×

সাময়িকী

কুয়াশায় রোদে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ০৫:২৭ পিএম

কুয়াশায় রোদে
টেবিলের ওপর ছড়ানো কাগজপত্রগুলো গুছিয়ে নিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো শেখর। অদ্ভুত এক অস্থিরতা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাকে। ভালো লাগছে না, কিছুই আর ভালো লাগছে না এখন। নৈঃশব্দের মধ্যেও কেমন যেন কল্লোলিত এই ঘর। স্মৃতিময় এবং উদাসী। বাঁধাছকের জীবনে অভ্যস্ত সে। কোনো বড়মাপের সুখ বা দুঃখ তার নেই। তেমন কোনো সংকটের মুখোমুখিও হতে হয়নি কোনোদিন। প্রতিটি আত্মবিশ্বাসী, জেদি, স্বাধীনচেতা মানুষের জীবনে যেমন কিছু অবশ্যম্ভাবী সমস্যা থাকে তেমনই কিছু নীতিহীন প্রতিরোধ এবং দীনতার সঙ্গে সামান্য লড়াই তাকেও লড়তে হয়েছিল একসময়। আইনকানুন, উদাসীন সহনশীলতা আর শিকড়ের মধ্যে লুকিয়ে থাকা অদম্য তেজ তাকে পথভ্রষ্ট হতে দেয়নি কখনো। চা’এর কাপটা নিয়ে বারান্দায় দাঁড়ালো শেখর। রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। দু’একটা পুলিশের গাড়ি ছাড়া কোনো গাড়িও দেখা যাচ্ছে না। মানুষজনও প্রায় নেই। তাহ’লে কি এই শহরের হুজুগে মানুষগুলো, যারা কাল পর্যন্ত ‘কুছ পরোয়া নেই’ ভাব দেখিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল তারা ভয় পেয়েছে? সংক্রমণের, জরিমানার না জেলের, কিসের ভয় আজ তাদের আটকে রাখলো ঘরে? কারণ যাই হোক, শেষ পর্যন্ত শুভবুদ্ধির বাতাবরণ ফিরে এলেই ভালো। এসব নিয়ে বেশি ভেবে লাভ নেই। ভাবলেই মাথা গরম হয়ে যায়। উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কাল যেমন অনিলেশের সঙ্গে তর্কাতর্কি হলো ফোনে। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে এখন। উত্তেজনা এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন ডাক্তার। এখন নয়, অনেকদিন আগে থেকেই। কিন্তু, কেন জানি না কারণে অকারণে আজকাল প্রায়ই রেগে যায় সে। যুক্তি দিয়ে নিজেকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করেছে, শান্ত থাকার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সামান্য ব্যাপারে হঠাৎ হঠাৎই মেজাজ হারিয়ে ফেলে শেখর। কাল রাত্তিরে ঘুম ভেঙে জল খেতে উঠেছিল একবার। ছেলের ঘরে আলো জ্বলতে দেখে এগিয়ে গিয়েছিল। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়া ওর চিরদিনের অভ্যাস। আলো নেভাতে ঘরে ঢুকে দেখেছিল একমনে অফিসের কাজ করছে রক্তিম। অনেক রাত হ’ল। ঘুমোবি না? শেখরের গলা শুনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল রক্তিম... বাবা, তুমি? শরীর ঠিক আছে তো! হ্যাঁ রে। তোর ঘরে আলো জ্বলছিল তাই... কাল ভিডিও কনফারেন্স আছে সকাল ১০টায়। তাই একটু বাড়ি থেকে কাজ করার ব্যবস্থায়, তোরা তো আরও ব্যস্ত দেখছি। আরও চাপ... এই দুর্দিনে এটা তো করতেই হবে বাবা। কোম্পানি বাঁচলে, আমরাও বাঁচবো। বুঝতেই পারছো আমাদের অর্থনীতির কী হাল হতে চলেছে ... ছেলের কথায় খুশি হয়েছিল শেখর। বলেছিল তা অবশ্য ঠিক। কফি খাবি? করে আনবো? হেসে ফেলেছিল রক্তিম। ...না না একটু আগেই তো পিঙ্কি কফি দিয়ে ঘুমোতে গেল। ওরও তো কাল কি সব আছে। কাজ করছিল এতক্ষণ। তোরা ভাই-বোন দুজনেই কাজপাগল। উপায় নেই বাবা। এখন তো অস্তিত্বের লড়াই। কে যে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি কেউ জানি না। রাস্তায় হঠাৎ কিছু লোকের ছোটাছুটি এবং দ্রুতগতিতে আসা দু’টো পুলিশের গাড়ি দেখে একটু ঝুঁকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছিল শেখর। পিঙ্কি এসে পাশে দাঁড়ালো। বাবার হাত দুটো শক্ত করে ধরে জিজ্ঞাসা করলো কী দেখছো... কিছু না, ছোটাছুটি, পুলিশের গাড়ি... বোঝার চেষ্টা করছি কী ব্যাপার... হবে কোনো উৎসাহী জনতা... ছাড়ো ওসব। সরে এসো। হয় চেয়ারটায় বসো, না হয় ঘরে চলো। অমন ঝোঁকাঝুঁকি করলে আমার ভয় লাগে খুব। বারান্দার দরোজা বন্ধ করে এসিটা চালিয়ে দিলো পিঙ্কি। হেসে জানতে চাইল... কিছু খাবে? না, এই তো খেলাম। সে তো রুটিন ব্রেকফাস্ট। কতদিন, সবাই একসঙ্গে আছি, এই আনন্দে কিছু এক্সট্রা তো চাই তাই না। সে তো খুবই ভালো। কিন্তু তোর অফিসের কাজ নেই? আছে তো... তিনটে থেকে মান্থলি মিটিং... দাঁড়াও চিঁড়ের পকোড়া বানিয়ে আনি। দা’ভাই তো সকাল থেকেই ব্যস্ত ল্যাপটপে ...