সংক্রমণ
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ০৪:৫২ পিএম
করোনার এই দিনে দুই অপদার্থ বিষাক্ত মদ খেয়ে মরেছে। স্ক্রল দেখাচ্ছে টেলিভিশনে। দেখে প্রথমত বিরক্ত হলো, দ্বিতীয়ত বিরক্ত হলো এবং তৃতীয়ত সহানুভ‚তিশীল হলো ফরাহিম নবী। গাধার বাচ্চা গাধা! মদ খাবি ভালো মদ খা! মেথরপট্টির মদ ভালো মদ। তারা নিজেরা খায়, ভেজাল দেয় না। দুই গাধা নিশ্চয় মেথরপট্টি যায়নি। নাম কী দুই গাধার? স্ক্রলে দেখায়নি। দেখালে ভালো হতো। দুই গাধার নামে কিছু শোকজারি করতে পারত ফরাহিম নবী। একবার অবশ্য তার মনে হলো যে, টেলিভিশন চ্যানেলে কল দেয়। তারা কি দুই গাধার নাম বলতে পারবে? করোনায় যারা মরেছে সকলের নাম বলতে পারবে?
পারবে না।
অগত্যা ফরাহিম নবী নিজেই দুই গাধার দুটো নাম দিয়ে দিল। বিষাক্ত মদ গিলে মরেছে এদের নাম ইশরাক কি তোজো হবে না। এই বিবেচনা করে ফরাহিম নবী মৃত দুই মদ্যপের নাম রাখল সিকান্দার আসলাম এবং সহিদুল আলম। তাতে কিছু শোক তার অন্তরে উথলাল। সন্ধ্যার পর থেকে সে খাচ্ছে। এখন বাজে রাত দশটা এগার। নিজের জন্য আর নিল না, সিকান্দার আসলামের জন্য একটা লার্জ পেগ এবং সহিদুল আলমের জন্য একটা লার্জ পেগ নিল ফরাহিম নবী। খা ভাই, ভালো মদ খা। এটা স্মিরনক। রাশিয়ান ভদকা। অ্যালকোহল চল্লিশ শতাংশ। ভ্লাদিমির পুতিনের মতো ‘কুল’ জিনিস। ঠাণ্ডা এবং মধুর তারল্য, যতক্ষণ কিক না দেয়। সিকান্দার আসলাম বলল, ‘চিয়ার্স’ সহিদুল আলম বলল, ‘চিয়ার্স।’
ফরাহিম নবী বলল, ‘চিয়ার্স’ কী রে বিলাই ব্রাদার্স? ইংলিশ***? বাংলায় বল! বল, মালে বাড়ি।’
সিকান্দার আসলাম বলল, ‘মালে বাড়ি!’
সহিদুল আলম বলল, ‘মালে বাড়ি!’
ফরাহিম নবী বলল, ‘সাধু! খেতে থাক।’
মদ খাওয়ার লাইসেন্স তার আছে, লকডাউনের আগেই যত পারে মদের বোতল জোগাড় করে রেখেছে ফরাহিম নবী। নানা পদের মদ। বিপুল উনিশ বোতল জোগান দিয়েছে। ওমর ছয় বোতল জোগান দিয়েছে। কামরুল পারেনি। তার করোনা ধরা পড়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইনে আছে ছেলেটা।
ফরাহিম নবী রোজ মদ খায় না। হিসাব আছে। সপ্তাহে তিনদিন। শনি সোম এবং বুধবারে খায়। ছয়-সাত-আট-নয় পেগ খায়। মনে করে মাতাল হয়নি। একে তাকে ফোন করে বসে। কী বলে না বলে কিছুই পরদিন মনে করতে পারে না আর। বিস্বাদ লাগে সেই পরদিনটা। এখন আশা করছে কাল বিস্বাদ লাগবে না। মৃত দুই বোকা প্রাণীর সঙ্গে বসে এখন মদ খাচ্ছে সে। পঞ্চাশভাগ ঠিক হলো কথাটা। সে আর খাচ্ছে না। মৃত দুই প্রাণী খাচ্ছে, সে দেখছে।
মরে গেছে, নেশা যায় নাই।
ফরাহিম নবী বলল, ‘সিকান্দার আসলাম।’
সিকান্দার আসলাম বলল, ‘জি, ওস্তাদ?’
