×

সারাদেশ

উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে পানি বাড়ছেই, কমছে পূর্বাঞ্চলে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২০, ১০:৪৮ এএম

উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে পানি বাড়ছেই, কমছে পূর্বাঞ্চলে

গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায় বাঙালি নদীর বাঁধ ভেঙে মহিমাগঞ্জ ইউনিয়নের বোঁচাদহসহ প্রায় ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ২৭ জুলাইয়ের ছবি -ভোরের কাগজ

ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, ঘাঘট, তিস্তা, ধরলা, করতোয়া, পদ্মা ও আড়িয়ালখাঁ নদের পানি এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের জেলা গাইবান্ধা, জামালপুর, শেরপুর, টাঙ্গাইল, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। এসব জেলার বানভাসিদের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এদিকে সুরমা, সারী, ধলাই নদীর পানি ধীরে ধীরে কমছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে পূর্বাঞ্চলের জেলা সুনামগঞ্জ ও সিলেটে। নিচে এ সম্পর্কে আমাদের প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্ট-

গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় আরো দুটি নতুন ইউনিয়নসহ ৪০টি ইউনিয়নে বন্যার অবনতি ঘটেছে। সোমবার সকালে ব্রহ্মপুত্রের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৮ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি শহর পয়েন্টে বিপদসীমার ৭১ সেন্টিমিটার এবং করতোয়ার পানি কাঁটাখালী পয়েন্টে বিপদসীমার ১১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এদিকে করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বাঙ্গালী নদীর বোচাদহ গ্রামে বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার মহিমাগঞ্জ, রাখালবুরুজ ও কোচাশহর ইউনিয়নের বোচাদহ, বালুয়া, ছয়ঘরিয়া, শ্রীপতিপুর, কুমিড়াডাঙ্গা, পুনতাইর, পাছপাড়া, গোপালপুর, জিরাই, সোনাইডাঙ্গা, হরিনাথপুর-বিশপুকুর, কাজিরচক, পচারিয়া, মাদারদহ, কাজিপাড়া, ফরিকরপাড়া, পানিয়াসহ ২০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে ফসলের ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। অপরদিকে গাইবান্ধা জেলা শহর সংলগ্ন কুপতলা, খোলাহাটি, ঘাগোয়া, গিদারী ইউনিয়নের নতুন নতুন এলাকায় বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ফলে ওই সব ইউনিয়নের বসতবাড়ি এবং সড়কগুলোতে এখন হাঁটু পানিতে নিমজ্জিত।

রাজবাড়ী : রাজবাড়ীতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। পদ্মা নদীর পানি রাজবাড়ীর তিনটি পয়েন্টেই আবার বৃদ্ধি পেয়েছে। দৌলতদিয়া পয়েন্টে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ সে.মি. বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১১৮ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে চরাঞ্চলের বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে। এলাকার মানুষ রাস্তা, বাঁধ ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বসবাস করছেন। তবে দেখা দিয়েছে গবাদিপশুর খাদ্য সংকটও।

মাদারীপুর : প্রবল বর্ষণ ও অব্যাহতভাবে নদীর পানি বৃদ্ধিতে গতকাল সোমবার মাদারীপুরের ৪টি উপজেলার নিম্নাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহ ধরে বন্যার পানির স্রোতের তীব্রতায় দ্রুত পানি প্রবেশ করে শিবচর উপজেলার পদ্মা নদীবেষ্টিত চর ও সংলগ্ন ইউনিয়নগুলোতে। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় নিম্ন আয়ের মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন। ক্রমেই নতুন করে বন্যার পানিতে প্লাবিত হচ্ছে জেলার বাকি ৩ উপজেলা রাজৈর, কালকিনি ও মাদারীপুর সদর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের কয়েক হাজার মানুষ। জেলায় এ পর্যন্ত ৩৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। মাওয়া পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি বিপদসীমার ৭১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শিবচরে পদ্মা ও আড়িয়ালখাঁ নদে গত ২৪ ঘণ্টায় বন্যার পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে এবং মাদারীপুর শহরের কাছে আড়িয়ালখা নদের পানি বৃদ্ধি পেয়ে ৪ সে.মি. বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জামালপুর : জামালপুরে যমুনা নদীর পানি আগামী দুই দিন কমার পর আবারো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড। এতে বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হলে দুর্ভোগ আরো বাড়বে বানভাসিদের। তবে বানভাসিদের দুর্ভোগ কমাতে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে জেলা প্রশাসন। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, সোমবার দুপুরে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১০৫ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্র নদের পানি জামালপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সকালে জামালপুর পৌরসভার নাওভাঙ্গার চর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বন্যার পানি এখনো না কমায় শতাধিক গ্রামবাসী এক মাস ধরে আশ্রয় নিয়ে আছেন শহর রক্ষা বাঁধে। তাদের অভিযোগ, একবার সরকারি ত্রাণ সহায়তা পেলেও চাহিদার তুলনায় তা কম। তারা আবারো ত্রাণের দাবি জানান।

