×

মুক্তচিন্তা

ঈদুল আজহায় আমাদের করণীয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ জুলাই ২০২০, ০৯:২৪ পিএম

করোনা মহামারির মধ্যেই ভয়াবহ বন্যায় কবলিত দেশের বিভিন্ন জনপদ। ইতোমধ্যে অর্ধকোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেকের ফসলি জমি ডুবে গেছে। ফলে তারা খুবই বিপন্ন অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। করোনার কারণে জীবিকা হারানো অনেকেই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরেছেন। স্থানীয়ভাবেও অনেকের আয়রোজগার বন্ধ। অনেকের জীবনে চরম বিপর্যয় ডেকে এনেছে। উৎসব-আনন্দ সবই আজ সীমিত-বিধিবদ্ধ। তবুও সময় তো থেমে থাকে না, সময়ের পথ বেয়ে আসছে পবিত্র ঈদুল আজহা। এমন পরিস্থিতিতে আগামীকাল সারাদেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। আমাদের এই সমাজে সব উৎসবই সামাজিক উৎসব। সবাই চায় যার যার মতো করে সবার সঙ্গে উৎসবে মিলে যেতে। উৎসব মানুষকে আত্মকেন্দ্রিকতার বলয় থেকে বের করে মিলনমেলায় মিলিয়ে দেয়। কিন্তু এখন সে মিলনে বাদ সেধেছে কোভিড-১৯ নামক আগ্রাসী এক ভাইরাস। ‘সামাজিক দূরত্ব’ মানুষের সামাজিক মিলনকে সীমিত করে দিয়েছে। মানুষ নতুন স্বাভাবিকতায় নতুন রীতিতে উৎসব উদযাপনের চেষ্টা করছে। ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়। কারণে ও অকারণে বদলায়, সকাল ও বিকালে বদলায়।’ মুনীর চৌধুরীর এ বিখ্যাত উক্তি মানবজীবনের বড় সত্য। তবে করোনার কারণে আজ শুধু ব্যক্তিমানুষ নয় মানুষের জীবন-জীবিকা, সামাজিক সম্পর্ক, উৎসব-আনন্দ, অর্থনীতি, শিষ্টাচার সবই বদলে গেছে। মুসলমানদের বছরে দুটি ঈদ : ঈদুল ফিতর আর ঈদুল আজহা। করোনাকালেই পালিত হয়েছে ঘরবন্দি ঈদুল ফিতর। করোনা কবে যাবে আমরা জানি না। ঈদুল আজহা বা কুরবানির ঈদও করোনাকালেই পালন করতে হবে। আমরা আশা আর স্বপ্ন নিয়ে বাঁচি। সময় যতই বিরূপ হোক তবুও মানুষ নতুন স্বপ্ন দেখে, আশায় বাঁধে বুক। করোনার এ ঘোর-অমানিশা শেষে আসবে নতুন ভোর। এ আশাতেই স্বাগত ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহার অন্যতম বিষয় পশু কুরবানি। কুরবানি একটি ইবাদত। ইসলামের সব ইবাদত ও বিধানই মানুষের জন্য কল্যাণকর। এই কল্যাণ জাগতিক এবং পরকালীন। কুরবানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম মিল্লাতের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও তাঁর শিশুপুত্র ইসমাইলের ত্যাগ ও উৎসর্গের অনুপম অনন্য ইতিহাস। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে হজরত ইব্রাহিম (আ.) ওপর নির্দেশ এলো তাঁর প্রিয় পুত্র কুরবানির বা উৎসর্গের। তিনি তাঁর পুত্রকে বললেন, ‘প্রিয় পুত্র আমি স্বপ্নে দেখেছি, তোমাকে জবাই করছি। এখন তোমার মতামত বল।’ নবীর ছেলে, ভবিষ্যতের নবী। বয়স অল্প হলেও বুঝে ফেললেন এটা মহান আল্লাহপাকের ওহি এবং আল্লাহর রাহে নিজেকে উৎসর্গ করার সর্বোত্তম সুযোগ। পুত্র ইসমাইল পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.) এর ছুরির নিচে মাথা পেতে দিলেন। উৎসর্গ, স্রষ্টার দাসত্ব আর আত্মসমর্পণের এর চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে। পিতা-পুত্র একই চেতনা আর প্রেরণায় উজ্জীবিত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) ছুরি চালালেন একান্ত প্রিয় শিশুপুত্র ইসমাইলের গলায়। আল্লাহপাকের উদ্দেশ্যে পিতা-পুত্রের ত্যাগের কী অনন্য দৃষ্টান্ত। আল্লাহ খুশি হন। আল্লাহর কুদরতে পুত্রের বদলে কুরবানি হয় পশু। ‘প্রিয় বস্তু’ উৎসর্গের চরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন হজরত ইব্রাহিম (আ.) আর ধৈর্যের পরম পরীক্ষায় পাস করেন হজরত ইসমাইল (আ.)