ফরাহিম নবী খেপল, ‘ওস্তাদ কী রে? এই! তোরা কি পকেটমার নাকি? আমি তোদের মতো দুটো পকেটমারের ওস্তাদ? শেম টু ইউ! শেম টু ইউ!’
সিকান্দার আসলাম বলল, ‘সেইম টু ইউ! সেইম টু ইউ!’
ফরাহিম নবী বলল, ‘মানে?’
‘বেয়াদবি নিবেন না ওস্তাদ। আমি স (শ) উচ্চারণ করতে পারি না।’
‘কী মুশকিল! সহিদুল আলম তুই?’
‘আমি শ্যার শ (স) উচ্চারণ করতে পারি না।’
‘যন্ত্রণা তো! শোন, তোরা কালই আন্তজার্তিক ভাষা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়ে যাবি। আমি রেকমেন্ড করে দেব। সিকান্দার আসলাম তুই পালি ভাষা পড়বি। সহিদুল আলম তুই ফারসি ভাষা পড়বি।’
‘জি শ্যার। জি শ্যার।’
‘জি ওস্-স্যার! জি স্যার!’
‘মানে কী দাঁড়াল তাহলে? মানে কী? মানে কী? মদ গিলে বিশিষ্ট দুজন ভাষাবিদ মরে গেছে দেশের।’
‘বিষাক্ত মদ গিলে শ্যার।’
‘চুপ কর গাধা। বিষ গিলে হজম করতে পারলি না, তোরা মদ গিলতে গেলি কোন বিবেচনায়? তোরা মরে যা ক্ষতি নাই। কিন্তু দুজনই বিশিষ্ট ভাষাবিদ। ওহ্! অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির। করোনার জন্য মহামান্য রাষ্ট্রপতি এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তোদের জন্য শোকবাণী দিতে পারলেন না। আমি একটা শোকবাণী দেই। তোরা দূর হ।’
‘শ্যার?’
‘স্যার?’
‘কী বললাম বুঝতে পারিসনি? বাংলায়ই তো বললাম। ইংলিশে বলি, গেট লস্ট।’
লস্ট হলো তারা। এই লেভেলের দুটো অপদার্থের সঙ্গে বসে মদ খাওয়ার কোনো মানেই হয় না। নিজের অপমান। মদেরও অপমান। আরো দুই পেগ নিল ফরাহিম নবী। মাতাল হলো এবং কল প্রজেক্ট খুলল। কাকে কল দেবে? রসু খাঁ, ইদি আমিন, উদো সাদ্দাম, সালমা হায়েক, পরিণীতি চোপড়া? ইদি আমিনকে বিশেষ একটা কথা বলতে হবে। সেটা অবশ্য পরে বললেও চলবে। ইদি আমিনকে করোনা ধরেছে এবং আইসিইউতে অবস্থান করছে সে। পরশু পর্যন্ত ফোনে কথা বলতে পেরেছে। হাসিখুশি ছিল। কাল অবস্থা ডিটোরেট করেছে। আইসিইউতে নিশ্চয় ইদি আমিন মোবাইল ফোন পকেটে নিয়ে ইন করে যায়নি। বরং রসু খাঁর অবস্থান দেখা যাক। রসু খাঁ এখন কী করছে? বউকে ঝাপটে ধরে ঘুমাচ্ছে? শালা খবিস! গতকাল রাত ১টা ৩১ মিনিট ২৭ সেকেন্ড সে মেসেজ পাঠিয়েছে ফরাহিম নবীকে।
