×

মুক্তচিন্তা

মন্ত্রীরা এসব (চুক্তি) পড়েন না!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২০, ০৮:০৪ পিএম

কোনো মন্ত্রীর ভাষ্যই চোখে পড়েনি যে কথাটা ঠিক নয়। অন্তত তিনি চুক্তি পড়েন। তাহলে কি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সবার মুখপাত্র হিসেবে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে মন্ত্রীরা এসব পড়েন না। কিংবা কোনো মন্ত্রীর কোনো কথা যদি সরকার কিংবা মন্ত্রীর রাজনৈতিক দল সবার জন্য গ্রহণযোগ্য মনে না করে কিংবা বিব্রতকর ভাবে তাহলে দলের একজন মুখপাত্র প্রকাশ্যে অথবা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেন যে বক্তব্যটি উক্ত মন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত বক্তব্য, এর দায় দল বা সরকারের নয়।

শপথ পাঠই কি মন্ত্রীর শেষ পাঠ? এ কথা অনস্বীকার্য করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাধিকালে বাংলাদেশ সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী অবশ্যই স্বাস্থ্যমন্ত্রী। ১৭ কোটি মানুষের জীবনমৃত্যু, সক্ষমতা, সুস্থতার দায় তারই। (দুয়েকটি ব্যতিক্রমও আছে : যারা ভাড়া করা উড়োজাহাজে অসুস্থতার দোহাই দিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে কোনো না কোনো সংস্থার শুভেচ্ছা নিয়ে দেশ ছাড়েন, তাদের দায় মন্ত্রীর ওপর বর্তাবে না। করোনামুক্ত থাকার সরকারি নির্দেশনামা গায়ের জোরে অমান্য করে যারা ঝুঁকিতে পড়েছেন, মন্ত্রী তাদের দায়ও নেবেন না। রিজেন্ট হাসপাতালখ্যাত সাহেদ কোনোভাবে সাতক্ষীরা সীমান্ত পেরিয়ে বশিরহাটে ঢুকে পড়তে পারলে তার দায় এড়ানো যেত, কিন্তু এখন যেহেতু ধরা পড়ে গেছেন এবং রাষ্ট্রীয় হেফাজতেই রয়েছেন অনাকাক্সিক্ষত করোনামৃত্যু যদি এসেই যায় সাবরিনা-সাহেদ-আরিফের পক্ষের আইনজীবীরা রাষ্ট্রকেই দায়ী করার চেষ্টা চালাবেন, প্রকারান্তরে মন্ত্রীকেও।) রাষ্ট্রের জন্য অতি অপরিহার্য বিবেচনা করেই লাগাতার প্রতারণা, শঠতা ও মিথ্যাচারের ঘটনা একের পর এক ফাঁস হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা খাতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি তলানিতে এসে ঠেকলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেশের জন্য অপরিহার্য বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি এবার তার সহকর্মী মন্ত্রীদের ভাবমূর্তিও শূন্যে ঠেকানোর আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলেছেন। হাসপাতাল কেলেঙ্কারির শীর্ষে থাকা রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তথা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে যে চুক্তি করে দুর্নীতিকে উসকে দিয়েছে সেই চুক্তিটি মন্ত্রী পড়েছেন কিনা জিজ্ঞেস করা হলে দেশের বহুল পঠিত একটি সংবাদপত্রকে মন্ত্রী বলেছেন, এটা এমন কোনো কাজ না। আর মন্ত্রীরা এসব চুক্তি পড়েন না। এসব পড়তেও যান না। অজস্র চুক্তি হয়। মন্ত্রীরা চুক্তি পড়েন না বলার পর এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, কোনো মন্ত্রীর ভাষ্যই চোখে