×

সাময়িকী

বাড়ি ফেরার গল্প

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ০৫:০৩ পিএম

বাড়ি ফেরার গল্প
নাহ্, মিজান সাহেব যেমনটি ভেবে রেখেছিলেন তেমনটি কিছুতেই হলো না। এর নাম ঢাকা শহর যে! এ শহরের অলিগলিতে প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতারণার ফাঁদ পাতা। সতেরো বছর পাঁচ মাস তেরো দিনের সম্পর্ক যার সঙ্গে তার চরিত্র কি বাকি থাকে চিনতে! চটুল রমনীর মতো ছলাকলা তো কম জানে না এই নগরী! চটকদার রূপের ঝলকানিতে চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিলেও ভেতরে মাকাল ফল, অন্তঃসারশূন্য। কেউ কথা রাখে না এখানে, পাঁকাল মাছের মতো সবাই গা বাঁচিয়ে চলতে চায়; কাকে দোষ দেবেন আর কাকে সাধু বলবেন! ট্রাক-লরি-পিকআপ ভ্যান নিয়ে যাদের পরিবহন ব্যবসা, তাদের মধ্যে কজনই বা কথার দাম রাখে! মুখের কথায় নটাকে ছটা আর ছটাকে নটা করার ওস্তাদ ওরা, ধাক্কা খেতে খেতে এই ঢাকা নগরীর সঙ্গে ওরা এভাবেই অ্যাডজাস্ট করে নিয়েছে; কারো তর্জন-গর্জন কিংবা চোখ রাঙানির তোয়াক্কা করে না, মিজান সাহেব তো এনজিও কর্মকর্তা মাত্র। মিজান সাহেব চেয়েছিলেন সারারাত ধরে বাঁধাছাঁদা করে ট্রাকে মালপত্তর সাজিয়ে একবারে ভোরবেলা বাসার সামনে থেকে রওনা দেবেন। ফজরের আজান হয়ে গেলে বি-বøকের মসজিদে না হয় শেষবারের মতো নামাজ আদায় করে নেবেন। খুব তাড়াহুড়ো হলে পুরো নামাজ না পড়ে দুই রাকাত ফরজ পড়েই বেরিয়ে পড়বেন। দূরের পথ, সকাল সকাল রওনা হতে পারলেই ভালো। বাঁধাছাঁদা-ট্রাক লোড দেয়া এসব নিয়ে বিস্তারিত কথা হয়েছে আলিফ এন্টারপ্রাইজের লোকজনের সঙ্গে। তারা আশ্বস্ত করেছে আপনি কিছু ভাববেন না। আমাদের লোকজন সব ঠিকঠাক করে দেবে। তা বটে প্রফেশনালিজম বলে কথা! একই কাজ বারবার করতে করতে মানুষের দক্ষতা বাড়ে, ভেতরের সুপ্ত ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তা না হলে মাত্র এক-দেড় ঘণ্টার মধ্যে সমস্ত মালামাল পাঁচতলা-সাততলা থেকে নামিয়ে ট্রাকে তুলে সাজানো তো সোজা কথা নয়! এই সাড়ে সতেরো বছরের মধ্যে সেই গোড়ার দিকে মিজান সাহেব একবার মাত্র বাসা বদল করলেও এই ঢাকা শহরে একাধিক সহকর্মীর বাসা বদলের ঝক্কি-ঝামেলা খুব কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে, এমনকি দু’এক জায়গায় নিজেকে হাত লাগাতেও হয়েছে। সে ওই প্রাথমিক গোছগাছ বা নানান সাইজের বস্তার মুখ বাঁধাছাঁদা পর্যন্তই; মূল টানাটানি করে কোম্পানির লোকেরাই। ড্রাইভার-হেল্পারের সঙ্গে নির্দিষ্ট সংখ্যক লেবারও সেঁটে দেয়া থাকে, তারাই অতি দ্রুত সব সম্পন্ন করে। চাহিদা মতো টাকা-পয়সা মেটাতে পারলেই সব পরিষ্কার। লেনদেনের ব্যাপারে খটমটে হলেও কাজকর্মে কোনো গাফিলতি নেই। এই ঢাকা শহরের মধ্যেই বিভিন্ন ব্রাঞ্চ-অফিসের ছোটখাটো টানাটানির কাজে আলিফ এন্টারপ্রাইজ তো ভালোই সার্ভিস দিয়েছে, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই মিজান সাহেব এই দূরের খেপও তাদের দায়িত্বে দিয়েছে। কিন্তু এখন কার্যক্ষেত্রে হলোটা কী! সারারাত কারো কোনো পাত্তা নেই। ২৪ ঘণ্টা সার্ভিসের কথা বলে, অথচ রাত বারোটার পর আর ফোনই ধরে না। কী টেনশন! কী টেনশন! মধ্যরাত পেরিয়ে যাবার পর ক্ষোভে-দুঃখে যখন মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলার দশা, তখন একবার উত্তরবঙ্গ এন্টারপ্রাইজের ওহাবের কথা মনে পড়েছিল। সে তাকে সাবধানও করেছিলÑ আলিফর কথা বাদ দ্যান। ঢাকা শহরের ওদের