করোনাতেও চলছে
আদিম যুদ্ধ,
হায়রে মানব চরিত্র,
কবে হবে শুদ্ধ।
গত পরশু রাত ৯টা ৩৯ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে
সুন্দরী দুই ভাড়াটিয়া নিয়ে,
ভাই খেলে ক্যারাম,
বয়স হলেও ভাইয়ের মেশিন তাই
কে এস আর এম।
করোনা কবি করে দিয়েছে শালাকে। এবং আরো খবিস। উল্লেখিত ভাই হলো উদো সাদ্দাম।
উদো সাদ্দামরা বিয়াট যৌথ পরিবার। বছর দুই আগে একতলা ভেঙে তারা চারতলা বিল্ডিং করেছে। নিচতলা এবং চারতলায় বর্তমানে রূপবতী দুই ভাড়াটিয়া থাকেন। বিকালে আণ্ডা বাচ্চা নিয়ে ছাদে উঠেন তারা। উদো সাদ্দামও উঠে। উদো সাদ্দামের বউ থেকেও নাই। বউয়ের সঙ্গে আট বছর ধরে অভিমান ‘চলিতেছে’। বউ বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে সেই। ফিরে না আর। উদো সাদ্দাম দুঃখের সঙ্গে একা কাটায়। রূপবতী দুই নারী দেখে বিবর্ণ এই করোনার দিনে যদি সে সামান্য পুলকিত থাকে, তাতে তোর কী রে খবিস? সে কি তোর মতো এই করোনার মধ্যেও যখন মনে হয় তখন অঘটন ঘটাচ্ছে। শালা খবিসের আরো কিছু মেসেজ আছে ফরাহিম নবীর ফোনে। ডিলিট করেনি। আদি রসাত্মক মেসেজ। নির্দোষ ডকুমেন্ট। করোনার সময় কত জন কত কী করেছে। করোনাকালীন মানুষের মনস্তত্ত¡ নিয়ে এখনই গবেষণা হচ্ছে দেশে-বিদেশে। ভবিষ্যতেও হবে। ভবিষ্যতের গবেষকদের জন্য এমন কিছু ডকুমেন্ট অবশ্যই জমা রেখে যাবে ফরাহিম নবী। এটা দায়িত্ব। খবিস রসু খাঁ কি এখন কল দিলে ধরবে?
ফকির মজনু শাহকে কল দিল ফরাহিম নবী, ‘ফকির ভাই, কী করো তুমি?’
‘সিনেমা দেখি ভাই। বাংলা সিনেমা। রাজ্জাক-ববিতা জুটির ‘অনন্ত প্রেম।’ মাই চ্যানেলে দেখাইতেছে, হ্যাঁ!’
‘মাই চ্যানেল। খিক-খিক!-খিক! মাই চ্যানেল!’
সব শালা গেছে।
‘তোমার ফকিরনি ঘরে নাই?’
‘আছে রে ভাই। তারে নিয়া আছি বিরাট যন্ত্রণায়। চার মাসের একটারে পেটে নিয়া সে ঘুরতেছে। এইটা একটা নাইয্য বিচার হইল করোনায় এই দুর্ভোগের দিনে?’
