×

সাময়িকী

উপেক্ষিতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২০, ০৫:৫৩ পিএম

উপেক্ষিতা
‘আমি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যাচ্ছি সরমা।’ বলল বিভীষণ। ‘রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যাচ্ছ!’ ‘হ্যাঁ।’ ‘কেন! কেন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যাচ্ছ তুমি!’ সরমা বলল। ‘এত বড় অপমানের পরও এই রাজভবনে থাকতে বলো তুমি আমায়!’ ‘তোমার জ্যেষ্ঠ সহোদর, না হয় তিনি তোমায় ভর্ৎসনা করেছেন!’ ‘এটাকে ভর্ৎসনা বলো তুমি! লাথি মারাকে তিরস্কার বলো!’ জ্বলে ওঠা কণ্ঠ বিভীষণের। ‘তোমার দাদা তিনি। এই মুহূর্তে উচাটন তাঁর। অস্থিরতার মধ্যে কাজটি করে ফেলেছেন।’ ‘তাই বলে জনসমক্ষে! প্রকাশ্য রাজসভায়! এতজন সভাষদের সামনে!’ ‘মাথা ঠাণ্ডা করো তুমি, ধৈর্য ধরো।’ বলে সরমা। ‘এ রকম মর্মান্তিক অপদস্থতার পরও স্থির থাকতে বলছ তুমি আমায়? আমার কি পৌরুষ নেই! আমি কি এই রাজপরিবারের কেউ নই!’ ‘হ্যাঁ, তুমি তো এই স্বর্ণলঙ্কার রাজপুত্র। দাদা কুম্ভকর্ণ বয়সে তোমার বড় বটে, কিন্তু বড়দার কাছে তোমার গুরুত্ব কুম্ভকর্ণের অধিক।’ ‘সেই গুরুত্বের কী নিদারুণ মর্যাদা পেলাম আজ! হাঃ! বেদনা ঝলকে উঠল বিভীষণের কণ্ঠে। ‘লঙ্কাধিপতির এ রকম দুর্ব্যবহারের কথা শুনে আমারও কম খারাপ লেগেছে বলো! অপমানে মরে যেতে ইচ্ছে করেছে তখন আমার।’ ‘সেই অপমান, আমাকে রাজসভায় লাঞ্ছিত করবার সেই ঘটনাটি যদি তোমাকে মর্মাহতই করে, তাহলে রাজবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে আমাকে বাধা দিচ্ছ কেন? কেন তুমিও আমার সঙ্গে এই কলঙ্কপুরী ত্যাগ করছ না?’ ‘আমার যে হাত-পা বাঁধা আর্যপুত্র।’ স্বামী বিভীষণের উদ্দেশে করুণ কণ্ঠে বলল সরমা। ‘দুটো কারণে হাত-পা বাঁধা আমার।’ আবার বলল সরমা। বিভীষণ বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘দুটো কারণে হাত-পা বাঁধা!’ ‘হ্যাঁ দুটো কারণে এই স্বর্ণলঙ্কা ত্যাগ করে যেতে পারি না আমি। তার প্রথমটি রামপত্নী সীতা, আর দ্বিতীয় কারণ দেশপ্রেম। শেষেরটা তোমার মধ্যে নেই।’ বলল সরমা। ‘নেই! নেই মানে কী! আমি কি আমার জন্মভ‚মি লঙ্কাকে ভালোবাসি না?’ চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করে বিভীষণ। সরমা প্রসঙ্গ এড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে কোথায় যাচ্ছ তুমি?’ একটু থতমত খেল বিভীষণ। আমতা আমতা করে বলল, ‘দেখি, কোথায় যাওয়া যায়।’ ‘ইতস্ততার ভঙ্গি করে সত্যকে ঢাকছ তুমি।’ স্পষ্ট গলায় বলল সরমা। ‘সত্যকে ঢাকছি!’ ‘তাই তো। নইলে সত্য বলতে তোমার এত দ্বিধা কেন?’ ‘রামশিবিরে যোগদান করতে।’ এবার ঢাক ঢাক গুড়গুড়ে গেল না বিভীষণ। নিরাবেগ গলায় সরমা জিজ্ঞেস করল, ‘রাম কে?’ ‘রাম, কে মানে! রাম কে তুমি জান না! দাদা রাবণ যে সীতাকে অপহরণ করে এনেছে, সেই সীতার স্বামী রাম!’ ‘জানি।’ ‘তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছ রাম কে!’ ‘রাম শুধু সীতা উদ্ধারকারী নয়, একজন আক্রমণকারীও। তার হাতে যদি লঙ্কার পতন হয়, এই দেশের কী হবে ভেবেছ?’ ‘রাবণের মৃত্যু হবে।’ ‘শুধু লঙ্কাধিপতির মৃত্যুটাই দেখলে, লঙ্কার স্বাধীনতাটা দেখলে না! আর্যদের পায়ের নিচে এই অনার্য রাজ্যটি পিষ্ট হতে থাকবে, সেটা ভাবলে না? লঙ্কা যে অযোধ্যার একটা করদ রাজ্যে রূপান্তরিত হবে, সেটা বুঝছ না!’ মাথা নিচু করে থাকে বিভীষণ। সরমা আবার বলে, ‘তোমার মধ্যে আর যা-ই থাকুক, দেশপ্রেম নেই। দেশশত্রু রাই অরিদলে যোগদান করে।’ ‘এসব কী বলছ তুমি! তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমি তোমার স্বামী!’ ‘তুমি একজন বিশ্বাসঘাতক। স্বার্থপর তুমি।’ ‘আর তুমি এমন কি বিশ্বাসরক্ষক হয়েছ যে, রাবণের পরনারী হরণকে সমর্থন করছ!’ ‘দাদার এই কুকীর্তিকে কিছুতেই সমর্থন করি না আমি। তাই বলে বিশ্বাসঘাতক হব কেন? শত্রুদলে যোগ দেব কেন? দেশ তো আমার মায়ের সমান। স্বর্গের বড়ো। এই স্বর্গকে পররাজ্যলোভী রামের হাতে তুলে দেব কেন?’ সরমার কথা শুনে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় বিভীষণ। নিজেকে সংহত করে। বলে, ‘আর যে সীতার কথা বললে! দেশপ্রেমের কথা বুঝলাম, কিন্তু সীতার জন্য রাজপ্রাসাদ ছাড়বে না, বুঝলাম না তো!’ ‘সেটা তোমার না বোঝার মধ্যেই থাকুক। তোমার দৃষ্টিশক্তি যদি তীক্ষè হতো, তাহলে এই প্রশ্নটি করতে না। যাক সে কথা। তোমাকে একটা অনুরোধ করব, বড় দাদাকে ত্যাগ করে যেয়ো না। তুমি রাজনীতি অভিজ্ঞ মানুষ। এই সংকটে তোমাকে বড় প্রয়োজন দাদা রাবণের। দাদা বাহুবলী, কিন্তু মেধাহীন। তোমার কৌশলী পরামর্শে দাদা এই যুদ্ধে অবশ্যই জিতে যাবেন।’ ‘তোমার কথা রাখতে পারব না আমি। আমাকে যেতেই হবে। রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা আমার জন্য জরুরি।’ ‘কেন যাচ্ছ?’ ‘রাবণের পদাঘাত করার শোধ নিতে।’ ‘আমি বিশ্বাস করি না। তুমি শত্রু শিবিরে যোগদান করছ রাবণের মৃত্যু ঘটিয়ে এই স্বর্ণলঙ্কার রাজা হতে। ধিক তোমাকে!’ ‘তুমি যতই আমাকে ধিক্কার দাও, তোমায় ভালোবাসি আমি সরমা। আজীবন ভালোবেসে যাব তোমায়।’ চোখে তীব্র জ্বালা ছড়িয়ে সরমা বলল, ‘বিশ্বাসঘাতকের আবার ভালোবাসা!’ সেদিন স্ত্রীর অনুরোধ রক্ষা করেনি বিভীষণ। গোপন পথে প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। রাম-লক্ষ্মণ তাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন। অপার বিস্ময় আর বিপুল অস্থিরতা নিয়ে সরমা রাজপ্রাসাদে ছটফট করছিল। তার একদিকে স্বামীপ্রেম, অন্যদিকে দেশপ্রেম। স্বামীপ্রেমকে হেলায় ঠেলে দেশপ্রেমকে বুকের নিচে জাগিয়ে রেখেছিল। বিশ্রবা আর নিকষা স্বামী-স্ত্রী। কালে কালে এদের সন্তান হলো তিন পুত্র, এক কন্যা। পুত্রদের নাম রাবণ, কুম্ভকর্ণ, বিভীষণ। আর সূপর্ণখা হলো কন্যার নাম। কালক্রমে রাবণ লঙ্কার রাজা হলো। মাটির লঙ্কাকে স্বর্ণলঙ্কায় রূপান্তরিত করল। রাজপ্রাসাদকে স্বর্ণ দিয়ে মোড়াল। রাবণ শক্তিতে মত্ত। কুম্ভকর্ণ রাজনীতির ক‚টচালে থাকে না। রাবণ তার কাছে দেবতার মতন। বিভীষণ বিচক্ষণ। বুদ্ধিতে ক্ষুরধার সে। ছোটবেলা থেকেই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। রাবণ আর কুম্ভকর্ণ আজকে দেখে, বিভীষণ দেখে আগামীকালকে বা তারও পরের পরের ভবিষ্যৎকে। বিয়ের বয়স হলে মা নিকষা বিভীষণের বিয়ের উদ্যোগ নেয়। তার আগে বড় এবং মেজ পুত্রের বিয়ে সম্পন্ন করেছে নিকষা। মন্দোদরীকে নিজে নির্বাচন করেছে রাবণ, নিকষার নির্বাচনে কুম্ভকর্ণের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের প্রসঙ্গে বিভীষণ মাকে শুধু বলেছে, ‘মা, তোমার পুত্রবধূকে সুন্দরী এবং নরম স্বভাবের হতে হবে।’ সরমার সঙ্গেই বিয়ে হলো বিভীষণের। সরমা শান্ত, নম্র স্বভাবা, সুন্দরী এবং স্নিগ্ধা। গন্ধর্বকন্যা সরমা। বাবা ব্রাহ্মণ, মা অনার্যা। গান্ধার দেশের রাজা শৈলূষের প্রাসাদে বড় হতে থাকে সরমা। ফুল্ল-কুসুম যেন সরমা। মায়াময় চোখ, লাবণ্যে ভরা দেহ। মনটা দয়ার্দ্র। মায়ের আদেশে রাবণ বিভীষণের জন্য পাত্রীর সন্ধানে বেরিয়েছে। এদেশ-ওদেশ ঘুরতে ঘুরতে একদিন গান্ধার দেশে উপস্থিত হলো রাবণ। সরমাকে দেখে রাবণ বড় মুগ্ধ হলো। এ রকম শাস্ত্রজ্ঞ, ধর্মমনস্ক, মানবিক কন্যাই তো দরকার বিভীষণের জন্য! বিয়ের প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন গান্ধার-রাজ শৈলূষ। মহাসমারোপে বিভীষণ আর সরমাতে বিয়েটা হয়ে গেল। দিন চলল আপন ছন্দে। বিভীষণে এবং সরমাতে ভালোবাসাবাসির অন্ত নেই। সরমা একমুহূর্ত চোখের আড়াল হলে বিভীষণের উচাটন। বছরাধিককাল অতিবাহিত হলো। সন্তান এলো তাদের ঘরে। প্রথমে তরণীসেন, পরে কলা। তরণীসেন পুত্র, কলা কন্যা। সরমা-বিভীষণের জীবনে সুখ উছলে উঠল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসাবাসি আরো গভীর হলো। তারপর হঠাৎ সেই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটল। রাবণ দোর্দন্তপ্রতাপী। তার অনেক