হ্যাঁ, তুইও তৈরি হয়ে নে। আমায় নিয়ে ভেবো না। সব করে ফেলবো সময়মতো। সকাল থেকে বইটা খুঁজছিল শেখর। পিঙ্কি ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলো হ্যাঁ রে, আমার ‘চিকেন স্যুপ ফর সোল’ বইটা কোথায় গেল বলতে পারিস? তোরা কেউ পিঙ্কি হাসলো। পাকোড়ার প্লেটটা নামিয়ে বললো ভুলে গেলে? মানে? শেখরের দিকে স্যানিটাইজারের শিশিটা এগিয়ে দিয়ে বললো রীতা আন্টি সেদিন তো প্রায় জোর করে নিয়ে গেল বইটা। তুমি দিতে চাওনি, মনে নেই? তুমি খুব বিরক্ত হয়েছিলে। উনি চলে যাবার পর বলেছিলে ‘এ বই আর ফেরত পাবো না’। তাইতো, ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ, মানে এই অস্থিরতার সময়ে খুব দরকার ছিল বইটা। ঠিক বলেছো, মন ভালো করা সব ছোট ছোট গল্প তুমি পড়ে শোনাতে আমাদের... ভেবো না, এই অবস্থাটা একটু স্বাভাবিক হলেই আমি ফোন করে নিয়ে আসবো এখন খেয়ে বলো কেমন হয়েছে, আমি চা আনছি। তোর কাপটাও নিয়ে আয়। চায়ে চুমুক দিয়ে পিঙ্কি বললো আমি আর দা’ভাই ঠিক করেছি আজ ডিনারের পর সবাই মিলে সিনেমা দেখবো। ... কি সিনেমা? IT COULD HAPPEN TO YOU কাল ডাউনলোড করেছি। সুন্দর মন ভালো করা গল্প। তোদের তো সারাদিন কাজ থাকে। রাত্তিরে আবার বেশি বড় ছবি নয়। দু’ঘণ্টারও কম। দেখবে তো? সারাদিন টিভির খবর শুনতে শুনতে বোর হয়ে গিয়েছি। কোথাও কোনো ভালো খবর নেই। যা বলেছিস। হয় আতঙ্ক নয় চাপানউতোর । তোমার ওসব দেখার দরকার নেই। বিচিত্র মানুষজন সব। পিঙ্কির কথায় একটু হাসলো শেখর। একেবারে ওর মার মতো কথা বলার ধরন। এভাবেই তাকে আগলে রাখতো সরমা। ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজ পড়া চিরকালের অভ্যাস। এখন সেটা নিয়েও বিধিনিষেধ। চার ঘণ্টা নাকি হাত দেয়া যাবে না। কোনটার পক্ষে যে কী বৈজ্ঞানিক যুক্তি কেউ জানে না। হুজুগ আর আতঙ্ক মিলেমিশে প্রায় সবাইকে খুব সচেতন করে তুলেছে। যে যা পারে বলছে, মেনে চলার চেষ্টা করছে অন্যরা। পিঙ্কিও। বাইরে কোলাপ্সিবল গেটে পড়ে থাকা কাগজ ফ্ল্যাটে ঢুকছে বেলা ১১টা নাগাদ। চা নিয়ে তাই টিভির সামনে বসে থাকার বদভ্যাস তৈরি হচ্ছে ক্রমশ। অবশ্য খবর মানেই আক্রান্ত আর মৃত্যুর পরিসংখ্যান, কিছু মানুষের অমানুষিক কাজকর্ম, প্রতিবেশীদের অসভ্যতা, আর কিছু ভোজনরসিক নির্বোধ মানুষদের ক্রিয়াকলাপ। বাজারে, রাস্তায় এই লোকজনদের ভিড় দেখলেই মাথা গরম হয়ে যায় শেখরের। পিঙ্কি থামায়। রাগ করছো কেন? স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়, দেশে যখন ‘আইন অমান্য’ আন্দোলন হয়েছিল তখন এরা অনেকেই জন্মায়নি। কেউ কেউ শুনেছে বা পড়েছে। সুযোগ পেয়ে এখন প্রতিদিন আইন অমান্য করে দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়ে বিপ্লবী সাজছে। কে জানে হয়ত নতুন কোনো ক্রান্তিকাল আসবে। একেবারে মা’র মতো হয়েছিস। তোদের ভাষায় এতো ‘কুল’ থাকিস কি করে? কোনো প্রতিক্রিয়া নেই... থাকবে না কেন? ভালো মন্দ সবই বুঝি। অশিক্ষিত মানুষদের কথা ছেড়েই দিলাম, শিক্ষিত বিবেকহীন মানুষদের নিয়ে কি করবে বলো। আমি তাই ওসব না দেখে পুলিশের মানবিক দিকটা দেখি। গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, প্রয়োজনে চাল ডাল ওষুধ পৌঁছে দেওয়া, যতদূর সম্ভব ধৈর্য নিয়ে মানুষকে বোঝানো, প্রকৃত অসুবিধায় পড়া মানুষজনকে গন্তব্যে বা হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, নিজেরা টাকা দিয়ে রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষদের খাওয়ানো... নিজেদের শরীরের তোয়াক্কা না করে কিনা করছে ওরা... ঠিক বলেছিস অথচ কোথাও কোথাও তাদের ওপরই চড়াও হচ্ছে মানুষ। ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালের অন্য সব কর্মী, পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে নিজেদের উদ্যোগে যারা মানুষের পাশে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে, তাদের কথা ভাবো, ভালো লাগবে। খারাপ যা কিছু আছে থাক, আমরা শুধু ভালোটাই দেখবো, তাতেই আনন্দ। পিঙ্কির দিকে অবাক হয়ে তাকালো শেখর। হেসে বললো একেবারে ঠাকুমা হয়েছিস। কোথায় শিখলি এসব? কেন মা’র কাছে। মা বলতেন জীবনের ইতিবাচক দিকটা নাকি তোমার কাছেই শেখা। বলতেন দুটো চোখ আছে। একটা ভালো দেখার জন্য, একটা খারাপ... ভালো দেখবি সবসময়। হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল সে। পিঙ্কি বোধহয় বুঝতে পেরেছিল, বললো... কি ভাবছো বাপি? ভাবছি, আমার সেই ছোট্ট মেয়েটা কবে এত বড় হয়ে