×

জাতীয়

প্রদীপকাণ্ডে প্রশ্নবিদ্ধ পুলিশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২০, ০৯:২৩ এএম

অসৎ কর্মকর্তার অপকর্মে ম্লান বাহিনীর ইতিবাচক অর্জন

করোনাকালে জনসম্পৃক্ততা ও সেবার মাধ্যমে জনমনে আস্থার জায়গা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় দেশের পুলিশ বাহিনী। কিন্তু টেকনাফের প্রদীপকাণ্ডে ফের প্রশ্নের মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এই বাহিনীটি। পুলিশের বিরুদ্ধে লোকজনকে হয়রানি ও ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ পুরনো। তবে সরকার পুলিশের বেতন-ভাতা, রেশন সুবিধা বাড়ানোসহ পরিবহন ও আবাসন সংকট নিরসনে উদ্যোগ নিলে পুরনো বদনাম ঘুচিয়ে তারা ইতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হয়। বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারি করোনার মধ্যে পুলিশ যেভাবে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তাতে মানবিক পুলিশের ভূমিকা সর্বত্র প্রশংসা কুড়িয়েছে।

এর মধ্যে পুলিশের নিয়োগ ও বদলিতে অনেকটা স্বচ্ছতা এসেছে। বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ যোগদানের পর পুলিশকে আরো জনমুখী করতে গ্রামগঞ্জে বিট পুলিশিং চালুর উদ্যোগ নিয়ে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। কিন্তু পুলিশের সব ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ম্লান করে দিয়েছে টেকনাফের চেকপোস্টে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান ওরফে আদনানের হত্যাকাণ্ড। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও ফাঁড়ির আইসি লিয়াকত হোসেনের কর্মকাণ্ডে পুলিশের ভূমিকা এখন কাঠগড়ায়। তার অপকর্মের কারণে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক ও পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। মূলত তাদের প্রশ্রয়ে টেকনাফের ওসি ছিলেন বেপরোয়া। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী থানার ওসি হওয়ায় ‘মাদক ব্যবসায়ীদের ক্রসফায়ার’ দেয়ার নাটক সাজানোর নামে তিনি পেয়েছিলেন আলাদীনের চেরাগ। দুহাতে টাকা কামিয়ে পদস্থ কর্মকর্তাদেরও তিনি তুষ্ট করেছেন বলে চাউর রয়েছে। তারা প্রদীপের অপকীর্তি জেনেও ছিলেন নিশ্চুপ বরং অনেক সময় তার হয়ে সাফাই গেয়েছেন প্রকাশ্যে।

জানা গেছে, ওসি প্রদীপ ও ইন্সপেক্টর লিয়াকতের বিরুদ্ধে অভিযোগ পুরনো। পদস্থ কর্মকর্তারা তাদের অপকর্মের ব্যাপারে জ্ঞাত

হলেও রহস্যজনক কারণে নীরব থাকায় এ কাণ্ডে জড়িয়ে গেছে অনেক সুবিধাভোগী কর্মকর্তার নাম। কৌশলে ইয়াবা ব্যবসা, ব্যবসায়ীদের ছাড় দিয়ে ও ফাঁসিয়ে মাসে কোটি কোটি টাকা হাতানোর অভিযোগ এখন অনেকের বিরুদ্ধে। পুলিশে চলমান শুদ্ধি অভিযানের মধ্যেও এই অঞ্চল ছিল দৃষ্টির বাইরে। বিশেষ করে ‘মাদক কারবারিদের আত্মসমর্পণকে’ নাটক হিসেবে দেখছেন স্থানীয়রা। এর মধ্যদিয়ে স্থানীয় পুলিশ পদস্থদের কাছ থেকে ‘ক্রসফায়ারের ব্ল্যাঙ্ক চেক’ নিয়ে দেদার অপকর্ম করেছে বলে একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর টেকনাফ থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে প্রদীপ কুমার দাশের যোগদানের পর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক আতঙ্কের জোনে পরিণত হয়। ২ বছরে এই সড়কে ‘ক্রসফায়ারে’ শতাধিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। মাদক নির্মূলের নামে ‘ক্রসফায়ারে’ মানুষ হত্যা করা ছিল ওই এলাকার নিত্যদিনের ঘটনা। ২২ মাসে টেকনাফে ১৪৪টি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২০৪ জন মারা গেছেন। তাদের অর্ধেকের বেশি লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভে। যারা মারা গেছেন তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। যাকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হতো ১০-১২ দিন তাকে থানা হাজতে রাখা হতো। আবার মাসের পর মাস থানা হাজতে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। এই সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেয়ার আশ্বাসে ওই ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে আদায় করা হতো লাখ লাখ টাকা। তবে শেষরক্ষা হয়নি অনেকের।

টেকনাফের গুদারবিল এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু ছৈয়দ এবং সাবরাংয়ের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আছারবনিয়ার ইউপি সদস্য শরিফ প্রকাশ শরিফ বলি ছিলেন প্রদীপের অপকর্মের সহযোগী। প্রদীপের টাকায় মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে গরু এনে টেকনাফ হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করা হতো। ভাগের টাকা চট্টগ্রামে বুঝে নিতেন প্রদীপের লোকজন। অধিকাংশ ‘ক্রসফায়ারের’ চাঁদাবাজির টাকাও এই দুই মেম্বারের হাতে যেত। অন্য টাকা নিতেন প্রদীপের বডিগার্ড কনস্টেবল সাগর। ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে আটক ব্যক্তির পরিবার থেকে লুটে নেয়া হতো স্বর্ণালঙ্কার। তা বিক্রি করা হতো চট্টগ্রামের স্বর্ণ মহাজন সজল ধরের কাছে। তার কাছে যেত লুণ্ঠিত সব ধরনের স্বর্ণালঙ্কার। টেকনাফে প্রদীপের সহযোগীর মধ্যে অন্যতম হিসেবে নাম এসেছে টেকনাফ কমিউনিটি পুলিশের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নুরুল হোসাইনের। পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ভয়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন তিনি।