যত ক্যাদ্দানি আর মস্তানি! ঢাকার বাইরে ওদের খবর নাই। মিজান সাহেব একে বিজনেস-জেলাসি বলেই গণ্য করেন। এমন হয়। একই প্রফেশনের মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতার বদলে ঢুকে পড়ে হিংসা-বিদ্বেষ। একে অপরের ভালো কিছুই দেখতে পায় না, খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে পরস্পরের সম্পর্ককে, আর নির্লজ্জভাবে নিজের ঢাক পেটাতে থাকে। আলিফ এন্টারপ্রাইজের সঙ্গে দাম দস্তর ফাইনাল করার সময় তারা এমনভাবে কথার প্যাঁচে আঁকড়ে ধরে যে মিজান সাহেবকে কবুল করতেই হয় তিনি উত্তরবঙ্গ এন্টারপ্রাইজেও একবার খোঁজ-খবর নিতে গিয়েছিলেন, এই দুঃসময়ে শ’পাঁচেক টাকাও যদি কমানো যায় সেই প্রত্যাশায়। ভেতরের ইচ্ছেটাকে ঢেকে রেখে তিনি কায়দা করে বলেন, ‘না মানে, ওহাব তো আমাদের উত্তরবঙ্গের মানুষ, তাই একটু ..., ‘কিয়ের উত্তরবঙ্গ! হ্যারে আপনি চিনেন?’ না, মিজান সাহেব মোটেই চেনেন না। উত্তরবঙ্গের সাইনবোর্ড দেখে এগিয়ে যাওয়া। তবে সে অখাতির কিছু করেনি। বরং উত্তরবঙ্গের মানুষ জেনে বেশ খানিকটা সম্মান করেছে। কিন্তু সেসব কথা না বলে তিনি কথা ঘুরিয়ে নেন, ‘আরে আমি তো চিনি আপনারে!’ আলিফ মিয়া খুশি হয়। মাথার টুপি খুলে ফুঁ দিয়ে আবার মাথায় পরিয়ে বলে, ‘তাইলে হের লগে কিয়ের কাম! ও হইল গিয়া টঙ্গীর টাউট। সিরাজগঞ্জে সেকেন্ড ম্যারেজ কইরা উত্তরবঙ্গের ভেক ধরছে। আপনে যাইবেন কই, খুইলা কন।’ গন্তব্য রংপুর কুড়িগ্রাম শুনে ফিক করে হেসে ওঠে, ‘অ বুঝছি, এর লাইগা যান উত্তরবঙ্গ! তা কত চাইছে ওই উত্তরবঙ্গের বাটপার?’ ‘কী মুশকিল! তার সঙ্গে আমার কোনো দামদরের কথায় হয়নি।’ মুখের গহ্বরে পানের খিলি ঢুকিয়ে আলিফ মিয়া কটাক্ষ করে, ‘উত্তরবঙ্গের জামাই দেইখ্যা হে মাংনা দিবনি এক ট্রিপ!’ মিজান সাহেব ধীরে ধীরে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। উত্তরবঙ্গ এন্টারপ্রাইজে একবার কথা বলে কী এমন অন্যায় করেছেন তিনি যে না-হক এত কথা শুনতে হবে! ভেতরের গজগজানি নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই, আলিফ মিয়া খপ করে হাত চেপে ধরে, ‘বয়েন বয়েন ভাইজান। রাগ হইছেননি? কতা ফাইনাল কইরা যান।’ এরপর আরো কিছুক্ষণ বকবকানি শোনায় আলিফ মিয়া। উত্তরবঙ্গের ওহাব যে ভাড়া চাইবে, সে তার চেয়ে পাঁচশ টাকা কমে কাজ করতে রাজি। ভালো ট্রাক দেবে, ভালো লেবার পাঠাবে, এক ঘণ্টার মধ্যে মালামাল নামিয়ে ভালোভাবে সেট করে দেবে; তারপর ফজরের আজানের পর রওনা কথাবার্তা এভাবেই ফাইনাল হয় আলিফ মিয়ার সঙ্গে। দিন, তারিখ, সময় সব টুকে নেয় তার টালিখাতায়। শেষবেলায় এক গাল হাসির সঙ্গে জর্দার ঘ্রাণ ছড়িয়ে বলে, ‘আপনে আমার পুরানো কাস্টোমার না! কুনু চিন্তা কইরেন না। সব দায়িত্ব আমার!’ চিন্তা তো হওয়ারই কথা। বাসার সামনে ট্রাক এসে পৌঁছবার কথা রাত দশটার মধ্যে। কোথায় দশটা! ফোন করলেই আলিফ মিয়া জানায়। ট্রাক আইতাছে, চিন্তা কইরেন না। এগারোটা গেল, বারোটার পর আলিফ মিয়ার ফোন বন্ধ। তখন চিন্তা না হয় কার! ভোর পাঁচটার দিকে হঠাৎ অচেনা নম্বর থেকে ফোন আসায় চমকে ওঠেন মিজান সাহেব। মানসিক অস্থিরতার মধ্যেও চোখের পাতায় একটুখানি তন্দ্রা নেমে এসেছিল কি! নইলে এমন ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ধড়ফড় করে উঠবেন কেন? তাড়াতাড়ি লা-ইলাহা কলেমা পড়ে বুকে ফুঁ দেয়ার পর মোবাইলের ইয়েস বাটন টিপে কানে ধরেন, ‘হ্যালো! স্লমালেকুম!’ অপর প্রান্ত থেকে আছড়ে পড়ে গভীর আশ্বাস, ‘আমরা তো আইয়া পড়ছি। কত নম্বর বাসা য্যান!’ মেজাজ খিঁচয়ে যায় মিজান সাহেবের, একটু রুক্ষস্বরে জানতে চান, ‘কে বলছেন আপনি?’ ‘ডেরাইভার মোতালেব কইতাছি। ফেরিঘাটে আটকা পড়েছিলাম সাব। এই যে সাত নম্বর রোডে ঢুকছি। বাসা নং ...।’ ‘বাসা নং সাঁইত্রিশ। কালভার্টের বামে।’ ‘অ। এই যে, আইয়া পড়ছি।’ আলিফ মিয়া সময়ের নড়চড় করলেও অন্যান্য কথা মোটামুটি ঠিকই রেখেছে। বিশেষ করে পরিবহনের ট্রাকটি বেশ পছন্দ। মালবাহী গাড়ি হলেও ড্রাইভারের পেছনে যে কেবিনের ব্যবস্থা আছে, তাতে দুই ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীসহ মিজান সাহেবের বেশ সংকুলান হয়ে যায়। কিন্তু সেই ভোরবেলায় লেবার-টেবার ডেকে হেঁকে মালপত্র নামিয়ে গাড়ি ছাড়তে ছাড়তে সকাল নটা। এ নিয়ে কিছু বলতে গেলেই মোতালেব ড্রাইভার একেবার আলিফ মিয়ার মতো করে বলে, ‘টেনশন লইবেন না সাব, সব দায়িত্ব আমার।’ তা বটে, অচিরেই বুঝা গেল লোকটা যথেষ্ট করিৎকর্মা। ঘুম ভাঙিয়ে লেবার ডেকে এনে তাদের সঙ্গে নিজেও হাত লাগায় এবং বিরক্তিহীনভাবে কাজ করে চলে। কিন্তু মৃদুলের তো আর তর সয় না। সন্ধ্যা থেকে অস্থির কখন আসবে ট্রাক, আসছে না কেন, কত প্রশ্ন তার! খাট-বিছানা গুটিয়ে ফেলার পর শোবার জায়গার নেই ঠিক ঠিকানা। মোহনা ঘুমিয়েছে সোফার উপরে। ভোরবেলায় ঘুম ভাঙার পর থেকে সে গুম ধরে বসে আছে ঘরের কোনায়। আজ নয়, মন খারাপ তার আরো আগে থেকে, ঢাকা ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত সে মানতেই পারেনি। ক্লাস এইটের ছাত্রী সে, অনেক কিছুই বুঝতে পারে, হয়তো সে কারণেই চুপচাপ। কিন্তু ভোরবেলায় মায়ের কোল থেকে জেগে ওঠার পর থেকে মৃদুলের দৌড়ঝাঁপের শেষ নেই। এই চারতলা থেকে কতবার যে তার ওঠানামা হলো তার তো গোনাগুনতি নেই। বাবার ধমকানি খাবার পরে বারবার নিচে এসে ড্রাইভার-হেল্পারকে জিজ্ঞেস করে, ‘আর কতক্ষণ আংকেল? কটার সময় ছাড়বেন?’ মোতালেব ড্রাইভার এরই মধ্যে মিটমিট করে হাসে, শিশুদের বেশ পাত্তা দেয়, ‘মামাবাড়ি যাইবেন তো আংকেল?’ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে একটু সময় লাগে মৃদুলের। মামাবাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত তো সে জানে না। অবশ্য তার দাদিবাড়ি থেকে মামাবাড়ি দূরত্ব এমন বেশি নয়। অনেকদিন পর দেশে যাচ্ছে, মামাবাড়িও যাওয়া হবে নিশ্চয়। সে একটু বুদ্ধি খাটিয়ে উত্তর দেয়, ‘আমরা তো যাব কুড়িগ্রামের রৌমারী।’ হাতে কাজ করতে করতে মোতালেব বলে, ‘হেইডা তো জানি। হেইখানে তোমাগো মামাবাড়ি না?’ ‘মামাবাড়িও আছে, দাদুবাড়িও আছে। আমরা যাব দাদুবাড়ি।’ মৃদুল দাদুবাড়ির কথাই স্পষ্ট জানিয়ে দেয়। এ নিয়ে সে মা-বাবার মধ্যে বিস্তর তর্কাতর্কি শুনেছে। তর্কের কারণ স্থান-সংকুলানের প্রশ্ন নিয়ে। মৃদুলের মামাবাড়ি রৌমারী পৌরসভার মধ্যে, টিনশেড হলেও বেশ গোছানো, বাইরের দিকে দুটো ঘরে ভাড়াটের বাস। মৃদুলের মায়ের ইচ্ছে ভাইকে বলে ভাড়াটে তুলে দিয়ে সেইখানে তারা উঠবে। মিজান সাহেবের তাতে প্রবল আপত্তি। এ কি দু’দশ দিনের ব্যাপার! কতদিন এ রকম যাযাবর-জীবন কাটাতে হবে তার ঠিক আছে! পিতা বেঁচে নেই তাতে কী, তবু তিনি পৈতৃক ভিটেতে উঠতেই আগ্রহী। নদীভাঙন এলাকায় তাদের বাড়িঘর, নদীর হা-এর মধ্যে আশৈশব বসবাস। আবাদি জমি কতবার গিলে খেয়েছে নদী, বসতবাড়িও যে কোনো সময় সাবড়ে দিতে পারে। সেই ভয়ে শক্তপোক্ত দালানকোঠা