গেল। একটু বোধহয় লজ্জা পেল পিঙ্কি। টেবিল চেয়ার মুছতে মুছতে বললো বলতে ভুলে গিয়েছি, অনিলেশ কাকু ফোন করেছিলেন। মন্দিরা নাকি খুব অশান্তি করছে বাড়ির বাইরে বেরোনো নিয়ে, তাই আর বাজার দোকানে যাচ্ছেন না। সব না মিটে যাওয়া পর্যন্ত বেরোবেন না, কথা দিয়েছেন মন্দিরাকে। বাহ শেষ পর্যন্ত সুবুদ্ধি হলো তাহ’লে... আসলে এসব করে ও নিজেকে, বাড়ির সকলকে, পড়শিদের এবং সরকারকে বিপদে ফেলছিল, সেটা বুঝতে যে পেরেছে এটাই অনেক... সরমার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিল শেখর। সাধারণত দুপুরে ঘুমোয় না। গান শোনে। কখনো বা প্রিয় কোনো বইয়ের সঙ্গে সময় কাটায়। আজও একটা গান চালিয়ে শুয়েছিল। সরমার প্রিয় গান। তারও। ‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায় তাহা যায়’ একসময় এই গানটা খুব গাইতো শেখর। সরমার কাছে শিখেছিল। অথচ কেন জানি না এই গানটা শুনলেই আজকাল চোখে কেমন জল চলে আসে। আজও যেমন দ্বিতীয় লাইনটা শুনে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। ‘কণাটুকু যদি হারায় তা লয়ে প্রাণ করে হায় হায়’ যেমন লেখা তেমন সুর। আমাদের সকলের দুঃখ কষ্ট নিয়ে বিষাদমন্থন করে যেন তিনি পেয়েছিলেন এই সরল অথচ গভীর শব্দাবলী। খুব মন খারাপ নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল শেখর। এমন অনেক গানই আছে যা শুনতে শুনতে চোখ বন্ধ করলেই মনে হয় কোথাও যেন ঘরের মধ্যে বসে আছে সরমা। দেখতে দেখতে চার বছর হয়ে গেল তবু এখনও যেন তার অদৃশ্য পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় শেখর। গভীর রাতে লেপ বা গায়ের চাদর ঠিক করে দেওয়া, বুকের ওপর হাত রেখে ঘুমোলেই, আস্তে আস্তে হাত সরিয়ে দেওয়া, খুব জোরে ঘুরতে থাকা পাখায় ঠাণ্ডা লাগলে, হঠাৎ তার গতি কমে যাওয়া, এসব তো প্রায় রোজই হয়। কাউকে বলে না শেখর। এছাড়াও কিছু ব্যাপার এমন ঘটে যা রীতিমতো অবাক করে দেয় তাকে। খুব প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ তন্নতন্ন করেও কিছুতেই হয়ত খুঁজে পায়নি শেখর, কিংবা কোনো টাকা হয়ত হারিয়েছে বা চুরি গিয়েছে ঠিক নেই, দু’একদিন পরে সেগুলো আবার পেয়ে গিয়েছে সে। সামনের যে ড্রয়ার সে অনেকবার খুঁজেছে সেখান থেকেই পাওয়া গিয়েছে সবকিছু। এখন একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। কোনোকিছু হারিয়ে গেলে, বা কোনো অপমানে বা অকারণ অবহেলায় কষ্ট পেলে, চুপচাপ সরমার ছবির সামনে একটু দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু বলে না। আরও একটা পুরনো অভ্যাস রয়ে গিয়েছে তার। রাতে শোবার আগে সারাদিনের জমানো সব কথা পরস্পরকে বলতো দুজনেই। এখন সরমা সামনে না থাকলেও, আপনমনে প্রায় সবকিছুই বলে যায় শেখর। নিজের উদ্বেগ, আশঙ্কা, সুখ-অসুখ সবই। রক্তিম ও পিঙ্কিকে, সংবেদনশীল সুন্দর এবং প্রকৃত মানুষ করে তোলার জন্য প্রতিদিন নীরবে কৃতজ্ঞতা জানায় সরমাকে। ওর শিক্ষাতেই স্বনির্ভর হয়েছে ওদের ছেলেমেয়ে দুজনেই। মাতৃহীন ওদের দুজনকে শেখরেরই আগলে রাখার কথা। কিন্তু বাস্তবটা ঠিক উল্টো। ওরাই সারাক্ষণ আগলে রেখেছে বাবাকে। এসব নিয়ে কোনো কথাই সে বলেনি পিঙ্কি বা রক্তিমকে। তবে মনে হয় ওরা দু’জনেই কিছু বোঝে। একবার যেমন হারানো টাকা ফিরে পাবার কথা বলতেই পিঙ্কি বলেছিল জানতাম ঠিক ফিরে পাবে তুমি। মানে? কি করে জানলি? আমিও পেয়েছিলাম। একবার পাঁচ হাজার টাকা হারিয়ে গিয়েছিল। খুব কেঁদেছিলাম। ঘুমের মধ্যে মনে হ’ল মাথায় হাত বোলাচ্ছে কেউ। পরদিন ব্যাগের একটা খাপে পেয়ে গেলাম। সে কি বলিসনি তো \ কি আর বলবো। ভেবেছিলাম আমিই বোধহয় ভুল করে... রক্তিম শুনছিল সবকিছু। বললো ঠিক বলেছিস। আমিও তাই ভাবি। বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে শেখর শুনছিল রক্তিমের কথা। ওর দিকে তাকিয়ে রক্তিম বলছিল... হ্যাঁ বাবা, পার্স বা দরকারি কাগজ হারিয়ে গেলে পিঙ্কিই খুঁজে দেয় সবকিছু। একবার পিঙ্কি বোধহয় মামারবাড়ি গিয়েছিল কয়েকদিনের জন্য। তখনও কিছু হারিয়ে গেলে পেয়ে যেতাম ফাইলে, বা বইয়ের ভেতর। অবাক হতাম। কিন্তু আমিও মনের ভুল বলে মেনে নিয়েছিলাম। তিনজনেই চুপ করে বসেছিল কিছুক্ষণ। হয়তো ভাবছিল, কেউই বোধহয় বলতে পারলো না তাদের মনের কথা। দরোজায় শব্দ শুনে উঠে গিয়েছিল পিঙ্কি। ফিরে এসে বললো নিচে মাছওলা এসেছে। দারোয়ান কাকু জানতে চাইল নেব কিনা নিবি? না, আছে তো। তাছাড়া আজ তো দা’ভাই টমাটো চিকেন রাঁধবে। সঙ্গে মিষ্টি পোলাও। বাহ, তোর মা রক্তিমের এই রান্নাটা খুব পছন্দ করতো। হুম... মনে আছে প্রথমবার খেয়ে তো দা’ভাইকে একটা সুন্দর টি-শার্ট উপহার দিয়েছিলেন। একান্ত নিজের, একটা বই-এর আলমারি ছিল সরমার। সেখান থেকেই ওর খুব প্রিয় একটা বই নিয়ে আজ বসেছে শেখর। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’। বেশ কয়েকবার পড়া হলেও প্রতিবারই নতুন নতুনভাবে ভালো লাগে। ইতিহাস আর কল্পনা মিলেমিশে এক অনবদ্য কাহিনী। ঘটনাকাল ও ঘটনাস্থল সপ্তম শতাব্দীর আরবদেশ। এই উপন্যাসের কিছু কিছু অংশের পাঠও শুনেছে সরমার কণ্ঠে। অসাধারণ ছিল সেই পাঠ। তেমনই একটা অংশে এসে আটকে গেল শেখর। বইটা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। হয়তো ঘুমিয়েও পড়েছিল একটু। কী একটা শব্দে তাকিয়ে দেখল বইটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রক্তিম। তোমায় একটা কথা বলতে এসেছিলাম, দেখলাম কোলের ওপর বইটা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছো। হুম পড়তে পড়তে কখন যে...। মা’কেও পড়তে দেখেছি অনেকবার। খুব প্রিয় বই ছিল তোর মা’র। ... কী যেন বলবি বলছিলিস এই অবস্থা কতদিন চলবে জানি না। হয়ত আরও কিছুদিন ঘরবন্দি হয়েই থাকতে হবে। সংক্রমণ তো ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সেটাই তো... ভাবছিলাম, আরও কিছু চাল, ডাল, তেল আর তোমার ওষুধ আনিয়ে নেবো। পুচকুকে বললেই বলবে, ‘মজুত করার দরকার নেই। সবই তো পাওয়া যাচ্ছে। দরকারে দেখা যাবে।’ ওষুধ বোধহয় আছে এখন। আসলে আমার কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। বেসরকারি অফিস তো ...কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেলে... মাইনে দেবে কি করে? তাই বলছিলাম, একটু বেশি বেশি করে আনিয়ে রাখি সব। আসলে কী জানো তো ... পুচকুটা হঠাৎ বড় হয়ে গিয়েছে। টাকাপয়সা নিতে চায় না। দিতে গেলেই ‘পরে নেবো’ বলে এড়িয়ে যায়। সেদিন গাড়ি স্টার্ট দিতে গিয়ে গোলমাল হচ্ছিল... পুচকু শুনেই বললো লকডাউন উঠলে যা করার করিয়ে নিস। নো চিন্তা, হাম হ্যায় না। হাসি পেল শেখরের। আমার কাছ থেকেও নেয় না। পাগলি একটা। এবার হাসলো রক্তিম। কিন্তু জানো তো বাবা, চাকরি পেয়ে প্রথম মাইনে পাবার দিন থেকে ওকে সামান্য হাতখরচ দিই, খুবই সামান্য। জানি তো। এখন দিস না? দিই তো, যা বলছিলাম, সেটা দিতে একদিন দেরি হলে চেয়ে নিয়ে যায়। বলে এটা আমার হকের টাকা। এটা ভুলবি না। তোর বিয়ে হলেও না। আমার বিয়ে হলেও না।... ওর স্বভাবটা একদম মা’র মতো। কিছু দিতে গেলেই বলতো ‘সব টাকাই তো আমাদের সকলের। যার কাছে হোক থাকলেই হলো।’ আর পুচকু কি বলে জানো তো ...‘একদিন না একদিন তো বিয়ে করবি। বউয়ের শখ আহ্লাদ মেটাতে হবে না? জমিয়ে রাখ টাকাগুলো। আমার দা’ভাইকে কেউ যেন কৃপণ না বলে।’ একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল শেখর। কী ভাবছো বাবা। ভাবছি, ঈশ্বরের আশীর্বাদে এমন একটা সংসার পেয়েছি আমরা। আমি না থাকলেও তোরা ভাইবোনে এমন মিলেমিশে থাকবি তো... পুচকু আমাদের চোখের মণি। ওকে সারাজীবন ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। মা’কে কথা দিয়েছি যে। আসলে চারপাশে যা দেখি ভয় হয়। সামান্য সম্পত্তি নিয়ে ভাই ভাইয়ের সঙ্গে লড়ছে, কেউ বা বোনেদের কীভাবে ফাঁকি দেওয়া যায় সেসব ভাবছে... হুম, ওসব আমাদের কোনোদিন হবে না। বাইরের কেউ এসে যাতে বিষিয়ে না দেয় সব, এই ভেবে, আমি তো ওর বিয়ে না দিয়ে, নিজে বিয়েই করবো না। কিন্তু আমি যে তোদের বিয়ে দেখে যেতে চাই। কিছু দায়িত্ব তোর মা আমাকেও যে দিয়ে গিয়েছেন। কে কাকে কী দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছেন শুনি...। দু’হাতে দুটো প্লেট ভাজাভুজি নিয়ে ঘরে ঢুকেছে পিঙ্কি। বাপি তোমার ফুলকপির বড়া। আর দা’ভাই তোর পিঁয়াজি। আর দুটোতেই ভাগ বসাবো আমি। খেতে খেতে শেখরই তুললো কথাটা। শোন, শুনছি লকডাউন নাকি থাকবে আরও কিছুদিন। হ্যাঁ এখন উঠলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। করোনার কামড়...। তাহলে তো আরও কিছু চাল ডাল আনা দরকার। আগামী দু’মাস দরকার হবে না। সব আছে। মানে? এ বাড়ির গিন্নির নাম পিঙ্কি কুল। ঠাণ্ডা মাথায় হিসেবমতো সমস্ত করা আছে। চাপ নিও না। আমি বরং কফিটা নিয়ে আসি। রক্তিম অবাক হয়ে তাকালো ওর বাবার দিকে। কিছু না বলে