×

স্বাস্থ্য

লাইসেন্স নবায়নে গরজ নেই বেসরকারি হাসপাতালের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২০, ০৯:১৮ এএম

 শর্ত পূরণ করতে না পারা বর্ধিত ফি ও কারিগরি ঘাটতি অধিদপ্তরের জনবল সংকট
দেশে অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনায় লাইসেন্স করা কিংবা তা নবায়নের বিষয়টি ঝুলে পড়ে ২০১৮ সালের পর থেকেই। ওই বছর ৪ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এক পরিপত্রে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের নিবন্ধন ফি এবং নিবন্ধন নবায়ন ফি ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে সর্বনি¤œ ৫০ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেয়া হয়। এছাড়া ওই একই বছর লিখিত আবেদনের পরিবর্তে অনলাইনে আবেদনের পদ্ধতি চালু হয়। এরপর থেকে অনেক বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার লাইসেন্স করা কিংবা তা নবায়নে আগ্রহ হারায়। অনেকে আবেদন করলেও তা নির্ভুল বা সঠিক পদ্ধতিতে করতে পারেনি। অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক শর্ত পূরণ করতে না পারায় আবেদনও করেনি। আবার যারা আবেদন করেছে তাদের সেই আবেদন খুলে দেখাসহ বাছাই করার জন্য যে জনবল দরকার সেটিও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। একজন সহকারী পরিচালক ও ২ জন মেডিকেল অফিসার দিয়ে চলে হাসপাতাল পরিদর্শনের কাজ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত অনলাইনে ১০ হাজার ৯৪০টি হাসপাতাল ও ক্লিনিক লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে লাইসেন্স আছে ৪ হাজার ১৬৪টির। পরিদর্শনের অপেক্ষায় আছে ১ হাজার ৫২৫টি। আবেদন ঝুলে আছে ৪ হাজার ৫২৬টি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি ক্রাইসিস সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক ডা. আয়শা আক্তার ভোরের কাগজকে বলেন, যারা আগে ম্যানুয়ালি লাইসেন্স নিয়েছে তাদেরও অনলাইনে লাইসেন্স নিতে হবে। অনলাইনে আবেদন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর থেকেই এক ধরনের শৈথিল্য দেখা যায়। তবে লাইসেন্স নবায়ন নেই এমন হাসপাতাল ক্লিনিকের তালিকা করা হচ্ছে। সেই তালিকা ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে দেয়া হয়েছে। আরো কাজ চলছে। তালিকা ধরেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এসোসিয়েশনের সভাপতি ডা. মনিরুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, লাইসেন্স নবায়নের ফি ৫ হাজার টাকার পরিবর্তে যখন ৫০ হাজার টাকা করা হলোÑ তখন থেকেই লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা বাড়তে থাকল। কারণ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মধ্যে অধিকাংশই ছোট। যাদের অনেকেই সব খরচ মিটিয়ে আয় করতে পারে না। তাদের পক্ষে ৫০ হাজার টাকা ফি দিয়ে লাইসেন্স নবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া ২০১৮ সালের পর থেকে হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিবন্ধন ও নবায়ন করতে হয় অনলাইনে। সেখানে যেসব শর্ত দেয়া আছে তা পূরণ করতে পারে না অনেক হাসপাতাল। তথ্যগুলো নির্দিষ্ট ফরমেটে পূরণ করতে হয়। কোনো তথ্য বাদ থাকলে সফটওয়্যার তা নেয় না। এমন আরো কিছু কারিগরি ঘাটতির কারণে অনেকেই ওই ফরমেট পূরণ করতে পারে না। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে আবাসিক এলাকায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক না রাখার যে নির্দেশনা আছে সেটিও নবায়নের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ অনেক হাসপাতাল ও ক্লিনিক এখনো আবাসিক এলাকায় রয়ে গেছে। ফরম পূরণের ক্ষেত্রে ঠিকানার জায়গায় গিয়ে অনেকে আটকে যাচ্ছে। ফলে তারাও নবায়ন এড়িয়ে যাচ্ছে। আর নিবন্ধনও নবায়ন করতে পারছে না। যেসব শর্তে লাইসেন্স দেয়া হয় : হাসপাতালের ধরন অনুযায়ী শর্ত থাকে। ঢাকা এবং ঢাকার বাইরের ১০ বেডের হাসপাতাল বা ক্লিনিককে এক বছরের জন্য লাইসেন্স দেয়া হয়, যা প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। তবে এক্ষেত্রে ওই হাসপাতালের যেসব শর্ত মানতে হবে তা হলো কমপক্ষে ৩ জন এমবিবিএস ডাক্তার, ৬ জন নার্স ও ২ জন ক্লিনার থাকতে হবে। প্রত্যেকটি বেডের জন্য ৮০ বর্গফুট জায়গা থাকতে হবে। আউটডোর, এমার্জেন্সি এবং অপারেশন থিয়েটার বাধ্যতামূলক নয়। যদি অপারেশন থিয়েটার রাখা হয় তা হতে হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। থাকতে হবে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও নারকোটিকসের লাইসেন্স। এর সঙ্গে থাকতে হবে ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন নম্বর, বিআইএন নম্বর, পরিবেশের ছাড়পত্রও। এরপর বেড সংখ্যা বেশি হলে আনুপাতিক হারে জনবল বাড়ে। আবেদনের ভিত্তিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন উপপরিচালকের নেতৃত্বে ৩ সদস্যের টিম সরেজমিন পরিদর্শন করে লাইসেন্স দেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার তথ্য অনুযায়ী, শর্ত পূরণ ছাড়া লাইসেন্স দেয়ার যেমন নিয়ম নেই, তেমনি লাইসেন্সের শর্ত ভাঙলে বা তা নবায়ন না করলে তা বাতিলেরও বিধান আছে। তবে লাইসেন্স বাতিলের মতো ঘটনা নেই। ২০১৮ সালে ঢাকার ৩০টি বেসরকারি ক্লিনিককে শোকজ করে ১৫ দিনের মধ্যে সাময়িকভাবে বন্ধ করতে বলেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সেই হাসপাতালগুলো পুনরায় চালু হয়েছে। কিন্তু এরপর কোনো হাসপাতালকে সাময়িক বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়নি। লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে কিংবা নবায়ন না করলে কী ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়Ñ এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বেসকারি হাসপাতাল শাখা) ইউনূস আলী ভোরের কাগজকে বলেন, লাইসেন্সের শর্ত ভাঙলে বা তা নবায়ন না করলে তা বাতিলের বিধান আছে। তবে লাইসেন্স বাতিল করার এখতিয়ার আছে কেবল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, অধিদপ্তরের নয়। শর্ত পূরণ না করলে আমরা লাইসেন্স দেই না। আর লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করলে তাদের শোকজ করি। লাইসেন্স বাতিলসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সুপারিশ করি। এদিকে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে এ সংখ্যা ১৭ হাজার ২৪৪টি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, আমরা লাইসেন্স নবায়নের কথা বলছি। কিন্তু লাইসেন্সই নেই এমন হাসপাতাল ও ক্লিনিকের সংখ্যাও কম নয়। যার হিসাব অধিদপ্তরের কাছেও নেই। আর বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার এসোসিয়েশন বলছে এসোসিয়েশনের সদস্য ১০ হাজারের বেশি। তবে এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও বলা হচ্ছে, তাদের সদস্য নয় এমন অনেক হাসপাতাল আছে। আর লাইসেন্স ছাড়া হাসপাতাল ও ক্লিনিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে একাধিকবার বলা হয়েছে। ওই ধরনের হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দিয়েছিল বলে দাবি করছে সংগঠনটি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, যারা এসব হাসপাতাল খুলেন এবং দিনের পর দিন লাইসেন্সবিহীনভাবে হাসপাতাল চালিয়ে যেতে পারেন তাদের খুঁটির জোর অনেক শক্ত। আর সে কারণেই অধিদপ্তর থেকে লাইসেন্স নবায়নের জন্য চাপ দিলেও তা বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক পাত্তা দেন না। ক্ষমতাসীন দলের নেতা, এমপি মন্ত্রীদের সঙ্গে তাদের সখ্যতা আছে। অনেক সময় প্রশাসনের মদদে কিংবা ম্যানেজ করেই তারা রমরমা বাণিজ্য চালিয়ে যান। এছাড়া এত হাসপাতাল পরিদর্শনের মতো জনবলও নেই অধিদপ্তরের।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App