×

মুক্তচিন্তা

সাহেদরা...

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২০, ০৭:৩৬ পিএম

শিরোনামটি সম্পূর্ণ করতে পারিনি। অনেক কিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। সাহেদরা আছে- থাকবে, সাহেদরা অপ্রতিরোধ্য, সাহেদরা অন্যকে কিনে ফেলে ইত্যাদি নানাভাবে শিরোনামটি শেষ করা যায়। পাঠকদের কাছেই ছেড়ে দিলাম তারা কী দিয়ে শেষ শব্দগুলো পূরণ করতে চান। ধারাবাহিকভাবে গত কয়েক মাসে আমরা কিছু নাম পেয়েছি। সম্রাট, পাপিয়া, এমপি পাপুল, ক্যাসিনো ব্রাদার্স এনামুল হক এনু ও রুপন ভুঁইয়া, সাহেদ, ডা. সাবরিনা ইত্যাদি। র‌্যাব কর্তৃক গ্রেপ্তার হওয়ার পর এদের নামগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। এদের নানাবিধ কলঙ্কের কথা বের হয়ে এসেছে। গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত এদের নামে কোনো কলঙ্কের ইতিহাস প্রকাশিত হয়নি। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে আদেশপ্রাপ্ত হয়ে র‌্যাব এদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষটি সুস্পষ্টভাবে এবং কঠিনভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। তারপরই শুরু হয়েছে গ্রেপ্তার এবং নানা ধরনের কার্যক্রম। অনেক বড় প্রশ্নের সুযোগ এখানেই। অপরাধীদের কেউই একদিন-দু’দিনে এত বড় অপরাধী বনে যাননি। তারা সবাই এ সমাজে অপরাধের চর্চা করেছেন অনেকদিন ধরেই। অপরাধ করার পূর্বে অথবা অপরাধ করার সময় তারা কেউ বাধাগ্রস্ত হননি। নির্বিঘ্নেই তারা তাদের পাপের কাজগুলো একের পর এক করে যেতে পেরেছেন। প্রশ্ন হলো- সেই অপরাধের তথ্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন কিংবা সংবাদমাধ্যম আগে জানতে পারেনি কেন? নাকি জানলেও প্রকাশের সুযোগ বা সাহস পায়নি? প্রশ্নটা এভাবে রেখেই বাকি লেখাটা শেষ করতে চাই। এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তির নাম সাহেদ। রিজেন্ট হাসপাতালের এমডি সাহেদ। তার প্রতিষ্ঠান ৬ হাজার করোনার নমুনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট প্রদান করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, হাসপাতালটির মালিক মোহাম্মদ সাহেদ বিএনপির সময় বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগের হয়ে গিয়েছেন। ইতোমধ্যে আমরা দেখলাম জেকেজি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী এবং তার স্বামী জেকেজির এমডি মো. আরিফ চৌধুরীর লীলাখেলা। এদের আগের নায়ক ছিলেন সাড়াজাগানো ক্যাসিনো সম্রাট। যুবলীগের শক্তিশালী নেতা সম্রাটকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট একসময় যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন এবং একটি বিপজ্জনক কর্মীবাহিনী গড়ে তুলে তার আড়ালে অবৈধভাবে ক্যাসিনো বাণিজ্য গড়ে তুলেন এবং বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক বনে যান। যখন প্রভাবশালী জিকে শামিমকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন প্রকাশ্যে আসেন সম্রাট। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বিশেষ করে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অলিখিত ঠিকাদার মাফিয়া জিকে শামিমকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আদেশবলে রাজনৈতিকভাবে যথেষ্ট প্রভাবশালী হয়েও তারা তাদের গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হননি কিংবা প্রভাবশালী কেউ তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারেননি। ক্যাসিনো ঘটনার অন্য দুজন নায়ক ‘ক্যাসিনো ব্রাদার্স’ নামে খ্যাত এনামুল হক এনু ও রুপন ভুঁইয়া। এনু-রুপনের উত্থান সিনেমাকেও হার মানিয়ে দেয়। তাদের দুজনের নামে মোট ৯১টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ছিল। এসব অ্যাকাউন্টে জমা পড়েছে ২০৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। তাদের আছে ২০টি বাড়ি। এনু-রুপন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবে ২০১৪ সাল থেকে অবৈধভাবে ক্যাসিনো ব্যবসা শুরু করেন। তদন্তের এক পর্যায়ে র‌্যাব এনু-রুপনের লালমোহন সাহা স্ট্রিটের বাসা থেকে নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার এফডিআর এবং এক কেজি সোনা জব্দ করে। এর পরের কীর্তিমান খেলোয়াড়টি ছিলেন নরসিংদীর যুব মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া। এখানেও র‌্যাব সফলতার সঙ্গে তার বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার পূর্বমূহূর্তে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশক্রমে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়। দেশের মাটিতে নয়, বিদেশের মাটিতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল। মানব এবং অর্থ পাচারের অভিযোগে কুয়েত সরকার