করা হয়নি। বড় ভাই স্থানীয় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। চাকরি হারানোর পর ছোট ভাই সপরিবারে বাড়ি চলে আসতে চাইছে জেনে প্রথমে একটু অস্বস্তিতে পড়েন তিনি। ঢাকার বাসার অত সব জিনিসপত্র কোথায় রাখবে, কতদিনই বা থাকবে তারা সেই হিসাবে মেলাতে গিয়ে মাথা ঘুরে ওঠে, তাঁর স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে যায়। হোক এনজিওর চাকরি, দীর্ঘ সতেরো বছরে একটি ভাই ঢাকা শহরে থিতু হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে জেনে তাঁর খুব গর্ব হয়, আনন্দ হয়, আবার ভরসাও হয় কখনো যদি ভাইপো-ভাইঝিদের টেনে উপরে তোলে। চাকরিজীবী ছোট ভাইয়ের কাছে তো কোনোদিনই কিছুই চাননি, কেবল নিভৃতে ওইটুক স্বপ্ন পুষে রেখেছেন বুকের ভেতরে। সেই ভাই এতদিনের ঢাকার বাস তুলে দিয়ে গ্রামে ফিরে আসবে, এ যে একেবারে তাজ্জব হবার মতো কথা! মোবাইল ফোনে বড় ভাইকে জানিয়েছেন কাদায় পড়ে গেছি, প্রতিদিন তলিয়ে যাচ্ছি কাদায়, প্রতি মাসে বাসা ভাড়া টানতে হচ্ছে কুড়ি হাজার টাকা; এখন পালাতে পারলেই বাঁচি। এ কথা শোনার পর বড় ভাই মসিউর রহমান স্থির থাকেন কী করে! কাদায় ডুবে যাচ্ছে ছোট ভাই! দিন যত গড়াবে আরো তলিয়ে যাবে! কী ভয়াবহ কথা! সেই কবে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় গেছে কোনোদিন কিছুই চায়নি তো সে! এই বাড়িঘর, মাঠের ফসল (পরিমাণে যা-ই হোক), সব কিছুতে তার অধিকার আছে। অথচ কখনো সে এক মুঠো চাল কিংবা মসুরের ডাল পর্যন্ত দাবি করেনি। সেই মানুষ এখন বাড়ি ফিরতে চায়, এর আবার অনুমতি কী! মনের কোনে লুকানো দ্বিধা সম্পূর্ণ ঝেড়ে ফেলে মসিউর রহমান জানিয়ে দেন, ‘চলে আয় তুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বাড়ি চলে আয়।’ মিজানুর রহমানের চোখ ভিজে যায়, কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হয়ে আসে। বড় ভাই আবারো বলেন, ঢাকা থেকে গ্রামে এসে ছেলেমেয়েদের কষ্ট হবে। কিন্তু কী আর করা, আগে প্রাণে তো বাঁচুক। কত মানুষ ভয়াবহ এই দুঃসময়ে মৃত্যুভয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। মিজানুর তো সেভাবে পালাতে চায়নি। সেই মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থেকেছে ঢাকায়, চাকরি হারিয়ে সাধ্যমতো চাকরি খুঁজেছে; অতপর বাতি নিভে যাওয়া অন্ধকারে আর কত সাঁতরাবে সেঁ! নিজে থেকে ফোন করেন, ‘চলে আয় মিজান। কোনো চিন্তা করিস না। বাড়ির দক্ষিণে টিনের ছাপড়া করে দিচ্ছি। তোর সংসারের অত সব জিনিসপত্রের জায়গা দিতে হবে তো!’ সেই টিনের ছাপড়া ঘর তৈরি হয়ে যাবার খবর পাবার পরে রওনা দিয়েছেন মিজান সাহেব। সিদ্ধান্ত চ‚ড়ান্ত করার আগে স্ত্রীর সঙ্গে নানানভাবে মতবিনিময় করেছেন। দূর মফস্বলের যে মেয়ে বিয়ের পর ঢাকায় এসে ছটফট করত বাড়ির জন্য, ঢাকা ছেড়ে যাবার কথায় সেই মানুষ এখন কেঁদে বুক ভাসায়, মুখ গোমড়া করে কাটিয়ে দেয় দিনের পর দিন। ঢাকা শহরে তার কে আছে, কার জন্য মন খারাপ করবে, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পায় না, কিন্তু মন খারাপ করে ঠিকই। জমানো টাকা ভেঙে বাসা ভাড়া দিতে গিয়ে হাত কাঁপে, অবশেষে স্বামীর হাত ধরে ডুকরে ওঠে এভাবে আর নয়, যা ভালো হয় করো একটা কিছু! বাড়ি যাবার সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও প্রশ্ন উঠেছে গ্রামে গিয়ে চলবে কী করে? জমানো টাকায় কদিন চলবে? পাঁচ লাখ টাকার যে