‘দুর্ভোগের দিন! তুমি আবার পোয়াতী করেছ ভাবিকে! এটা ঠিক করো নাই, ফকির ভাই। বিয়ের পর থেকে মহিলাকে তুমি দুটা দিন খালি পেটে থাকতে দিলে না।’
‘এইটা কি আমার দোষ ভাই। কনডম ছিঁড়ে যায়।’
‘তামার কনডম পর।’
পরামর্শ দিয়ে আত্মতুষ্টির সঙ্গে লাইন কেটে দিলো ফরাহিম নবী। ফকির মজনু শাহ ভাইয়ের জন্য একটা অব্যর্থ কাজের পরামর্শ হয়েছে। রসু খাঁ এদিক থেকে সতর্ক বদমায়েশ। যা বলে সেটা অত্যন্ত প্রাইভেট এবং খবিস অর্থমূলক। বর্তমান ফকির মজনু শাহ ভাই ফকির বংশের ধারক এবং বাহক। ভাটি অঞ্চলের মরমী কবি ফকির চান শাহের বংশ। সেই বংশের পরম্পরা আছে। ফকির মজনু শাহ ভাইও একজন কবি হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছেন। কবিতা যদিও কখনো লিখেননি। লিখবেন কেন? সব কবিকে কবিতা লিখতে হয় না।
ভাবির চার মাস। ফকির মজনু শাহ ভাই তাহলে আতান্তরে আছেন। প্রবীণ কেষ্ঠ ঠাকুর চৌধুরী সাহেব দুই না তিনদিন আগে হায় আফসোস করেছেন। গোপিনীদের সাহচর্য নিতে পারছেন না। এদিকে ভাবিও তার সঙ্গে বেজায় অসহযোগিতামূলক আচরণ করেছেন। চৌধুরী সাহেবের বয়স ৭৩। ভাবির ৫৯। ফরাহিম নবীর সঙ্গে চৌধুরী সাহেবের সম্পর্কটা রঙ্গ রসিকতার। মানুষটা এখন ঘুমিয়ে আছেন। না হলে রঙ্গ রসিকতা করা যেত কিছু।
মৃত্যুভয় কামার্ত করে মানুষকে। তাই হচ্ছে। লীলাখেলা কম চলছে না করোনায়।
স্মল ফর দ্য রোড। যদিও সে কোথায়ও যাচ্ছে না। আরেকটা নিতে গিয়ে ফরাহিম নবী দেখল বোতল খালি হয়ে গেছে। দুর শালা! এত কখন হলো? রাত কত হলো?
মোবাইল ফোন ছাড়াও একটা ডানাআলা ঘড়ি আছে ফরাহিম নবীর ঘরের দেয়ালে। মিস অউল অরিগামি পারে। এ-ফোর সাইজের কাগজ ভাঁজ করে দুটো ডানা বানিয়ে দিয়ে গেছে ঘড়ির। ফরাহিম নবী এখন মোবাইল ফোন দেখল না। ঘড়িও দেখল না। ডানা দুটো দেখল। সামান্য কাঁপছে। ফ্যানের বাতাসে।
মদ্যপানের রাতে সব সময়ই ফ্যান এবং এসি ছেড়ে রাখে ফরাহিম নবী। শীতকাল হলেও। এখন গ্রীষ্মকাল। আজব গ্রীষ্মকাল। কালবৈশাখী হলো একদিন। আমের বোলের সতেজ ঘ্রাণ ছিল হাওয়ায়। ইদি আমিনের বয়স কম হলেও চিন্তা ভাবনা হাই লেভেলের। সে কবি। কৃষ্ণচ‚ড়া ফুলের একটা দারুণ ছবি দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছিল, সুন্দর এসে ফিরে যায়।
