×

সারাদেশ

গাইবান্ধায় ঈদ আনন্দ নেই বানভাসীদের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২০, ০৫:৩২ পিএম

গাইবান্ধায় ঈদ আনন্দ নেই বানভাসীদের
আগামী শনিবার পবিত্র ঈদুল আজহা। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান। মহামারী করোনা আর ৩৫দিন ধরে বন্যার পানিতে ঘরবাড়ি ডুবে থাকা গাইবান্ধার ৬টি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়নের ২৬৭টি গ্রামের ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৬ মানুষের এবার কোরবানীর ঈদ নিরানন্দে পরিনত হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র, উঁচু স্থান ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রিতরা কবে বাড়ি ফিরতে পারবে তারও নিশ্চয়তা নেই। তাদের মাঝে ঈদ নিয়ে কোন ভাবনা নেই। ঈদের কথা বলতেই তারা ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বন্যা দুর্গত এলাকায় শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্য ও মহিলাদের পয় নিস্কাশনের সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করায় ঈদ নিয়ে ভাববার সময় তাদের নেই। নদ-নদীর সামান্য পানি কমলেও জীবন বাঁচানোই যেন তাদের একমাত্র সাধনায় পরিনত হয়েছে। গাইবান্ধায় সবগুলো নদীর পানি কিছুটা কমলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার উপরে এবং ঘাঘট নদীর পানি বিপদসীমার ২৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৬ জুন রাতে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমা দ্রুত অতিক্রম করায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের সৈয়দপুর, ভাষারপাড়া, মধ্যকঞ্চিপাড়া, মাঝিপাড়া গ্রাম বন্যার পানিতে ডুবে যায়। সেখানকার শত শত পরিবারের মানুষ গুলো রাতারাতি ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ রিং বাঁধে আশ্রয় নেয়। প্রায় ৩৪ দিন অতিবাহিত হলেও বাঁধে আশ্রিত লোকজন সরকারি ত্রাণ পাচ্ছেন না। তাদের অভিযোগ চেয়ারম্যান মেম্বাররা তাদের খোঁজ-খবর রাখছেন না। এমনকি তারা কোন ত্রাণ সহায়তা পাচ্ছেন না। তারা জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ তুলেছেন। সরেজমিন ঘুরে বন্যার কারণে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়া ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের ভাষারপাড়া গ্রামের রমিছা বেগমের সাথে কথা হয়। তার বাড়িঘর ব্রহ্মপুত্রের পানিতে ডুবে যাওয়ায় পঙ্গু স্বামী বাবলু মিয়া, ৮ম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে এবং ছোট ছেলেকে নিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। তার সাথে কথা হয় তিনি বলেন, বানের(বন্যার) পানি আসার একমাস পার হোলো কষ্ট করি বান্দোত(বাঁধ) পলিথিন দিয়া ডেরা তুলি ছাওয়া-পাওয়া আর পংগু স্বামীক নিয়া খায়া না খায়া কষ্টো করি আছি। আজ পর্যন্ত কোন চেয়ারম্যান, মেম্বার দেখপ্যার(দেখতে) আসে নাই, খোঁজও নেয় নাই। এক মুঠ চাউল কেউ দিলো না বাবা। সামনে ঈদের দিন কি করবেন? এমন প্রশ্ন করলে রমিছা বগেম বলেন, হামরা(আমরা) গরীব মানুষ। হামার ঈদ আছে। আজও যেমন ঈদের দিনও তেমন। বন্যার কারণে রমিছা বেগমের মতো বাঁধে আশ্রয় নেয়া ভাষারপাড়া গ্রামের ইসোভান বেওয়া, মোর্শেদা বেগম, শাহিনুর বেগম, জহুরা বেগম, হালিমা খাতুন, আসমা খাতুন, আয়শা বেগম, অজিফা খাতুন, নাজিভান বেগম, আলফা বেগমদের একই অভিযোগ তারা এখন পর্যন্ত সরকারি কোন ত্রাণ পায়নি। তাদের কেউ খোঁজ নেয়নি। কাল বাদে পরশু ঈদ। ঈদের দিন কি করবেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে কয়েকজন