×

জাতীয়

আদিবাসী দিবসের জাতীয় স্বীকৃতি দাবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২০, ১০:৫৫ পিএম

আদিবাসী দিবসের জাতীয় স্বীকৃতি দাবি

ছবি: ভোরের কাগজ

আদিবাসী দিবসের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে বক্তারা বলেছেন, পাকিস্তান আমলে বাঙালি হিসেবে অস্বীকার যেমন বাঙালিদের মনে ক্ষোভ ও জ্বালা সৃষ্টি করত, আদিবাসী হিসেবে স্বীকার না করা আদিবাসীদের মনে ক্ষোভ ও জ্বালা সৃষ্টি করেছে। রবিবার (৯ আগস্ট) সকালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস ২০২০ উপলক্ষে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম আয়োজিত দিনব্যাপী ভার্চ্যুয়াল অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমার সভাপতিত্বে আয়োজিত দিনব্যাপী ভার্চুয়াল আয়োজনে অংশগ্রহণ করেন ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা, ঐক্য ন্যাপের সভাপতি পঙ্কজ ভট্টাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের ডীন অধ্যাপক সাদেকা হালিম, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, খুশী কবির, মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান, টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, এএলআরডি’র নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা, আদিবাসী ফোরামের সদস্য মেইনথিন প্রমীলা ও অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী অভিলাষ ত্রিপুরা প্রমুখ।

এছাড়াও শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন কনা, রোবায়েত ফেরদৌস, শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী, পরিবেশকর্মী জুমলিয়ান আমলাই বম, কণ্ঠশিল্পী মাকসুদ, মাদল ব্যান্ডের হরেন্দ্রনাথ সিং, ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি উজ্জল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি জুয়েল চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি দেবশ্রী তনচংগ্যা, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের প্রতিনিধি প্রমুখ।

রাশেদ খান মেনন বলেন, আদিবাসী দিবসের রাষ্ট্রীয় ও জাতীয় স্বীকৃতি প্রয়োজন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রতিষ্ঠা ও একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম গেল শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা ছিল। কিন্তু বাঙালি হিসেবে নিজ জাতিসত্তার আত্মপ্রতিষ্ঠার মাদকতা দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার উপস্থিতি সম্পর্কে আমাদের বিস্মৃত করেছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী দেশের সামনে পুরাতন ভুল শুধরে নেওয়ার নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু সেখানে তাদের দাবি মোতাবেক আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। পাকিস্তান আমলে বাঙালি হিসেবে অস্বীকার যেমন আমাদের মনে ক্ষোভ ও জ্বালা সৃষ্টি করত, আদিবাসী হিসেবে স্বীকার না করা আদিবাসীদের মনে ক্ষোভ ও জ্বালা সৃষ্টি করে রেখেছে।

জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা বলেন, দেশে আজও আদিবাসী জনগণের মানবাধিকার পরিস্থিতি ভালো নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আদিবাসীদের ভূমি বেদখল ও তাদের চিরায়ত ভূমি থেকে উচ্ছেদ করার হীন উদ্দেশ্যে আদিবাসীদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা, ভূমি জবরদখল ও উচ্ছেদ, আদিবাসী নারীর উপর নির্যাতন ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২২ বছরেও মৌলিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করেনি। বিশেষত ভূমি কমিশন পুরোপুরি অকার্যকর অবস্থায় রয়ে গেছে।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ২৩ বছর হতে চলল পার্বত্য চুক্তির মৌলিক বিষয়গুলো যথাযথভাবে আজও বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ দেশের স্বার্থে এ চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া অতীব জরুরী। তিনি সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক ভূমি কমিশনের জোর দাবি জানান।

ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, আদিবাসী শব্দ একদিন আমাদের সংস্কৃতিতে জায়গা করে নেবে আমি সেই আশাবাদ ব্যক্ত করি। আমাদের এলাকায় কৃষির বিকাশ আদিবাসীদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু আজ আদিবাসীদের সেই জায়গা-জমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। করোনাকালীন সময়ে আদিবাসীরা এর থেকে রেহাই পাচ্ছে না। সমতলের আদিবাসীদের জন্য পৃথক মন্ত্রণালয় ও ভূমিকমিশন গঠনের জোর দাবি জানাই।