হাসলো শেখর। বেশ ভালো লাগছিল তার। তিনজনে একসঙ্গে বসে গল্পগুজব আর হয়ই না আজকাল। সবাই ব্যস্ত। ওরা অফিস যাবার পর সে তো পুরোপুরি একা। এখন এই ঘরবন্দি অবস্থায় ওদের তবু একটু কাছে পাচ্ছে। জানো বাপি, দা’ভাই বলছিল ও তোমায় দেখিয়ে দেবে কীভাবে ভিডিও কল করতে হয় আমি শিখে কী করবো? রক্তিম বললো কেন? বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মারবে, গল্প করবে তেমন বন্ধু আর কোথায়, সবাই বলতে চায়, শোনার ধৈর্য চলে যাচ্ছে মানুষের। হাতেগোনা দু’একজন আছে যাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলা যায়। কিন্তু তারা কেউ এসব ব্যপারে সড়গড় নয় বোধহয়... কিন্তু তাতে কি, শিখতে তো আপত্তি নেই... দেখিয়ে দিস কীভাবে কী করতে হয়। ...আমাদের অফিসে ভিডিও কল হতো কিন্তু সব তো করতো আইটির ছেলেরা। আমরা অংশ নিতাম শুধু ঠিক আছে, আজ সন্ধ্যায় আমরা ছোটমাসির সঙ্গে কথা বলবো। বোনেরাও থাকবে। কতদিন আড্ডা হয় না সবাই মিলে কতদিন পরে আজ পরমাকে দেখলো শেখর। কথাও বললো দু’একটা। শরীর নিয়ে উদ্বেগ, এই গৃহবন্দি অবস্থায় কি কি করা উচিত, মনটাকে কীভাবে সবসময় হালকা আর সতেজ রাখা যায়, এইসব। পিঙ্কি আর রক্তিম অবশ্য মাসি এবং দুই বোনেদের সঙ্গে খুব হাসি মজা করছিল। ফাঁকে ফাঁকে পরমার কাছে দুয়েকটা রান্নাও শিখে নিচ্ছিল পিঙ্কি। রক্তিমের অনুরোধে একটা গান শোনাল নেহা। বদলে দাদার কাছে কিছু আবদারও জানিয়ে রাখলো। সব মিলিয়ে মন্দ কাটলো না সময়টা। এখন আর দিনের হিসেব নেই। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলে আজ রবিবার না সোমবার বলা মুশকিল। অদ্ভুত নতুন এক অভিজ্ঞতা নিয়ে কাটছে জীবন। বন্ধুদের ফোন আসা মানেই একই কথা। নানান গুজব। মিথ্যে গল্প। শেখর এসবে কান দেয় না। মাঝে মাঝে তর্কও হয়। হঠাৎ সবাই খুব দরদী হয়ে গিয়েছে গরিবদের জন্য। সারাবছর এদের দুঃখ-কষ্টের খবর রাখে না। সেদিন এক বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেছিল, সে কোনো রিলিফ ব্যবস্থায় সশরীরে বা অর্থ সাহায্য করে অংশ নিয়েছে কিনা! রেগে গিয়েছিল বন্ধুটি। বেশির ভাগ মানুষই এমন। ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’ এই পুরনো নীতি মেনে চলে। অন্যের কথা ভাবার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। নিরন্ন মানুষদের জন্য মড়াকান্না, সব ব্যাপারে সমালোচনা করা এগুলো আসলে ‘টাইমপাস’। সত্যি সত্যি গ্রামের দিনমজুর, বা ‘দিন আনি দিন খাই’ মানুষেরা কী অবস্থায় আছে কেউ জানে না, জানতেও চায় না। খালি কথার চমক। আবার সমাজে এমন মানুষও আছেন, যারা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন বিপদে পড়া মানুষগুলোর জন্য। অনেকেই নিজের সাধ্যমতো নেমে পড়েছেন ত্রাণের কাজে। সেদিন টিভিতে দেখালো দুই ভাই তাদের জমি বিক্রি করে, সেই টাকায় গ্রামের লোকদের প্রতিদিন দু’বেলা খাবার ব্যবস্থা করছে। শহরের রাস্তায় ভবঘুরে মানুষদের মুখে খাবার তুলে দেবেন বলে গাড়িভর্তি খাবার নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কিছু মানুষ। বেশির ভাগ ক্লাবগুলোই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে ত্রাণ বিলির কাজে। ‘মানুষের ধর্মে আজ মানুষ দাঁড়ায় শুধু মানুষের পাশে।‘ ভুল বলা হলো, শুধু মানুষ কেন, রাস্তায় বাস করা জন্তুদের জন্যও অবিরাম কাজ করে যাচ্ছেন কিছু মানুষ, নীরবে। আর এই নীরবে কাজ করে যাওয়া মানুষদের প্রতি পরম শ্রদ্ধায় নতজানু সে। প্রণতি জানায় সেইসব গবেষকদের, যারা নিরলসভাবে খুঁজে যাচ্ছেন মানুষকে এই অসহায় দুর্যোগ থেকে বাঁচাবার রাস্তা। আজও টিভিতে দেখালো, বেশ কিছু ডাক্তার, নার্স, হাসপাতালের অন্য কর্মীরা, আক্রান্ত হয়েছেন এই সংক্রমণে। পুলিশকর্মীরা, যারা নিজেদের বিপদ উপেক্ষা করে আমাদের সুরক্ষিত রাখার জন্য সর্বদা কাজ করে, তারাও বাদ যাননি এই আক্রমণ থেকে। কিছু নির্বোধ মানুষ, এই দেবতুল্য মানুষদেরও নিগ্রহ করতে ছাড়ছে না। বুঝছে না, আজ যে ডাক্তারদের ওপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার করছে, এই করোনা যুদ্ধ শেষ হলে, তাদের কাছেই ছুটতে হবে নিজের বা পরিবারের কারোর চিকিৎসার জন্য। পুলিশদের কাছে যেতে হবে সুরক্ষার জন্য। ভাবতেও কষ্ট হয়। কখনো কখনো মনে হয় এটা হয়ত এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। পৃথিবীর সব দেশেই, এই মুহূর্তে এক ধরনের অস্থিরতায়, অস্তিত্বের সংকটে ভুগছে মানুষ। হয়তো এসব তারই বহিঃপ্রকাশ। তাই বিচারকের আসনে বসার কোনো বাসনা নেই শেখরের। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যে কোনো ঘটনাকে দেখাই তার অভ্যাস। বিচিত্র এই জগৎ। কর্মজীবনে যারা ঘুরঘুর করতো চারপাশে, সুযোগ-সুবিধা পাবার লোভে তাকে প্রায় দেবতা বানিয়ে রেখেছিল তারা কেউ আর খোঁজ করে না এখন। যাদের ওপর খুব রাগ করতো বকাবকি করতো, তাদের কয়েকজনের ফোন আসে কখনো কখনো। তেমনই একজন নন্দিতা। শেখরের অফিসের টাইপিস্ট ছিল। এখন অফিসার। ওর ফোন এলেই হাসি পায় তার। একদম ছকে বাঁধা কথাবার্তা। প্রথমে শেখরের শরীর তারপর রক্তিম আর পিঙ্কিকে নিয়ে কিছু খোঁজখবর, সরমার হাসি আর গান নিয়ে কিছু কথা আর সবশেষে তার অফিসের সমস্যা, এর বাইরে কোনো কথা বলে না নন্দিতা। নিজের মনে হাসাহাসি করলেও শেখর জানে প্রায় সব মানুষই এভাবেই কথা বলে। প্রথমে সামাজিক শিষ্টাচার তারপর প্রয়োজন, সবশেষে কিছু ইড়িং বিড়িং, বা আবোল-তাবোল। এই অপ্রয়োজনীয় কথাগুলোই খুব মন দিয়ে শোনে শেখর। মনে হয় এইসব কথা দিয়েই বোঝা যায় একজন মানুষের গভীরতা। আজ অবশ্য নন্দিতা ফোন করেছিল অন্য কারণে। ওর পাড়ায় কয়েকটা বাড়ি পরে এই অসুখে আক্রান্ত হয়েছে দুজন। পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে রাস্তাঘাট। এই অবস্থায় তার কী করা উচিত বুঝতে পারছে না। অফিস না হয় নাই গেল, ছেলেকে নিয়ে দাদার বাড়ি যাওয়া উচিত হবে কিনা, এইসব জানতে চাইছিল। ঠিক কী বলা উচিত বুঝতে পারছিল না শেখর। এমন সমস্যায় তো কেউ পড়েনি আগে। বলেছিল একদম প্যানিক করবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখবে। ব্যাংকে, মানে তোমার অফিসে জানিয়ে দাও। আর বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবার দরকার নেই। যেখানে যাবে সেখানেও যে কিছু হবে না কে বলতে পারে? যে সব এলাকা সিল করে দিয়েছে, সেখানে দেবদূতের মতো কাজ করছে পুলিশ। ওরা ওদের নাম্বার দিয়ে দেবে। প্রয়োজনে ওরাই সব সাহায্য করবে। তাছাড়া আমরা তো আছি। আমি, রক্তিম, পিঙ্কি সবাই বাড়িতে। ভয় পেয়ো না। একটু আগেই নন্দিতা ফোন করেছিল। পাড়ার অনেকের সঙ্গে ওদেরও রক্ত পরীক্ষা করবে আজ। তারপর ঠিক হবে কোয়ারেন্টাইন না আইসোলেশন। একটু ভয় পেয়ে গিয়েছে স্বাভাবিকভাবেই। শেখরের কাছে জানতে চাইছিল হাসপাতালে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে কিনা। টেস্ট পজিটিভ হলে আইসোলেশনে যেতেই হবে। যাওয়া দরকারও। আর যেহেতু কোনো রোগীর সংস্পর্শে ওরা আসেনি ওদের কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে যাবার কথা নয়। বড়োজোর বাড়িতে থাকতে বলবে। এসবই বুঝিয়েছে শেখর। পিঙ্কি বলছিল অনিলেশদের পাড়াতেও তিন চারটে বাড়িতে ছড়িয়েছে এই রোগ। পুরো পাড়া স্যানিটাইজ করা হয়েছে। আগে যেখানে থাকতো শেখররা, সেই পাড়া থেকেও ফোন এসেছিল, আতঙ্কে আছে সবাই। এখন তো শোনা যাচ্ছে কোনো উপসর্গ নেই এমন মানুষদের মধ্যেও বাসা বেঁধেছে করোনা। চতুর্দিকে অদ্ভুত এক অস্থিরতা। সারা পৃথিবীতে মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোজ। কতদিন যে এমন অসহায় হয়ে বসে থাকতে হবে কে জানে! পিঙ্কির ভাবনা অবশ্য অন্যরকম। ওর সামনে এসব বললেই খুব গম্ভীর গলায় বলবে আমরা কেউ কিন্তু বসে নেই। করোনা যুদ্ধে আমরাও লড়ছি। ফ্রন্ট লাইনে ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সাংবাদিক এবং আরও অনেকে হয়ত আছেন, কিন্তু বাড়িতে থেকে আমরা যদি এই লড়াইয়ে শামিল না হতাম, কি হতো ভাবো তো! পিঙ্কির এই ভাবনার কথাটা নন্দিতাকেও বলেছে শেখর। ভয়ে ভয়ে জানতে চেয়েছে নন্দিতা এ যুদ্ধটা আমরা জিতব তো! নিশ্চয়ই জিতব। পৃথিবীর সব মানুষ একসাথে লড়ছি আমরা। জিততে তো হবেই। নন্দিতার ভয়টা অমূলক নয়। গত বছরের প্রথমদিকে একদিনের জ্বরে চলে গিয়েছিল মনীশ, ওর স্বামী। চিকিৎসার কোনো সুযোগ পায়নি। তারপর থেকে, যে কোনো ব্যাপারে ভয় পায় খুব। প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে এ বাড়িতেই ফোন করে। রক্তিম, পিঙ্কিকে অনেকদিন ধরেই চেনে নন্দিতা। সরমার সঙ্গে শেখরের অফিসে প্রায়ই যেতো দুই ভাইবোন। তখন থেকেই এ বাড়ির সকলের পছন্দ নন্দিতাকে। খুব বিশ্বাসী আর সুন্দর স্বভাবের মেয়ে বলে শেখরও খুব স্নেহ করে। বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল শেখর। দূষণমুক্ত আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে মন্দ লাগে না আজকাল। পাশের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল নিশা। কেমন আছো কাকু? পিঙ্কি কোথায়? অফিসের কাজে ব্যস্ত নিশ্চয়ই উপায় নেই। আমাদেরও তো অনলাইন ক্লাস করতে হচ্ছে। কতদিন যে এমন চলবে... দেখা যাক, তবে আরও দু’সপ্তাহ তো বটেই। পিঙ্কির সঙ্গে কথা হয় না তোমার? রোজ রাত্রে ভিডিও কলে আমরা আড্ডা দিই তো পিঙ্কি রক্তিমদা আরও সব বন্ধু। খুব মজা করি আমরা। খোঁজখবর নিই সকলের। কি বলছে সব বন্ধু? করোনা নিয়ে কারো কোনো ভয় নেই। সবাই কুল, বিন্দাস। জিতব, জিততেই হবে। মানুষের ইতিহাস এক অলৌকিক ইতিহাস। মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষ হার মানে না সহজে। হয়তো কিছু হারাচ্ছি আমরা। অনেক কিছুই হয়ত পাবো না আর। আবার অনেক কিছু নতুন করে পাবো... তবে স্বপ্নটা যেন না হারায় তোমাদের খেয়াল রেখো কি সুন্দর করে বললে কাকু। তুমি... না... একেবারে অনবদ্য। আরে বাবু, বাবাটি কার দেখবি তো রক্তিমের গলা। কখন যে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পারেনি। বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে রক্তিম বললো তোমার ফোন না পেয়ে নন্দিতা মাসি ফোন করেছিল আমায়। কিছু খারাপ খবর? না গো খুবই ভালো। ওদের দু’জনের টেস্টই নেগেটিভ। বাহ দারুণ খবর। আর কি বলেছে পুলিশ? বলেছে আরও কিছুদিন বাইরে না বেরোতে তা তো বটেই। খুব টেনশনে ছিলাম রে জানি তো, শুধু তুমি নয়, আমরা সকলেই... পিঙ্কিকে বলেছিস? কোথায় সে? ঘরে, জামা কাপড় ইস্ত্রি করছে। জানো তো বাবা দরকার হতে পারে ভেবে ও নন্দিতা মাসির জন্য টাকাপয়সারও ব্যবস্থা করে রেখেছিল... কিছু বলেনি আমায়। তবে জানতাম এসব করবে পিঙ্কি। ওকে ডেকে এসেছিস তো বলতে না বলতেই পিঙ্কি ঢুকলো ঘরে। হাসিমুখে শেখর বললো- শুনেছিস? আরও একটা খবর আছে। শোনাতে পারি, কিন্তু একটা শর্তে। রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বললো একটু কফি খাওয়াবি দা’ভাই। খুব ক্লান্ত লাগছে রে উইথ প্লেজার, কিন্তু খবরটা শুনে যাই। মন্দিরা ফোন করেছিল। ওদের পাড়ায় যাদের করোনা আক্রান্ত বলা হয়েছিল তারা সবাই নেগেটিভ। আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠে রক্তিম বললো তব্ তো কফি বনতাই বনতা হ্যায়। অল্প হলেও, অন্ধকার ভেঙে আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে ক্রমশ। মনে মনে সরমাকে খুঁজলো শেখর। দেখতে দেখতে প্রায় এক মাসের ওপর হয়ে গেল ঘর থেকে বেরনো নিষেধ। আগামী সপ্তাহে লকডাউন উঠে যাবার কথা। বন্দিদশার অবসান হবে হয়তো। কিন্তু সবাই বেরোতে শুরু করলে সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবার সম্ভাবনা। আবার বেশিদিন বন্ধ থাকলে দেশের অর্থনীতিও একেবারে ভেঙে পড়ার অবস্থা হবে। চাকরি হারাতে পারে অনেক মানুষ। অভ‚তপূর্ব এক পরিস্থিতি বিশ্বজুড়ে। প্রতিটি দেশই এই মহামারির কবলে পড়ে হিমশিম খাচ্ছে সব কিছু সামলাতে। তবে একটাই আশার কথা, পৃথিবীর অনেক বড়ো বড়ো দেশের তুলনায় আমরা একটু ভালো জায়গায় আছি। আক্রান্তের সংখ্যা বা মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু সেটা তো কোনো সান্ত¡না হতে পারে না। যে কোনো সময়েই পাল্টে যেতে পারে সবকিছু। একদিন চা বানিয়ে তোদের খাওয়াতে পারি না! আগে তো করতাম। পিঙ্কি হাসলো জানি তো, মা খুব পছন্দ করতেন। আসলে কাল সারারাত আমি আর দা’ভাই প্রায় ঘুমোইনি কেন রে? উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো শেখর। দা’ভাইয়ের বস্ ফোন করেছিলেন রাত ১২টা নাগাদ। তার স্ত্রীর খুব শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল কাল সন্ধ্যে থেকে। আর কোনো উপসর্গ ছিল না। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন করোনা সন্দেহে ভর্তি করে নিয়েছে। ওর আর ওর ছেলের আজ টেস্ট হবে। তারপর হয় ভর্তি নয় আইসোলেশন। ওই হাসপাতালের কোনো ডাক্তারকে দা’ভাই চেনে কিনা, সরকারি কোনো হাসপাতালে যাওয়া যায় কিনা, টাকাপয়সা, অফিস এসব নিয়ে চিন্তায় আছেন। তাই দা’ভাইকে... সত্যিই তো, হঠাৎ করে এমন বিপদ... কেউই তো ভালো করে জানি না কিছুই। যাইহোক হাসপাতালে ভর্তি হতে পেরেছেন এটাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। সরকার তো রাতারাতি নতুন হাসপাতাল তৈরি করতে পারে না। তাই একটু ভয়েই থাকি। কিছু হ’লে জায়গা পাবো তো। কিচ্ছু ভেবো না বাপি। শুনছি দিন পনেরো পরেই নাকি লকডাউন একেবারে উঠে যাবে। তার মানে উন্নতি হচ্ছে পরিস্থিতির। হলেই ভালো। অনেকের রুজি রোজগার একদম বন্ধ। তাদের কথা ভেবে অন্তত স্বাভাবিকতার দিকে যাওয়ার চেষ্টা হোক। তবে সচেতন হতে হবে সবাইকে... তবে... তবে? তোদের অফিস খুললে আমি আবার একা... এমনিতে খুব একটা বেরোয় না শেখর। নিজের মতো পড়াশোনা নিয়ে থাকে। ইচ্ছে হলে লেখে কখনো কখনো। কবিতা। রেখে দেয়। ছাপতে দিতে ইচ্ছে করে না। নিজের সঙ্গে নির্বাসনে থাকতেই ভালো লাগে তার। স্মৃতির মতো ভালো সঙ্গী আর নেই। চা নিয়ে এসেছিল পিঙ্কি। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল- রাতে ঘুম হয়নি তোমার? না রে কাল ঘুমের ওষুধটা খাওয়া হয়নি। যাকগে, রক্তিমের বস্, ওর স্ত্রীর খবর পেলি? দেখতে দেখতে অনেক দিন তো হয়ে গেল। দা’ভাই বললো ভদ্রমহিলা সুস্থ হয়ে উঠছেন ক্রমশ। বস্ ও তার ছেলেও হাসপাতালে। ভালো আছে। আরও দুটো টেস্ট হবে কয়েকদিনের মধ্যে। তারপর ছাড়বে। তবে বাড়িতে থাকতে হবে আরও কিছুদিন। বাহ ভালো খবর। হ্যাঁ, কিন্তু সংক্রমণ তো কমছে না। এখন আবার শুনলাম আমার দুই বন্ধু ইনফেক্টেড। প্রায় দেড় মাস বাড়ি থেকে বেরোয়নি। তবু...। কী যে হচ্ছে সব। এর ওপর যদি তুলে নেয় লকডাউন? ভার্টিগো আছে বলে, রাতের বেলা বারান্দায় না যাবার কড়া নির্দেশ আছে পিঙ্কির। ঘুম না এলে পায়ে পায়ে দক্ষিণের জানলার কাছেই দাঁড়ায় শেখর। দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে অসীম তন্ময়তায় নক্ষত্রমালার ভিড়ে কী যেন খোঁজে। এমন নির্মল আকাশ, দেখাই যায় না এ শহরে। সন্ধ্যাবেলায় ফেসবুকে দেখছিল একটা ভিডিও। গঙ্গার ছবি। এমনই স্বচ্ছ জল যে নিচের পাথরগুলোও দেখা যাচ্ছে। আহা দূষণমুক্ত এ শহর উজিয়ে যদি একদিন, ওই নীল স্রোতে ভেজাতে পারতো সমস্ত শরীর। কেন জানি না, বেশ কয়েকদিন হ’ল মন ভালো নেই তার। ঘুমের সঙ্গেও হয়তো মনোমালিন্য হয়েছে কিছু। তারও আসা যাওয়ার কোনো ঠিক নেই। ইচ্ছেমতো এসে দুচোখের পাতা ছুঁয়ে তিনি উড়ে যান উত্তরের দিকে। ঘুম নেই মানে স্বপ্নও নেই। অর্থাৎ সরমাও নেই। সরমার অদৃশ্য উপস্থিতি হয়ত অনুভব করতে পারে শেখর, কিন্তু স্বপ্নের সরমা যেন অনেক জীবন্ত, অনেক কাছের। বোধহয় ভোরবেলা ঘুম নিয়ে এসেছিল সরমা। মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে জানতে চেয়েছিল কীসের অস্বস্তি, কীসের এতো দুশ্চিন্তা। প্রথমে কিছু বলতে পারেনি শেখর। তারপর ওর হাতে হাত রেখে খুব আস্তে আস্তে বলেছিল মৌসুমি হাওয়ার মতো, শরতের নীল আকাশের মতো নির্মল আর স্পষ্ট চোখে দেখতে চাই জীবনের যাবতীয় না দেখা অংশ। নিশ্বাস নিতে চাই খোলা হাওয়ায়, নিরীহ পবিত্র এক সবুজ মাঠের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মেখে নিতে চাই পৃথিবীর বর্ণময় আলো। প্রতি রোমক‚পে স্বপ্ন ভরে নিয়ে এগিয়ে যেতে চাই সেই আনন্দযজ্ঞের দিকে যার মধ্যমণি হয়ে বসে আছো তুমি আর অনন্ত জীবন। উঠে দাঁড়িয়েছিল সরমা। বোধহয় ভালো লাগেনি শেখরের এই আর্তিময় কথাগুলো। হাতের ওপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলেছিল কেমন যেন পাল্টে গেছো তুমি। ভুলে গেলে? এই হাতে হাত রেখে যে সমস্ত কথা দিয়েছিলে, সব ভুলে গেলে? সব প্রতিশ্রুতি? তারপর আর দেখতে পায়নি সরমাকে। অদ্ভুত এক বিষণ্ণ আচ্ছন্নতায় ঘুম ভেঙেছিল শেখরের। মনে মনে ধমক দিয়েছিল নিজেকে। ...না ভোলেনি, কিছুই ভোলেনি সে। সকালবেলা চায়ের জন্য অপেক্ষা না করে বাইরের ঘরে বাবাকে আসতে দেখে একটু অবাক হয়েছিল পিঙ্কি। কিছু বলবে বাপি? চায়ে চুমুক দিয়ে শেখর বললো হ্যাঁ রে, যদি ভুলে যাই, তাই এখনই বলতে এলাম। অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকালো রক্তিম। বলছিলাম, FAR FROM THE MADDING CROWD ছবিটা দেখতে ইচ্ছে করছে। ডাউনলোড করা যায়? পিঙ্কি হাসলো এই ছবি দেখতে গিয়েই, মা’র সঙ্গে তোমার প্রথম আলাপ হয়েছিল। তাই না? হুম... রক্তিম হেসে বললো ছবির নামটা কিন্তু আমাদের এই পরিস্থিতির সঙ্গে বেশ মানানসই... বললি না তো, করা যাবে? নিশ্চয়ই। তবে শর্ত আছে একা দেখা যাবে না। আমি আর দা’ভাইও দেখবো হাসলো শেখর। বললো ঠিক আছে। কিন্তু সামাজিক দূরত্বটা মেনে বসতে হবে। ছেলেমেয়েদের হাসির আওয়াজে কেমন যেন মনে হ’ল, হাসিমুখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে সরমা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App