×

সাময়িকী

সুখবিলাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ০৫:৩৯ পিএম

সুখবিলাস
নগরীর সবচেয়ে অভিজাত এলাকাটা রাতারাতি যুদ্ধবন্দিদের শিবিরে পরিণত, যেখান থেকে শৃঙ্খলের বিলাপ ছাড়া আর কিছু শোনা যায় না। এমন অবস্থা কল্পনা করেননি কখনো শিল্পপতি আবু তাহের চৌধুরী। তিন মাস, তারও বেশি হবে, নিজেদের ফ্লাটে আটকে আছেন। প্রথমদিকে মনে হয়েছিল সব আপদের মতোই এই আপদটা দূর হবে, কিন্তু তা হয়নি। বরং ক্রমশ বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর দানবের কুৎসিত মুখ যা আগে কেউ দেখিনি। প্রার্থনার মিছিল চলেছে দেশ ও বিদেশে; আল্লাহ, ঈশ্বর ও ভগবানকে ডেকে চলেছে অবরুদ্ধ মানুষ। চীন দেশ থেকে ছড়িয়ে প্রাণঘাতী রোগটি গোটা পৃথিবী গ্রাস করে চলেছে। এর ওষুধ নেই, চিকিৎসা নেই। বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হাত-পা গুটিয়ে লুকিয়ে থাকা, যেভাবে তাড়া খাওয়া খরগোশ ও শিয়ালেরা গর্তে লুকায়। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পপতি তাহের চৌধুরীর স্বাভাবিক জীবনযাপন বন্ধ হয়েছে; বন্ধ হয়েছে গুলশানের মনোরম লেক ঘিরে বারিধারার পার্কে প্রাতঃভ্রমণ, গুলশান কিংবা ঢাকা ক্লাবে সান্ধ্য পানাহার, বন্ধু দর্শন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তদারকিসহ নিত্যদিনের অলঙ্ঘনীয় যা কিছু। মাসে একবার তিনি ব্যাংককের ম্যাসাজ পার্লারে গিয়ে মন ও শরীর চাঙ্গা করে আসতেন, সেটিও বন্ধ। তার মতো একজন মানুষের জন্য পরিস্থিতি কতটা শ্বাসরুদ্ধ কর তা কেবল তিনিই বোঝেন! গত রাতে, বারোটারও পরে হবে, হঠাৎ অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন কানে আসে। মরণাপন্ন কেউ হাসপাতালে যাচ্ছে, কিংবা লাশ যাচ্ছে গোরস্তানে। আওয়াজটা কানে আসতেই চৌধুরী সাহেবের বুক ধরফর করে ওঠে। রক্তচাপ বেড়ে যায়। একটা ট্যাবলেট মুখে দিয়ে পড়িমরি করে তিনি ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্রটা বের করেন; কিন্তু মাপতে পারেন না। হাত কাঁপতে থাকে। তবু জানালা খুলে বাইরে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বারো তলার উঁচু জানালা থেকে দূরের গাছপালা, ঘরবাড়ি দেখা গেলেও নিজের তল্লাটের দৃশ্য চোখে পড়ে না। বিপদের স্বরূপ চিন্তা করতে করতে অস্থির মনে হেঁটে, বসে বাকি রাত কাটাবার চিন্তা করলেন চৌধুরী সাহেব। বুঝলেন ছোট মেয়ে সামিয়া জেগে আছে। টেলিফোনে কথা বলার শব্দ কানে আসছে। পাশের রুম থেকে বার কয়েক ফ্লাস টানার শব্দ শুনে বুঝলেন স্ত্রীও ঘুমোতে পারেনি। জিগ্যেস করলেন তুমি ঘুমোওনি নাকি? কড়া উত্তর এলো না। তিন হাজার বর্গফুটের আধুনিক ফ্লাট নাম ‘সুখবিলাস’। ইচ্ছে করেই অনেক উচ্চতায় উঠেছিলেন যাতে নগরীর নিসর্গ দেখতে পান। ধন ও প্রতিপত্তি দুটোই তার করায়ত্বে। রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, আমলা, পুলিশ, মিলিটারির উঁচু পদের লোকদের সঙ্গে উঠাবসা তার। দেদার টাকা বানিয়েছেন কন্ট্রাকটরি ও সাপ্লাইয়ের কাজ করে। অর্থের বড় অংশ রেখেছেন বিদেশের ব্যাংকে। কারণ মুখপোড়া এই দেশে কখন কি ঘটে কেউ কি বলতে পারে! ইত্যকার