। এই অনন্য ত্যাগের মহিমাকে স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে ঈদে পশু কুরবানির মাধ্যমে। পিতা-পুত্রের সেই অমর স্মৃতিকে মানবজাতির ইতিহাসে জাগরুক রাখতে প্রতি বছর তাঁদের অনুসরণে পশু কুরবানির নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগত ঈদুল আজহায় সারা বিশ্বের মুসলমানরা দুই হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ঐতিহ্যের পুনরাবৃত্তি করে যার যার সাধ্যমতো পশু কুরবানি করবে। ঈদুল আজহা একদিকে ত্যাগের পরীক্ষা অন্যদিকে আনন্দের উৎসব। পশু কুরবানি দেয়া সামর্থ্যবান মুসলিমের ওপর ওয়াজিব বা বিশেষ কর্তব্য। পশু কুরবানির মাধ্যমে ত্যাগ আর উৎসর্গের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মহান আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি অর্জনই কুরবানির মূল উদ্দেশ্যে। কুরবানি দেয়া পশুর রক্ত-মাংস কিছুই স্রষ্টার কাছে পৌঁছে না, শুধু পৌঁছে তাকওয়া। অনেক মুসলিম এটি বুঝতে না পেরে ত্যাগের উৎসবকে ভোগ আর প্রদর্শনীর মহড়ায় পরিণত করে। অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বা মানুষের বাহবা কুড়ানোর জন্য কুরবানির বড় পশু কেনাটা অর্থ-বিত্তের উৎকট প্রদর্শনী বৈ অন্য কিছু নয়। এটা ধর্ম ও ত্যাগ কোনোটিই নয়। এটা ভোগ আর প্রদর্শনী। বিত্তের প্রতিযোগিতা নয়, বৈভবের প্রদর্শনী নয়, ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে ধর্মীয় ভাব-গাম্ভীর্য বজায় রেখে কুরবানি করাই আসল কুরবানি। পশু জবাইয়ের সঙ্গে সঙ্গে মনের পশুকেও কুরবানি দিতে পারলেই ত্যাগের পরীক্ষায় পাস করে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। কেবল গোশত খাওয়াই এ কুরবানির উদ্দেশ্য নয় বরং কুরবানির পশুর মতো নিজেদের পশুত্বকে বলি দেয়ার শিক্ষাও আমরা এ থেকেই পেয়ে থাকি। আল্লাহপাক বলেছেন, ‘এগুলোর মাংস বা এদের রক্ত কখনো আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, বরং তার কাছে তোমাদের পক্ষ থেকে তাকওয়া পৌঁছে।’ (সুরা হাজ, আয়াত : ৩৭) হজরত যায়েদ ইবনে আরকাম (রা.) বলেন, একদিন মহানবীর (সা.) সাহাবিরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! এ কুরবানি কি? হুজুর (সা.) উত্তর দিলেন, তোমাদের পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সুন্নত। তারা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, এতে আমাদের কি পুণ্য আছে, হে আল্লাহর রাসুল? হুজুর (সা.) বললেন, কুরবানির পশুর প্রত্যেক লোমের জন্য একটি করে পুণ্য আছে। তারা আবার জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! পশমওয়ালা পশুর পরিবর্তে কি হবে? অর্থাৎ এদের পশম তো অনেক বেশি। হুজুর (সা.) বললেন, পশমওয়ালা পশুর প্রত্যেক পশমের পরিবর্তে একটি পুণ্য রয়েছে’ (ইবনে মাজাহ)। একটি জাতির ভাষা, ধর্ম, উৎসব, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য ইত্যাদি নিয়েই তার সংস্কৃতি। এটি মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুব ভালো করে বুঝতেন। সে কারণেই নজরুলের কবিতায় ধর্মীয় উৎসব এবং এর উদ্দেশ্য, তাৎপর্য ও শিক্ষা এসেছে স্বতঃস্ফ‚র্তভাবে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘কোরবানী’ কবিতায় কুরবানির আসল উদ্দেশ্য সুন্দরভাবে বলেছেন, “ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্যাগ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন দুর্বল ! ভীরু ! চুপ রহো, ওহো খামাখা ক্ষুব্ধ মন ! ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর, — আজিকার এ খুন কোরবানীর!” ঈদুল আজহার চাঁদ আনন্দ ও খুশির সঙ্গে বয়ে আনে ত্যাগ আর মনের পশুকে দমন করার বার্তা। বিদ্রোহী কবি নজরুল তাঁর ‘নতুন চাঁদের তকবীর শোন’ কবিতায় দীপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “এল স্মরণ করিয়ে দিতে ঈদজ্জোহার এই সে চাঁদ, (তোরা) ভোগের পাত্র ফেল দে ছুড়ে, ত্যাগের তরে হৃদয় বাঁধ। কোরাস : কোরবানী দে তোরা, কোরবানী দে। প্রাণের যা তোর প্রিয়তম আজকে সে সব আন, খোদার রাহে আজ তাহাদের করবে কোরবান। কি হবে ঐ বনের পশু খোদারে দিয়ে (তোর) কাম ক্রোধাদি মনের পশু জবেহ কর নিয়ে। কোরাস : কোরবানী দে তোরা কোরবানী দে।। ” এই করোনাকালে একদিকে মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও সুবিধাবঞ্চিতরা জীবন ও জীবিকা উভয়ের জন্যই লড়াই করছে। দেশের বড় একটা অংশ বন্যাকবলিত। বানভাসি মানুষের দুঃখ-কষ্টের সীমা নেই। এর মধ্যেও এক শ্রেণির মানুষের লোভ আর ভোগের পেয়ালা উপচে পড়ছে। এরা কী লোভকে দমন করে ভোগকে কমিয়ে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে? যদি না দাড়ায় তাহলে তার পশু কুরবানি বৃথা। যে আল্লাহপাকের উদ্দেশ্যে কুরবানি, তাঁর অভুক্ত-অসহায় বান্দার প্রতি মমতা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া ঈদুল আজহার অন্যতম শিক্ষা। সমাজে যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল, তারা চাইলে এই ঈদে অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়ে আল্লাহর নিকটবর্তী হতে পারেন। এই বিবর্ণ করোনাকালে কুরবানি কিছুটা হলেও আলো ছড়াবে ধনী-দরিদ্র সবার মাঝে। মানুষের কবি নজরুল তাঁর এক কবিতায় বলেছেন, “তোর পাশের ঘরে গরীব কাঙাল কাঁদছে যে তুই তাকে ফেলে ঈদগাহে যাস সঙ সেজে, তাই চাঁদ উঠল, এল না ঈদ, নাই হিম্মৎ, নাই উন্মিদ, শোন কেঁদে বেহেশত হতে হজরত আজ কি চাহে\” লোভ-লালসা, অতিভোগ, দ্রুত অবৈধভাবে ধনী হওয়ার জন্য দুর্নীতি অনেক মানুষকে আজ মানুষের মহত্তম আসন থেকে পশুরও অধম অবস্থানে নামিয়ে এনেছে। আল্লাহ ভীতি, আত্মমর্যাদা, প্রজ্ঞা, মানুষের প্রতি মমতা-ভালোবাসা, ত্যাগের মানসিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ আজ বড় প্রয়োজন। এবারের ঈদুল আজহা দরদি সমাজ আর মানবিক পৃথিবী গড়ায় মানুষের ভেতরের পশুত্বকে দমিয়ে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তুলুক। তবে এবার কুরবানিতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে। কুরবানির পশুর হাট থেকে শুরু করে পশু জবাই সবক্ষেত্রে। এটার ব্যবস্থা যেমন সরকার করবে, তেমনি নাগরিক হিসেবেও আমাদের দায়িত্ব আছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। আল্লাহতায়ালা আমাদের এ কুরবানি ও তার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দান গ্রহণ করুন, আমিন। আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া : কবি ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App