×

জাতীয়

হতবিহ্বল বাঙালি জাতির প্রথম প্রতিবাদ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ আগস্ট ২০২০, ০৯:৪৩ এএম

‘সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে,/ ভালোবাসা আছে, শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল/ আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি/ আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।’ বাঙালির চিন্তা, চেতনা, মননে বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসের বাঁকে একাকার হয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ নাম দুটিকে চিরতরে মুছে দেয়ার জন্য দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীরা বাংলার আকাশে সেঁটে দিয়েছিল পিতৃহত্যার কলঙ্ক। ইতিহাসবিদ ও বঙ্গবন্ধু গবেষকদের মতে, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতা হত্যাকা-ের পর শোকে মুহ্যমান, ভয়ে বিহ্বল জাতি সম্মিলিত প্রতিবাদ করার শক্তি হারিয়েছিল।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি, কুখ্যাত ইনডেমিনিটি অধ্যাদেশে দেশজুড়ে গুমরে কাঁদছিল মানবতা। জাতীয় ৪ নেতা এবং তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাকসহ আওয়ামী লীগের মূল নেতারা তখন কারাগারে। কেউ কেউ আত্মগোপনে। বাকশালের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে দ্বিধা করেননি। ছাত্রনেতারা বাকশাল নেতাদের কাছ থেকে আশাব্যঞ্জক কিছু না পেয়ে হতাশ ছিলেন। অন্যদিকে প্রতিবাদ ভেস্তে দিতে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরপর টানা প্রায় ২ মাস রমজান ও শারদীয় দুর্গাপূজা দেখিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে পাথর সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলা ছিল অন্যন্ত দুরূহ। তবে বন্দুকের নল উপেক্ষা করে বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন অনেকেই। বেঁচে থাকা প্রতিবাদীদের সহ্য করতে হয়েছে জেল-জুলুম। হত্যাকা-ের সেই তিমির অন্ধকারেই প্রতিরোধের চেষ্টা করে জীবন দিয়েছেন কর্নেল জামিল।

কাদের সিদ্দিকীর ২২ মাস ‘প্রতিরোধ যুদ্ধ’ : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে প্রথম প্রতিবাদ হয় কিশোরগঞ্জ ও বরগুনায়। প্রান্তিক সাধারণ মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নেমে সামরিক সরকারের রোষানলে পড়েন। ‘নিষিদ্ধ’ বঙ্গবন্ধু নিয়ে প্রকাশ্যে কবিতা আবৃত্তির জন্য কারাগারে যেতে হয় নির্মলেন্দু গুণকে। ৭ দিন পুলিশ কাস্টডিতে রাখা হয়েছিল তাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- পরবর্তী প্রতিবাদের নাম কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। একাত্তরের দুঃসাহসিক কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান টাইগার সিদ্দিকী ১৭ হাজার মুজিবভক্তকে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধে নামেন। ২২ আগস্ট প্রথমে ৬ জন সঙ্গী নিয়ে জামালপুর সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢোকে ‘হত্যাকারী অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে’ সশস্ত্র প্রতিরোধের ডাক দেন। অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে এই বাহিনীর একটি গ্রুপ যমুনা নদী হয়ে নৌপথে বাংলাদেশে আসে। সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের নিশ্চিন্তপুর চরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে তাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এতে বগুড়া জেলা যুবলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক খসরু নিহত হন। পরে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট সীমান্তে গোবড়াকুড়া গ্রামে প্রবোধ দিওর বাড়িতে প্রতিরোধব্যুহ তৈরি করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়া হয়। প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হেডকোয়ার্টার ছিল বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ভারতের তিন মাইল ভেতরে চান্দুভূইয়ে। ‘জাতীয় মুক্তিবাহিনী’ নামে তাদের লোগো ও ব্যাজে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ব্যবহার করা হয়। ৭টি ফ্রন্টে বিভক্ত হয়ে তারা দীর্ঘ ২২ মাস প্রতিরোধ যুদ্ধ করেন। এতে নিহত হন ১০৪ জন। আহত হন কয়েকশ যোদ্ধা। এছাড়া প্রতিশোধ ও প্রতিরোধের ডাক দিয়ে শেরপুরের ৫০০ প্রতিবাদী তরুণের বিদ্রোহ ও লড়াই আলোচিত ঘটনা।

