×

জাতীয়

করোনার থাবার মধ্যেও সংখ্যালঘু নির্যাতন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২০, ০৭:৩৩ পিএম

করোনার থাবার মধ্যেও সংখ্যালঘু নির্যাতন

করোনাকালেও চলছে সংখ্যালঘু নির্যাতন। ছবি: প্রতীকী

করোনার ভয়াল থাবায় জনজীবন বিপর্যস্ত। এমন বৈরী পরিস্থিতিতেও চলছে ধর্মীয় জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন-নিপীড়ন, মঠ-মন্দিরে হামলা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা বলছেন, অপ্রিয় হলেও সত্য, সরকারের কড়া নজরদারি থাকা সত্ত্বেও করোনা মহামারির মধ্যেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর ৭০/৭৫টি হামলা, মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর, বাড়িঘর লুটপাট, জোরপূর্বক অপহরণ ও ধর্মান্তরকরণ, ধর্ষণ, দেশত্যাগের হুমকির ঘটনা ঘটেছে।

তারা আরো বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভূয়া গুজব ছড়িয়ে একাধিকবার দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির আক্রমণের শিকার হতে হয়েছে। কখনো কখনো দলবদ্ধভাবে হামলার শিকার হয়েছে। তাদের সহায় সম্পত্তির ক্ষতি হয়েছে, নিরাপত্তার ক্ষেত্রে আস্থার-সংকট সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমেও এই ঘটনাগুলো তুলে ধরা হয়েছে।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ৫ ফেব্রুয়ারি বরগুনা জেলার বামনা উপজেলার বোকাবুনিয়া ইউনিয়নের ধোপাবাড়ি গ্রামের নীপেন্দ্র চন্দ্র দাসের হরিমন্দির ও বিগ্রহ ভাঙচুর হয়, ৪ মার্চ সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসভার মজলিসপুর গ্রামে শিবগাছ (বাবাগাছ) উপাসনালয় ভাঙচুর করা হয়। ৩০ মার্চ বরিশাল জেলার উজিরপুর উপজেলার মালিকান্দা গ্রামে এলাকার সন্ত্রাসী সেরাজুল ইসলামের নেতৃত্বে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হয়। গত ৭ এপ্রিল মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর উপজেলার বাজার রাধানগর গ্রামের সুকান্ত চক্রবর্তীর পৈত্রিক ভিটায় নির্মিত স্থাপনা বিএনপির নেতা মিজানুর রহমান গং গুড়িয়ে দিয়েছে।

এরপর ১৩ এপ্রিল সাতক্ষীরার তালা উপজেলার নগরঘাটায় মুদি ব্যবসায়ী সুবল চক্রবর্তীকে প্রকাশ্যে মারধর ও ভারতে পাঠিয়ে দেয়ার হুমকি দেয় আব্দুর রহিম সরদারের ছেলে সন্ত্রাসী মোস্তাক। ১৫ এপ্রিল নীলফামারী জেলার ডিমলা থানার ধনেশ্বর রায়ের কন্যা প্রতিমা রানী রায়কে মামুন ইসলাম গং জোরপূর্বক অপহরণ করে ধর্মান্তরিত করে। ১৬ এপ্রিল রাজশাহীর মোহনপুর থানার ঘাসী গ্রামে নিমাই সরকারের মেয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রী অষ্টমী সরকার স্কুলের সহকারী শিক্ষক শরিয়ত আলীর সহায়তায় পাশের গ্রামের আফজাল হোসেনের ছেলে গোলাম মোস্তফা ও তার সহযোগিদের উত্যক্তে অতিষ্ট হয়ে আত্মহত্যা করে।

