এরপর পাঁচলাইশ থানার ওসি হিসেবে বদলি হয়ে ব্যবসায়ীদের হয়রানি শুরু করেন প্রদীপ। ২০১৩ সালের ২৪ জানুয়ারি একটি মামলার রিমান্ড আবেদনের বিরোধিতা করায় লালদিঘিরপাড় থেকে এক আইনজীবীকে ধরে নিয়ে রাতভর থানায় আটকে নির্যাতন করেন তিনি। পরে ওই আইনজীবী ওসিসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম আইনজীবী সমিতির ওসি প্রদীপের পক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা পরিচালনা করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন অভিযোগের পর ২০১৩ সালের ২১ আগস্ট তাকে পাঁচলাইশ থানা থেকে প্রত্যাহার করা হয়। এছাড়া নগরীর কোতোয়ালি থানায় এসআই থাকাকালে প্রদীপ নগরীর পাথরঘাটার এক নারীর জমি দখল করেন। পরবর্তী সময়ে পাঁচলাইশ থানা এলাকায় নিজের বোনের জমিও দখল করেন তিনি। এসব অভিযোগ তদন্ত হলেও অদৃশ্য ইশারায় প্রদীপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর টেকনাফ থানায় ওসি হিসেবে প্রদীপ কুমার দাশ যোগ দেয়ার পরই কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়ক ‘ক্রসফায়ার’ রোডে পরিণত হয়। গত দুই বছরে শুধু মেরিন ড্রাইভেই শতাধিক লাশ ফেলেছেন প্রদীপ। শুধু টেকনাফেই গত ২২ মাসে প্রদীপের আমলে ১৪৪টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মারা গেছে ২০৪ জন। যাকে ক্রসফায়ার করা হতো, তাকে ক্রসফায়ারের আগে অন্তত ১০ থেকে ১২ দিন থানা হাজতে রাখা হতো। এই সময়ে আটক ব্যক্তির পরিবার পরিজনের কাছ থেকে ক্রসফায়ার না দেয়ার আশ্বাস দিয়ে লাখ লাখ টাকা এবং স্বর্ণালঙ্কার আদায় করতেন তিনি। এসব স্বর্ণালঙ্কার তিনি বিক্রি করতে তার সহযোগী সজল ধরের কাছে।

প্রদীপের বাড়ি চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের উত্তর কঞ্জুরী গ্রামে। গ্রামের বাড়িতে একতলা বিল্ডিং। সেখানে তার সৎভাইয়েরা থাকেন। গ্রামবাসী জানায়, প্রদীপের বাবা মৃত হরেন্দ্র লাল দাশ ছিলেন চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা প্রহরী। হরেন্দ্র লালের ৫ ছেলে ও ৬ মেয়ে। প্রদীপ কুমারের অন্য ২ ভাই দিলিপ ও সদীপ। বড় ভাই দিলিপ চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন। আরেক ভাই সদীপও চট্টগ্রাম মহানগরীর ডবলমুরিং থানায় পুলিশ পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত। আরেক ভাই প্রণব দাশ পুলিশে চাকরি না করেও এলাকায় পুলিশের দাপট দেখিয়ে চলে। প্রদীপের ২ সন্তানসহ স্ত্রী বাস করেন চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার এলাকার একটি বাসায়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App