×

জাতীয়

‘সত্য’ বলায় মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি রায়হান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২০, ০৯:৫১ এএম

‘সত্য’ বলায় মালয়েশিয়ায় গ্রেপ্তার বাংলাদেশি রায়হান

রায়হান কবির/ফাইল ছবি।

মালয়েশিয়ায় অভিবাসী শ্রমিকদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে বিরাজমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলায় সে দেশে রায়হান কবির নামে এক বাংলাদেশি নাগরিককে গত শুক্রবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।  শনিবার (২৫ জুলাই) মালয়েশিয়ার অভিবাসন মহাপরিচালক খায়রুল জাইমি দাউদ জানান, রায়হান নামের এই যুবককে দেশে ফেরত পাঠানোর পাশাপাশি কালো তালিকাভুক্ত করা হবে; যাতে তিনি আর কখনোই মালয়েশিয়াতে যেতে না পারেন। উল্লেখ্য, গত ৩ জুলাই আল-জাজিরা টেলিভিশনে প্রচারিত এক প্রতিবেদনে রায়হান প্রতিবেদকের এক প্রশ্নের উত্তরে জানান, করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যেও অবৈধ শ্রমিকদের আটক ও জেলে পাঠানোর মাধ্যমে মালয়েশিয়া সরকার বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। তবে দেশটির কর্মকর্তারা আল-জাজিরার ওই খবর ‘ভুল ও বিভ্রান্তিকর’ বলে দাবি করেন। এদিকে এ ঘটনায় পুলিশ আল-জাজিরার সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করার পর মানবাধিকার সংগঠনগুলো অভিযোগ করছে, দেশটির সরকার গণমাধ্যমের প্রতি দমনমূলক আচরণ করছে। রায়হান কবিরের গ্রেপ্তার বিষয়ে কাতারভিত্তিক আল- জাজিরা কোনো বক্তব্য না দিলেও বলা হয়, তাদের কর্মী এবং ওই প্রতিবেদনে যাদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছিল, তাদের হয়রানি, হত্যার হুমকি এবং ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ফাঁস করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। করোনা ভাইরাসের বিস্তার রোধে লকডাউন শুরু হলে মালয়েশিয়া সরকার শিশু, রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ কয়েকশ অবৈধ শ্রমিককে আটক করে। সরকারের কর্মকর্তারা সংক্রমণ ঠেকাতেই অবৈধ অভিবাসীদের আটকের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেও অধিকারকর্মীরা এ ধরনের ধরপাকড়কে ‘অমানবিক’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। রায়হান কবির নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার শাহি মসজিদ নূরবাগ এলাকার গার্মেন্টকর্মী শাহ আলমের একমাত্র ছেলে। গতকাল শনিবার ওই এলাকায় গিয়ে জানা যায়, সেখানে তিনি বরাবরই সাহসী, সত্যবাদী ও প্রতিবাদী তরুণ হিসেবে পরিচিত। এলাকাবাসী তাদের ‘প্রিয়’ রায়হানের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দেশের মানুষ ও সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। রায়হানদের প্রতিবেশী শাকিলা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সে আমাদের এলাকার গর্ব। খুব খারাপ লাগছে। ভালোমন্দ সবকিছুতে রায়হান এগিয়ে আসত। কেউ পড়াশোনা করতে পারছে না, তাকে নিজের বই দিয়ে, অর্থ দিয়ে সাহায্য করত। মাদক ও অন্যায় কিছু হলেই প্রতিবাদ করত।’ আরেক প্রতিবেশী আমেনা বেগম বলেন, ‘আমি মরেই যাচ্ছিলাম। আমাকে রক্ত দিয়ে জীবন বাঁচিয়েছে রায়হান। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের আবেদন, ওর মুক্তির ব্যবস্থা করেন। আমাদের ছেলেকে আমাদের বুকে ফিরিয়ে দিন।’ রায়হানের বোন মেহেরুন নেসা বলেন, ‘ভাই সব সময় তাকে বলতেন, মানুষের পাশে থাকতে হবে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। ভাইয়ের কথা শুনে তিনিও এভাবে চলতে চেষ্টা করছেন।’ পঞ্চবটী বিসিক শিল্প নগরীর একটি রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানার স্যাম্পলম্যান শাহ আলম জানান, ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে মালয়েশিয়ায় পড়তে যায় রায়হান। স্নাতক পাস করার পর ঈদুল ফিতরের আগে একটি কোম্পানিতে চাকরি হয় তার। কিন্তু চাকরির সব টাকা সেখানেই কষ্টে থাকা মানুষের জন্য খরচ করত সে। তিনি আরো জানান, এলাকায় আগে তার একটি মুদি দোকান ছিল। ওই দোকানে তিনি সিগারেট বিক্রি করতেন। একদিন রায়হান এসে বলল, সিগারেট বিক্রি করলে এলাকার ছেলেরা খারাপ হয়ে যাবে। ছেলের প্রতিবাদের পর থেকে তিনি সিগারেট বিক্রি করা বন্ধ করে দেন। রায়হানের মা রাশিদা বেগম বলেন, লকডাউনে বন্ধুকে দেখতে গিয়ে তার খারাপ অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেনি রায়হান। তাই সে আল-জাজিরা টেলিভিশনে সত্য কথা বলে দিয়েছে। রায়হানের বিষয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। এ বিষয়ে খোঁজ নেয়া হবে। রায়হানের মুক্তি চায় ২১ সংগঠন : রায়হান কবিরের গ্রেপ্তারের নিন্দা জানিয়েছে বাংলাদেশের অভিবাসন খাতের ২১ সংগঠন। রায়হানের নিরাপত্তা নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে দ্রুত তার মুক্তি দাবি করেছে সংগঠনগুলো। এ ব্যাপারে মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন, ঢাকার পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় হওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। গতকাল শনিবার ২১টি সংগঠনের যৌথ বিবৃতিতে এই আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ৩ জুলাই ‘লকড আপ ইন মালয়েশিয়ান লকডাউন-১০১ ইস্ট’ শীর্ষক একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আল-জাজিরা। এতে দেখানো হয়, মালয়েশিয়া সরকার মুভমেন্ট কন্ট্র্রোল অর্ডারের (এমসিও) মাধ্যমে মহামারির সময়ে অভিবাসীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করছে। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে অভিবাসীদের প্রতি মালয়েশিয়ার নিপীড়নের যে ছবি উঠে এসেছে সেটা নিন্দনীয় ও গভীর উদ্বেগের। আমরা ১১ জুলাই এক বিবৃতিতে মালয়েশিয়ার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি এই ধরনের অভিযোগগুলো তদন্তের আহ্বান জানিয়েছিলাম। সংগঠনের নেতাদের বলেন, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, এই ঘটনার পর সাংবাদিকদের ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ করল মালয়েশিয়া সরকার। আল-জাজিরার প্রতিবেদনে সাক্ষাৎকার দেয়ায় বাংলাদেশি তরুণ রায়হানের ব্যক্তিগত তথ্য চেয়ে সমন জারি ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয় প্রশাসন। আমরা পরিষ্কার করে বলতে চাই, গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়া কোনো অন্যায় নয়। আর রায়হান কোনো অপরাধও করেনি। অথচ এমনভাবে মালয়েশিয়া বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তাকে খুঁজছে যেন সে বড় অপরাধী। এর মধ্যেই শুক্রবার সন্ধ্যায় তাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় মালয়েশিয়ার পুলিশ। আমরা রায়হানের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।’ বিবৃতি প্রদানকারী সংগঠনগুলো হলো- রামরু, ওয়ারবি, ব্র্যাক, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ), ওকাপ, বিএনএসকে, আইআইডি, আসক, বমসা, বাসুগ, ইনাফি, কর্মজীবী নারী, বিএনপিএস, ডেভকম, ইমা, আওয়াজ ফাউন্ডেশন, রাইটস যশোর, বিলস, বাস্তব, ফিল্মস ফর পিস ফাউন্ডেশন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App