শেরপুর : শেরপুরে ২৪ গত ঘণ্টায় অবিরাম বর্ষণে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বন্যার পানিতে রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত হয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে আমন বীজতলা, রোপা আমন, আউশ, পাট ও শাক-সবজির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শেরপুর সদর উপজেলার ৮টি ইউনিয়নসহ জেলার প্রায় ২০টি ইউনিয়ন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

সিলেট : সিলেটে ধীরে ধীরে কমে আসছে প্রধান নদ-নদীর পানি। আর এতে উন্নতির পথে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি। বৃষ্টিপাত কম থাকায় সুরমা, সারী, ধলাই, লোভ নদীর পানি কমতে থাকলেও একটি পয়েন্টে এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে কুশিয়ারা নদী। সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত সিলেটের কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার নিচে নেমে এসেছে সুরমার পানি। সিলেট পয়েন্টেও বিপদসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার নিচে নেমে যাওয়ায় সিলেট সদর, কানাইঘাট ও মহানগরীর বেশ কয়েকটি এলাকা থেকে পানি নেমে গিয়ে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।

এদিকে শেরপুর, শ্যাওলা ও আমলসিদ পয়েন্টে কুশিয়ারার পানি দ্রুত নামলেও ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে এখনো বিপদসীমার ৪৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যা মাত্র ১ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়েছে। আর এতে করে এখনো ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিতই রয়েছে। লোভা, সারী ও ধলাই নদীর পানি দ্রুত কমে গিয়ে কোম্পানীগঞ্জ, জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট এলাকার বন্যা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে।

সুনামগঞ্জ : তিন দফা বন্যার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারো পানি উন্নয়ন বোর্ড সুনামগঞ্জের সীমান্তবর্তী মেঘালয় ও চেরাপুঞ্জিতে আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছে। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সবিবুর রহমান জানান, আগামী ৭২ ঘণ্টায় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে নদ-নদীর পানির বাড়লেও আগের বন্যার মতো বাড়বে না। অন্যদিকে সুনামগঞ্জে বন্যার পানি কমতে শুরু করলেও জেলার দিরাই ও জগন্নাথপুর উপজেলার প্রায় লক্ষাধিক মানুষ এখনো পানিবন্দি অবস্থায়।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার নদীর পানি কমলেও এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে । এ অবস্থায় নদীবেষ্টিত এ জেলার নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের প্রায় চার লক্ষাধিক বন্যাদুর্গত মানুষ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি ও স্যানিটেশনের অভাবে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অধিকাংশ কৃষক পরিবার গো-খাদ্যের অভাবে তাদের গবাদিপশু নিয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে দিন পার করছেন।

টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। যমুনা ও ধলেশ্বরীসহ বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার ১১টি উপজেলার নিম্নাঞ্চল বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। ফলে এসব উপজেলার প্রায় সাড়ে ৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। বন্যার পানির স্রোতে রাস্তাঘাট, ব্রিজ এবং ব্রিজের অ্যাপ্রোচ সড়ক দেবে যাচ্ছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট।

বগুড়া : বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে বাঙ্গালী নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদীতে পানি বাড়ায় সোনাতলা, ধুনট ও সারিয়াকান্দি উপজেলার চরাঞ্চলের চালুয়াবাড়ী, কর্ণিবাড়ী, কুতুবপুর, চন্দনবাইশা, কাজলা, কামালপুর, রহদহ, সারিয়াকান্দি সদরসহ মোট ১৬টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল এবং পাট, ধানসহ ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় ৭০ হাজার মানুষ।

সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। নিম্নাঞ্চলের বানভাসি মানুষ রয়েছেন চরম দুর্ভোগে। এসব অঞ্চলে দেখা দিচ্ছে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছেন। অপরদিকে যমুনার ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় তিন শতাধিক পরিবার।

মানিকগঞ্জ : পদ্মা-যমুনাসহ জেলার অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় মানিকগঞ্জের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। জেলার ৭টি উপজেলার মধ্যে ৬টি উপজেলাই এখনো বন্যাকবলিত। মানিকগঞ্জ সদর ও সাটুরিয়া উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়েছেন দুই লক্ষাধিক মানুষ।

শরীয়তপুর : শরীয়তপুরে পদ্মা নদীর পানি বাড়ছে। ফলে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। গতকাল সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপদসীমার ১৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এ এস এম আহসান হাবীব বলেন, নদীতে পানি বাড়ার কারণে সড়ক ও নদীর পাড় ভাঙন শুরু হয়েছে। ভাঙনরোধে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। এদিকে বন্যায় জেলায় প্রায় ২ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App