গুণ প্রজাহিতৈষী, দেশপ্রেমিক, বীর, দানশীল, সৌন্দর্যানুরাগী। প্রত্যেক গুণশালী মানুষের চরিত্রে একটা হীনতা থাকে। রাবণের চরিত্রেও সেই হীনতা আছে। রাবণ নারীলোলুপ। সূপর্ণখা পুরুষলোভী। পঞ্চবটী বনে রামকে দেখে সঙ্গসুখের লোভ জাগল সূপর্ণখার। রাম দ্বারা প্রত্যাখ্যাতা এবং লক্ষ্মণ দ্বারা লাঞ্ছিতা সূপর্ণখা রাবণকে সীতার সন্ধান দিল। সীতা অপার রূপসী। এ রকম রূপে-লাবণ্যে ভরা নারী রাবণপ্রাসাদে নেই। রাবণ বোনের অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সঙ্গে যুক্ত হলো রমণেচ্ছা। পরনারী রমণেতে স্বর্গসুখ। রামের পিতা দশরথের রাজ্য লঙ্কা থেকে বহু বহু যোজন দূর, অযোধ্যা ছেড়ে রাম-ল²ণ-সীতার গহিন অরণ্য পঞ্চবটীতে আসার কথা নয়। এসেছিলেন চৌদ্দ বছরের বনবাসে, পিতৃসত্য রক্ষা করার জন্য। রাম-সীতার পর্ণকুটিরে বসবাস, লক্ষ্মণ ওঁদের নিরাপত্তা-প্রহরী। ইতোমধ্যে ১৩ বছর ৯ মাস অতিবাহিত। চৌদ্দ বছর পূর্ণ হওয়ার মাত্র ৩ মাস আগে রাবণ সীতাকে হরণ করে বসল। অপহরণের প্রথম রাত রাবণ সীতাকে রাজপ্রাসাদে রাখল। অন্যরা তো দূরের কথা, সেই রাতে স্ত্রী মন্দোদরীর কাছ থেকেও প্রাসাদে অবস্থান করার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল রাবণ। পরদিন সীতা নিক্ষিপ্ত হলেন প্রাসাদ-সংলগ্ন অশোক বনে। ভয়ঙ্কর-দর্শন চেড়িরা সীতার প্রহরায় থাকল। চেড়িরা দুরাচারী, তাদের মুখে সর্বদা কটুভাষ। অন্য কারো প্রবেশাধিকার নেই সেই অশোক বনে। অনেক অনুনয়ের পর রাবণের কাছ থেকে সীতাসঙ্গের অধিকার পেয়েছে সরমা। সরমা বড় বোনের মতো সীতাকে সঙ্গ দেয়, অভয় দেয়। সরমার কাছ থেকে রাম-রাবণের সম্ভাব্য যুদ্ধের কথা অবগত হন সীতা। সীতা হরণের পর লঙ্কার রাজপ্রাসাদ দ্বিধা-বিভক্ত। রাবণ, কুম্ভকর্ণ, অমাত্যসকল, বীর যোদ্ধারা, বীরবাহু, মেঘনাদ, সূূপর্ণখা হরণের পক্ষে। তারা সাধারণ জনমানুষকে বোঝাল রাম পররাজ্যলোভী। আর্যশাসন অনার্যশাসিত লঙ্কা পর্যন্ত বিস্তৃত করতে বানরসেনা দিয়ে লঙ্কা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সীতাহরণের ব্যাপারটি কৃত্রিম একটা উপলক্ষ মাত্র। কিষ্কিন্ধ্যার বানররাজ সুগ্রীব বিশ্বসঘাতক। নিজে অনার্য হয়েও সাদাচামড়ার আর্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। রাজা এবং রাজন্যদের ভাষণে লঙ্কার সাধারণ মানুষেরা রাবণের পক্ষ নিল। কিন্তু সীতাহরণের বিপক্ষে তিনজন মন্দোদরী, সরমা এবং বিভীষণ। প্রধান মহিষী মন্দোদরীর কেন জানি মনে হচ্ছে সীতাহরণ তার জীবনে শনি ডেকে এনেছে। সীতাহরণের পর থেকে রাজা রাবণ কেন জানি তার প্রতি অনাগ্রহী হয়ে উঠেছে। বিভীষণেরও মনে হচ্ছে, দাদার