পড়েনি যে কথাটা ঠিক নয়। অন্তত তিনি চুক্তি পড়েন। তাহলে কি স্বাস্থ্যমন্ত্রী সবার মুখপাত্র হিসেবে দেশবাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে মন্ত্রীরা এসব পড়েন না। কিংবা কোনো মন্ত্রীর কোনো কথা যদি সরকার কিংবা মন্ত্রীর রাজনৈতিক দল সবার জন্য গ্রহণযোগ্য মনে না করে কিংবা বিব্রতকর ভাবে তাহলে দলের একজন মুখপাত্র প্রকাশ্যে অথবা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেন যে বক্তব্যটি উক্ত মন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত বক্তব্য, এর দায় দল বা সরকারের নয়। এমনকি সত্যিকথনও কখনো কখনো বিব্রতকর হয়ে পড়লে কৌশলগত কারণে সরকার বা দল তার মালিকানা গ্রহণ করে না, সরাসরি বলে দেয় এ দায়িত্ব বক্তার নিজের। কিন্তু মন্ত্রীদের এই ‘চুক্তিপত্র না পড়া’ নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ও সাফাইয়ের পর সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও দল বা সরকারের মুখপাত্র এখনো মুখ খোলেননি। নাকি এই বক্তব্যটিকে যথার্থ মনে করে মুখ খোলার প্রয়োজন নেই বলে মনে করেছেন, তাও স্পষ্ট নয়। জেকেজি কিংবা রিজেন্ট হাসপাতাল কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের প্রশ্রয়ে লালিত পারস্পরিক স্বার্থ হাসিলের হাতিয়ার চিকিৎসক সার্টিফিকেটধারী সাবরিনা কিংবা ছোট পর্দায় বুদ্ধিজীবী সাজা সাহেদের কর্মকাণ্ড মোটেও এই রচনাটির আলোচ্য নয়; আলোচ্য মন্ত্রীদের শপথ পাঠ এবং চুক্তি পাঠ। জনপ্রতিনিধিদের মধ্য থেকেই হোক কিংবা এর বাইরে থেকেই হোক যিনি মন্ত্রী হবেন তার জন্য একটি পাঠ বাধ্যতামূলক, আর তা হচ্ছে শপথ পাঠ। মন্ত্রী হিসেবে নাম ঘোষিত হবার পর যতক্ষণ তিনি শপথবাক্য পাঠ না করছেন, তিনি মন্ত্রী হতে পারছেন না। তার পদটি শপথের পদ। ‘আমি... (মন্ত্রী নিজের নাম বলবেন) সশ্রদ্ধচিত্তে শপথ করিতেছি যে আমি আইন অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রী পদের কর্তব্য বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব, আমি বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ^াস ও আনুগত্য পোষণ করিব। আমি সংবিধানের রক্ষণ সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব এবং আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।’ এই শপথই শেষ নয়, মন্ত্রীকে রাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হতে পারে এমন গোপনীয়তা রক্ষা করার শপথও নিতে হয়। মন্ত্রীর সশ্রদ্ধ শপথের প্রথম ধাপটি হচ্ছে মন্ত্রী পদের দায়িত্ব বিশ^স্ততার সঙ্গে পালন করা। মন্ত্রীর দায়িত্ব কি, মন্ত্রীর কর্তৃত্ব কতদূর রুলস অব বিজনেস সবই স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একাধিক মন্ত্রী থাকলে অভ্যন্তরীণ কর্মবণ্টনও কার কি করণীয় তা বলে দেয়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বালক-বালিকাকে যেমন শিক্ষকের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, মন্ত্রীকেও হরেক রকমের হরেক পেশার মানুষের প্রশ্নের জবাব দিতে হয়। বিশ্বস্ততা কাকে বলে কেউ যদি এ প্রশ্ন