×

জাতীয়

স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিতই রইল!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২০, ০৯:১৫ এএম

সরেজমিন : রাজধানীর পশুরহাট চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও বরিশাল থেকে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো পৃথক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে পশুরহাটে স্বাস্থ্যবিধি না মানার চিত্র

রাজধানীর পশুরহাটগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে কেনাবেচা শুরু হচ্ছে আজ থেকে। চলবে ঈদের দিন সকাল পর্যন্ত। এরইমধ্যে কুরবানির জন্য আনা পশুতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়েছে হাটগুলো। প্রস্তুতির সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে ইজারা কর্তৃপক্ষ। গরু রাখা, হাসিল আদায়ের একাধিক কাউন্টার, নিরাপত্তা বাহিনীর জন্য অস্থায়ী ক্যাম্প, স্বেচ্ছাসেবক, এমনকি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরাও লাগানো হয়েছে। কিন্তু করোনার এই চ্যালেঞ্জে দেখা মেলেনি স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের। বেশিরভাগ বেপারির মুখে মাস্ক নেই, নেই হ্যান্ড গ্লাভস-স্যানিটাইজার বা হাত ধোঁয়ার সাবানও। গরুর পাশেই গাদাগাদি করে বসে আড্ডা দেন বেপারিরা। রাতে গরুর পাশেই থাকেনও গাদাগাদি করে। মশার কামড়ে ঘুমাতেও পারেন না অনেকে। পালাক্রমে দুই থেকে তিন ঘণ্টা করে ঘুমান কেউ কেউ। অন্যারা জেগে থাকেন মশা তাড়াতে। কয়েল জ্বালালেও, উন্মুক্ত জায়গায় কাজ হয় না খুব একটা। ফলে মশার কামড়ে অনেকের হাত-পা ফুলে গেছে। এতে করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু আতঙ্কও রয়েছে। কিন্তু হাট ইজারার শর্তে স্বাস্থ্যবিধি মানার কঠোর নির্দেশনা থাকলেও কোনোটির বিষয়ে পদক্ষেপ দেখা যায়নি ইজারা কর্তৃপক্ষের। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন বেপারিরাও।বিশেষজ্ঞদের মতে হাটে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষিত। এ থেকে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে যাবে আরো ব্যাপক হারে।

আশরাফ আলী ও মজনু আরো চারজনসহ মোট ছয়জন টাঙ্গাইল থেকে যৌথভাবে ১৪টি মাঝারি সাইজের দেশীয় গরু এনেছেন রাজধানীর শাহজাহানপুর পশুর হাটে। এসব গরু শনিবার আনা হলেও গতকাল পর্যন্ত বিক্রি হয়নি একটিও। তবে দরদাম করেছেন কেউ কেউ। তাতে বনিবনা না হওয়ায় বিক্রি করেননি। স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে তাদের মধ্যে কোনো আগ্রহও নেই। ভোরের কাগজকে মজনু জানান, শনিবার রাতে গরু নিয়ে আসার পর রবিবার একটি মাস্ক কিনে নিয়েছেন তিনি। কোমর থেকে বের করলে দেখা যায় হলুদ রঙের একটি ময়লা মাস্ক। হ্যান্ড স্যানিটাইজারের কথা জানতে চাইলে মজনু বলেন, তা নেই। ইজারাদার মাস্ক কিনে নেয়ার কথা বলেছেন; কিন্তু তারা কোনো মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস বা সাবান কোনোটিই দেননি। তার সঙ্গে আরো কয়েকজনকে দেখা গেল গরুকে খাবার দেয়া ও পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত। কিন্তু কারো মুখেই কোনো মাস্ক নেই। জিজ্ঞেস করলেও মাস্ক দেখাতে পারেনি। সরকারের কঠোর বার্তার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা বলেন, ‘দেখি পরে মাস্ক কিনে নেবো’। আলি আহমদ নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, আমাদের এলাকায় করোনা হয়নি। তাই ঢাকাতেও করোনা আমাদের হবে না।