ফিক্সড ডিপোজিট আছে, সেটার গায়েও হাত পড়বে অচিরেই। আঁতকে ওঠেন মিজান সাহেব না না, ওটা দিয়ে আমি তো ব্যবসা করব রৌমারী বাজারে। ওখানে হাত দিতে পারব না। এত সব ভাবনা-দুর্ভাবনার কথা শুনে বড় ভাই মসিউর রহমান একদিন খুব আশ্বস্ত করেনÑ সে একটা কিছু হবে। তুই চলে আয় দেখি। রুজির মালিক আল্লাহ। তিনিই দেখবেন, এভাবে আশ্বস্ত করার পরও হঠাৎ তিনি বলেন, ‘ছোটবেলায় তুই তো ভালো ছাত্র ছিলি মিজান, গ্রামে প্রাইভেট পড়াতে পারবি না? আমিই ঘুরে ঘুরে ছাত্র জোগাড় করে দেব। স্কুলের ছাত্র, মাদ্রাসার ছাত্র, পারবি না পড়াতে?’ তাহলে তো ভালোই হয়। মিজান সাহেব বেকারত্ব নিয়ে উৎকণ্ঠিত থেকেছেন, কিন্তু এ লাইনে তো মোটেই ভেবে দেখেননি। প্রাইভেটের একটা ব্যাচ খুলতে পারলে তো নিজের ছেলেমেয়ে দুটোকেও সঙ্গে নিয়ে বসা যায়। ইশকুল-টিশকুল কিছু নেই, ওরা বসবে তো বাবার কাছে! ওরা তো বাবাকে কখনো শিক্ষক হিসেবে দ্যাখেনি! এনজিওর চাকরিতে টাকা-পয়সা একটু ধরে দেয় বটে কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাঁধে থাকে অসম্ভব কাজের চাপ। নিশ্বাস নেবার সময় থাকে না, সন্তানদের উপরে মাস্টারি করবে কখন! তাছাড়া নিজে ভালো ছাত্র হলেও শিক্ষকতার কাজটা তার কখনো ভালো লাগেনি। অথচ এই ঢাকা শহরে টিউশনি দিয়েই শুরু হয়েছিল জীবন-জীবিকার লড়াই। সে আমলের দু’একজন ছাত্র বড় হয়ে যাবার পরও তাঁকে চিনতে পারে, সালাম দেয়, বেশ ভক্তিটক্তিও করে। তখন আবার বেশ ভালোই লাগে। দেখা যাক জীবনযুদ্ধের এই পর্বে শিক্ষকতা যদি ভালো লেগেই যায়, তাতে মন্দ কী! বড় ভাইকে জানিয়ে দেন আচ্ছা, বাড়ি আসি তো আগে, তারপর একটা কিছু করলেই হবে। গাড়ি ঘুরানোর সুবিধার্থে মোতালেব ড্রাইভার বনশ্রীর বি-ব্লকের শেষ মাথা দিয়ে সি-ব্লক হয়ে ঢুকলে মৃদুলের ভালোই হয়। ওদের সানরাইন প্রি-ক্যাডেটের সামনে দিয়ে যাবার সময় সে আবদার জানায় ড্রাইভার আংকেল একটু দাঁড়ান না প্লিজ! মিজান সাহেব ধমকে ওঠেন, ‘কেন, এখানে আবার কী হলো!’ মিজান সাহেবের বিরক্ত হওয়ার কারণ আছে। এমনিতেই ঢের দেরি হয়ে গেছে। গাড়িতে উঠেও আবার নেমে পড়ে মৃদুলের মা, লাফিয়ে ওঠে চারতলা বাসায়। ফেলে যাওয়া কোনো কিছুর কথা মনে পড়েছে হয়তো। কিন্তু সে আর নামে না। দশ মিনিট পরে মিজান সাহেব উঠে গিয়ে দেখেন পরিত্যক্ত বেডরুমের বেলকানিতে দাঁড়িয়ে সে অঝোরে এবং নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছে। ছোট্ট এই বেলকানিজুড়ে দাম্পত্য জীবনের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে ঠিকই, তাই বলে এই অসময়ে মেয়েলি সেন্টিমেন্টের কোনো মানে হয়! টবের ক্যাকটাস গাছের দিকে তাকিয়েও নির্মোহ ভঙ্গিতে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেন মিজান সাহেব। ট্রাকে তিল ধারণের আর জায়গা নেই। তিনি স্ত্রীর হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে ট্রাকের কেবিনে উঠে বসেন। আবার একটুখানি চাকা গড়াতে না গড়াতেই পুত্রের আবদার। অবলীলায় সে জানায় আমাদের ইশকুল বাবা। ওই যে গেটের মুখেই কলা বিক্রি হচ্ছে, কলা নেবে না? এমন বিব্রত এবং বিপন্ন মুহূর্তেও ‘রথ দেখা ও কলা বিক্রি’র প্রবাদটা মনে পড়ে যায় মিজান সাহেবের। সকালে তাড়াহুড়োর মধ্যে কলা-পাউরুটি দিয়ে নাস্তা করার সময় কলা কম পড়ে এবং তখন কথা হয় পথে নেমে কলা কিনে নেয়া হবে। তাই বলে এখনই কলা পাওয়া যাবে, কে জানত সে কথা! নাকি যাবার বেলায় এতদিনের প্রিয় ইশকুলটি একবার দেখে যাবার সাধ হলো মৃদুলেরও! মোতালেব ড্রাইভার ট্রাক থামাতেই বাবার সঙ্গে সঙ্গে সেও লাফ দিয়ে নেমে পড়ে কেবিন থেকে। সোজা গিয়ে দাঁড়ায় কলা বিক্রেতার সামনে। হাত তুলে সালাম জানায় ভক্তিভরে। তারপর বলে, ‘আপনাকে আমি টিভির খবরে দেখেছি স্যার।’ মিজান সাহেব বিস্ময়ে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকেন, বুঝতেই পারেন না ইশকুল গেটের কলা বিক্রেতা মৃদুলের স্যার হলো কী করে! কলা বিক্রেতা হাসি হাসি মুখে জানায়, ‘কী করব বাবা, তোমাদের ইশকুল বন্ধ, আমাদের বেতনও বন্ধ। সংসার তো শোনে না সে কথা!’ এতক্ষণে মিজান সাহেব এগিয়ে আসেন সামনে, জানতে চান, ‘আপনি কি এই ইশকুলের টিচার ছিলেন?’ ‘ছিলাম কেন, এখনো আছি। প্রাইভেট ইশকুুল, মাইনে দেবে কোত্থেকে!’ ‘সেই জন্যে ব্যবসায় নেমে পড়েছেন?’ কলা বিক্রেতা অসহায় ভঙ্গিতে জানায়, ‘কী করব ভাইজান, রিলিফের চাল-ডালে কয়দিন চলে। কলা বিক্রি করে যদি কিছু ইনকাম হয়!’ ‘তা, ইনকাম হয় আপনার!’ ‘দুই কেজি চালের দাম হলেই আমি খুশি। কিন্তু টেলিভিশনের সাংবাদিক এসে আমার ক্ষতি করে দিল।’ ‘কী রকম?’ কলা বিক্রেতা গভীর দুঃখে জানায়, খবরে তার ছবি দেখার পর ইশকুল গেটে অনেকেই আসে মজা দেখতে, দু’চারজন সহকর্মীও এসেছেন। তারা কেউ কলা কেনে না, বরং ইশকুল গেট থেকে সরে গিয়ে ব্যবসা করার জন্য হুমকি দেয়। মিজান সাহেব টেলিভিশন দেখেন না বেশ কদিন থেকে। আগে খবর না দেখে ঘুমোতে যেতেন না। এখন খবর দেখলে বিবমিষায় পেয়ে বসে, সত্যিই বমনের উদ্রেক হয়। সংবাদ পাঠিকা কেমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে প্রতিদিন করোনায় মৃতের ক্রমবর্ধমান পরিসংখ্যান শুনিয়ে যায়, তার লিপস্টিকের প্রলেপে একটুও ভাঁজ পড়ে না। এসব দেখতে আর মোটেই ভালো লাগে না। এর মধ্যে মৃদুল তার শিক্ষকের জীবিকা-বদলের সচিত্র সংবাদ দেখে থাকলেও সে চিত্র তার বাবা দেখেননি। এখন যা দেখছেন আর শুনছেন, তাতেই শরীরে কাঁপুনি ধরে যায়। কোনো রকম দরদাম না করে এক ছড়ি কলা তুলে নিয়ে একশ টাকার একটা নোট কলা বিক্রেতার হাতের মুঠোয় গুঁজে দিয়ে পালাতে উদ্যত হন মিজান সাহেব। কলা বিক্রেতা সে কথা শুনবে কেন, এক ছড়ি কলার দাম রেখে উদ্বৃত্ত টাকা হাতে নিয়ে ছুটে আসে ট্রাকের দরজার কাছে, জানতে চায়, ‘ভাইজান কি বাসা বদল করছেন?’ মিজান সাহেবের কথা বলতে ইচ্ছে করে না, মৃদুলের দুই হাত ধরে ট্রাকের কেবিনে ঢুকিয়ে দেন। কলা বিক্রেতা আবারো প্রশ্ন করে, ‘কোন এলাকায় যাচ্ছেন, মৃদুল আর এ ইশকুলে আসবে না?’ সহসা খাপছাড়া রকমের রুক্ষস্বরে বলে ওঠেন মিজান সাহেব, ‘বাড়ি যাচ্ছি, বাড়ি। গ্রামের বাড়ি।’ কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে মালামাল বোঝাই ট্রাক ঘোঁতঘোঁত করতে করতে সামনে এগিয়ে যায়। কলা বিক্রেতা শিক্ষক কয়েক মুহূর্ত বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাস্তার ওপরে। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে আসে ইশকুল গেটের সামনে তার অস্থায়ী কলার দোকানে। ঢাকা মহানগরীর চৌহদ্দি থেকে বেরিয়ে আসার পর মোতালেব ড্রাইভারের ট্রাক পঙ্খিরাজের মতো উড়ে চলে। আলিফ মিয়া যথার্থ কথা রেখেছে। ভালো ট্রাক যেমন দিয়েছে, তার উপযুক্ত ড্রাইভারও সঙ্গে দিয়েছে। প্রচণ্ড সদালাপী একটা মানুষ। মুখের গহ্বরে ঘণ্টায় দুটো করে পান ঢোকাতে পারলেই মেজাজ ফুরফুরে। কেউ শুনুক আর না-ই শুনুক, এরপর তার বিরতিহীন বকবকানি চলতে