সাবধানতার পরও ঘাতক করোনার ভয় তাকে অস্থির করে তুলেছে। জানালার পর্দাগুলো বাতাসে উড়লেই মনে হয় এই বুঝি ঘরে ঢুকে পড়ল দানবটা। চৌধুরী সাহেব ভাগ্যবানদের একজন। দুই মিলিয়ন ডলার দিয়ে বিদেশে বাড়ি কিনেছেন। ছেলেমেয়েদের আমেরিকা-ইউরোপে পড়িয়েছেন। ছোট মেয়েটা ছুটিতে দেশে এসে আটকা পড়েছে। ছেলেটা পারিবারিক ব্যবসা দেখে। মাসখানেক আগে ইতালি গিয়ে আটকা পড়েছে। এই বিপদে ছেলেটা কেমন আছে ভাবতেই উদ্বিঘ্ন পিতা সন্তানকে ফোন করেন। কি হলো আব্বু, এখন তো অনেক রাত এখানে! যা হোক, তোমরা ভালো তো? ঢাকার পরিস্থিতি কী? খবর ভালো নয় বাবা। প্রায় সারাদেশ লকডাউন। প্রতিদিন মানুষ মরছে। বয়স্করাই বেশি মরছে। আমরা ঘরে বন্দি হয়ে আছি। তুই কেমন? শুনলাম ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সে নাকি হাজার হাজার মারা যাচ্ছে? ঠিকই শুনেছ, তবে আমি হোটেলের বাইরে যাই না। এভাবে কতদিন থাকব বুঝতে পারছি না। প্লেন বন্ধ, সব যাতায়াত বন্ধ। ছেলে আরো বলে, ইউরোপের বেশির ভাগ শহরে কমপ্লিট লকডাউন। প্রতিদিন শত শত মানুষ মারা মরছে করোনায়। বলেই ছেলে ভিডিও অন করে পিতাকে রাতের মিলান নগরীর দৃশ্য দেখায়। কী ভয়ার্ত নগরী! কোনো যানবাহন নেই, জনমানব শূন্য মিলান। স্ট্রিট লাইটের আলোগুলো যেন বিলাপ করছে। কিন্তু বেশিক্ষণ দেখা হয় না। স্ত্রী ছুটে এসে ফোনটা ছিনিয়ে নিয়ে কান্না ভেজা কণ্ঠে বলতে থাকে আল্লার কছম বাবা, তুমি একবারও হোটেলের বাইরে যাবে না। যে বাড়িতে রুটিন মাফিক কয়েকজন কাজের মেয়ে ও ড্রাইভার আসে, সে বাড়ি আজ লোকশূন্য। সবাইকে আসতে নিষেধ করা হয়েছে। ছোট মেয়ে সামিয়া প্রতিবাদ করলেও লাভ হয় না। কারণ সংক্রমণ ঠেকাতে হবে। অবশ্য সামিয়ার প্রতিবাদের সঙ্গত কারণ ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে ওকে আড্ডায় যেতে হয়, প্রেমিকের সঙ্গে সময় কাটাতে হয়, ড্রাইভার না থাকলে তার কী হবে! কিন্তু মৃত্যু ভয়ের কাছে হেরে যায় সবাই। সামিয়া বেশির ভাগ সময় বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথা বলে, বাকি সময় শুয়ে-বসে মোবাইল-আইপ্যাডে ইউটিউব কিংবা নেটফ্লিক্স দেখে। আর নিত্যদিনের কাজ সম্পাদন করেন চৌধুরী ও তার স্ত্রী। ফ্লোর পরিষ্কার, বাসনকোসন মাজা, রুটিভাত তরকারি রান্না, যা কোনোদিন তারা করেননি, কিংবা করার কথা ভাবেননি। সকাল হতেই ষাটোর্ধ্ব তাহের চৌধুরী এক গ্লাস গরম পানি খান। আদাকুচি ও জিরা দিয়ে চা বানান। এতে নাকি প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। এরপর চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ড্রইং রুমে আসেন। ভাবেন নিউ জার্সিতে ফোন করে বড় মেয়ের খোঁজখবর নেবেন। পরক্ষণেই ভাবেন এখন ফোন করা ঠিক হবে না কারণ ওদের অনেক রাত এখন। ভাবতে ভাবতে চৌধুরী সাহেব টিভি ছাড়েন। গতকালের খবর ছিল ইতালি, ফ্রান্স ও স্পেনের, আজ আসছে ইরান, ইংল্যান্ড এবং আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে আমেরিকার। বিশ্বজুড়ে করোনার সংক্রমণ বেড়ে চলেছে হু হু করে। টিভি চ্যানেলগুলো যখন মৃত ও আক্রান্তের বিবরণ দিতে শুরু করে তখন তাহের চৌধুরীর হাত