×

মুক্তচিন্তা

করোনা বন্যা প্রকৃতি ও আমরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২০, ০৬:৫৫ পিএম

প্রাকৃতিক সম্পদকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। বুঝতে হবে- বনের উদ্ভিদ আর প্রাণিকুল আমাদের শত্রু নয় বন্ধু। বন-জল-নদী দিয়ে আঁকা অপরূপা সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝা ও দৈত্যসম ঘূর্ণিঝড়ের দাপটের সামনে বুক চিতিয়ে মানুষের জীবনে ও ঘর-বসতি রক্ষা করে চলেছে।

করোনা আর বন্যা- দুটি নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি আমরা। মহামারি করোনার দখলে বিশ্ব। সর্বগ্রাসী বন্যার কবলে দেশ। ভয়াবহ দুর্যোগের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত প্রকৃতি আর মানুষ। প্রতিদিন সারা পৃথিবীতে হাজার হাজার মানুষের জীবন কেড়ে নিচ্ছে নিষ্ঠুর করোনা। ধনী-গরিব, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ এই অদৃশ্য ভাইরাসের কাছে প্রতিনিয়ত হার মানছে। ঝরে যাচ্ছে দিন, ঝরে যাচ্ছে জীবন। ঝরা পাতার মতোই ঝরে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে কত চেনা-অচেনা আপনজন। যে যায়, সে আর ফিরে না। হারিয়ে যায় চিরতরে। সান্ত¡না এটাই- কেউ আসে, কেউ যায়। সম্প্রতি করোনার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বন্যা। আবহমান বাংলার ইতিহাসে বর্ষা আর বন্যা একাকার। বন্যা না হলেও বর্ষা ঋতুর আগমনে মাঠঘাট, নগর, জনপদ জলে সয়লাব হয়। বাংলার সব নদ-নদীই বর্ষায় প্লাবিত হয়। দুক‚ল ছাপিয়ে পানি ঢুকে পড়ে ফসলের মাঠে, লোকালয়ে, নগরে, বন্দরে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। দরিদ্র মানুষের দুঃখকষ্ট বেড়ে যায়। বিত্তবানরা অবশ্য শীত-বর্ষা দুই-ই উপভোগ করে। আমরা দেখি নব্যধনীদের বর্ষাবরণ ও উদযাপন। এবার কিন্তু বর্ষা ভয়ঙ্কর বন্যা হয়ে এসেছে। দেশের ৩১ জেলার নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত। খোদ রাজধানী ঢাকার আশপাশের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। আগ্রাসী বন্যায় ভেসে গেছে মানুষের ঘরবাড়ি, ফসলের মাঠ, গবাদি পশু, ভেঙে গেছে রাস্তাঘাট, কালভার্ট, ব্রিজ, নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা, স্কুল-কলেজ, আশ্রয়কেন্দ্র। বানের জলে ঘরবাড়ি-ফসলি জমির সঙ্গে ভেসে গেছে জীবনের স্মৃতি আর সুখ। ভরা যৌবনা নদী-জলের ঢেউয়ের ভাঁজে ভাঁজে সব হারানো মানুষগুলোর দুঃখগুলো লুকিয়ে থাকে। অসহায় বাস্তুচ্যুত স্বপ্নহারা মানুষ খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে মানুষ আর পশুতে একসঙ্গে বসবাস। অনাহারে-অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করছে আবালবৃদ্ধবনিতা। প্রান্তিক প্রকৃতিনির্ভর গ্রামীণ মানুষের আজ বড় দুর্দিন। ঘরহীন, আশাহীন নদীগর্ভে ঠিকানা হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো আজ যেন পরিযায়ী পাখি। চোখে কষ্টের নদী। সেখানে শুধুই নোনাপানি। ভিটেমাটি হারানো কৃষকের চোখের পাপড়ি চুইয়ে যে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে তার সঙ্গে মিশে যায় কান্নার নোনাজল। খাবার, খাবার পানির অভাব তার সঙ্গে নানা রোগ- বড় অসহায় বানভাসি মানুষগুলো। বন্যার জল কোনো কোনো শহরের রাস্তায়ও জল খেলা করছে। অন্যরকম সে দৃশ্য আমরা দেখি অনেক বছর আগে আঁকা শহীদ কাদরীর কবিতায়। কবি কাদরী তার ‘বৃষ্টি, বৃষ্টি’ কবিতায় বলেছেন : ‘নামল সন্ধ্যার সঙ্গে অপ্রসন্ন বিপন্ন বিদ্যুৎ মেঘ, জল, হাওয়া,— হাওয়া, ময়ূরের মতো তার বর্ণালি চিৎকার, কী বিপদগ্রস্ত ঘরদোর, ডানা মেলে দিতে চায় জানালা-কপাট নড়ে ওঠে টিরোনসিরসের মতন যেন প্রাচীন এ- বাড়ি! জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় জনারণ্য, শহরের জানু আর চকচকে ঝলমলে বেসামাল এভিনিউ।’ আমরা প্রকৃতিরই অংশ। পরিবেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি ভালো থাকলে আমরাও ভালো থাকি। কিন্তু অনাদিকাল থেকে মানুষের অন্যতম কাজ যেন প্রকৃতিকে ধ্বংস করা। পলি জমে নদীর জলধারণ ক্ষমতা কমে গেছে, খালগুলো খেয়ে ফেলা হয়েছে, নদ-নদী, খালবিল ভরাট করা, দখল করা, নদীকে-বনকে হত্যা করা, বন কেটে-পাহাড় কেটে রাস্তা, অট্টালিকা নগর তৈরি করা, অপ্রয়োজনীয় বাঁধ ও নদী শাসন করে নদীর স্বাভাবিক গতিপথকে রুদ্ধ করা- এসব কারণে আজ প্রাকৃতিক দৃর্যোগ নেমে আসছে। এমন পরিস্থতির জন্য আমরাই দায়ী। উল্লেখ্য, সাগরের পানির উচ্চতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনো বলা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে দেশের এক-তৃতীয়াংশ সাগরের পানিতে তলিয়ে যাবে। তাহলে কি রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশের একটি বড় অংশ হারিয়ে যাবে চিরতরে। রক্তে যার জন্ম তা কি জলে বিনাশ হবে! উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণেই বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্রিনহাউস ইফেক্ট এর জন্য মূলত দায়ী। আর উন্নত দেশগুলোর কারণেই বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বাড়ছে। প্রকৃতি বিনাশী এ তৎপরতা না থামলে প্রকৃতি আর মানুষ একসঙ্গে ধ্বংস হবে। যার লক্ষণ ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। নদ-নদীর, খাল-বিলের মধ্য দিয়ে জলের চলার পথ বিঘি্নত না করলে, খাল-বিল ভরাট না হলে বন্যার প্রকোপ সহনীয় হতো। প্রকৃতিকে ধ্বংস করায় পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। এমনো সময় ছিল মানুষ ঘরে বসে বন্যপ্রাণীর ডাক শুনেছে। আর এখন বনে গিয়ে কান পাতলেও শোনা যায় না। প্রাণীদের অপেক্ষায় দিন গুনতে হয় পর্যটকদের। ক্রমাগত বন উজাড়, অবাধ শিকার আর পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করার কারণে হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণীরা। হারিয়ে যাচ্ছে জীববৈচিত্র্য। পাহাড়, সাগর, নদী, বন-জঙ্গলের প্রতি মানুষের মমতা, ভালোবাসা, দরদ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য সুরক্ষায় সবাইকে উচ্চকণ্ঠ হতে হবে। মানুষ ও বন্যপ্রাণীর চিরায়ত বিরোধের হ্রাস ঘটিয়ে বন্যপ্রাণী ও তার আবাসকে সংরক্ষণ করে প্রাকৃতিক সম্পদকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। বুঝতে হবে- বনের উদ্ভিদ আর প্রাণিকুল আমাদের শত্রু নয় বন্ধু। বন-জল-নদী দিয়ে আঁকা অপরূপা সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝা ও দৈত্যসম ঘূর্ণিঝড়ের দাপটের সামনে বুক চিতিয়ে মানুষের জীবনে ও ঘর-বসতি রক্ষা করে চলেছে। সেই সুন্দরবনকে ভালোবাসা, যত্ন নেয়া এবং রক্ষা করা তো আমাদেরই দায়িত্ব। দরদি সমাজ ও মানবিক পৃথিবী চাইলে পশু-পাখি, গাছপালা, পাহাড়, সাগর, নদী, বন-বনানী সবকিছুর প্রতিই মমতা ও দরদ থাকতে হবে।

আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া : বিশিষ্ট ব্যাংকার ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App