তাকে গ্রেপ্তার করেছে। হঠাৎ করেই বাংলাদেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যে আলোচিত চরিত্র হয়ে উঠেন পাপুল। পাপুল বর্তমানে কুয়েতের কারাগারে আছেন। প্রত্যেকটি ঘটনাই আলাদা এবং আলাদা আলাদা পরিপ্রেক্ষিতে ঘটেছে। কিন্তু সব ঘটনার অভিন্ন একটি বার্তা আছে। সমাজের এই প্রভাবশালী অপরাধীদের বিরুদ্ধে স্বয়ংক্রিয় কোনো সরকারি পদ্ধতি কাজ করেনি। বিশেষ ক্ষেত্রে সরকারের সর্বোচ্চ ক্ষমতার ব্যক্তিটি অর্থাৎ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতাবলে নির্দিষ্ট করে অনুমোদন দেয়াতে র‌্যাব তৎপরতার সঙ্গে এসব অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। রাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব অপরাধ এবং অপরাধীকে থামিয়ে দিতে পারেনি। এদের থামাতে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়েছে। প্রশ্ন হলো- তিনি এভাবে কতগুলো অপরাধের খোঁজ পাবেন? তার কাছে পৌঁছতে হবে বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলো। সেই কাজটিও কিন্তু সহজ এবং কম কষ্টসাধ্য নয়। তার কাছে পৌঁছানো, তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং অনুমোদন লাভ করা ইত্যাদি পুরো প্রক্রিয়াটিই জটিল এবং তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধ এবং অপরাধীকে আটকে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নয়। বাংলাদেশে এখন এমনটাই মনে হচ্ছে যে, কোনো বড় ধরনের অপরাধীকে আটকানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা অত্যাবশ্যকীয়। সাধারণ পদ্ধতিতে বড় বড় অপরাধ দমন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরাধপ্রবণতা মানুষের জাগতিক একটি প্রবণতা এবং সুযোগ দিলে এই প্রবণতার কবলে পড়ে যায় যে কোনো দুর্বল মানুষ। বাংলাদেশে ঠিক এমনটাই ঘটছে। ধীরে ধীরে এখানে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোতে পদ্ধতিগত ত্রæটি দেখা দিয়েছে, প্রশাসনে পদ্ধতিগত সমস্যা দেখা দিয়েছে। এমন ব্যর্থ পদ্ধতির সুযোগে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাই অপরাধ কিংবা অপরাধী এখানে বাধাগ্রস্ত হতে পারছে না। আর সেই অব্যবস্থার মধ্যে বন্দি হয়ে আছে সরকারের সব সংস্থা, রাজনীতি এবং সংগঠনগুলো। এখানে পুলিশ কিংবা সরকারি কর্মকর্তারা প্রকৃত রাজনীতিবিদদের থেকে কখনো কখনো বড় রাজনীতিবিদ বনে যাচ্ছেন। এখানে অপরাধীর পক্ষে প্রভাবশালীদের অবস্থান; বন্দি হয়ে যাচ্ছে সবকিছু অর্থ আর লোভের কাছে। তাই অপরাধী ধরা না পড়ার বিষয়ে একরকম নিশ্চিত হয়েই কাজ করছে। এমনটাই ঘটেছে উপরে উল্লিখিত সব ঘটনায়। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির কাছে ধরা পড়েনি এরা কেউই। এদের অন্যায়ের ঘনঘটা এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, তা পৌঁছে গিয়েছিল দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ নজরে। তিনি শক্ত হাতে না ধরলে এরা হয়তো কখনো গ্রেপ্তারই হতেন না; এদের অপরাধের চাকা থেমে যেত না। কিন্তু একটিমাত্র লোক কতদিক দেখবেন, কতটা দেখবেন? তার নির্দেশ না আসা পর্যন্ত কোনো সংবাদ মাধ্যমে এসব অপরাধীর অপরাধ নিয়ে কোনো প্রতিবেদন এলো না, আইনপ্রয়োগকারী কোনো সংস্থা থেকে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না- ব্যাপারটি সত্যিই বিস্ময়কর! যদি এমনটাই হয় যে, সবকিছু অজান্তেই হয়েছে- তবে সংবাদমাধ্যম, গোয়েন্দা সংস্থা, প্রশাসন এবং পুলিশ ব্যবস্থা তাহলে কী কাজে লাগছে? যদি এমনটা হয় যে, সবাই সবটা জানে- কিন্তু ওই প্রভাবশালী মহলের ভয়ে কেউ মুখ কিংবা কলম চালাতে পারছে না, তবে সেই একই প্রশ্ন দাঁড়ায়- তাহলে তাদের অস্তিত্ব আছে কী জন্য? এমন একটি পরিস্থিতিতে দেশ মহাসংকটে পতিত হয়েছে, যা থেকে উদ্ধারের উপায় সেই একটি মানুষকেই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে পদ্ধতি উন্নয়নে কাজ করতে হবে। অপরাধ হবে, অপরাধী থাকবে- কিন্তু রাষ্ট্রীয় পদ্ধতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই অপরাধীর বিরুদ্ধে দাঁড়াবে। সেই পদ্ধতি ফিরিয়ে আনতে রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী কাঠামো এবং জবাবদিহিতার শৃঙ্খলে ফিরিয়ে আনতে হবে। সাহেদরা কিংবা সাবরিনারা চলতে থাকবেন, আর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কিংবা স্বাস্থ্য খাতের কেউ জবাবদিহিতার আওতায় আসবেন না- এমনটা যতদিন চলতে থাকবে, ততদিন এমন অপরাধপ্রবণতা আর অপরাধীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। তাই নিশ্চিত করতে হবে জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসন। সমাজকে উপহার দিতে হবে সুশৃঙ্খল এক প্রশাসনিক পদ্ধতি।

মেজর (অব.) সুধীর সাহা : কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App