থাকবে। পথে পথে ঘোরে বলে কত রাজ্যের কত রকম খবর যে তার মাথার ভেতরে জ্যাম হচ্ছে তার কি শেষ বলে কিছু আছে! করোনার ভয়ডর বলেও কিছু নেই তার। মুখে মাস্ক পরলে ঘন ঘন পান খাওয়া এবং পিক ফেলার অসুবিধা, তাই মাস্কের একটা হ্যান্ডেল এক কানে ঝুলিয়ে রেখেছে মাত্র, পুলিশ-টুলিশ ধরলে তখন অপর হ্যান্ডেলের সুতো টেনে অন্য কানে বেঁধে একেবারে ভালো মানুষ হয়ে যায়। সগৌরবে ঘোষণা করে মরণ-বাঁচন সেই এক আল্লাহর হাত। যেদিন থিকা টিরাকের ডেরাইভার হইছি, মরণরে মাইন্যা লইয়াই স্টিয়ারিং ধরছি। করেনা-ফরোনায় কীয়ের ডর? নতুন এই ভ‚তের ডরে মাইনষের জীবন এ্যাক্কেরে ওলোট-পালোট হইয়া গেল গা। জীবনের ওলোট-পালোটের কতটুকু যে মোতালেব ড্রাইভার দেখেছে সে কথা সে-ই জানে। আল্লাহর ওপেের তার অগাধ বিশ্বাস। তার ধারণা মানুষের ইমানের জোর কমে গেছে বলেই এসব গজব নেমে এসেছে, সমাজে পাপ লেগেছে। একদিন এর অবসান হবেই, যেহেতু আল্লাহ রহমানুর রহিম, গাফুফুর রহিম। ক্ষমা তিনি করবেনই। মিজান সাহেবের ভালো লাগে না এত বকবকানি। মোতালেব ড্রাইভার কারো ভালো লাগা না লাগার তোয়াক্কা করলে তো! এই ট্রাকের হেল্পার জুব্বার হচ্ছে তার সাগরেদ। কথার ফাঁকে ফাঁকে ইচ্ছে হলেই সে জুব্বারের সমর্থন চায় ‘কী কছ জুব্বাইর‌্যা?’ সাগরেদও জুটেছে ভালো, বুঝে হোক না বুঝে হোক সে ঘাড় দুলিয়ে সমর্থন জানায়, ‘হাচাই কইছেন ওস্তাদ।’ ব্যাস, ওইটুকু সমর্থন পেলেই হলো, ওস্তাদকে আর থামায় কে, তার বয়ান চলতেই থাকে অর্গলহীন। মোতালেবের মুখের দাড়ি এবং মাথার জাল-টুপিকে প্রথমে করোনাকালীন অর্জন মনে হলেও কাছে থেকে দেখার ফলে মিজান সাহেবের মনে হয় এর শেকড় অনেক গভীরে। নিজের গালে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবেন, সবাই কি আমার মতো নাকি! ট্রাক ছুটে চলেছে তীব্র বেগে হা হা করে। কত না পরিচিত পথ-প্রান্তর পেছনে ফেলে তারা এগিয়ে চলেছে সামনে রংপুরের কুড়িগ্রাম, কুড়িগ্রামের রৌমারী, ধরলা নদী আর দুধকুমারের পাড়ে। মায়ের কোলে ঢলে পড়েছে মৃদুল। মোহনার চোখে ঘুম ঘুম ঢুলুনি। সহসা মিজান সাহেবের চোখে ভেসে ওঠে বৃদ্ধ মায়ের এবং বড় ভাইয়ের ছবি। মনে পড়ে যায় ছোট বোন মরিয়মকে। আহা, কতদিন পর দেখা হবে জান পস্তানো স্বজনদের সঙ্গে! মায়ের চোখে ছানি পড়েছে, ভালো দেখতে পায় না। ভাবনা হয় এই শ্মশ্রুমণ্ডিত চেহারায় মা চিনতে পারবে তো তাকে? বড় ভাই অবশ্য চেহারার এই পরিবর্তন দেখে খুব খুশি হবেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাড়ির সামনে নিজের জমিতে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তাঁদের মরহুম পিতা, যোগ্য সন্তান মওলানা মসিউর রহমান সে মসজিদের দেখভাল করেন, পাড়ার মুসল্লিদের আঙ্গুল তুলে দেখান নদী ভাঙনের গতিবিধি দেখেছ? অজগরের মতো রাক্ষুসী নদীতেও ভয় পায় খোদার ঘর মসজিদকে। সেই কারণে নিজের গতিপথ বদলে নিতে বাধ্য হয়। তাঁর প্রবল বিশ্বাস, বাড়ির দক্ষিণে এই মসজিদ থাকার কারণে নদীর ছোবল থেকে তাঁদের বাড়িটি এতদিন রক্ষা পেয়েছে। ছোট ভাইয়ের বাসার মালামাল রাখার জন্য তিনি অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে টিনের ছাপড়া ঘর তুলে দিয়েছেন জাগ্রত সেই মসজিদের পাশেই। মিজানুর রহমানের মুখে নবীর সুন্নত দেখে বড় ভাই খুবই খুশি হবেন এতে কোনো সংশয় নেই। বলতে গেলে বাড়ির উঠোনে মসজিদ, সেখানে পাঁচবেলা নামাজ আদায় করতে দেখলে তো আনন্দে আত্মহারা হবার কথা। সত্যি বলতে কী ছোট ভাইটি