বেলাশেষের দিনগুলি
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২০, ১১:১৭ পিএম
আশি বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরলোক গমন করেন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগস্ট। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে। না, কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কিংবা সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে নয়। এসেছিলেন রাজশাহীর নওগাঁর পতিসরে। সেই শেষ আসা। ‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে...’। ১৯৩৭ সালের মধ্যভাগে (১২ শ্রাবণ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দ) নওগাঁর পতিসর হাইস্কুলে কবিকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করা হয়। একই দিনে কালীগ্রাম পরগনার ‘রাজভক্ত প্রজাবৃন্দের পক্ষে’ অভ্যর্থনা জানানো হয় তাঁকে।
প্রজাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কবির সঙ্গী ছিলেন রাজশাহীর জেলা প্রশাসক অন্নদাশঙ্কর রায়, কবির সচিব সুধাকান্ত রায়চৌধুরী এবং নগেন্দ্রনাথ চৌধুরী। সংবর্ধনার জবাবে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, তা গভীর তাৎপর্যবহ ও মর্মস্পর্শী। কবির সবিনয় প্রত্যুত্তর ছিল এই
“... সংসার থেকে বিদায় নেবার সময় তোমাদের সঙ্গে দেখা হল এইটিই আমার সান্ত¡না। তোমাদের কাছে অনেক পেয়েছি,কিন্তু কিছু দিতে পেরেছি বলে মনে হয় না। সেসব কথা মনে হলে বড়ো দুঃখ পাই। কিন্তু আর সময় নেই, আমার যাবার সময় হয়েছে, শরীর আমার অসুস্থ এ অবস্থায় তোমাদের মধ্যে এসে, তোমাদের সঙ্গে থেকে তোমাদের উন্নতির জন্য কিছু করবার ইচ্ছা থাকলেও আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তোমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়াও,তোমাদের সবার মঙ্গল হোক তোমাদের সবাইকে এই আশীর্বাদই আমার শেষ আশীর্বাদ। আজ তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে এসেছি। তোমরা আমার বড়ো আপনার জন, তোমরা সুখে থেকো।
তোমাদের জন্য কিছু করতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল...সব ছেড়ে দিয়ে তোমাদের সঙ্গে তোমাদের মতই সহজ হয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেব। কী করে বাঁচতে হবে তোমাদের সঙ্গে মিলে সেই সাধনা করব, কিন্তু আমার এই বয়সে তা হবার নয়, আমার যাবার সময় হয়ে এসেছে। এই নিয়ে দুঃখ করে কী করব? তোমাদের সবার উন্নতি হোক,এই কামনা নিয়ে আমি পরলোকে চলে যাব।”
বেলাশেষের দিনগুলি
রবীন্দ্রপ্রয়াণের অল্প কিছু সময় আগেকার কথা। কবি বুদ্ধদেব বসু সপরিবারে ও সাহিত্যিক জ্যোতির্ময় রায় গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রসন্নিধানে। বুদ্ধদেব বসু শান্তিনিকেতনে ছিলেন তেরো দিন। শান্তিনিকেতন বাসের কথা তিনি লিখেছেন তাঁর ‘সব পেয়েছির দেশে’ বইয়ে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অসুস্থ। বুদ্ধদেবের ধারণা ছিল, কবি “হয়তো দু’একটির বেশি কথা বলবেন না, হয়তো আগেকার মতো নিঃসংশয় নিঃসঙ্কোচে তাঁর পাশে গিয়ে বসা চলবে না। দেখে ভুল ভাঙল।.. মুখ তাঁর শীর্ণ। আগুনের মত গায়ের রং ফিকে হয়েছে, কিন্তু হাতের মুঠি কি কব্জির দিকে তাকালে বিরাট বলিষ্ঠ দেহের আভাস এখনো পাওয়া যায়। কেশরের মতো যে কেশগুচ্ছ তাঁর ঘাড় বেয়ে নামত তা ছেঁটে ফেলা হয়েছে, কিন্তু মাথার মাঝখান দিয়ে দ্বিধা-বিভক্ত কুঞ্চিত শুভ্র দীর্ঘ কেশের সৌন্দর্য এখনো অম্লান।.. এই অপরূপ রূপবান পুরুষের দিকে এখন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়, যেমন ক’রে আমরা শিল্পীর গড়া কোনো মূর্তি দেখি। এত সুন্দর বুঝি রবীন্দ্রনাথও আগে কখনো ছিলেন না, এর জন্যে এই বয়সের ভার আর রোগদুঃখভোগের দরকার ছিল।..
