×

সারাদেশ

কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ এখন আতঙ্কের সড়ক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ আগস্ট ২০২০, ০৯:১২ এএম

কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভ এখন আতঙ্কের সড়ক

ফাইল ছবি

কক্সবাজারের স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ ‘ক্রসফায়ারের’ নিরাপদ এলাকায় পরিণত হয়েছে। কথিত বন্দুকযুদ্ধে মৃতদের মরদেহে এখন আতঙ্কের সড়কে পরিণত হয়েছে মেরিন ড্রাইভ। অভিযোগ উঠেছে, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে গ্রেপ্তার বাণিজ্য আর চাঁদাবাজি করছে স্থানীয় পুলিশ। তাদের এই গ্রেপ্তার বাণিজ্যে অতিষ্ঠ টেকনাফবাসী।

শুরুর দিকে বড় বড় অপরাধী ও মাদক কারবারিরা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেলেও সম্প্রতি মানুষের মনে ভয়ের কাঁপন ধরিয়েছে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি পুলিশের চাঁদাবাজির কারণে। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের টাকার চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেকের জীবনও গেছে। সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় নির্মিত মেরিন ড্রাইভে কয়েক দিন আগে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীরই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় ইয়াবাবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর আগে থানার কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেই ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ ছিল। চলছিল ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য।’ রাতবিরাতে ইয়াবা কারবারের অভিযোগ তুলে লোকজনকে আটক করে থানায় আনা হতো। এরপর তাদের ইয়াবার পুঁটলি দেখিয়ে চালান দেয়ার নামে আদায় করা হতো টাকা।

ইয়াবা কারবারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ইতিবাচক অভিযান চলার পর টেকনাফে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের স্থলে জায়গা নেয় লোমহর্ষক ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’। এতে কৌশলেরও রদবদল হয়েছে। যেমন, এখন প্রকাশ্যে কোনো পুলিশ সদস্যকে মাসোহারা আদায়ের কাজে লাগানো হয় না। পথেঘাটে কোনো পুলিশ সদস্য চাঁদাবাজিতে নেই। কিন্তু ভেতরে চলছে ভয়ংকর কারবার। অভিযোগ উঠেছে, যারা ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার হয়, মৃত্যুর আগে তাদের কাছ থেকেও বিপুল চাঁদা আদায় করা হয়।

গত ২৪ জুলাই টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ নিজেই অভিযান চালিয়ে উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক ইয়াবা গডফাদার মৌলভি বখতিয়ার নামের একজন ইউপি সদস্যসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করেন। একদিন পর দুজনের ভাগ্যে জোটে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, মৌলভি বখতিয়ারের ঘর থেকে ১০ লাখ নগদ টাকা এবং ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।

অভিযোগে বলা হয়েছে, টেকনাফের হোয়াইক্যং ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সহসভাপতি মুফিদ আলমকে ক্রসফায়ারের নামে ধরে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করা হয়। একই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাকের আলমকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় ২০০টি ইয়াবা দিয়ে।

সেন্টমার্টিন দ্বীপের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিম ও মোহাম্মদ জুবায়েরকে দ্বীপের পুলিশ ঈদুল আজহার তিন দিন আগে আটক করে ইয়াবা কারবারের অভিযোগে। তাদের দ্বীপ থেকে চালান করা হয় টেকনাফ থানায়। অভিযোগ উঠেছে, তাদের ক্রসফায়ারে দেয়ার ভয় দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। আটক হওয়া আজিমকে লেনদেনের মাধ্যমে ক্রসফায়ার থেকে রেহাই দিয়ে চার হাজার ইয়াবা দিয়ে চালান দেয়া হয় আদালতে। আর জুবায়েরকে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয় চাহিদামাফিক টাকার জন্য।

সূত্র জানায়, শুধু টেকনাফেই গত ২২ মাসে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের হাতে ১৫৬টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মারা গেছে ২০৪ জন। তাদর অর্ধেকের লাশ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভে।

ইয়াবাসহ মাদক পকেটে ঢুকিয়ে হয়রানির বিস্তর অভিযোগ : গত ৩ জুন যশোর সদর উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামের নেছার আলীর ছেলে কলেজ ছাত্র ইমরানকে সাজিয়ালি ফাঁড়ির পুলিশ আটক করে নির্যাতন চালায়। নির্যাতনে ইমরানের কিডনি নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়। এ অবস্থায় পুলিশ অভিযোগ করে, গাঁজাসহ ইমরানকে আটক করা হয়েছে। পরে ইমরানের বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষ থেকে মাদক সেবনের অভিযোগ তোলা হলে হাইকোর্টের নির্দেশে তার ডোপ টেস্ট করা হয়। যশোরের সিভিল সার্জন হাইকোর্টে পেশ করা প্রতিবেদনে ইমরানের শরীরে মাদকের কোনো নমুনা পাওয়া যায়নি বলে জানান ইমরানের বিষয়ে রিট আবেদনকারী আইনজীবী ব্যারিস্টার হুমায়ুন কবির পল্লব। হাইকোর্ট বিষয়টি নিয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। ইমরানের ওপর নির্যাতনের সংবাদে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গত ১১ জুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন এক বিজ্ঞপ্তিতে ঘটনায় দায়ী পুলিশ সদস্যের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছে।

রাজধানীর আদাবর থানার মনসুরাবাদ এলাকার মুদি দোকানি মাহবুব আলম দিদার ও তার স্ত্রী নাজমা বেগমকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে গত বছরের ২৮ নভেম্বর। তাদের ৩৭০ পিস ইয়াবাসহ আটক করা হয় বলে মামলায় বলা হয়। ওই দম্পতির অভিযোগ, পুলিশ তাদের নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে মাদকের মামলা দিয়েছে। হাইকোর্ট এই দম্পতিকে এরই মধ্যে জামিন দিয়েছেন। ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থানার ওসিসহ সাত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ‘পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে’ হয়রানির অভিযোগে আদালতে মামলা করেন মেহেরুন্নিসা নামের এক নারী। তার অভিযোগ, ছেলে মেহেদি হাসানকে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ তিন লাখ টাকা দাবি করে। তিনি টাকা দিতে অস্বীকার করলে ছেলের পকেটে ৪০টি ইয়াবা পাওয়ার অভিযোগে মামলা দেয় পুলিশ।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতি মাসেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে দেশের বিভিন্ন কারাগার পরিদর্শনে যাওয়া হয়। কারাগারে গিয়ে পরিদর্শন কমিটি সাধারণ বন্দিদের সঙ্গে কথা বলে। এ সময় মাদক মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যাওয়া অনেক বন্দি অভিযোগ করে, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App