×

মুক্তচিন্তা

আদিবাসী বনাম উপজাতি বিতর্ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮ আগস্ট ২০২০, ০৮:৪৮ পিএম

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদে ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ লিপিবদ্ধ হওয়ার পর কয়েক বছর যাবৎ পার্বত্য এলাকাবাসী ‘আদিবাসী’ দাবির সপক্ষে অনেক সংগঠনের মাধ্যমে প্রচারণায় আত্মনিয়োগ করেছে। ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ও তাদের তরফ থেকে উদযাপন করা হচ্ছে। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামের জননিরাপত্তার অবস্থা এখনো শোচনীয়। তিনটি অস্ত্রধারী গ্রুপ নিজেদের মধ্যে দলাদলি ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কেউ-ই সেই গ্রুপের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। এমনকি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতেও মাসে মাসে চাঁদা দিতে হচ্ছে। অস্ত্রের মুখে অপহৃত হলে নগদ টাকা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। নেতৃত্ব নিয়েও রয়েছে দ্ব›দ্ব-সংঘাত। ভোটের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও সাধারণ মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভোটার লিস্ট নিয়েও রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এলাকায় সেনাবাহিনী নানা উন্নয়নমূলক কাজে নিয়োজিত থাকলেও সেখানকার গুপ্ত সন্ত্রাসী দলগুলোর কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারে সক্ষম হননি তারা। সেখানকার অধিবাসীদের ভাষ্য, নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে অস্ত্র উদ্ধারে এবং সন্ত্রাস নির্মূলে সফলতা লাভে সেনাবাহিনী অগ্রসর হলে তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। আসলে পার্বত্য এলাকার মানুষের নিরাপদে বেঁচে থাকা ও মানবতা অক্ষুণœ রাখা আজ কঠিন হয়ে পড়েছে। উপরন্তু আছে বিশ্বের পরিপ্রেক্ষিত না বুঝে ‘আদিবাসী’ দাবিনামা প্রকাশের চেষ্টা। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য সরকারি, আধাসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা স¤প্রতি তুলে নেয়া হয়েছে। তবে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য এখনো কোটা সুবিধা রয়েছে। এসব সুবিধাভোগী ২০১৯ সালেও ‘আদিবাসী ফোরাম’ নামের সংগঠন থেকে ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনের জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছিল। পক্ষান্তরে গত কয়েক বছর সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসী শব্দটি না থাকায় বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কাছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো চিঠিতে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উদযাপনে সরকারের কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। যদিও ‘করোনা মহামারি’তে এবারের পরিস্থিতি ভিন্ন। এর আগে সংবিধানের ‘উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়’ শব্দগুলোর পরিবর্তে আদিবাসী ফোরামের দাবি হচ্ছে এখানে ‘আদিবাসী জাতিসমূহ’ সংযুক্ত করা হোক। শেখ হাসিনা সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে এবং তা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সভাপতি জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা নানা বক্তব্য ও মন্তব্যে অসহযোগিতার মনোভাব প্রকাশ করে এসেছেন দীর্ঘ সময় ধরে। ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র ২০০৭’ অনুসারে তাদের ৪৬টি অধিকারের কথা লিপিবদ্ধ হয়েছে। এই ঘোষণাপত্রে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি বা সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তাছাড়া ঘোষণাপত্রের অন্য সব সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বসম্মত সমর্থন নেই। এ কারণে বাংলাদেশ আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক ঘোষণাপত্রের ওপর ভোটগ্রহণের সময় তারা ভোটদানে বিরত ছিল। তবে যে কোনো অনগ্রসর জাতিগোষ্ঠীর অধিকারের প্রতি সমর্থন রয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের। সংবিধান অনুসারে সরকার প্রধান প্রধান মানবাধিকার চুক্তির প্রতি অনুগত এবং উপজাতিদের অধিকার সমর্থন করে এসেছে। উল্লেখ্য, ‘আদিবাসী’ শব্দটি সংবিধানে সংযোজিত হলে ২০০৭ সালের ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্র’ মেনে নিতে হবে; যা হবে বাংলাদেশের জন্য আত্মঘাতী। কারণ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৪-এ আছে ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চর্চার বেলায়, তাদের অভ্যন্তরীণ ও স্থানীয় বিষয়ের ক্ষেত্রে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বশাসিত সরকারের অধিকার রয়েছে ও তাদের স্বশাসনের কার্যাবলির জন্য অর্থায়নের পন্থা এবং উৎসের ক্ষেত্রেও অনুরূপ অধিকার রয়েছে।’ অর্থাৎ ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করলে ও পার্বত্যাঞ্চলে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের অনুমতি ছাড়া বাংলাদেশ সরকার খাগড়াছড়ির গ্যাস উত্তোলন করে অন্য জেলায় আনতে পারত না। কারণ সেখানকার স্বশাসিত আদিবাসী শাসক নিজেদের অর্থায়নের উৎস হিসেবে সেই খনিজ, বনজ ও অন্যান্য সম্পদ নিজেদের বলে চিন্তা করত। আবার অনুচ্ছেদ ৩৬-এ আছে, ‘আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষত যারা আন্তর্জাতিক সীমানা দ্বারা বিভক্ত হয়েছে, তাদের অন্য প্রান্তের নিজস্ব জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আধ্যাত্মিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক কার্যক্রমসহ যোগাযোগ সম্পর্ক ও সহযোগিতা বজায় রাখার ও উন্নয়নের অধিকার রয়েছে।’ রাষ্ট্র এই অধিকার কার্যকরে সহযোগিতা প্রদান ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবে। ঘোষণাপত্রের এই নির্দেশ কোনো সরকারই মেনে নিতে পারবে না। কারণ পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যক্রম অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হবে। তাছাড়া বাংলাদেশে পার্বত্যাঞ্চলের সীমান্তবর্তী এলাকায় জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি পাবে; যা ক্রমেই সরকারের মাথাব্যথার কারণ হয়ে জাতীয় উন্নয়ন ব্যাহত করবে। জাতিসংঘের এই ঘোষণাপত্রের শেষ অনুচ্ছেদ ৪৬-এ সবার মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতার প্রতি সম্মান দেখানোর কথা বলা হয়েছে এবং এই কাজটি বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছে। এর আগে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ অনুসারে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সমতা, বৈষম্যহীনতা, সুশাসন এবং সরল বিশ্বাসের মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। জাতিসংঘের ঘোষণাপত্রের একাধিক অনুচ্ছেদ অনুসারে আদিবাসীদের কোনো অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে বৈষম্য করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, চাকরি ও অন্যান্য বিষয়ে বাঙালিদের মতো তাদেরও সমান সুযোগ দিতে বাধ্য থাকবে রাষ্ট্র। উল্লেখ্য, ভারতে বসবাসকারী একই সম্প্রদায়ভুক্ত উপজাতিদের সেখানকার সংবিধানে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সম্বোধন করা হয়নি। বলা হয়েছে ঝপযবফঁষবফ ঈধংঃব ধহফ ঝপযবফঁষবফ ঞৎরনবং। সংবিধানে আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামকে উপজাতি অধ্যুষিত রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৯(১)(২), ৩০(১)(১এ), ৪৬, ২৪৪(১) ২৪৪এ(১), ৩৩২(১), ৩৩৫, পঞ্চম অধ্যায়, পার্ট বি, অনুচ্ছেদ-৪ এবং ষষ্ঠ অধ্যায়ের অনুচ্ছেদ ১-এর অংশগুলোর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী তথা উপজাতিগুলোর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ১৯৭২ সালের ২২ জুন আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ওখঙ) প্রণীত ‘ইন্ডিজেনাস এন্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন, ১৯৫৭’ (কনভেনশন নম্বর ১০৭)-এ অনুস্বাক্ষর করেন।বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নৃতাত্তি¡ক জাতিগোষ্ঠী এবং ট্রাইবাল জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়সহ তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার জন্য জাতিসংঘের এই সংস্থাটি আবার সংশোধিত ‘ইন্ডিজেনাস এন্ড ট্রাইবাল পপুলেশনস কনভেনশন ১৯৮৯’ (কনভেনশন নম্বর ১৬৯) গ্রহণ করে। এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ আইনি দলিল জাতীয় পর্যায়ে উপজাতিদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা ও কার্যকর করার জন্য প্রয়োজনীয়। এখানে ট্রাইবাল বা সেমি-ট্রাইবাল বলতে ওই গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের বোঝানো হয়েছে, যারা তাদের ট্রাইবাল বৈশিষ্ট্য হারানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে এবং এখনো জাতীয় জনসমষ্টির সঙ্গে একীভ‚ত হয়নি। বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত পথে অগ্রসর হয়ে শেখ হাসিনা সরকার পার্বত্য শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ি অধিবাসীদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। দেশের অখÐতা রক্ষার জন্য উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের ধারণা সবাই মেনে নেবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের প্ররোচনায় পার্বত্য এলাকা থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র হবে মর্মান্তিক। পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের জন্য সবার ঐকান্তিক ইচ্ছাই গুরুত্বপূর্ণ। ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’তে ন্যায়বিচার, গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, সমতা, বৈষম্যহীনতা, সুশাসন এবং সরল বিশ্বাসের মূলনীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এজন্য সংবিধানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ গণ্য করার দাবির পরিবর্তে পার্বত্য শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের দাবি অনেক বেশি যৌক্তিক। ড. মিল্টন বিশ্বাস : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App