×

জাতীয়

জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৭ আগস্ট ২০২০, ০৯:১৪ এএম

জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক!

স্বাস্থ্যবিধি মেনে গণপরিবহনে যাত্রী নেয়ার নির্দেশনা থাকলেও কম ক্ষেত্রেই তা মানা হয়। রাজধানীর কমলাপুর থেকে গুলশান চলাচলকারী ৬ নম্বর বাসে কোনো রকম সামাজিক দূরত্ব না রেখেই যাত্রী উঠানো হয়েছে। ছবি -মামুন আবেদীন

করোনা ভাইরাস নিয়ে নাকাল গোটা বিশ্ব। প্রতিদিনই নতুন তথ্য জানাচ্ছেন গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। দুদিন আগে করা মন্তব্য থেকে সরে এসে নতুন তথ্য জানাচ্ছে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু বাংলাদেশে যেন একেবারেই বিপরীত চিত্র। মানুষের হালচাল দেখে মনেই হয় না করোনা মহামারি নিয়ে তারা ভীতসন্ত্রস্ত। এখানে জনজীবন এখন প্রায় স্বাভাবিক! সরকারের পক্ষ থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কথা বলা হলেও তা কানেই তুলছেন না অধিকাংশ মানুষ। সংক্রমণের শুরুর দিকে সামাজিক দূরত্ববিধি কিছুটা মানা হলেও সে পাট চুকেছে অনেক আগেই। সঠিক নিয়মে মাস্ক না পরে তা ঝুলিয়ে রাখা হচ্ছে কানে, থুঁতনিতে, কেউবা মাস্ক পকেটে নিয়ে ঘুরছেন। মুখে মাস্ক না থাকায় কেউ দোহাই দিচ্ছেন, দম বন্ধ হয়ে আসে, কিংবা ভুলে বাসায় রেখে এসেছি। শহর ছাড়িয়ে করোনার বিস্তার এখন ঘটেছে গ্রামেও। কিন্তু ‘করোনা শহুরে ও ধনী মানুষের অসুখ, গরিব মানুষের করোনা হয় না’- এমন ধারণাও পোষণ করছেন অনেকেই। এমনকি ‘আল্লাহর দোহাই’ দিয়েও অনেকে ঢাকতে চাইছেন নিজের অসচেতনতা। গণপরিবহনে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা হবে, এমন শর্তে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বাড়তি ভাড়াটা নেয়া হলেও সামাজিক দূরত্ববিধির তোয়াক্কা করছেন না প্রায় কেউই। বাজার, হোটেল, রেস্টুরেন্টে ও অন্যান্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই ফিরে আসছে সংক্রমণের আগের পরিবেশ। সায়েদাবাদ থেকে এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য বলাকা গাড়িতে উঠেছেন আলাল মিয়া। মুখে মাস্ক নেই ষাটোর্ধ্ব আলাল মিয়ার। কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘মানুষ করোনায় না ডরেই মরতাছে। এত কিছু করে কোনো লাভ নাই। আল্লায় যখন নিবো তখন এমনিতেও যাইতে হবে। করোনা তো খালি উছিলা।’ রিকশা চালক মকবুল আলীও আল্লার ভরসায় মাস্ক পরেন না। জানালেন মাস্ক পরে থাকলে তার শ্বাসকষ্ট হয় এবং রিকশা চালাতে পারেন না। মহাখালী কাঁচাবাজারে ফল বিক্রেতা সবুজের মাস্ক ঝুলছে তার কানে। জানালেন, ক্রেতারা এলে মাস্ক পরে নেন। এদিকে মহামারির মধ্যে ৭৫ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী বাড়ি বসে কাজ করার সুযোগ পেলেও ওই নিয়ম তুলে দিয়েছে সরকার। সরকারি সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আগের মতো সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অফিস করতে হবে বলে মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। জনগণের মধ্যে করোনার ভয় কেটে গেছে বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম। তিনি বলেন, করোনার ভয় কেটে গিয়ে মানুষ এখন কেয়ারলেস হয়ে গেছে। তারা আগের মতো আর ভীত নয়। গত ৩০ মে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে সর্বসাধারণের প্রতি কঠোর নির্দেশনা দিয়ে পরিপত্র জারি করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা স্বাক্ষরিত ওই পরিপত্রে মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জীবাণুনাশক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর মাস্ক না পরে বাইরে বের হওয়া ‘বেআইনি’ বলেও উল্লেখ করা হয়। সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ আইনের আওতায় মাস্ক না পরে বের হলে অর্থদণ্ড, কারাদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডই কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এর কার্যকারিতা খুব একটা দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, শাস্তি কার্যকর করা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজ। কিন্তু এক্ষেত্রে তাদের কার্যকর ভূমিকা দেখা যায়নি। নমুনা পরীক্ষাও কমেছে। নমুনা পরীক্ষার জন্য সরকার ফি নির্ধারণ করে দেয়ার পর থেকেই এই সংখ্যা কমছে। যে লোকটি দিন মজুর তার পরিবারে যদি চার থেকে পাঁচজন সদস্য থাকে ওই ব্যক্তির পক্ষে দুইশ টা ফি দিয়ে পরিবারের সবার নমুনা পরীক্ষা করানো সম্ভব নয়। কোভিড-১৯ মোকাবেলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা ভাইরাসে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়টি কী অনেকে তা বুঝতেও পারেননি। আবার অনেকে বুঝলেও মানতে নারাজ। পরিস্থিতি এখন এমন, স্বাস্থ্যবিধি হচ্ছে কাজীর গরু, যা কেতাবে আছে গোয়ালে নেই। নমুনা পরীক্ষার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, করোনা মহামারির শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে এসেছে। সংস্থার পক্ষ থেকে সন্দেহভাজন প্রত্যেক মানুষকে পরীক্ষা করার পরামর্শ দিয়েছে। কিন্তু আমরা নানাভাবে নমুনা পরীক্ষা সংকুচিত করেছি। ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে মানুষের আগ্রহ কমেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অপর এক সদস্য ভোরের কাগজকে বলেন, কীভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব তা নিয়ে শহরগুলোতে ব্যাপক প্রচার করা হলেও গ্রামে তেমনটা দেখা যায়নি। টিভি ও পত্রিকা দেখে মানুষ এসব জেনেছে। কিন্তু জানলে কী হবে তা মেনে চলতে দেখা যায়নি অধিকাংশ মানুষকে। মেডিকেল অ্যানথ্রোপলজি ও জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস ভোরের কাগজকে বলেন, দেশের মানুষের মধ্যে করোনার ভীতি প্রথম দিকে যেমন ছিল তা এখন নেই বললেই চলে। প্রথমে কোনো বিষয়ে মানুষের মধ্যে যে ভীতি তৈরি হয় তা ধীরে ধীরে সয়ে যায় এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলব প্রশাসন ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বহীনতার কারণে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। জীবন ও জীবিকার জন্য মানুষকে রাস্তায় নামতেই হবে। টেস্ট বাড়ানোর কথা থাকলেও তা কমছে। তারা ধরে নিয়েছে অদৃশ্য এই ভাইরাসের সঙ্গে মানিয়ে চলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তাই ভয় কাটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App