প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পুরো জাতির মতোই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে ক্যাম্পাস। তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্রনেতারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদের চেষ্টা করলেও সেনা সদস্যদের কড়া টহলের কারণে ব্যর্থ হন। ডাকসুর তৎকালীন ভিপি, বর্তমানে কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ছাত্রনেতারা ওইদিনই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদের চেষ্টা করেন। কিন্তু সেনা সদস্যদের কড়া টহলের কারণে তা ব্যর্থ হয়। এরপরই ঈদ ও পূজা মিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ২ মাস বন্ধ ঘোষণা করা হয়। প্রকাশ্য কর্মসূচি না হলেও জাতীয় ছাত্রলীগ নেতারা একের পর এক বৈঠকে করেন। টানা ৬৭ দিন বন্ধ থাকার পর ১৮ অক্টোবর খোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কারফিউ, পুলিশ-বিডিআরের টহলসহ গোয়েন্দা তৎপরতার মধ্যেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগের রাতে কলাভবন, সায়েন্স এনেক্স ও কার্জন হলের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয় ১৫ আগস্ট থেকে ‘নিষিদ্ধ’ ৩টি স্লোগান জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু এবং এক মুজিবের রক্ত থেকে লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে। ঢাকায় প্রকাশ্য প্রতিবাদ হয় ২০ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে সংগ্রামী ছাত্র সমাজের ব্যানারে।

৪ নভেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় সিনেট সভায় হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বক্তব্য রাখেন চ্যান্সেলর। ছাত্র প্রতিনিধি ইসমত কাদির গামা, মাহবুব জামান ও অজয় দাশগুপ্ত আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করলে সর্বসম্মতভাবে তা অনুমোদিত হয় এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ওইদিন ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যায়। কলাবাগানের মোড় থেকে মিছিলে যোগ দেন জেনারেল খালেদ মোশাররফের মা। ৩২ নম্বরে তালাবদ্ধ গেটের সামনে ফুল দিয়ে শোক জানানো হয়। বঙ্গবন্ধু এবং জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার প্রতিবাদে ৫ নভেম্বর ঢাকায় আধা বেলা হরতালের ডাক দেয়া হয়।

হরতাল শেষে বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে গায়েবানা জানাজা শেষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠা; বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা; বাংলাদেশ বেতারের নাম পুনর্বহালসহ খুনিদের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়। প্রতিবাদে মাঠে সরব ছিলেন ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান, নূহ-উল-আলম লেনিন, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন, কাজী আকরাম হোসেন, বাহলুল মজনুন চুন্নু, মৃণাল সরকার, রবিউল আলম মুক্তাদির, খন্দকার শওকত হোসেন, মমতাজ হোসেন, কাজল ব্যানার্জি প্রমুখ।

প্রচারপত্রে প্রতিবাদ : ৪ নভেম্বর ছাত্র-জনতার মিছিলের জন্য ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ শিরোনামে একটি ছোট লিফলেট ছাপানো হয়। ওই সময় মোহাম্মদপুরে লিফলেটসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজল ব্যানার্জি (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক) ও শওকত হোসেন। এজি অফিসে লিফলেট বিলির সময় গ্রেপ্তার হন চামেলীবাগের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আবু সিদ্দিক ও শাহ জামাল। তাদের ওপর অমানুসিক নির্যাতন চালানো হয়।

সিপিবির ‘বিদেশি সংবাদপত্র ও বেতারে বাংলাদেশ’ নামে বুকলেটে সানডে টাইমসে দেয়া আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক-রশিদ চক্রের খুনের পরিকল্পনা ও হত্যাযজ্ঞে নেতত্বের কথা তুলে ধরা হয়। এছাড়া ‘চক্রান্ত রুখে দাঁড়াও, খুনিদের শাস্তি দাও’ ‘ওদের ক্ষমা নেই’ শিরোনামে লিফলেট প্রচার করে সিপিবি।

সংসদ সদস্যদের প্রতিবাদ : খুনি খন্দকার মোশতাক ১৬ অক্টোবর এমপিদের বৈঠক ডাকে। সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, অধ্যাপক আবু সাইদসহ ১০ জন এমপি বৈঠক বর্জন করেন। যোগ দেন ২৭০ জন এমপি। তেজগাঁও এমপি হোস্টেলে আয়োজিত ওই বৈঠকে খুনিচক্র ফারুক, রশীদ, হুদা, ডালিম, শাহরিয়ার, নূর উপস্থিত থাকায় বৈঠকের শুরুতেই কয়েকজন এমপির তীব্র প্রতিবাদে তারা চলে যেতে বাধ্য হয়। এমপিদের কয়েকজন হত্যাকা-ের নিন্দা জানান। প্রয়াত এডভোকেট সিরাজুল হক মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ অভিহিত করে বলেন, আমার প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু। আপনি আমার প্রেসিডেন্ট নন। আপনি খুনি। অন্যদিকে মাঠে সরব ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা ও সংসদ সদস্য জহিরুল কাইয়ুম, মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন, ন্যাপের পঙ্কজ ভট্টাচার্য, চৌধুরী হারুনুর রশীদ প্রমুখ।

দেশের বাইরে প্রথম প্রতিবাদ : বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরের মারদেকা টুর্নামেন্টে ছিল জাতীয় ফুটবল দল। বঙ্গবন্ধু ও তার পুত্র ক্রীড়ানুরাগী, আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা শেখ কামালের হত্যাকা-ের সংবাদে সালাহউদ্দিন ও চুন্নুদের উদ্যোগে বাংলাদেশের খেলার দিন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং খেলার শুরুতে খেলোয়াড়রা এক মিনিট নীরবতা পালন করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App