মেধাবী ছাত্র বলে গ্রামের সবার মতো তিনিও গর্ব অনুভব করেন, কিন্তু ধর্মকর্মে তার উদাসীনতায় চিরদিনই তিনি মর্মে মর্মে ব্যথিত ছিলেন। এবার সেই ভাইয়ের পরিবর্তন দেখে নিশ্চয় নিঃশেষে মুছে যাবে সেই ব্যথা। মিজান সাহেব মনে মনে বড় ভাইয়ের মুখে প্রসন্নতার ছবি দিব্যি দেখতে পান! মায়ের পেটের ভাই, এর কি কোনো তুলনা হয়। সেই সকাল থেকে মোবাইল ফোনে খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে গেছে। ফি আমানিল্লাহর সঙ্গে বারবার উচ্চারণ করেছেন সবাই মিলে নিরাপদে বাড়ি চলে আয়। তোর ভাবির রান্নাবান্না হয়ে গেছে। চলে আয়। দীর্ঘপথের ক্লান্তিতে মিজান সাহেবেরও কি তন্দ্রা নেমেছিল চোখের পাতায়! নইলের স্বপ্নের ঘোর এলো কেমন করে! স্বপ্নই তো বটে! এই যে মোবাইল ফোন পকেটেই আছে! শেষ কথা হয়েছে অনেকক্ষণ আগে। তবু বড় ভাইয়ের কণ্ঠ যেন তার কানের দুয়ারে বেজেই চলেছে। আচ্ছা, মানুষের কণ্ঠস্বর কি কখনো নদীর কলতানের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে পারে! ধরলা বা দুধকুমারের মতো মমতামাখা হয়! পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে বড় ভাইয়ের নম্বর টিপে কানে ধরেন মিজান সাহেব। রিংটোন বেজে বেজে শেষ হয়ে যায়। একবার। দুবার। তিনবার। নাহ, কেউ ধরে না। কপালে ভাঁজ পড়ে হলো টা কী! অবশ্য আর বেশি পথও নেই। জামালপুর হয়ে আসার কারণে পথের সুবিধা হয়েছে কিছুটা। কিন্তু সকাল থেকেই আকাশটা নুয়ে গেছে গর্ভবতী মেয়ের মতো। সারাদিন রোদের দেখা নেই। বৃষ্টিফিষ্টি নামের আগে বাড়ি পৌঁছতে পারলে হয়। ভাই-ভাবি, বাড়ির ছেলেপুলে তাদের পথ চেয়ে আছে। মৃদুলের গায়ে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন এই দ্যাখ, চোখ মেলে দ্যাখ না, এই যে তোর দাদি বাড়ি এসে গেছি। এই মৃদুল, ওঠ না! সত্যি সত্যি মৃদুল-মোহনার দাদি বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে একেবারে বেলা পড়ে যায়। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই মানব জটলা দেখে চমকে ওঠেন মিজান সাহেব, হৃদপিণ্ড দুলে ওঠে পেন্ডুলামের মতো এই অবেলায় এত মানুষ কেন এখানে! গ্রামের কৃতী সন্তানের গৃহে প্রত্যাবর্তনে আনন্দ-আপ্লুত গ্রামবাসী কি তবে নদীতীরে এসে দাঁড়িয়ে আছে সংবর্ধনা জানাবার জন্য! কিন্তু এতকালের চেনা বাড়ির সামনেকার মসজিদটা গেল কোথায়? ট্রাকের সংকীর্ণ দুয়ার খুলে লাফিয়ে নেমে পড়েন মিজান সাহেব। জন্মভ‚মির মাটিতে পায়ের স্পর্শ লাগতেই নিমিষে তিনি বুঝে ফেলেন সবকিছু। খোদার ঘর বলে এবার আর ক্ষমা করেনি নদী। ওপারের তিস্তা নদীর জোয়ার এসে এপারের ধরলা-দুধকুমারের বুকেও এনে দিয়েছে যৌবনের উগ্র আবেগ। কিছুক্ষণ আগে ভাসিয়ে নিয়েছে মসজিদ, এখন ছোবল চলছে নবনির্মিত টিনের ছাপড়া ঘরের ওপরে। মাটি ফাটলের হাঁ একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দুঃসাহসী কিছু যুবক তবু দ্রুত হাতে টিনগুলো খুলে ফেলার চেষ্টা করছে। ভাঙনের দৃশ্য দেখে দেখে অভ্যস্ত নদীপারের অন্যান্য মানুষ নিতান্ত কৌত‚হলে উপভোগ করছে ভাঙনের খেলা। এরই মাঝে মওলানা মসিউর রহমান উদার দুই হাত বাড়িয়ে ছোট ভাই মিজানুর রহমানকে বুকের মধ্যে গ্রহণ করেন এবং শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েন। নদী নয়, মাটি নয়, বড় ভাইয়ের বুকে মাথা রেখে মিজানুর রহমান তখন পেয়ে যান সমুদ্রের সন্ধান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App