×

জাতীয়

থানায় রহস্যময় বিস্ফোরণ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২০, ০৯:১৩ এএম

থানায় রহস্যময় বিস্ফোরণ

প্রতীকী ছবি।

ওয়েট মেশিনে নতুন ধরনের বোমা চার পুলিশ সদস্যসহ আহত ৫ জন দায় স্বীকার করেছে জঙ্গি আইএস
হঠাৎ করে রহস্যঘেরা বোমা বিস্ফোরণে কেপে উঠেছে রাজধানীর পল্লবী থানা। সকালের নিস্তব্ধতার মধ্যে বোমার বিকট শব্দে গোটা এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গতকাল বুধবার সকালের এ ঘটনায় আহত হয়েছেন পুলিশের ৪ সদস্যসহ ৫ জন। আহতদের মধ্যে একজনের বাঁ-হাতের কবজি ও ডান হাতের আঙুল বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ওয়েট মেশিনের ভেতরে বিশেষ কায়দায় বসানো একেবারেই নতুন ধরনের এ বোমার সঙ্গে গতকালই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রথম পরিচয় ঘটল। স্থানীয় একজন রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্যে এই বোমা তৈরি করা হয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত করেছে। বিস্ফোরণের ঘটনার পর পল্লবী থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ ছিল। কয়েক ঘণ্টা পর থানায় জিডি বা মামলা নেয়াসহ স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দাবি করেছেন এর সঙ্গে জঙ্গিরা জড়িত নয়। তবে এই হামলার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। অনলাইনে জঙ্গি কার্যক্রম পর্যবেক্ষণকারী মার্কিন সাইট ইন্টেলিজেন্ট গ্রুপ গতকাল রাতে তাদের ওয়েবসাইটে এ তথ্য জানিয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, পল্লবী থানায় বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা নেই। আমি মনে করি না, এই ঘটনার সঙ্গে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতা আছে। যাদের আটক করা হয়েছে তারা ডাকাত দলের সদস্য। তাদের কাছে থাকা কিছু একটার বিস্ফোরণ হয়েছে। এ ঘটনা তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার শফিকুল ইসলাম জানান, আটককৃতরা কী উদ্দেশ্যে এমন বোমা তৈরি করেছিল তা জানার চেষ্টা চলছে। পলাতকদের আটকের অভিযান চালাচ্ছে একাধিক টিম। এ ঘটনায় ৩ জন গ্রেপ্তার রয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এখন পর্যন্ত এ ঘটনাটি কোনো সন্ত্রাসবাদী বা জঙ্গি তৎপরতা মনে হয়নি। আর গ্রেপ্তারকৃতরা অপরাধ চক্রের সদস্য। গ্রেপ্তারকৃতদের অপরাধের পরিকল্পনা ছিল। সেটা হতে পারে কাউকে হত্যা করা, সম্পত্তিগত বা ডাকাতি করা। এছাড়া বিস্ফোরক পালানো বা ভিকটিমকে বিভ্রান্ত করা বা পুলিশের হাত থেকে পালাতে ব্যবহৃত হয়। এজন্যই বিস্ফোরক এনেছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তিনি বলেন, ঈদ ও আগস্ট মাস সামনে রেখে কেউ যাতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে না পারে সেজন্য পুলিশ সতর্ক রয়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) ওয়ালিদ হোসেন বলেন, বোমা বহনকারী যে ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নেয়ার পর ওই বিস্ফোরণ ঘটে, তারা ‘ভাড়াটে খুনি’। পুলিশের কাছে তথ্য ছিল তারা পল্লবীর স্থানীয় একজন রাজনৈতিক নেতাকে হত্যা করবে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে। তদন্তের পর বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে। আটক ৩ জন হচ্ছেন শহিদুল ইসলাম (২৩), মোশাররফ হোসেন (২৬) ও রফিকুল ইসলাম (২৫)। তাদের থানা থেকে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। পল্লবী থানার উপপরিদর্শক আকলিমা আক্তার ৩ জনকে গোয়েন্দা কার্যালয়ে পাঠানোর তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তবে কাকে তারা হত্যার পরিকল্পনা করেছিল, সে বিষয়েও কিছু বলেননি পুলিশ কর্মকর্তারা। এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুপুরে বলেন, কালশী কবরস্থানের কাছে ‘একদল সন্ত্রাসী’ অবস্থান করছে খবর পেয়ে রাত ২টার দিকে পল্লবী থানা-পুলিশ সেখানে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই ৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। আরো কয়েকজন ছিল যারা পালিয়ে যায়। গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ২টি পিস্তল, ৪ রাউন্ড গুলি এবং একটি ডিভাইস পাওয়া যায়, যেটি দেখতে ওজন মাপার মেশিনের মতো। থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে গ্রেপ্তারকৃত ৩ জন পুলিশকে জানায়, ওই ওজন মাপার যন্ত্রে ‘বোমা রয়েছে’। এরপর বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলকে খবর দেয়া হলে তারা এসে ডিউটি অফিসারের কক্ষে ওই ওজন মাপার মেশিন পরীক্ষা করেন। পরে আরেকটি বিশেষজ্ঞ দলকে ডাকা হয়, তারা পৌঁছানোর আগেই বিস্ফোরণ ঘটে। পুলিশ কর্মকর্তা কৃঞ্চপদ রায়ের ভাষ্যমতে, সেখানে আরো কয়েকজন ছিল যারা পালিয়ে যায়। সেখান থেকে ২টি আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলির সঙ্গে একটি ডিভাইস উদ্ধার করা হয়, যেটি ওয়েট মেশিনের মতো। ওজন মেশিনের মতো কোনো জিনিস কেন তাদের কাছে থাকবে, সেটা কী প্রশ্ন ওঠায় রাতেই বোম্ব^ ডিসপোজাল ইউনিটকে খবর দেয়া হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে বোম্ব^ ডিসপোজাল ইউনিট থানায় চলে আসে। তারা ওই ডিভাইসটিকে পরীক্ষা করে। সেটা দেখার পর তারা আরো বিশদভাবে ডিভাইসগুলো খতিয়ে দেখতে আরো কিছু পর্যবেক্ষণ মেশিনসহ আসার জন্য ইউনিটের অন্য সহকর্মীদের খবর দেয়। এক্সপার্র্ট টিম এসে পৌঁছানোর পর তারা পুরো এলাকা সিকিউরড করে। প্রাথমিক স্তরে থেকে তারা ধারণা দেয় যে, আরো কিছু বিস্ফোরক অবিস্ফোরিত থাকতে পারে। এরপর আরো ২টি অবিস্ফোরিত এক্সপ্লোসিভ নিষ্ক্রিয় করে থানা ভবন নিরাপদ করা হয়। কাউন্টার টেরোরিজম এন্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইমের স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের অতিরিক্ত উপকমিশনার রহমত উল্লাহ বলেন, বিস্ফোরণের আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) জাতীয় কিছু বিস্ফোরিত হয়েছে। এদিকে বিস্ফোরণের ধাক্কায় থানার দোতলার জানালার কাচ ভেঙে যায়, আশপাশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয় আতঙ্ক। পল্লবী থানার পরিদর্শক (অপারেশন্স) এমরানুল ইসলামসহ ৫ জনকে আহতাবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশের দাবি, মিরপুর কেন্দ্রিক একটি অপরাধ চক্রের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত মাপ যন্ত্র সাদৃশ্য বস্তুর বিস্ফোরণেই বুধবার সকালে এমন ঘটনা ঘটেছে। পরিষ্কার ধারণা না দিলেও কাউকে হত্যা করা, সম্পত্তিগত দ্ব›দ্ব বা ডাকাতির পরিকল্পনা ওই চক্রের ছিল বলে জানানো হয়। ডিএমপি ও ঢামেক হাসপাতাল সূত্রমতে, গতকাল সকাল ৭টার দিকে থানার ভেতর এই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পরে অবিস্ফোরিত আরো ২টি বোমা নিষ্ক্রিয় করে বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিরা হলেন পল্লবী থানার পরিদর্শক (অভিযান) ইমরানুল ইসলাম, উপপরিদর্শক (এসআই) সজীব আহমেদ, উপপরিদর্শক (এসআই) রুমি, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) অঙ্কুর চন্দ্র ও থানায় ফুট-ফরমায়েশের কাজে নিয়োজিত রিয়াজ। রুমি ও রিয়াজ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ইমরানুল ও সজীব চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। অঙ্কুর জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন। ঢামেক হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ব্লকের আবাসিক সার্জন আলাউদ্দিন জানান, রুমির বাঁ-হাতে স্প্রিন্টারের আঘাত রয়েছে। রিয়াজের হাতে আঘাত আছে। তার শরীরও ঝলসে গেছে। ইমরানুলের পায়ে স্প্রিন্টারের আঘাত ও সজীবের কানে শব্দের আঘাত লেগেছে। এছাড়া অঙ্কুরের চোখে আঘাত লেগেছে। তাকে জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। আহত সবাই আশঙ্কামুক্ত। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগের আবাসিক সার্জন (আরএস) ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, পল্লবী থানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় আহত সিভিলিয়ান রিয়াজের অবস্থা গুরুতর। তার বাম হাতের কবজি বিস্ফোরণে ক্ষত-বিক্ষত হওয়ায় অস্ত্রোপচারের সময় তা কেটে ফেলা হয়েছে। ঘটনার পর আহতদের ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হলে ২ জন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। একজনকে চক্ষু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। আহত শিক্ষানবিশ উপপরিদর্শক (পিএসআই) রুমি ও সিভিলিয়ান রিয়াজ ঢামেকে চিকিৎসাধীন। ডা. মোহাম্মদ আলাউদ্দিন জানান, রিয়াজের বাম হাতের করজি পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়েছে। এছাড়া তার ডান হাতের একটি আঙুল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সেটিও রাখা যায়নি। তার পেটে বড় ধরনের ইনজুরি আছে। তিনি আরো বলেন, পুলিশ সদস্য রুমির পায়ে ও হাতে ইনজুরি আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা সবাই স্প্রিন্টারের আঘাতে আহত হয়েছেন। প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে কুরবানির ঈদ ও আগস্ট মাসকে সামনে রেখে দেশে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা রয়েছে জানিয়ে পুলিশের সব ইউনিটকে সতর্ক করেছিল পুলিশ সদর দপ্তর। এমতাবস্থায় থানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App