“কে বলবে তাঁকে দেখে যে তাঁর অসুখ!.. কণ্ঠস্বর ঈষৎ ক্ষীণ, মাঝে মাঝে একটু থামেন, কিন্তু কথার জন্য কক্ষনো হাৎড়াতে হয় না, ঠিক জায়গায় ঠিক কথাটি আপনিই মুখে এসে বসে।.. সেদিন এক ঘণ্টার উপরে প্রায় অনর্গল কথা বললেন, সাহিত্য সংগীত চিত্রকলা জীবনদর্শন হাস্যপরিহাস মেশানো এক আশ্চর্য অবিশ্বাস্য ঝরনায় নেয়ে উঠলুম। এঁর অসুখ! ভাবা যায় না। এই প্রদীপ্ত মনীষা, জীবনের ছোটো বড়ো সমস্ত ব্যাপারে এই জ্বলন্ত উৎসাহ, ভাষার উপর এই রাজকীয় কর্তৃত্ব এর সঙ্গে কোনো রকম রোগ কি বৈকল্যকে সংশ্লিষ্ট করতে আমাদের মন একেবারেই বিমুখ হয়। অথচ সত্যি তিনি অসুস্থ, অত্যন্ত অসুস্থ। তাঁর রোগে যন্ত্রণা যেমন, ছোটোখাটো বিরক্তিকর আনুষঙ্গিকও কম নয়।.. কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিস্বরূপের এতটুকু বিকৃতি কোথাও হয়নি। তাঁর মুখে সব কথাই আছে, রোগের কথা একটিও নেই।.. এতটুকু শৈথিল্য নেই আচরণে কি চিন্তায় কি ব্যবহারে।...”
কবির অসুখ দিন দিন বাড়তে লাগল। কোনো চিকিৎসায় কোনো উপকার পাওয়া যাচ্ছে না। কলকাতা থেকে ডাক্তাররা ছুটে গেলেন শান্তিনিকেতনে। তাঁরা কবিকে পরীক্ষা করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিলেন। অতঃপর কবিকে কলকাতায় নেওয়া হলো ২৫ জুলাই (১৯৪১)। তৎকালীন ই.আই. রেলওয়ের এক অধিকর্তা কবির জন্য বিশেষ একখানি সেলুনগাড়ির বন্দোবস্ত করে দিলেন। জোড়াসাঁকোর পৈতৃক বাড়িতে এলেন কবি। যেন বুঝতে পারছেন আয়ু ক্ষীণ হয়ে আসছে। দু’দিন পরে, ১১ শ্রাবণ লিখলেন :
প্রথম দিনের সূর্য
প্রশ্ন করেছিল
সত্তার নূতন আবির্ভাবে
কে তুমি।
মেলেনি উত্তর।
বৎসর বৎসর চলে গেল,
দিবসের শেষ সূর্য
শেষ প্রশ্ন উচ্চারিল পশ্চিমসাগরতীরে
নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়
কে তুমি।
পেল না উত্তর।
কবির শরীরে অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করা হলো ৩০ জুলাই। অপারেশনের পর কয়েকদিনের মধ্যে শরীরের গতি সম্পূর্ণ বদলে গেল। অবশেষে রাখীপূর্ণিমার অবসানে ১৩৪৮ সালের ২২ শ্রাবণ (৭ আগস্ট ১৯৪১) বেলা ১২টা ২০ মিনিটে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
বরেণ্য নেতৃবর্গের শোকবাণী
রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের দিন ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট কলকাতায় ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় ছাপা হয় বরেণ্য নেতৃবৃন্দের শোকবার্তা ও শ্রদ্ধার্ঘ্য।
ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় নিম্নস্নোক্ত শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। এই বার্তা তিনি প্রেরণ করেছিলেন বাংলার গভর্নরের মাধ্যমে। শোকবার্তায় ভাইসরয় বলেন, “আমি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছি আপনার পিতার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে। এটা শুধু একটা ঘটনাবহুল দীর্ঘ জীবনেরই অবসান নয়, মহান ও উচ্চ আদর্শের প্রতীক হিসেবে তাঁর জীবন ছিল অনুকরণীয় উদাহরণ, প্রতিটি প্রজন্মের জন্য। তাঁর মৃত্যুতে বাঙ্গালী তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়েছে, যিনি তাঁর বহুমুখী প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছেন। অনুগ্রহপূর্বক আপনার অপূরণীয় এই ক্ষতিতে আমার অকৃত্রিম শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করুন।”