প্রাক্তন বউ হয়। প্রাক্তন শ্যালিকা কী হয়? ইদি আমিন হতে দেয়নি। তার শ্যালিকা ছিল একটাই। তারা বিয়ে করে ফেলেছে। বউ তার সঙ্গে থাকলে অবশ্য করত না। বউ চলে গেছে এক কোটিপতির সঙ্গে। ইউটিউবের কোটিপতি। ছেলেটা গান গায়। তার একটা গান ইউটিউবে এক কোটি বারের বেশি দেখা হয়েছে। ইদি আমিন এবং তার প্রাক্তন শ্যালিকা-বর্তমান বউও দেখেছে, লাইক দিয়েছে। ইদি আমিনের বউ-শ্যালিকা বাদ, ফরাহিম নবী তার নিজের বউ এবং শ্যালিকাকে নিয়ে পড়ল। প্রাক্তন বউ। ইদি আমিনের বউয়ের মতো আর কারো সঙ্গে চলে যায়নি। থাকেনি ফরাহিম নবীর সঙ্গে। সংস্কৃতি কর্মী। বাপজানের মঞ্জিলে থাকে এখন। সংস্কৃতি চর্চার নিয়োজিত রেখেছে নিজেকে। ছয় বছর তারা একসঙ্গে ছিল। বাচ্চা-কাচ্চা নেয়নি এবং একদিনও তাদের বনিবনা হয়নি। ছয় বছর তবে কিভাবে একসঙ্গে থাকল? থেকে গেছে। একসঙ্গে থাকা আর এক ছাদের নিচে থাকা এক না। এক ঘরে থাকাও না, এক খাটে শোয়াও না। এমনকি... করাও না। তুবা চলে গেছে ভালো হয়েছে। প্রাণে বেঁচে গেছে ফরাহিম নবী। ১৭ই জুলাই এখন ব্যক্তিগত স্বাধীনতা দিবস পালন করে সে। গত আট বছর ধরে করছে। নিয়মের ব্যতর হয় এই একদিন। সোম, শনি বা বুধবার না হলেও ১৭ই জুলাই মদ খায় ফরাহিম নবী। মাতাল হয়ে ফোন করে তুবাকে। নোংরা কথা বলে। তুবা শোনে এবং উত্তরও করে। উস্কায় ফরাহিম নবীকে। তাসনুভা তুবা। তার বোন তিনা। তাসমিয়া তিনা। ফরাহিম নবীর একমাত্র শ্যালিকা। ছোটো হলেও বুদ্ধিমতী মেয়ে। চার বছর আগে বিয়ে করেছে এবং যমজ পুত্র সন্তানের জননী হয়েছে। জামাই রিয়েল এস্টেট ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। যথেষ্ট সম্মান করে ফরাহিম নবীকে। খোঁজখবর রাখে, ফোন করে। দূরের কেউ হয়ে যায়নি তিনাও। মিস অউল অন্তত বছর ছয়েকের ছোটো তিনার। তাহলে তুবাকে বিয়ে না করে যদি তিনাকে বিয়ে করত ফরাহিম নবী? বোকা চিন্তা। ক্লিওপেট্রার নাম বোঁচা না তা হলে পৃথিবীর ইতিহাস আরেক রকম হতো। হয়নি। যা হওয়ার কথা কিছু হয় না। চৌধুরী সাহেব কয়েকবারই বলেছেন ‘আমি ভাবছিলাম মিয়া ছোডোটার লগেই আপনের সম্পর্ক। বিয়া করবেন।’
‘ভুল ভাবছিলেন।’
‘হ মিয়া, বিরাট ভুল।’
‘আপনি কি আমারে নিয়া মজা নিতেছেন?’
‘না রে মিয়া। মজা নেই না। আমিনুলের ছোটো মেয়েটাই আপনের উপযুক্ত ছিল।’
‘দেখতেও রূপবতী বলেন।’
চৌধুরী সাহেব পিতৃবন্ধু তাদের। তুবা, তিনার।
কিছু কথা শোনা হয়ে যায়। তুবা তার আত্মীয় স্বজনদের বলেছে, তিনার জন্য তার সংসার ভেঙেছে। অবান্তর কথা। তুবা মেন্টাল। অতিরিক্ত নিষ্ঠুর। বাতিকগ্রস্ত, সন্দেহপ্রবণ। তাদের বিয়ের আগে ফরাহিম নবী একদিন মজা করে বলেছিল তিনাকে, ‘শালির সঙ্গে মানুষ যা যা করে সব আমি তোমার সঙ্গে করব।’
‘কী করবে?’
‘শাস্ত্রে বলে শালি দ্বিতীয় পত্নী। পত্নীর সঙ্গে সব করা যায়। সে প্রথম হোক কী দ্বিতীয়।’
‘আচ্ছা! কোন শাস্ত্রে বলে রে ব্যাটা?’
