×

মুক্তচিন্তা

হাই আমেরিকা হায় আমেরিকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ জুলাই ২০২০, ০১:১৭ পিএম

আমেরিকায় আসলে কোনোকালেই সাদা-কালোর দ্ব›দ্ব ঘুচে যায়নি। যাবেও না। ট্রাম্প সম্ভবত এমন এক প্রেসিডেন্ট যিনি নিজের দেশকেও এক রাখতে চান না। তাহলে কী চান তিনি? আমার ধারণা তিনি চান তার গদি। আর সেটা থাকতে হবে সাদা সংখ্যাধিক্যের জোরে।

’৭১ সালে আমেরিকা-চীন চেয়েছিল ভারতকে হটাতে। বঙ্গোপসাগরে সাত রণতরী পাঠিয়েছিল তারা। আর আজ? আমেরিকা ও ভারত করছে যৌথ মহড়া। চীনকে ভয় লাগাতে। যে আমেরিকা ছিল রুজভেল্ট ওয়াশিংটনের দেশ সে দেশের প্রেসিডেন্ট একজন ক্লাউন। ট্রাম্প কী করে জানি না এখনো টিকে আছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের চেয়ে কম কিছু বলেননি। তারপরও তার পপুলারিটি কমেনি। বদলে যাওয়া দুনিয়ায় আমেরিকার শ্বাসকষ্ট হওয়ার ঘটনাটা কি বলে? আমি শ্বাস নিতে পারছি না। জর্জ ফ্লয়েডের এই কান্নার রং কি কালো? এই কান্না কি ভেসে আসছে আফ্রিকার অন্তঃস্থল থেকে? সেই যখন গাম্বিয়ার কিশোর কুন্তা কিন্তেকে পশুর মতো খাঁচায় বন্দি করে নিয়ে আসা হয়েছিল তার জন্মভ‚মির উদার প্রান্তর ও সবুজ শস্যক্ষেত থেকে। স্বাধীন মানুষকে অপহরণ, তাকে শিকলে বেঁধে জাহাজবোঝাই করে ভেড়ার পালের মতো নিয়ে আসা হয় এক নতুন দেশে। সে আমেরিকা আজ বিপন্ন এক দেশ। মানুষের এক সময়ের স্বপ্ন আর নির্ভরতার দেশ এখন বিপদের মুখে। একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ ৪৬ বছর বয়স্ক জর্জ ফ্লয়েডকে গ্রেপ্তারের সময় তার গলায় হাঁটু দিয়ে জোরে চেপে বসে আছেন আর জর্জ ফ্লয়েডকে হাঁসফাঁস করে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না’, এমন একটি ভিডিও প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ৪০টি শহরে বিক্ষোভকারীদের দমাতে কারফিউ জারি ছিল। নিউইয়র্ক শহরে মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ৫টা পর্যন্ত লকডাউন জারি রয়েছে। ওয়াশিংটনে আরো দুই রাতের জন্য কারফিউ বাড়ানো হয়েছে। বড় বড় শহরগুলোতে কারফিউ জারি থাকা সত্ত্বেও দমানো যাচ্ছে না বিক্ষোভ। বিক্ষোভ দমাতে চাপের মুখে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এমন পটভ‚মিতে বিক্ষোভকারীদের হটাতে সেনা পাঠানোর হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। একদা মসি ছিল অসির চেয়ে ঢের বেশি শক্তিশালী। আর এই উত্তরাধুনিক দুনিয়ায়, এই ‘ডিজিটাল ডাইন্যাসটি’র আমলে, কলমের চেয়ে অনেক বেশি প্রভাবশালী হলো ক্যামেরা। গোটা পৃথিবী সবিস্ময়ে তার প্রামাণ্য ভিডিও দেখল, অতি সম্প্রতি, মিনেসোটা প্রদেশের মিনিয়াপোলিস শহরে। স্রেফ একটা ছবি রীতিমতো একটা সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিল মার্কিন মুল্লুকে। এবং ইতিহাস বলছে, গত শতকের ছয়ের দশকের মাঝপর্বে বর্ণবৈষম্য ও সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই গণআন্দোলনের পর এমনটা আর কখনো দেখেনি আমেরিকা। এটা যে ঘটল তার কারণ, মার্টিন লুথার যে সুষম সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেটা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি সুসভ্য এবং সমৃদ্ধ আমেরিকায়। বরং বাস্তবটা হলো এই যে, ওই ভিডিও ক্লিপিংসটা একটা ‘শোকেস’ মাত্র, যেটা বিবৃত করে, এ রকম আরো আছে। যুগযুগান্ত ধরে ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে’! সেই কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর শ্বেতাঙ্গদের ‘গায়ের জোর’! সেই সংখ্যালঘুদের ওপর সংখ্যাগুরুদের ‘বলপ্রয়োগ’! সেদিনের মিনিয়াপোলিসের ওই ছবিটা আরো একবার জানান দিল, ‘গভীরে যাও, আরো গভীরে যাও’। আনন্দবাজারের মতামত পড়ে আমি একটা