সুলতানা কামাল বলেন, আমরা সবাই জানি আদিবাসীরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। তারা মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। অথচ মানুষ হিসেবে তাদের সে অধিকারগুলো দরকার। আমরা আদিবাসীদের সংগ্রামের সাথে সহভাগী হতে চাই।

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, আমরা সকলেই চেয়েছিলাম এদেশে মানুষ হিসেবে বাঁচবো। প্রান্তিক আদিবাসীরা তাদের ন্যায্য অধিকার পেতে চেয়েছেন। কিন্তু এদেশের সংবিধান ও দেশ পরিচালনাকারীরা তার ব্যবস্থা করে দিতে পারেননি। আদিবাসী মানুষের উপর কোভিড ১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব পড়েছে। সেজন্য আদিবাসীদের কর্মের নিশ্চয়তা, খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্যের অধিকার রাষ্ট্রকে সুনিশ্চিত করতে হবে। আমরা লড়ব, লড়তে হবে। আদিবাসী দিবসে সেই লড়াইয়ের আহ্বান জানাচ্ছি।

কৃষ্ণপদ মুন্ডা বলেন, করোনার পাশাপাশি আমাদের এলাকায় ঘূর্ণিঝর ‘আমফান’ আঘাত হেনেছে। আদিবাসীরা সামাজিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। আদিবাসীরা ভূমি বেদখলের শিকার হচ্ছে। আদিবাসীদের আদিবাসী হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি হবে। সুন্দরবন আদিবাসীদের সুপেয় পানির ব্যবস্থা করতে হবে। আদিবাসীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।

শাহীন আনাম আদিবাসীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে বলেন, করোনা মহামারিতে আদিবাসী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীরা বেকায়দায় পড়েছে। আদিবাসী এলাকায় বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে ত্রাণ পৌঁছায় নি। বাংলাদেশে আদিবাসীরা নানাভাবে অধিকার বঞ্চিত রয়েছে। তারা নানাভাবে প্রান্তিক অবস্থায় রয়েছে। এজন্য মূলধারার জনগোষ্ঠী দায়ী। সেজন্য আমি লজ্জিত।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আদিবাসী’ শব্দটার মধ্যে আশ্রয়হীন, অনাথ প্রকাশ করে। তারা নিজদেশে প্রবাসী। তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। বিচারবহির্ভুত হত্যা, অধিকারহীনতা, বঞ্চনা, মৌলিক অধিকারহরণ, দখল, উচ্ছেদ, ভূমি অদিকার ভুলন্ঠিত হওয়ার যত আয়োজন তার সবকিছুই হচ্ছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল প্রতিটি নাগরিকের সমানাধিকার। কিন্তু আজ নিজেদের পরিচয় আদিবাসী বলা যাবে না। আদিবাসী শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, ব্যবহার করলে হেনস্তার শিকার হতে হয়। এর চেয়ে আর কী বিব্রতকর অবস্থা আছে।

মেইনথেইন রাখাইন প্রমীলা বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আমাদের আদিবাসীদের অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। রাষ্ট্র কীরকম নিষ্ঠুর তার উদাহরণ অর্পিত সম্পত্তি আইন। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আদিবাসী জীবনকে বিপর্যস্ত করে রেখেছে। আমরা করোনাকে ভয় পাই না, মানুষরূপী দানব যারা মানবাধিকার লংঘন করে তাদেরকে ভয় পাই। তারা আমাদের জায়গা-জমি কেড়ে নিচ্ছে, আমাদেরকে উচ্ছেদ করছে, দেশান্তরী করছে।

সারাদিনব্যাপী ভার্চ্যুয়াল এ অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কবিতা পাঠ, আদিবাসীদের ব্যান্ড ও কণ্ঠশিল্পীরা নিজেদের গান এবং আদিবাসী নৃত্যশিল্পীরা আদিবাসী নাচ পরিবেশন করেন। বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী জয়দেব রোয়াজা ভিজুয়াল আর্ট পারফর্ম করেন।

সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ভার্চুয়াল এ আয়োজন শেষ হয় সন্ধ্যায়। আদিবাসী অধিকার আন্দোলনে যারা আত্মত্যাগ করেছেন এবং করোনা মহামারিতে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের উদ্দেশ্যে প্রদীপ প্রজ্জলন হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App