কাঁপতে থাকে। ভাবেন ওরাই যখন পেরে উঠছে না তখন আমাদের কী হবে! হঠাৎ চায়ের কাপটা হাত ফসকে গিয়ে দামি সোফা সেটটা ভিজিয়ে দেয়। তাকিয়ে দেখলেন পেছনে স্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে। উত্তেজিত স্বরে বলছে যা পার না তা করতে যাও কেন? মায়ের চিৎকার শুনে মেয়ে ঘর থেকে বেরোয়, বলে ঠিক আছে মাম্মি, এত রাগ করার কি আছে? না হয় একটু নষ্টই হলো। মেয়ের কথায় মা আরো রেগে যায়। বলে তোর কি? আছিস তো রাজ-রানীর মতো! একটা কাজেও হাত লাগাস না। আদরে বেড়ে ওঠা সামিয়া এসব শোনার পাত্র নয়। ওর রুক্ষ স্বভাব নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দুশ্চিন্তা আছে বটে কিন্তু করার কিছু নেই। লাগাতার লকডাউনে এমনিতেই জ্বলেপুড়ে আছে। মায়ের কথায় সে যন্ত্রণা বহুগুণ বেড়ে যায়। চিৎকার দিয়ে বলতে থাকে : পারবো না আমি, এভাবে জীবন কাটাতে পারবো না। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আমার? আই নিড এ ব্রেক। গাড়ি লাগবে না, আজই আমি রিক্সা নিয়ে বাইরে যাব যা হবার হবে। বলেই স্বজোরে নিজের কামরার দরজা বন্ধ করে দেয় সামিয়া। প্রথমদিকে অনলাইনে অর্ডার করে খাবার আনার ব্যবস্থা হয়েছিল। কিন্তু সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত হয়নি। অন্য ফ্লাটের লোকজন প্রতিবাদ করেছে। টেলিফোনে জানিয়েছে এসব কী অপকর্ম করছেন আপনি চৌধুরী সাহেব? আপনার জন্য দেখছি আমরা সবাই মারা যাব। এই খাবার সাপ্লায়াররা দিনে হাজার লোকের বাড়ি যায়, ওদের আপনি বাড়িতে ঢুকালেন! এ রকম কথায় তাহের সাহেব অপমানিত হন বটে তবে আতঙ্কিতও কম হন না। অতএব অনলাইনে খাবার আনা বন্ধ হয়। এমনকি সদ্য আসা পাকেটগুলোও ভয়ে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেন স্ত্রী। একটু বাদে ফোন হাতে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসেন স্ত্রী, বলেন, জুলিয়ার ফোন, নিউ জার্সি থেকে, দেখ, কী সব বলছে মেয়ে? জুলিয়ার কণ্ঠে বিপদের অন্য চিত্র ভেসে উঠে। প্রায় গোটা যুক্তরাষ্ট্র কাবু হয়েছে করোনার গ্রাসে। ছোট বাচ্চাটার দুধ শেষ, সে সারাদিন কান্নাকাটি করছে, কি করবে এখন? কেন, দুধ আনিয়ে নাও? বাবার উপদেশ শুনে মেয়ের স্বর পাল্টে যায়। বলে তোমাদের কোনো ধারণা আছে কী অবস্থায় আছি আমরা? কত মানুষ মারা গেছে খবর রাখ? নিউইয়র্ক, নিউ জার্সিসহ বড় বড় সব শহর লকডাউন, দোকানপাট বন্ধ, যদিও কিছু খোলা সেখানেও দুধ মিলছে না। সবজি কিনতে পাচ্ছি না, কিনবো কি ভয়ে কেউ বাইরেই যেতে পারি না। কী করে বাঁচবো আমরা বলতে পার? একাকার হয়ে গেছে সব উন্নত অনুন্নত, ধনী ও গরিব, সাদা ও কালো, শ্যামলা ও বাদামি। একাকার হয়ে গেছে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, অচীন মহামারি অবরুদ্ধ করেছে গোটা বিশ্ব, আক্রান্ত করেছে সব দেশ, সব ধর্ম, সব বর্ণ ও সব বিশ্বাস। ধনী ও গরিবের এই একাকার হয়ে যাওয়াটা চৌধুরী পরিবারের জন্য কী ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার তা কেবল ওরাই বোঝে। যে সাধারণ কাজের মানুষগুলোকে তারা সারাজীবন তুচ্ছজ্ঞান করেছে, সেই মানুষগুলোই অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে এখন। কি করবেন তারা? আর কতদিন এভাবে চলবেন? এরই মধ্যে বাথরুম পরিষ্কার করতে গিয়ে স্থুলকায় মিসেস চৌধুরী শক্ত চোট পেলেন কোমরে। তিনি বিছানাগত হলেন। না মিলছে ডাক্তার, না যাওয়া যাচ্ছে হাসপাতাল। বেশির ভাগ ক্লিনিক বন্ধ, হাসপাতাল গুলিতে করোনা রোগীর ভিড় রোগ ছড়াতে কতক্ষণ। হঠাৎ মনে পড়ল পুরনো বুয়াটারও কোমড়েও এ রকম ব্যথা হয়েছিল একবার কি একটা মলম লাগিয়ে সেরে উঠেছে। অতএব অনুন্যপায় হয়েই কাজের মেয়েটাকে ফোন দিলেন তাহের চৌধুরী। বললেন : শোন্, ওই যে কি একটা মলম দিয়ে তোর কোমরের ব্যথা কমেছিল সেটা কি আছে? টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে : একটুডা আছে স্যার, আমি নিয়ে আসি? স্ত্রীর চোখেমুখে তখন চরম বিরক্তি। স্বামীকে বললেন শেষ পর্যন্ত কাজের মেয়ের ব্যবহার করা মলম লাগাবো? তার চেয়ে মাস্ক পরে তুমিই ওষুধের দোকানে যাও, একটা কিনে আনো। কিন্তু তাহের চৌধুরীর সাহস হয় না। যদি কিছু হয়ে যায়। কাজেই তিনি কাজের মেয়েটাকে বললেন না না ওটা লাগবে না। তুই বরং একটা নতুন মলম কিনে এনে বাড়ির দারোয়ানের হাতে দিয়ে যা। পারবি? কাজের মেয়ে : কী কন স্যার পারমুনা ক্যান? স্ত্রী বিছানাগত হবার পর থেকে তাহের চৌধুরী নিজে চালডাল, লবণ তেলের খুঁজে নেন। ঘর পরিষ্কার করেন। কোনো রকমে চাল ফুটিয়ে দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা করেন। কখনো কখনো মেয়েকে ডাকেন মা, এই বিপদের দিনে বসে থাকলে চলে? সামিয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করে বাবাকে সাহায্য করতে। কিন্তু পেরে ওঠে না। কিন্তু এভাবে কতদিন? বাধ্য হয়ে অন্য কাজের মেয়েটাকে ফোন দেন মিসেস চৌধুরী। ভাবেন, ভাগ্যে যা থাকে থাকুক, তবু লোক দরকার। এভাবে আর চলতে পারবেন না। প্রথমেই জিগ্যেস করেন শোন, তোর স্বামী, বাচ্চা আর তোর নিজের জ্বর, সর্দিকাশি কিছু হয়নি তো? সত্য কথা বল? কাজের মেয়েটা স্বহাস্যে জবাব দেয় : না ম্যাডাম, এই রোগ নাকি বড় লোকের, আমরা গরিবরা সুস্থই আছি। কিন্তু ম্যাডাম ঘরে তো খাবার নাই। ‘খাবার নাই’ কথাটা শুনেও তেমন প্রতিক্রিয়া হয় না মিসেস চৌধুরীর। তবে সুস্থ আছে শুনে অবাক হন। টেলিফোন রেখে দেন। ভাবেন হতেই পারে না। কিন্তু অল্পদিনেই পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে হয়তো না খেয়েই থাকতে হবে। প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও সাহায্য পাওয়ার সুযোগ নেই। অতএব বাধ্য হয়ে একদিন অফিসের পিয়নকে ফোন করলেন চৌধুরী সাহেব। বললেন আব্দুল আজিজ, শোন, তুমিতো ইয়ংম্যান, একা মেসে থাক, নিজে রান্না করে খাও, নাকি—? আজিজ : না স্যার আমিই রান্না করি। মোটামুটি খারাপ হয় না স্যার? চৌধুরী : আচ্ছা শোন, তুমি কিছুদিনের জন্য আমার ফ্লাটে এসে থাকতে পারবে? আব্দুল আজিজ থাকতে রাজি হওয়ায় চৌধুরী পরিবারের মাথা থেকে একটা বড় বোঝা নেমে যায় বটে, কিন্তু ভাবেন, ওকে শুতে দেবেন কোথায়? নিচের সার্ভেন্টস কোয়ার্টারে জনা তিনেক দারোয়ান থাকে। বাইরের লোকের সাথে থাকলে রোগটা নির্ঘাত ঘরে ঢুকবে। অতএব ফ্লাটেই থাকার