২৭ জুলাই সেন্টমার্টিন থেকে আটক মাছ ব্যবসায়ী জুবায়েরকে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে বাঁচানোর কথা বলে দুই দফায় ১০ লাখ টাকা নেন নুরুল হোসাইন ও আবদুল কাইয়ুম নামে দুই ব্যক্তি। এরপরও জুবায়ের ছাড়া পাননি। অবশেষে তাকে মামলার আসামি করেন ওসি প্রদীপ। মামলায় জড়ানোর পর টাকা ফেরত পেতে সহযোগিতা চেয়ে টেকনাফের ইউএনও এবং বিশেষ এক গোয়েন্দা শাখার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন জুবায়েরের ভাই ইউনুস। নিজের আওতাধীন এলাকা না হওয়া সত্ত্বেও গত ২৪ জুলাই রাতে উখিয়ার কুতুপালং থেকে ইউপি সদস্য মোলভী বখতিয়ারকে ধরে নিয়ে যান ওসি প্রদীপ। তার সঙ্গে নিয়ে যান রোহিঙ্গা তাহের নামে আরেকজনকে। রাতে এসে বখতিয়ার মেম্বারের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৫০ লাখ টাকা নিয়ে যান ওসি প্রদীপ। পরে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ছেলে হেলালের কাছ থেকে নেয়া হয় আরো ২৭ লাখ টাকা। জমি-মার্কেট বন্ধক রেখে ৮৭ লাখ টাকা দেয়া হলেও পরদিন দুইজনকে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যা করেন ওসি প্রদীপ। এ ঘটনায় করা মামলায় বখতিয়ারের ঘর থেকে নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধারের গল্প সাজানো হয়। এসব তথ্য একটি বিশেষ সংস্থার কাছে দেয়া জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন মৌলভী বখতিয়ারের স্ত্রী।

ভুক্তভোগী সাবরাং কাটাবনিয়ার কামাল হোসন বলেন, গত বছরের ৭ জানুয়ারি টেকনাফ থানার এএসআই সজিব দত্ত আমার ভাই আবুল কালামকে আটক করে থানায় তিনদিন আটকে রাখেন। পরে আমার মা জরিনা খাতুন অনেক অনুরোধ করে এএসআই সজিব দত্তের সঙ্গে ৫ লাখ টাকায় ছেড়ে দেয়ার চুক্তি করেন। মা নিজ হাতে সজিবকে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকা দেন। ১০ জানুয়ারি সকালে আমার ভাইকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হয়। টাকা দেয়ার পরও রক্ষা পায়নি আমার ভাই। পরে এএসআই সজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে ৩ লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকি টাকা এখনো দেননি। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি হামজালাল মেম্বারকে আটক করে ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। পরে তাকে ৩ হাজার ইয়াবা দিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। একইভাবে টেকনাফ সদরের পল্লান পাড়ার আবদুস শুক্কুর বিএকে আটক করে ‘ক্রসফায়ারের’ ভয় দেখিয়ে চার লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর মুফতি জাফরের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার সরওয়ারের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা, ওমর হাকিম মেম্বারের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা, ছোট হাবির পাড়ার মহিউদ্দীনের কাছ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা, ইসলামাবাদের নেজামের কাছ থেকে দুই দফায় ৯ লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার মো. তৈয়ুবের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা ও রাজার ছড়ার মৌলভী আবদুল হামিদের কাছ থেকে দুই দফায় ১৫ লাখ টাকা নেন প্রদীপ।

শীলবনিয়া পাড়ার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর বাড়ি নির্মাণে বাধা দিয়ে ৫ লাখ টাকা, মাঠপাড়ার মোহাম্মদ হোছন থেকে ৪০ লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর ফিরোজ মিয়ার কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা, উত্তর লম্ব^রীর জামালের কাছ থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর সৈয়দ মিয়ার থেকে ৫ লাখ টাকা, দক্ষিণ লেঙ্গুরবিলের এনামের কাজ থেকে ৫ লাখ টাকা, সদর চেয়ারম্যান শাহজাহানের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা, সেন্ট মার্টিন পূর্বপাড়ার আজিমের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা, শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার ইসমাইলের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা সাবরাং ম-লপাড়ার এজাহার মিয়ার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা, একই এলাকার জামালের কাছ থেকে ৪ লাখ টাকা, লেঙ্গুরবিলের ইউনুসের কাছ থেকে ৭ লাখ টাকা নেন প্রদীপ। টাকা নিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ না দিয়ে কমবেশি ইয়াবা দিয়ে আদালতে এদের চালান দেন তিনি। এসব ঘটনার অনেককিছু পদস্থ কর্মকর্তরা নানাভাবে জ্ঞাত হলেও তাদের নীরবতায় প্রশ্নের ডালপালা গজিয়েছে।

প্রসঙ্গত, ৩১ জুলাই শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সাবেক মেজর সিনহা রাশেদ খান। এ ঘটনায় চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন ও নিরাপত্তা বিভাগ। একইভাবে তদন্তের স্বার্থে টেকনাফের বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ লিয়াকত আলিসহ ২০ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার ও ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। দুইজন এখনো পলাতক রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App