বিষয় জানলাম। আমেরিকায় আসলে কোনোকালেই সাদা-কালোর দ্ব›দ্ব ঘুচে যায়নি। যাবেও না। ট্রাম্প সম্ভবত এমন এক প্রেসিডেন্ট যিনি নিজের দেশকেও এক রাখতে চান না। তাহলে কী চান তিনি? আমার ধারণা তিনি চান তার গদি। আর সেটা থাকতে হবে সাদা সংখ্যাধিক্যের জোরে। এভাবে বলপ্রয়োগ কোনো দেশকেই নিরাপদ রাখে না। এমন একতরফা এককেন্দ্রিক ধর্মান্ধতা পাকিস্তানের মতো দেশগুলোকে সর্বস্বান্ত করে ছেড়েছে। আবার গণতান্ত্রিক ভারতকে হিন্দুত্বের নামে পাগল করে তুলেছেন মোদি। এসব আরো বড় আকারে বড় আয়তনে দেখছি গণতন্ত্রের সূতিকাগার নামে পরিচিত আমেরিকায়। ভাবলে বিস্ময় লাগে এ দেশে ছিলেন মার্টিন লুথার কিং। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র। এ দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন আব্রাহাম লিংকন বা জর্জ ওয়াশিংটন। আজ এক বদ্ধ উন্মাদের হাতে পড়ে আমেরিকা নিজেই দাঁড়িয়েছে আমেরিকার মুখোমুখি। জর্জ ফ্লয়েড যদি মারা না যেতেন আমরা জানতে পারতাম না, বুঝতে পারতাম না প্রদীপের তলায় কতটা অন্ধকার। করোনা মহামারি আমেরিকার পোশাক খুলে দিলেও এ ঘটনা তার প্রায় অন্তর্বাসও কেড়ে নিয়েছে। কোনো সভ্য দেশে, সভ্য সমাজে এমন লুটপাট দেখা যায় না। ইরাক, সিরিয়া বা আফ্রিকার দেশগুলোর চেয়েও ভয়াবহ এই লুটপাট প্রমাণ করে দিয়েছে আমেরিকায় শ্রেণিবৈষম্য কত প্রকট। মানুষের এই চলতি আন্দোলন এক সময় থিতিয়ে যাবেই। বরং এ ঘটনার পর থেকে মার্কিন দেশে মানুষে মানুষে সন্দেহ বাড়বে। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত আর শপিংমলে সাদারা ভুরু কুঁচকে তাকাবে কালোদের দিকে, স্বভাবের দোষে, ‘জলের গতি যেমন সদা নিম্ন দিকে ধায়’। পাড়া পার্ক আর গির্জায় কালোরা রুষ্ট চোখে তাকাবে সাদাদের দিকে, আক্রোশের অভ্যাসে, ‘আগুনেরই স্বভাব যেমন সব কিছু পোড়ায়’! সংখ্যাগুরুরা সুযোগ পেলেই সংখ্যালঘুদের ঘাড় মটকে দেবে। জাতীয় পতাকা হাতে জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় এক মার্কিন নাগরিক পাশের সহনাগরিকের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে তার গায়ের রংটা দেখে নেবে। বোঝার চেষ্টা করবে, তার কথাবার্তায় ‘অ্যাক্সেন্ট’ আছে কিনা। এই বিশ্বাসহীনতার ফিতে কেটে দিয়েছেন আমেরিকার ‘একটু অন্যরকম’ রাষ্ট্রপ্রধান স্বয়ং। তিনি প্রতিবেশী দেশের লাগোয়া সীমান্তে প্রাচীর তুলে দিতে চাইছেন। তিনি পেশাদার অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে তাড়িয়ে দিতে চাইছেন। তিনি একটা বিশেষ দেশের পড়ুয়াদের আমেরিকায় ঢোকা বন্ধ করে দিতে চাইছেন। এভাবেই লিঙ্কন আর লুথারের নির্মিত সমতার মানচিত্র থেকে দিনান্তের আলোর মতোই হারিয়ে যাচ্ছে ‘বহুজাতিক’ আমেরিকা। কয়েকটা বছর আগে দেখা আমাদের সেই বহুত্ববাদের আমেরিকা দ্রুত, খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এই ‘নতুন’ আমেরিকাকে আমরা চিনি না। আমাদের মনে হবে এই কি সেই আমেরিকা যেখানে যাওয়ার জন্য বাঙালি ঢাকার রাজপথে রাত জেগে লাইনে দাঁড়াত? এই কি সেই দেশ যেখানে পা রাখার জন্য এককালে তারকারা পাগলের মতো ছুটত? এই কি সেই আমেরিকা যার নামে দুনিয়া একঘাটে পানি খেত? সে আমেরিকা আর আজকের আমেরিকায় বিশাল ফারাক। এই ফারাক পূরণ করা সহজ হবে না। আমাদের অবশ্য খুব বেশি আনন্দিত হওয়ার কারণ নেই। আমরাও নানাভাবে বিদ্বেষ আর হিংসায় পরিপূর্ণ এক সমাজের মানুষ। ধর্মের নামে, সম্প্রদায়ের নামে, রাজনীতির নামে লিঙ্গ ভেদে আমরাও বৈষম্যের শিকার। তারপরও সবাইকে ছাড়িয়ে ট্রাম্পের আমেরিকা আজ নেগেটিভ আমেরিকা। তার এই কলঙ্ক সহজে মুছবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। হায় আমেরিকা। হাউ গড উইল সেভ আমেরিকা?

অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App