গত ২৪ এপ্রিল বাগেরহাট জেলার মোংলা থানার চিলাই ইউনিয়নের গুলেরডাঙ্গা গ্রামের অনিল বালার পরিবারের ওপর হামলা চালায় প্রভাবশালী আবদুস সালামের নেতৃত্বে একদল দুষ্কৃতকারী। এতে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূসহ পরিবারের ৭ জন সদস্য গুরুতর আহত হয়। ২৫ এপ্রিল লক্ষ্মীপুর সদর পৌরসভার শাঁখারীপাড়ার শ্রীশ্রী রক্ষাকালী মন্দির ভাঙচুর হয়। ২৮ এপ্রিল দিনাজপুর জেলার বোচাগঞ্জ উপজেলার ২নং ঈশানিয়া ইউনিয়নের মহেশাইল বাজারে অবস্থিত দুর্গামন্দির ও বনকালী কালী মন্দিরে দুষ্কৃতকারীরা প্রতিমা ভাঙচুর করে। একই তারিখে কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার কৈয়ারবিল ইউনিয়নের জলদাস পাড়ার মহাশ্মশাননের সীমানা প্রাচীর ভেঙে দখল করে নেয় ৬ নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো: জাহিদুল ইসলাম রাসেলের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা।

এরপর গেল ৫ মে চট্ট্রগ্রামের বাঁশখালির গামাড়া ৯ নং ওয়ার্ডের কালীদাসের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। এতে তাদের পরিবারের সদস্যরা গুরুতর আহত হয় এবং মুসলিম হয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। একইদিন নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলার বাকলজোড়া ইউনিয়নের কুমুদগঞ্জ বাজারের কালী প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। ১২ মে প্রতিবেশী মধু মিয়ার অত্যাচারে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীনাথপুর গ্রামের ব্রজেন্দ্র শঙ্করের কিশোরী মেয়ে সঞ্চিতা শঙ্কর আত্যহত্যা করে। মধু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চিতা শঙ্করকে নানাভাবে উত্যক্ত করে আসছিল এবং আত্মহত্যার ঘটনার আগের দিন রাতে সঞ্চিতাদের ঘরের দরজা ভেঙে ভিতরে ঢুকে তার শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করে।

এরপর ১৫ মে ভোলা জেলার মনপুরা উপজেলার শ্রীরামচন্দ্র দাস নামে এক যুবককে ফেসবুকে মহানবীকে (স.) কটূক্তি করার কথিত অভিযোগে পুলিশ গ্রেপ্তার করলেও অভিযুক্তের ফাঁসির দাবিতে স্থানীয় মুসল্লিরা হিন্দুদের বাড়িঘর ও দোকানে ব্যাপক হামলা চালায়। ২১ মে রাজবাড়ী সদরের সুতারপুর ইউনিয়নের লক্ষণপুর গ্রামের নমপাড়ার সার্বজনীন কালীমন্দিরে স্থানীয় রাকিব ও সজীবের নেতৃত্বে হামলা চালিয়ে কয়েকটি প্রতিমা ভাঙচুর করে। ২৩ মে কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর পৌর এলাকার ধুলজুরি গ্রামের বিধবা দিপালী রাণীর বাড়িতে প্রভাবশালী ফেরদৌস মিয়ার নেতৃত্বে একদল সন্ত্রাসী ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় এবং দিপালী রাণী ও তার কলেজ পড়ুয়া মেয়ে সেতু রাণীকে মারধর করে ও শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে।

এরপর গেল ২ জুন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানার এএস আই শামীম উদ্দীন স্থানীয় দোকানদার নিখিল তালুকদারকে কোনো কারণ ছাড়াই পিটিয়ে গুরুতর জখম করে। পরবর্তিতে আহত নিখিল তালুকদার ৪ জুন সকালে মৃত্যুবরণ করেন। ১২ জুন দিনাজপুরের কাহারোল উপজেলার তারাপুর গ্রামের পরেশ চন্দ্র রায়ের স্ত্রী শ্রীমতি প্রতিমা রাণীকে স্থানীয় দুলাল মিয়া গোয়ালঘরে ঢুকে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। ২০ জুন একদিনেই দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যা লুট, মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুরের মতো তিনটি ঘটনা ঘটেছে।