মহাত্মা গান্ধী (পরবর্তীকালে ভারতের জাতির পিতা) ওয়ার্ধা থেকে পাঠানো তাঁর শোকবাণীতে বলেন, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুতে আমরা এ যুগের একজন শ্রেষ্ঠ কবিকেই হারাইনি, একজন প্রদীপ্ত জাতীয়তাবাদীকে হারিয়েছি যিনি ছিলেন একজন মানবতাবাদী। খুব কম গণকর্মসূচিই ছিল, যেখানে তাঁর শক্তিমান ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেনি। তিনি শান্তিনিকেতনে সাহিত্যের বিরাট উত্তরাধিকার রেখে গেছেন জাতির জন্য তথা বিশ্বের জন্য। তাঁর আত্মা পরম শান্তিতে বিরাজ করুক এবং যারা শান্তিনিকেতনের দায়িত্বে আছেন, তারা যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে যোগ্যতার প্রমাণ দেবেন, এই আশাবাদ ব্যক্ত করছি।”
মি. গান্ধী কবিপুত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন, তাহলো... “তোমার ক্ষতি সেটা আমার ক্ষতি তথা জাতির ক্ষতি, বৃহত্তর অর্থে বিশ্বের ক্ষতি। আমাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে গুরুদেবের নৈতিক উৎকর্ষের প্রমাণ পাব, কারণ তিনি নিজেই ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। আমার শোকবাণী তোমাদের সবার জন্য।”
মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ (পরবর্তীকালে পাকিস্তানের জাতির পিতা) তাঁর শোকবাণীতে বলেন, “আমি বিশেষভাবে মর্মাহত হয়েছি ড. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুর সংবাদটি শুনে। তিনি ভারতের একজন শীর্ষস্থানীয় কবি, দার্শনিক ও সমাজকর্মী ছিলেন। আমার যৌবনকাল থেকেই তাঁকে জানার সুযোগ হয়েছিল। সর্বশেষ ১৯২৯ সালে তাঁর সঙ্গে লন্ডনে দেখা করার সুযোগ হয়। তাঁর খোলামেলা ব্যবহার ও উজ্জ্বল আলাপচারিতা ছিল খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। সর্বোপরি তিনি ছিলেন সত্যিকারের দেশপ্রেমিক এবং সর্বদা বিপরীত মতবাদ বুঝতে চাইতেন, যা যুক্তিনির্ভর তার প্রশংসা করতেন। আমার গভীর শ্রদ্ধা ও সহানুভ‚তি তাঁর শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি। তাঁর এই মৃত্যু ভারতের একটি অপূরণীয় ক্ষতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কর্মের মাঝে বেঁচে থাকবেন।”
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক (শেরে বাংলা) বলেন, “একজন বাঙালির জন্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যুসংবাদ অত্যন্ত দুঃখজনক ও গভীর পরিতাপের, যা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। নিঃসন্দেহে তিনি বর্তমান সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আধুনিক কবিদের একজন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তা পূরণ কোনোকালেই সম্ভব নয়। এমনি এক মুহূর্তে আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত এবং গভীর বেদনায় মুহ্যমান।”
বাংলা ভাষার দিগন্তকে বিস্তৃত করার জন্য বিশ্বকবির অবদানকে বঙ্গবন্ধু বিনয়ের সঙ্গে স্মরণ করতেন। চীনে ভ্রমণকালে তিনি তাঁর উপলব্ধি লিপিবদ্ধ করেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী পৃ : ২২৮)।