ব্যবস্থা হয় ওর। তরুণ আব্দুল আজিজ মনেপ্রাণে মালিককে খুশি করার চেষ্টা করে চলে। কারণ জানে মালিক খুশি হলে বেতন বাড়বে হয়তো। অতএব মুখে মাস্ক পরে, হাতে গ্লাভস লাগিয়ে সে প্রতিদিন বাজার করে আনে। প্রথম দিনেই বোঝা গেল ছেলেটার রান্নার হাত আছে। কিন্তু দিন কয়েকের মাথায় নতুন বিপদের সূচনা হলো। মিসেস চৌধুরী লক্ষ্য করলেন গভীর রাতে সামিয়া ও আজিজ ফোনে কথা বলে। স্পষ্ট শোনা না গেলেও, বুঝতে বাকি থাকে না দুজনের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠছে। দিনের চালচলনেও দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেল দুজনের। স্বামী-স্ত্রী এবার ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তায় পড়লেন। এক বিপদ তাড়াতে এ কোন বিপদ ডেকে আনলেন তারা! কিন্তু এ সংকটের মোকাবিলা করবেন তারা কীভাবে? স্ত্রী স্বামীকে বলে দেখ, মেয়ে জেদি স্বভাবের, আমি পারব না, তুমিই বরং ওকে ডেকে ব্যাপারটা জান। শেষে বড় ঝামেলা বাধিয়ে না ফেলে। কয়েকদিন পর বেলা বারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে সামিয়া নাস্তার টেবিলে বসে। চৌধুরী সাহেব লক্ষ্য করলেন নাস্তা খেতে খেতে সে আব্দুল আজিজের দিকে বারবার তাকায়, বার কয়েক কিচেনেও যায় এবং এক সময় বলে তোমার ফোনে ইন্টারনেট লাগাও না কেন আজিজ? তাহের চৌধুরী বিস্মত হন, বলেন : ওর আবার ইন্টারনেট কেন? সামিয়া : কেন, সবাই তো আমরা ভিডিও চ্যাট করি, আজিজও করবে। চৌধুরী সাহেব চুপসে যান, বলেন : ওহ্ তাই। সামিয়া : তাই মানে কি? আমরা পারব ও পারবে না কেন? দেখ বাবা, আজিজ আসার পর থেকে আমরা ভালো আছি, বাড়ির সব কাজকর্ম হচ্ছে, কথা বলারও একটা লোক হয়েছে। তুমি জান আজিজ গাড়িও চালাতে জানে? তাহের চৌধুরী অবাক হয়ে প্রশ্ন করেন : তুমি জানলে কি করে? সামিয়া : ওকেই জিগ্যেস কর? শোন আব্বু, এই লকডাউন আর মেনে নিতে পারছি না। ভাব, তিন মাস ঘরে বন্দি, আমার সাইকোলজিক্যাল ব্রেকডাউন হচ্ছে বোঝ তোমরা? আমি ঠিক করেছি আজ বাইরে বেরুবো, আজিজ গাড়ি চালাবে। তোমার আপত্তি আছে? এ পরিস্থিতিতে কি করবেন চৌধুরী ও তার স্ত্রী? মেয়ের কথার কোনো উত্তর দিতে পারেন না তারা। আগে রাতে লুকিয়ে গল্প হতো, কিছুদিন হলো প্রায় প্রকাশ্যেই ছেলেটাকে ঘরে ডেকে নেয় সামিয়া, দুজনে হাসাহাসি করে। এ পরিস্থিতিতে কি করবেন, ওকে তাড়িয়ে দেয়ার কথা বললে মেয়ে যদি বেঁকে বসে? আর তাড়িয়ে দিলেই বা তারা চলবেন কী করে! করোনার সন্ত্রাসে সব এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বন্ধ। বিদেশ যাবারও সুযোগ নেই। আর কোথায়ই বা যাবেন? ইউরোপ-আমেরিকায় মরছে মানুষ হাজারে হাজারে। দেশে মরছে ডাক্তার, নার্স, পুলিশ, বড় সরকারি কর্মকর্তা, মন্ত্রী, শিল্পপতি সবাই। অতএব পরিস্থিতি মেনে নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অসহনীয় অবরুদ্ধ এই জীবন থেকে কবে পরিত্রাণ মিলবে কেউ জানে না। এ জীবনের স্বাদ না পেলে কোনোদিনও কী এমন উপলব্ধি হতো যে, এই মহামারি পৃথিবীটাকে কতটা বদলে দিয়েছে, কতটা পাল্টে দিয়েছে!!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App