এই ভুলটির জন্য স্বর্ণলঙ্কা ছারখার হয়ে যাবে। লঙ্কার সকল সুখ-স্বস্তি-স্বাচ্ছন্দ্য তিরোহিত হবে। তাছাড়া একজনের স্ত্রীকে তার অসম্মতিতে গায়ের জোরে উঠিয়ে নিয়ে আসা! এ কেমন কথা! রাজা হয়ে রাবণের একী সিদ্ধান্ত! না না, এ বড়ো অন্যায়, এ বড়ো অর্বাচীনতা! দাদার এই হঠকারী কাজের প্রতিবাদ জানানো দরকার। বিভীষণপত্নী সরমারও মনে হয়েছে লঙ্কাধিপতি মস্তবড় অনীতি করেছেন, সীতাকে পঞ্চবটী থেকে হরণ করে এনে। সরমার প্রতিবাদ তো ওই ভাবনা পর্যন্ত। রাবণের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস সরমার নেই। কিন্তু বিভীষণ সাহস করে দাদার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। বলল, ‘সীতাকে হরণ করে আনা আপনার একেবারেই উচিত হয়নি দাদা। সীতা অন্য একজনের স্ত্রী। পরস্ত্রী হরণে মহাপাপ। শুধু মহাপাপ নয়, জগৎজুড়ে মহাকলঙ্কও রটে যাবে।’ রাবণ ক্রোধান্বিত হলো। প্রচণ্ড পদাঘাতে চিত করে ফেলে দিল বিভীষণকে। রাজসভাতেই ঘটল ঘটনাটা। অনন্ত অপমানে ডুবে গেল বিভীষণ। অপমান থেকে ক্রোধ জাগল। ক্রোধান্বিত বিভীষণ সিদ্ধান্ত নিল রাজপ্রাসাদ ছেড়ে যাবে, রামের দলে যোগদান করবে, রাবণ-ধ্বংসের সকল মন্ত্রণা দেবে রামপক্ষকে। যাওয়ার আগে সরমার সঙ্গে দেখা করা জরুরি। দেখা হলো দুজনের। কথাও হলো। দুজনেই সীতাহরণের বিপক্ষে। তারপরও বিভীষণের রামশিবিরে যোগদান করা চরম বিশ্বাসঘাতকতা। সেই কথাই স্বামীকে বলল সরমা। বলল, ‘আমি দাদার এই দুষ্কর্মের বিরোধী। সীতাকে আমি ভালোবাসি। সীতা এই কারাগার থেকে মুক্তি পাক, তাও চাই। কিন্তু এটা কিছুতেই চাই না, এই মুক্তি হবে লঙ্কার স্বাধীনতার বিনিময়ে। তুমি ভাবলে কী করে, রামদলে যোগ দেবে তুমি! কী স্বার্থ তোমার! ধর্মবোধ! আমি নিশ্চিত, ধর্মবোধের তাড়নায় তুমি দাদা বারণকে ত্যাগ করে যাচ্ছ না। তোমার এ যাত্রায় অন্য কোনো অভিসন্ধি আছে।’ অনেকক্ষণ কথা বলে হাঁপিয়ে উঠল। সরমা। বিভীষণ ত্বরিত বলে উঠল, ‘অভিসন্ধি!’ বলবার সময় বিভীষণের গলাটা কেন যেন একটু কেঁপে উঠল। টের পেল সরমা। বলল, ‘তোমার লক্ষ্য অন্যকিছু।’ ‘অন্যকিছু!’ ধরাপড়া কণ্ঠ বিভীষণের। ‘তা-ই মনে হচ্ছে আমার।’ বলে একটু থামল সরমা। খাঁকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিল। বলল, ‘তোমার লক্ষ্য লঙ্কার রাজসিংহাসন, তোমার লক্ষ্য...।’ বিভীষণ বলে উঠল, ‘থামলে কেন, বলো বলো, আর কী বলতে চাইছ।’ ‘না থাক। ভবিষ্যৎই বলবে, তোমার দ্বিতীয় লক্ষ্য কী।’ ম্লান কণ্ঠে সরমা বলল। ‘ভবিষ্যতের কথা বলছ কেন? এখনই বলো আমার দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটা কী?’ উষ্ণ গলায় বলল বিভীষণ। সরমা নিষ্ঠুর নির্মোহ কণ্ঠে বলল, ‘প্রধান মহিষী মন্দোদরীকে শয্যাসঙ্গিনী করা।’ একেবারেই স্তব্ধ হয়ে গেল বিভীষণ। অনেক চেষ্টাতেও তার মুখ থেকে রা বেরোল না। অনেকক্ষণ পর নিজেকে সংযত করে বিভীষণ বলল, ‘এ তোমার উর্বর মস্তিষ্কের উদ্ভট কল্পনা সরমা। বউদি মায়ের সমান। মন্দোদরী আমার সম্মানীয়। রাজমহিষী তিনি। তিনি রূপময়ী, কিন্তু দুর্মূল্য।’ বাঁকা একটু হাসি সরমার ঠোঁটে ঝিলিক দিয়ে উঠল। নীরব রইল সে। যা বলার বলে ফেলেছে সরমা। নিরুপায় বিভীষণ বলল, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি সরমা।’ সরমা বলে উঠেছিল, ‘বিশ্বাসঘাতকের আবার ভালোবাসা!’ সীতার কাছে ফিরে গিয়েছিল সরমা। আর বিভীষণ গিয়েছিল রামশিবিরে। সরমা সীতাকে বলেছিল, ‘তোমার মুক্তির দিন আসন্ন সীতা।’ করুণমুখে সীতা জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কী করে বুঝলে?’ সরমা বলল, শতসহস্র বছর যুদ্ধ করেও রাম তোমাকে উদ্ধার করতে পারতেন না।’ ‘এখন পারবে কী করে?’ ‘রাজা রাবণের ভাই বিশ্বাসঘাতক বিভীষণ রামদলে যোগদান করেছে।’ ‘তো!’ অবাক সীতা। সরমা বলল, ‘রাবণনিধনের অন্ধিসন্ধি বিভীষণের ভালো করেই জানা।’ সীতা নিশ্চুপ থাকে। সরমা গলা ছেড়ে কেঁদে ওঠে। রাম আর রাবণে ঘোর যুদ্ধ হয়। রামের পক্ষে বানরবাহিনী, রাবণের পক্ষে রাক্ষসবাহিনী। রাবণের এক লক্ষ পুত্র আর সোয়া লক্ষ নাতি নিহত হলো এই যুদ্ধে। রাবণপুত্র মেঘনাদকে বিভীষণের প্ররোচনায় হত্যা করা হলো। যুদ্ধে নিহত হলো সরমাপুত্র তরণীসেন। এমন শক্তিমান কুম্ভকর্ণ, একদিন সেও হত হলো। শেষ পর্যন্ত লঙ্কাধিপতি রাবণ পরাজিত ও নিহত হলো। সীতা উদ্ধার হলো। হাজার লক্ষ আত্মীয় এবং শত সহস্র স্বজাতিসৈন্যের রক্ত মাড়িয়ে বিভীষণ লঙ্কায় প্রবেশ করল। রাম বিভীষণকে লঙ্কার রাজপদে অভিষিক্ত করলেন। রাবণপত্নী মন্দোদরীকে বিয়ে করে প্রধান মহিষী বানাল বিভীষণ। উপেক্ষিতা সরমা বিস্মৃতির গর্ভে তলিয়ে গেল। বিভীষণের জৌলুশময় জীবন থেকে দূরে সরে গেল সে। সীতা-পরিত্যক্ত সেই অশোক বনে আশ্রয় নিয়েছে সরমা। জীর্ণ দেহ, শীর্ণ মুখ এখন তার। মাঝে মাঝে সরমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘বিশ্বাসহন্তা।’ বিভীষণের প্রতি সরমার এই কথা কেন, লঙ্কার স্বাধীনতা হরণে রামকে সহায়তা করেছে বলে, না সরমার প্রতি অবহেলা দেখিয়ে মন্দোদরীকে বিয়ে করেছে বলে? ঠিক করতে পারে না শ্রোতারা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে উপেক্ষিতা সরমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে তারা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App