গোপন না, প্রকাশ্য কথাবার্তা। তুবা ছিল এবং প্রচুর হেসেছিল। মেন্টাল। সব মনে রেখে দিয়েছিল ঠিক। শীতকালের এক সন্ধ্যার বিস্ফোরণ ঘটায়। সেদিন তিনা তাদের বাসায় ছিল এবং ফরাহিম নবীর পাশে শুয়ে ছিল। তুবা গিয়েছিল সংস্কৃতি উদ্ধারে। ফিরে এক কুইল্টের নিচে ফরাহিম নবী এবং তিনাকে দেখে মাথার রক্ত মাথার রক্ত চড়ে গিয়েছিল তার। টান দিয়ে কুইন্ট সরিয়ে দেখেছিল, দুলাভাই শালির শারীরিক অবস্থান। মাঝখানে যথেষ্ট দূরত্ব এবং একটা কোলবালিশ থাকলেও আমলে নেয়নি, চোখ রিমঝিম করে উঠেছিল, হিসহিস করে উঠেছিল সে, ‘হয়ে গেছে, না?’
‘কী হয়ে গেছে?’
ফরাহিম নবী আসলেও বোঝেনি। কোলবালিশ সরিয়ে দেখেছিল তুবা। কী দেখেছিল? ততক্ষণে তিনার ঘুম ভেঙে গেছে।
‘এই কী! কী হলো তোমাদের?’
‘চুপ!’
‘চুপ মানে? খেপে উঠছ কেন?’
‘খেপে উঠছি! শুয়োরের বাচ্চা! নাম তুই! খাট থেকে নাম!’
তাও বোঝেনি তিনা, ‘তুমি শোবে?’
‘আমি শোবো কেন? আমি শোবো কেন? তুই শো! তোরা শো! শুয়োরের বাচ্চা! কুত্তার-কুত্তীর মতো রাস্তায় গিয়ে ***।’
‘তুমি এসব কী বলছো? ছি:!’
‘কী বলছি! আরো শুনবি? আরো! আরো! আরো শুনবি? তুই আমার বাসায় আর কখনো আসবি না।’
‘আমি তোমার বাসার আসি না। আমি আসি ফরাহিমের বাসায়। ফরাহিম বলুক।’
ফরাহিম নবী কেন বলবে? তুবার রূপ তার আগেই দেখা হয়ে গেছে কিন্তু এতটা নোংরা পর্যায় সে কখনই ভাবেনি। সেই রাতেই আরেক প্রস্থ।
‘তিনার সাথে তুমি কী করেছ বলো।’
‘কী করব?’
‘কিছু করো নাই?’
‘আরে! কী আশ্চর্য!’
‘তোমাকে বিশ্বাস নাই। তিনা আজ কী রঙের ব্রা পরেছিল বলো!’
উষ্ণ ছিল, উষ্ণতর হচ্ছিল, আর হয়নি, শক্ত হয়ে গিয়েছিল ফরাহিম নবী। কেঁচোর মতো গুটিয়ে গিয়েছিল তৎক্ষণাৎ। তুবা ছাড়েনি, ‘এখন আর হবে কেন? দুপুরে হয়ে গেছে না?’
ছয় বছর ধরে একই রকম। ফরাহিম নবীর সঙ্গে তার শ্যালিকা তিনার ‘পবিত্র’ সম্পর্কটা অবশ্য তাতে কিছু ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। ফরাহিম নবী এখন কল দিল তিনাকে।
‘কী করো?’
‘ব্রেস্ট ফিড করাই।’
‘ছানা দুটাকে? নাকি?’
‘তবে আর কাকে রে বদমাশ!’
‘জামাই কী করে?’
‘অনলাইনে।’
‘অ। প্রস্তুতি নিচ্ছে?’
‘হ্যাঁ। কী? হি-হি-হি! আর বলো না এই এক যন্ত্রণা হয়েছে করোনায়। আরো কয়েকজন আমাকে বলছে।’
‘কুত্তা হয়ে আছে জামাইরা?’
‘হ্যাঁ। কোনো টাইম টেবিল নাই বুঝেছ?’
‘পুষ্টিকর খানা খাদ্য দিও। দুধ ডিম। ডিম তো আর পাড়তে পারবে না, মুরগির ডিমই দিও।’
‘দুর ব্যাটা! হি-হি-হি! তুমি কী করো?’
‘কনডমের বিজ্ঞাপন বানাই।’
‘কী!’
