×

জাতীয়

নদী গিলছে জনপদ!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২০, ০৯:১৯ এএম

নদী গিলছে জনপদ!

পুংলী নদীর পাড়ে টাঙ্গাইল শহর রক্ষা বাঁধের প্রায় ২৫০ মিটার ভেঙে হুমকির মুখে পড়েছে জনপদ। সদর উপজেলার গালা ইউনিয়নের শিবপুর পাছবেথর এলাকায় এ ভাঙন দেখা দেয়। ২৫ জুলা্ইয়ের ছবি -ভোরের কাগজ

উজান থেকে নিচের দিকে নেমে আসা ঢল ও বৃষ্টির কারণে দেশের ৩১ জেলা বন্যাকবলিত। প্রতিনিয়তই পানি বাড়ছে। বাড়ছে দুর্ভোগ। প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন। নিঃস্ব হয়ে পড়ছে মানুষ। অন্যদিকে পানিবন্দি মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে পানিবাহিত ডায়ারিয়া, আমাশয় ও হাত-পায়ে ঘাসহ নানা রোগ। সব মিলিয়ে বন্যা এবং ভাঙনে দিশাহারা হয়ে পড়েছে মানুষ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। তথ্যমতে, বর্তমানে দেশের ৩১টি জেলার প্রায় ৪০ লাখ লোক পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ভেঙে গেছে স্কুল-মাদরাসা ও বহু বাঁধ। ডুবে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ক্ষেতের ফসল। ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। গবাদিপশু, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, থাকা-খাওয়া নিয়ে চরম ভোগান্তিতে বানভাসিরা। পানি যত বাড়ছে বিভিন্ন স্থানে তত তীব্র হচ্ছে নদীভাঙন। বন্যাদুর্গত এলাকায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল হওয়ায় অনেক স্থানে বানভাসিরা ত্রাণ পাচ্ছে না। এদিকে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা হিসেবে ৫৫০ মেট্রিক টন চাল, ৮৭ লাখ টাকা ও ১৪ হাজার অন্যান্য খাবার বরাদ্দ দিয়েছে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, ব্রহ্মপুত্র-যমুনার শাখা নদ-নদীর পানি বাড়ছে, যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। এছাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টা পদ্মার পানি বাড়াও অব্যাহত থাকবে। তবে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, চাঁদপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকতে পারে। অন্যদিকে কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নাটোর, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও নওগাঁ জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। বর্তমানে ১৯টি নদীর ৩০টি স্টেশনে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পরিবেশ ও পানি বিশেষজ্ঞ ড. এ আতিক রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের দেশে প্রতি বছরই কমবেশি বন্যা হয়ে থাকে। আমরা বন্যা চলে যাওয়ার পর ব্যবস্থা নিই। ফলে আমাদের ক্ষতির পরিমাণও বাড়ে। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব। পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাত ভোরের কাগজকে বলেন, সরকারের উচিত সম্ভাব্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে আগে থেকে ব্যবস্থা নেয়া। তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা কমবে। তাছাড়া ভাঙনের পর পানি উন্নয়ন বোর্ড যে কাজ করে তা নিছক লোক দেখানো। সুতরাং এখন পর্যালোচনা করার সময় এসেছে কিভাবে কাজ করলে নদী পাড়ের মানুষকে রক্ষা করা যায়।

পাঁচ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে : কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, সিলেট, সুনামগঞ্জ এবং নেত্রকোনা জেলার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। সারাদেশে পর্যবেক্ষণাধীন ১০১টি পানি সমতল স্টেশনের মধ্যে বৃদ্ধি পেয়েছে ৭২টির, হ্রাস পেয়েছে ২৮ টির, অপরিবর্তিত রয়েছে ১টির, বন্যা আক্রান্ত জেলার সংখ্যা ১৭টি, বিপদসীমার উপরে নদীর সংখ্যা ১৯ এবং বিপদসীমার উপরে স্টেশনের সংখ্যা ৩০টি।

আগামী ২৪ ঘণ্টায় তিস্তা নদী ডালিয়া পয়েন্টে এবং বালু নদীর ডেমরা পয়েন্টে বিপদসীমা অতিক্রম করতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, নাটোর, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরিয়তপুর ও ঢাকা জেলার নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আগামী ২৪ ঘণ্টায় স্থিতিশীল থাকতে পারে। এছাড়া ঢাকা জেলার আশেপাশের নদীসমূহের পানি বাড়া আগামী ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। অন্যদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি সমতল বাড়ছে যা আগামী ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে। যমুনা নদীর পানি সমতল স্থিতিশীল আছে যা আগামী ২৪ ঘণ্টায় বাড়তে পারে।

চাঁদপুর : চাঁদপুরের মেঘনা নদীতে হু হু করে বাড়ছে পানি। এতে সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে দেখা দিয়েছে ভাঙন। এ ভাঙনে উদ্বোধনের আগেই নদীগর্ভে বিলীনের মুখে রয়েছে রাজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চ বিদ্যালয়। নির্মাণ শেষে মাত্র ২ মাস আগে হস্তান্তর করা হয় দৃষ্টিনন্দন চাঁদপুর রাজরাজেশ্বর ওমর আলী স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টার। ত্রিতল বিশিষ্ট ভবনটি নির্মাণে সরকারের ব্যয় হয় ২ কোটি ২৯ লাখ টাকা। শুধু তাই নয়, ইতোমধ্যে ইউনিয়নের প্রায় ২০০ বাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে এবং আরো ৫০০ বাড়ি নদীভাঙনে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

মাদারীপুর : অব্যাহত বর্ষণ ও বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় মাদারীপুরের ৪টি উপজেলায় চলছে নদীভাঙন। শিবচরে পদ্মা ও আড়িয়াল খাঁ নদে অব্যাহত ভাঙনে চরাঞ্চলের বাতিঘর এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয় ভবনটিসহ এ পর্যন্ত ২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি ও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। প্রায় ২০ হাজার মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আড়িয়াল খাঁ ও পদ্মা নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জ : বৃহত্তর চলনবিলসহ তাড়াশে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। শতশত ঘরবাড়ি, আশ্রয়কেন্দ্র ও গুচ্ছগ্রাম, ২ হাজার হেক্টর রোপা আমন বীজতলা, প্রায় ২ শতাধিক পুকুর বন্যার পানিতে ডুবে গেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া : তিতাস নদীর পানি নবীনগর পয়েন্টে ৭০ সেন্টিমিটার বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ : টানা বৃষ্টি ও উজান থেকে আসা ঢলে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মধ্যপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাড়ি, কমিউনিটি ক্লিনিক, মহিলা মাদরাসাসহ বেশ কয়েকটি গ্রাম পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের প্রায় সাড়ে ১২ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

এদিকে দীর্ঘ এক মাসেও নামেনি নদীবেষ্টিত জেলা গাইবান্ধার ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট, করতোয়া ও তিস্তার পানি। এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে এসব নদীর পানি। আর এই পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বাঁচতে হচ্ছে নিম্ন ও চরাঞ্চলের বানভাসিদের।

কুড়িগ্রামের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। দেখা দিয়েছে খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, গবাদিপশুর খাদ্য এবং স্যানিটেশন সমস্যা। গতকাল শনিবার ধরলা নদীর পানি ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার এবং ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে বিপদসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ও নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৬৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীভাঙনের শিকার হয়ে সারডোব, সাহেবের আলগা, থেতরাইসহ বিভিন্ন এলাকায় গৃহহীন হয়েছে আরো শতাধিক পরিবার। অনেকেই বাঁধে আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App