ভোলা জেলা দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের ব্যবসায়ী প্রবীর মাঝি তার ব্যবসাস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে একই ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি সেলিম মেম্বারের ছেলে সন্ত্রাসী শাহাবুদ্দিন দল-বল নিয়ে গাছ ফেলে মটরসাইকেল থামিয়ে ৫ লাখ টাকাসহ ১০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয় এবং তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সন্ত্রাসীরা তার ছোট ভাইকেও ছুরিকাঘাতে মারাত্মক আহত করে। একইদিন রাতে নেত্রকোণার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত শ্রীশ্রী কালি মন্দিরে রাখা সিসি ক্যামেরা ভেঙে দুর্বৃত্তরা মন্দিরের ভিতরে থাকা প্রণামীর অর্থ ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে যায়। ওই দিনই দুপুরে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার পুটিজানি ইউনিয়নের আবুল হোসেনের ছেলে রানা একই গ্রামের হরিমন্দিরের রাস উৎসবের ৫ টি প্রতিমা ভাঙচুর করে।

এরপর গত ১০ জুলাই ঠাকুরগাঁও সদরের পূর্ব গহরপাড়া গ্রামের উকিল চন্দ্র বর্মনের মেয়ে গোলাপী রাণী বর্মনকে সদর থানার জগন্নাথপুরের আহসান হাবীবের পুত্র রাকিব ইসলাম তার সহযোগী বন্ধুদের সহযোগিতায় অপহরণ করে। ঈদুল আযহার পরে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় দুর্বৃত্তরা স্থানীয় মগদেশ্বরী মন্দিরের ভেতরে গরুর হাড় ফেলে রেখে যায়। গাজীপুর মহানগরের টঙ্গি পৌরসভার ৫৪নং ওয়ার্ডের মিত্র বাড়ির মন্দিরের মাঠে ১০টি গরু কোরবানি দেয়া হয়েছে। রাঙামাটিতে সনাতন সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির দোকানে গরুর রক্ত ফেলে দেয়া হয়েছে।

গেল ৩ আগস্ট ঈদুল আজহার তৃতীয়দিনে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার সরিকল ইউনিয়নের দক্ষিণ সাকোকঠী গ্রামে কালী মন্দিরের প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এরপর ৪ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার উচিৎপুর ইউনিয়নের বিজয়নগর এলাকার শ্মশানকালী মন্দির ও শিবমন্দিরের ৭টি প্রতিমা ভাঙচুর করে। একইদিনে পাবনার ফরিদপুর উপজেলার চিকুলিয়ায় শম্ভুচাঁদ মন্দির রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতকারীরা পুড়িয়ে দেয়। ৬ আগস্ট বগুড়ার গাবতলী উপজেলার নেপালতলী ইউনিয়নের পারকাঁকড়ার ভাঙ্গিরপাড়া গ্রামে ছোট ভাইয়ের স্ত্রীকে শ্লীলতাহানির প্রতিবাদ করায় অমিত রায়কে প্রকাশ্যে গলাটিপে ও বুকে লাথি মেরে হত্যা করে এনামুল হক।

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নির্মল কুমার চ্যাটার্জী বলেন, যেকোনো ঘটনায় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণে সচেষ্ট থেকেছে। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতায় শাস্তির বিষয়টি তড়িৎ দৃশ্যমান না হওয়ায় মানুষ হতাশ হয়, আস্থার সংকট তৈরি করে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার এ বিষয়ে সতর্ক আছেন এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার মাধ্যমে দেশের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য, স্থীতিশীলতা ও উন্নয়ন ব্যাহত করার অপচেষ্টাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সাম্প্রদায়িক শক্তির এই ধরনের কর্মকাণ্ডের পেছনে দেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করার কোনো গভীর ষড়যন্ত্র কাজ করছে কিনা তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App