‘কনডমের বিজ্ঞাপন। পার্টনার ছাড়া পারফিউমড কনডম কীভাবে ইউজ করা যায়। চেরি ফ্লেভার নিয়ে ভাবছি।’
‘অসভ্য ব্যাটা! রাখি! ঘুমাও।’
এই তবে চলছে।
মারা যাব বলে ভয় পাচ্ছে মানুষ। শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত, সংস্কৃতিবান কিছু মানুষ। করোনার কারণে তারা কোয়ারেন্টাইনে। টিভি, ইউটিউব, ফেসবুক, গুগল সব তাদের বোর করে দিয়েছে। ভয়ের ছায়া কিছু অপনোদন হচ্ছে না। এটা পারে একমাত্র শরীর। ফরাহিম নবী এই সিদ্ধান্ত নিল এবং ভাবল সে একজন গবেষক। অধ্যাপক মুয়ীদ হাসান নজরুল। করোনাকালীন কিছু নরনারীর যৌন জীবন নিয়ে সে গবেষণা করছে। হা! হা! হা!
বোতল সাবাড় করে দিয়েছে, তাও আজ তাকে তেমন ধরেনি। কেন ধরেনি? ধরেনি, ভালো হয়েছে। সম্পূর্ণ সচেতন এখনো ফরাহিম নবী। সব কথা মনে আছে তার। সব কথা মনে থাকবে। ভুতুমরা কী করে তবে দেখা যাক।
করোনায় ন্যাড়া হয়ে গেছে ভুতুমরা।
ফরাহিম নবী কল দিয়ে বলল, ‘কীরে বেলভুতুম?’
ভুতুম হাসল, ‘দাদো! তুমি ঘুমাও নাই?’
‘ঘুমিয়েছি তো। তোর কি ধারণা তুই বাস্তবে আমার সঙ্গে কথা বলছিস? আমি স্বপ্নে কল দিয়েছি তোকে। তোদের কী হাল হকিকত বল।’
‘এই তো দাদো!’
‘কাজকর্ম চলছে?’
‘কাজকর্ম! কিসের?
‘তোদের!’
‘অ। হি-হি-হি। চলছে তো’
‘কন্টিনিউয়াস?’
‘আরে না। তবে আমরা ন্যুড ক্যাম্প করেছি। লকডাউনের পর থেকে কিছু পরি না।’
‘গুড। লাইফ গোজ অন ব্রাও না?’
‘না’।
পিংক সিটিতে থাকে ভুতুমরা। ভুতুম এবং তার পার্টনার গোল্ডফিশ। ভুতুম পেইন্টার, গোল্ডফিশ কনসালটেন্ট। গোল্ডফিশের মতো চোখ মেয়েটার। বেলমুণ্ডু হয়েছে সেও। তার বেলরূপ ফরাহিম নবী দেখেনি। ভুতুম বলেছে ছবি তুলে রেখেছে। লকডাউন কাটলে দেখাবে।
‘কেন, আমার মেইলে সেন্ড কর।’
‘না, দাদো।’
‘কেন রে বাবা? তোকে দেখতে পারছি আর তোর জামাইকে দেখতে পারব না?’
‘সে আমার জামাই না দাদো।’
‘অ স্যরি! জামাই তো তুই। এখন তোর বউকে দেখার একটা রাইট তো আমার আছে।’
‘তা আছে। কিন্তু আমার বউ খুবই লজ্জাবতী দাদো। সে চায় না তুমি তার বেলমুণ্ডু দেখো।’
‘না দেখলাম! হেই না চেহারা নাম রাখছে পেয়ারা। কত দেখলাম। একে গোল্ডফিশ আবার টাকলু। ভালো যে তোরা কোনো পোলাপান অ্যাডপ্ট করিস নাই এখনো। ভয় পেত এই মূর্তিকে দেখলে।’
‘হি-হি-হি! তুমি, দাদো! লাভ ইউ! লাভ ইউ!’