চোখের পানি ফেলে বললেন, খায়া না খায়া, অর্ধাহারে অনাহারে কাটামো বাবা। একই গ্রামের আব্দুস সোবহান, সাথি বেগম, রাবেয়া বেগম, কহিনুর বেগম, মঞ্জুরানী, ববিতা খাতুন অভিযোগ করে বলেন, করোনার কারণে সাড়ে চার মাস থাকি কর্ম নাই। ঘরবাড়ি বন্যায় ডুবে আছে একমাস ধরি। বাঁধোত পলিথিনের ঘর করি কোন রকমে থাকপার নাকছি। খালি শুনি সরকার করোনা এবং বন্যায় হামাক সহোযোগিতা করবে। দুইবার-তিনবার করে ছবি আর ভোটার আইডি কার্ড নিয়া গেলো। একবার ছবি আর কাগজ দিতে ২৫ থেকে ৩০ টাকা নাগে(লাগে)। ওইযে ছবি নিয়া গেল তারা আর আসলো না। হামাক কিছু কলো(বললো) না। হামাক কিছু দিলো না। তারা আরও বলেন, বান্দোত কেউ একটা টিউকল বসে দিলো না। পায়খানাও তৈরি করি দিলো না। মেয়ে মানুষ গুলা কতো কষ্ট করব্যার নাকছে। কিআর কমো বাবা। সাঘাটা উপজেলার পুটিমাটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেয়া ভুলু বেওয়া জানান, তার স্বামী মারা গেছেন এক যুগ আগে। দীর্ঘ চেষ্টার পরও কপালে জোটেনি বয়স্ক কিংবা বিধবা ভাতার কার্ড। চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে ১০ হাজার টাকা চান। ফলে কষ্ট করেই জীবন চলছে তার। টানা এক মাসের বন্যার মাঝে ঈদ আসছে। ধনীরা যখন ঈদের আনন্দে থাকবে তখন তার চুলায় আগুন জ্বলতেও পারে নাও পারে। ওয়াপদা বাঁধে আশ্রয় নেয়া ভুলু বেওয়ার মতো লাইলী, হালিমা ও মর্জিনা বেওয়ারও একই অবস্থা। লাইলী বেগম বলেন, ঈদের দিন কোরবানির গোস্ত কপালে জুটবে না। আমরা কতটা কষ্টে আছি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। ঘরবাড়িতে কোমর পানি; তাই বাঁধের ওপর ছাপরা ঘর তুলে আছি। রাত জেগে ভাবি কাল সকালে কী খাবো। দিন যায় রাত আসে, তবুও কষ্ট শেষ হয় না। তিনি বলেন, সরকারি সাহায্যের জন্য গেলে মেম্বাররা বলেন, ‘তুমি আমার ভোটার না।’ এভাবেই দিন যাচ্ছে। ছেলে-মেয়েরা কান্না করে নতুন কাপড়ের জন্য, কোথায় পাবো? সংসার চলে না। ঈদে আনন্দ আসবে কীভাবে? মর্জিনা বেওয়া বলেন, আমাদের কোনো ঈদ নেই। আজ যেমন, ঈদের দিনটাও তেমন। জীবন বাচাঁনো এখন আমাদের জন্য কষ্টকর। আমাদের আবার কিসের ঈদ, ঈদ তো ধনীদের। ঘরে হাঁটু পানি। পরপর তিনবার বন্যা হলো। বন্যার পানি কমে, আবার বাড়ে। বন্যার কবলে জীবন শেষ। গাইবান্ধায় সবগুলো নদীর পানি কিছুটা কমলেও ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৫৮ সেন্টিমিটার ও ঘাঘট নদীর পানি ৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বালুয়া গ্রামে বাঙ্গালী নদীর বাঁধ ভেঙে ৫টি ইউনিয়নের ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ফলে জেলার বন্যা পরিস্থিতির কোথাও উন্নতি আবার কোথাও অবনতি হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের দেয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ি জেলার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি, সাঘাটা, সাদুল্যাপুর, গোবিন্দগঞ্জ ও সদর উপজেলাসহ ৬টি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়নের ২৬৭টি গ্রাম বন্যা কবলিত হয়েছে। এসব এলাকার ২ লাখ ৫০ হাজার ৭৮৬ ব্যক্তি বন্যার ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দি হয়েছে। বন্যার কারণে ৩৫ হাজার ৫৫১টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইদ্রিস আলী জানান, তিন দফা বন্যায় এ পর্যন্ত বন্যার্তদের মধ্যে ৬১০ মেট্রিকটন চাল, জিআর নগদ ১৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, শিশু খাদ্য বাবদ ৪ লাখ, গো-খাদ্য বাবদ ৯ লাখ টাকা ও ৫ হাজার ৬৫০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App