শুধু তাই নয়, সরেজমিন শাহজাহানপুর রেলওয়ে কলোনির এই হাটটি ঘুরে দেখা গেছে, প্রায় ৬০ ভাগ মানুষের মুখে কোনো মাস্ক নেই। গরুর পাশেই গাদাগাদি করে বসে আছেন সবাই। ক্রেতার দেখা খুব একটা না মিললেও ছোট ছোট ছেলেরা দলবেঁধে গরু দেখতে ভিড় করছে। তাদের বেশিরভাগের মুখেই মাস্ক দেখা যায়নি। এমনকি কর্তব্যরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও কারো কারো মুখে মাস্ক দেখা যায়নি। কেউ কেউ আবার থুতনিতে মাস্ক ঝুলিয়ে রেখেছেন। স্বেচ্ছাসেবক ও হাট কমিটির লোকজনদেরও এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। অথচ সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করেই পশুরহাট বসানোর কথা জানিয়েছিলেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ। ভোরের কাগজকে তিনি বলেছিলেন, পশুরহাটে ক্রেতা-বিক্রেতার সামাজিক দূরত্ব তো নিশ্চিত করা হবেই। প্রতিটি হাটে একটি গরু থেকে আরেকটি গরুর দূরত্বও থাকবে। এছাড়া হাটে জ¦র মাপার যন্ত্র থাকবে। হ্যান্ড স্যানিটাইজার থাকবে। প্রত্যেককেই মাস্ক পড়ে হাটে আসতে হবে। কিন্তু তার কোনোটিই দেখা যায়নি।

একই অবস্থা গোপীবাগ ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠ সংলগ্ন অস্থায়ী পশুরহাটে। সেখানেও হাটের অন্যান্য সব প্রস্তুতি থাকলেও স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের কোনো নিদর্শনই নেই। একটি গরুর সঙ্গে আরেকটি গরু একেবারেই লাগোয়াভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। পাশেই গোল হয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছেন বেপারিরা। কারো মুখেই মাস্ক নেই। ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ড থেকে নিজের খামারের আটটি মাঝারি সাইজের দেশীয় গরু এনেছেন মাইনুল ইসলাম। গতকাল পর্যন্ত বিক্রি হয়নি একটিও। তার মুখেও কোনো মাস্ক দেখা যায়নি। এ নিয়ে হাট কমিটির পক্ষ থেকেও কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি।

রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, যেসব হাট সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। সেগুলো অবিলম্বে বন্ধ করে দেয়া উচিত। কারণ মানুষের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়ার অধিকার কারো নেই। তিনি বলেন, এমনিতেই জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে পশুরহাট বসানো হয়েছে। এর ফলে করোনা ঝুঁকি আরো বাড়বে। আর এটি হচ্ছে ইচ্ছাকৃত অবহেলা। যেকোনো ইচ্ছাকৃত অবহেলা অপরাধের মধ্যে পড়ে। তাই সরকারের উচিত হবে মানুষকে বাঁচাতে যা যা প্রয়োজন তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করা।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মোজাম্মেল হক বলেন, ২৩ জুলাই থেকে আমাদের মনিটরিং টিম কাজ করছে। তারা ইজারাদার, বেপারি, ক্রেতা-বিক্রেতা সবাইকে সচেতন করতে কাজ করছে। গাবতলী হাটে মুখে মাস্ক না থাকায় বেশ কয়েকজনকে আর্থিকভাবে জরিমানাও করা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেক ইজারাদারকে কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া আছে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে। এরপরও যদি তারা সেটা না করেন, তাহলে আরো কঠোর হওয়া ছাড়া আমাদের সামনে উপায় নেই।

এবার ঢাকায় দুটি স্থায়ীসহ মোট ১৮টি পশুরহাট বসানো হয়েছে। ঢাকা উত্তরে পাঁচটি অস্থায়ী ও একটি স্থায়ীসহ মোট ছয়টি আর ঢাকা দক্ষিণে ১১টি অস্থায়ী ও সারুলিয়ার একটি স্থায়ী হাটসহ মোট ১২টি পশুর হাট বসানো হয়েছে। বেশিরভাগ হাটেই স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানার বিষয়ে অনাগ্রহ দেখা গেছে বিক্রেতা-ক্রেতা এমনকি ইজারা কর্তৃপক্ষকেও।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App