কিছু পানির তেষ্টা পেয়েছে। ঠাণ্ডা পানি খায় ফরাহিম নবী। ফ্রিজার খুলে দেখল পানির বোতল যথাস্থানে আছে এবং র্যাকে আধ গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আছে। নিল। চুমুক দিল। পানি না ভদকা। কখন রেখেছিল? নির্জলা জিনিস। কখন রেখেছিল? পানি নিল না আর। লাস্ট ওয়ান ফর দ্য রোড। রোড। রাস্তা। রাস্তা যায়। কোনখানে যায়?
আর দুই বারে গ্লাস শেষ করে দিয়ে বেডরুমে ঢুকল ফরাহিম নবী। অন্ধকার বেডরুম। ফোন বেজে উঠল। মেসেজ সিগনাল। কী মেসেজ। কার?
‘ইদি ভাই আর নাই।’
ফকির ভাইয়ের মেসেজ।
‘মানে কী?
ইদি আর নাই! কী হয়েছে?
মাত্র মেসেজ ডেলিভারড হয়েছে। তার মানে ফকির ভাই জেগে আছে এখনো। কল দিতে গিয়েও দিল না ফরাহিম রেজা। ইদি আমিন আর না থাকলেও তাকে দেখতে যাওয়া যাবে না এখন। তবে... দুই দিন আগেও না সব ঠিক ছিল। হঠাৎ এমন কী হয়ে গেল, প্রাক্তন শ্যালিকা বর্তমান বউকে বিধবা করে চলে গেল ইদি আমিন! তার লাশ দাফন করা হবে কোথায়? কারা দাফন করবে? সহৃদয় কয়েকজন পুলিশ? এই তো হচ্ছে। করোনার মৃতরা অস্পৃশ্য যেনবা।
মিস অউলকে কল দিল ফরাহিম নবী মিস অউল ফোন সাইলেন্ট করে ঘুমাচ্ছে। ফরাহিম নবী তার ফোন অফ করে দিল। খাটে উঠে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে অন্ধকারতর একটা আকৃতি দেখল। খাটে শুয়ে আছে। মিস অউল। আঠারো দিন ধরে তারা আছে একসঙ্গে। মিস অউল আজ মদ খায়নি। কাল রাতে বেহেড মাতাল হয়েছিল। মিস অউল রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে। তার সাংসদ মা ফোন করেছিলেন দুপুরে। মহিলাকে মিস অউল বলেছে, ‘আমরা যথেষ্ট ভালো আছি মা। তুমি দশ হাজার টাকা পাঠাও।’
আমরা বলতে ফরাহিম নবী এবং সে না। মিস অউল থাকে নিকেতন এলাকায়। নিকিতা, ফারিয়া এবং মিস অউল। নিশ্চিত সাংসদ তৎক্ষণাৎ মেয়েকে দশ হাজার টাকা ট্রান্সফার করে দিয়েছেন।
ইদি আমিনসহ দেশে আজ মোট কতজন মরেছে করোনায়?
পৃথিবীতে কতজন মরেছে?
টিভিতে, অনলাইনে কয়েকবার দেখেছে। ফরাহিম নবী এখন মনে করতে পারল না। থাক। কিন্তু, আজ ধরল না তেমন। থাক। সব দিন ধরতে হবে নাকি? সব সময় ধরে?
কী ভীষণ এই করোনার রাত।
মিস অউল কিছু পরে শোয়নি। ফরাহিম নবী তার পাশে শুয়ে পড়ল।
পরদিন কিছুই ঘটল না।
পরদিন দরজার লক ভেঙে ঢুকে ফরাহিম নবীর লাশ উদ্ধার করল পুলিশ। টেলিভিশনে স্ক্রল দেখাল সন্ধ্যায়, বিষাক্ত মদ পান করে এক ব্যক্তির মৃত্যু। দেখে প্রথমত বিরক্ত হলো, দ্বিতীয়ত বিরক্ত হলো এবং তৃতীয়ত সহানুভ‚তিশীল হলো আরশাদ আওসাফ। গাধার বাচ্চা গাধা!