×

সাময়িকী

করোনাকালে মধ্যবিত্তের শিল্প-সাহিত্য

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ০৪:৩৫ পিএম

করোনাকালে মধ্যবিত্তের শিল্প-সাহিত্য

মামুনুর রশীদ

পৃথিবীতে অনেক মহামারি এলেও জানা ইতিহাসে ভয়াবহ এক মহামারি এসেছিল তার নাম প্লেগ। ইউরোপের বিশাল জনগোষ্ঠী এতে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্লেগের পরে দুটি বড় ঘটনা ঘটল। একটি শেক্সপিয়র অন্যটি শিল্প বিপ্লব। শিল্প বিপ্লবের প্রয়োজনেই ইউরোপ বিশেষ করে ব্রিটিশদের সারা বিশ্বে কাঁচামালের সন্ধানে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই সঙ্গে ইংরেজি ভাষা ও শেক্সপিয়রও চালান হয়ে গেল উপনিবেশে। প্লেগের এই দিনগুলোতে তফলিক নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন শেক্সপিয়র। অন্যদিকে সেই সময় নেরুদা রচনা করেন তার অসাধারণ নাটক এবং সনেট। আমাদের দিনে পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। যে মহামারিকালে আমরা আছি তা বৈশ্বিক। এক অজানা ভাইরাস দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সব জনপদে এবং তার শক্তি নিঃশেষিত হচ্ছে না। অন্য সব মহামারি ছিল স্থানিক এবং ক্ষণস্থায়ী। ছোটবেলায় আমরাই দেখেছি কলেরায় গ্রাম উজার হয়ে গেছে কিন্তু সেও কিছুদিনের জন্য। গুটি বসন্ত বা ম্যালেরিয়াও তাই। কিন্তু এমন অদৃশ্য ভাইরাস আর আসেনি। এর সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই, আবিষ্কার হয়নি কোনো ভ্যাকসিন। তাই সব সময় শুধু একাকী গৃহে থাকা এবং নিয়ম কানুন মানাই একমাত্র উপায়। কিন্তু সেই অবস্থায় থেকেও রেহাই পাওয়া যাচ্ছে না। এবং সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে কোনো যোগসাজশে যাওয়া যাচ্ছে না। অভিনয় করা যাচ্ছে না কোনো মিলনায়তনে, দর্শকদের আসাও নিষিদ্ধ। যদিও ইউরোপে বড় বড় যুদ্ধ লেগেছে সেই যুদ্ধের কালেও অভিনয় হয়েছে, নৃত্যগীতের আসরও বসেছে। কিন্তু করোনাকালে পৃথিবীর কোথাও কোনো শিল্পের আসর বসছে না। লেখাপড়ার কাজটি হয়তো নীরবে নিভৃতে চলতে পারে, চিত্রশিল্পীরাও ছবি আঁকতে পারেন কিন্তু যা কিছু মানুষকে নিয়ে তা সম্ভব হচ্ছে না। নির্মাতা, প্রযোজকরা ছবি হলে রিলিজ করতে পারছে না। শুনেছি বলিউডের এবং কলকাতার ছবি টেলিভিশনে বিক্রি করে দিচ্ছে। চলচ্চিত্রের রমরমা ব্যবসা যেখানে সেই দক্ষিণ ভারতেও একই অবস্থা। ফলে ইন্ডাস্ট্রিতে বড় সমস্যা দেখা দিচ্ছে। গত ৫ মাসে মধ্যস্তরের শিল্পী যাদের কোনো আয় নেই তারা পড়েছেন এক বড় দুর্দশায়। আমাদের দেশে চলচ্চিত্রের ইন্ডাস্ট্রি আগে থেকেই মুখ থুবড়ে পড়েছে কিন্তু টেলিভিশনকে ঘিরে একটি বড় ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। যদিও এই ইন্ডাস্ট্রি নানা কারনে আগে থেকেই নানা সমস্যায় পড়ে আছে। বিপুল পরিমাণ কর্মী যারা এখানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা পড়েছেন ভয়াবহ সংকটে। গানের শিল্পীদের জন্য ভালো রেকর্ডিং স্টুডিও গড়ে উঠেছে। যেখানে শিল্পী ও যন্ত্রীদের একটি বড় অংশ বেকার হয়ে পড়েছে। করোনা থেকে বাঁচার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান নির্দেশনা হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা। সাম্রাজ্যবাদের ভাষায় সামাজিক বিচ্ছিন্নতা। সমাজ থেকে দূরে থাকো, একা জীবন যাপন করো তাহলেই বাঁচবে। একটি ব্যাধিকেও তারা সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের অংশ করে নিলো। আসলে শব্দটি এখানে প্রযোজ্য হতো শারীরিক দূরত্ব হিসেবে। যাহোক করোনাকালে সব কিছুই সমাজ বিচ্ছিন্নতা। শিল্প সাহিত্য সামাজিক কারবার। বিচ্ছিন্নতা যদি প্রথমেই শুরু হয়ে যায় তাহলে শিল্প সাহিত্যের আর কিছু করার থাকে না। বিশেষ করে Performing art-এর ক্ষেত্র। তবুও দেখা যাচ্ছে এসব অবরুদ্ধ শিল্পীরা অনলাইনে নানা ধরনের অনুষ্ঠান, আলোচনা, নাট্যাভিনয়, গান, নাটকের মহড়া ইত্যাদি করে আসছে। সেগুলোও ফোনালাপের মতোই মনে হয়। ইদানীং ভয়ভীতি নিয়েই নাটকের শুটিং শুরু হয়েছে। ভয়ভীতি থাকলে কি সঠিক অভিনয়টি হবে? আমার অভিনয়ের সময় যদি মাস্কটি পরা থাকে তাহলে মুখের অধিকাংশ অভিব্যক্তির জায়গাটা থাকে কিনা? তার মানে মিডিয়ার দৌলতে পুরো ব্যাপারটাই বিপর্যয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এসব নির্দেশনা মানেনি খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই। কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার পর শ্বেতাঙ্গ বিরোধী যে আন্দোলন সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছিল যেখানে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা মানা হয়নি। তাদের মধ্যে কতজন সংক্রমিত হয়েছেন? শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, অন্য দেশেও এই প্রতিবাদ হয়েছে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা না মেনেই। বাংলাদেশে কথা বললে এখানকার মানুষ নানাভাবে নির্দেশনা দেয়ার পরও অনুশাসন মানছে না। গ্রামাঞ্চলেও তাই। খবর নিয়ে জানা গেলো সেসব এলাকায় করোনা সংক্রমণও কম। এসব এলাকায় গত পাঁচ মাসে যদি সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ত তাহলে বস্তি বা গ্রামাঞ্চলের প্রাণহানি হতো বিপুল। করোনা যে হয়নি তবে হতে কতক্ষণ! এখন সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায় নির্ভয় থাকার কারণ এক ধরনের অদৃষ্টবাদও। অদৃষ্টবাদ কোনো ব্যক্তির কাজ নয়। অনেক দরিদ্র মানুষের ঘরবন্দি হয়ে থাকার কোনো উপায় নেই। তাহলে এই যে মধ্যবিত্ত শিল্পীরা তা কি করবেন? বাড়িওয়ালার প্রবল নির্যাতন আছে, বাজার ঘাট করার সমস্যা আছে। যেমন আমাদের এলাকায় একজন শিক্ষক আছেন। তিনি টিউশনি করে, একটা স্কুল চালিয়ে মোটামুটি ভালোই ছিলেন। স্কুল ভাড়া বাকি পড়েছে আবার টিউশনি করার উপায় নেই। যা কিছু সঞ্চয় ছিল তাও গত ৫ মাসে শেষ হয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে শ্বশুরবাড়ির গ্রামে চলে গেছেন। আমাদের নাটকের শিল্পীরাও অনেকে বাধ্য হয়ে গ্রামে চলে গেছেন। এ অবস্থায় অবলম্বনের বিষয়টিও অনিশ্চিত। বস্তিবাসীদের জন্য ত্রাণ বিতরণ হয়েছে। কিন্তু ত্রাণের লাইনে যাদের দাঁড়ানোর উপায় নেই তারা কি করবেন? এ সংকটে ত্রাণদানকারী ব্যক্তি, সংস্থা এবং সাধারণ মানুষদের এক শ্রেণিতে দাঁড়িয়ে রাখার বুদ্ধি বের করতে হবে। আমরা মিডিয়ার কর্মরত নিম্ন আয়ের কর্মীদের জন্য নিজেদের উদ্যোগে একটা যত সামান্য ভাতার আয়োজন করেছি। তাতে হয়তো কিছুটা উপকার হয়েছে। কিন্তু তার পরিমাণ একেবারেই কম। মঞ্চের নেপথ্য কর্মী যারা এখান থেকেই উপার্জন করেন তাদের জন্যও কিছু ব্যবস্থা করা হয়েছে আমাদেরই মধ্যে থেকে একটু সচ্ছলদের অনুদানে। তা দিয়েই বা কতদিন চলে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় একবার ৫ হাজার টাকা করে দিয়েছিল। নগণ্য সংখ্যক শিল্পীদের মধ্যে। আমাদের দিনে ৫ হাজার টাকা কত টাকা? তা দিয়ে কতদিন চলে? একমাত্র দেখা যাচ্ছে সুখে আছেন সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা মানে ভালো বেতন যাদের, কেউ কেউ উপরিও পাচ্ছেন প্রচুর, করোনাকালে তো দুর্নীতি কমেনি। এ ধরনের সংকটকালে ব্যবসায়ীরা তো প্রচুর টাকা উপার্জন করে। কাঁচামরিচের দাম কেজিপ্রতি দুশ টাকা। এমন অকল্পনীয় মূল্যবৃদ্ধি! ব্যবসায়ীরা মাস্কের ব্যবসা করেন, দুর্নীতি করে ভালো আছেন। ভালো নেই কেবল নিরীহ খেটে খাওয়া মানুষ। যাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত শিল্পীকুল। প্রথমে শুরু করেছিলাম শেক্সপিয়রকে দিয়ে। প্লেগের সময় পৃথিবীকে উপহার দিয়েছেন অসাধারণ নাটক। এই একাকী নিঃসঙ্গতায় শিল্পীরা নানা টানাপড়নের মধ্যেও ভাবেন সোনালিকালের কথা। চিরকালই তারা এ কাজটি করে আসছেন। ইউরোপের মতো শিল্পবিপ্লব এখানে হয়তো হবে না। কিন্তু সবুজ বিপ্লব সম্ভব। পৃথিবীর অনেক দেশেই খাদ্যপণ্য রপ্তানি তাদের একমাত্র উপায়। হল্যান্ড আলু এবং মাশরুম রপ্তানি করে উন্নত রাষ্ট্রের দেশ হিসেবে বেঁচে আছে। বাংলাদেশের কৃষিজাত দ্রব্য হতে পারে আমাদের বাঁচার উপায়। আর শিল্পী তার গৃহকোণকেই শ্রমের এলাকা হিসেবে গণ্য করবে এবং মহৎ শিল্পের সন্ধান পাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App