নাও করেন তবুও মন্ত্রীকে জানতে হয় এ বিশ্বস্ততা কি এবং কার প্রতি। এ বিশ্বস্ততা রাষ্ট্রীয় ঠিকাদারিতে জড়িয়ে পড়া পুত্র-কন্যা-জামাতার প্রতি নয়। এক ডাকে দু’ডাকে পরিচিত সিন্ডিকেটের প্রতি নয়, সরকার ভজন করা পেশাদার লেজুড় সংগঠনের প্রতি নয়, সাহেদ-সাবরিনা-আরিফ-শামীম-পাপিয়াদের প্রতি নয়, এমনকি যে চুক্তি মন্ত্রী পড়তে নারাজ তার প্রতিও নয়। একটি চুক্তি, স্মারক, দলিল যত ক্ষুদ্র ব্যক্তিই সই করুন না কেন তিনি করেছেন তা রাষ্ট্রের পক্ষে, তাকে অর্পণ করা ক্ষমতা বলে। যে চুক্তি মন্ত্রী সই করেন, যে চুক্তি সচিব সই করেন, যে চুক্তি সহকারী সচিব সই করেন, যে চুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন অধিদপ্তর পরিদপ্তরের কর্মকর্তা সই করেন প্রত্যেকেই তার ওপর ডেলিগেটেড ক্ষমতা প্রয়োগ করে তা করে থাকেন। নিজে যেটা সই করলেন তার দায় তো অবশ্যই মন্ত্রীর এবং একেবারে প্রান্তবর্তী কর্মকর্তা যা সই করলেন তারও ‘সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি’ও মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর। কাজেই যখন বলা হবে মন্ত্রীরা এসব পড়েন না শপথ অনুযায়ী তাদের বিশ্বস্ততা নিয়ে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রশ্ন করা যাবে। মন্ত্রী যদি প্রকাশ্যে বলে দেন তিনি চুক্তি পড়েন না এবং তার সহকর্মী মন্ত্রীরাও পড়েন না তাহলে মন্ত্রীর যে দায়িত্ব তা তারা অবহেলা করেন। শপথের যে প্রতিশ্রুতি তা ভঙ্গ করেন। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদে ‘অউথস অ্যান্ড অ্যাফার্মেশন’-এর যে অন্তর্গত চাহিদা, ‘মন্ত্রীরা এসব চুক্তি পড়েন না’ এটা বললে এবং মেনে নিলে সেই চাহিদাকে অস্বীকার করা হয়, সেই শপথের এসেন্সকে বুড়ো আঙুল দেখানোর আর বাকি থাকে না। এটা মিথ্যে নয় যে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়া মন্ত্রীর পক্ষে সম্ভব নয়। সেজন্যই তাকে সহায়তা করতে গোটা মন্ত্রণালয় এবং এর অধীনস্ত অধিদপ্তর, পরিদপ্তরকে পায়ের আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বৃহত্তর অধিক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের যেসব কার্যক্রম ঘটেছে, ঘটছে এবং ঘটবে- এ সংক্রান্ত সমুদয় প্রশ্নের জবাবই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে জানতে হবে। অন্য মন্ত্রণালয়ের বেলায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে। মন্ত্রী যে বাস্তবিকই জানেন (মাতৃগর্ভ থেকে জেনে আসেন না, মন্ত্রণালয়ের কাজের মধ্য দিয়ে শেখেন) তার প্রমাণ সংসদীয় প্রশ্নোত্তর। তারকা চিহ্নিত হোক কি তারকাবিহীন, প্রশ্নের জবাব তাকে দিতে হয়। শুধু তাই নয়, তার জবাবের পর যেসব সম্পূরক প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে তার জবাব দেবার প্রস্তুতিও তার থাকতে হয়। যদি না থাকে তা হলে এক কথায় তিনি মন্ত্রী পদে থাকার উপযুক্ত নন। যদি তার মন্ত্রণালয় তাকে প্রস্তুত করতে না পারে সচিবও উপযুক্ত নন। মন্ত্রী যখন বলেন ‘মন্ত্রীরা এসব পড়েন না’ তখন সরকার ব্যবস্থায় মন্ত্রিত্বের যে ‘ইনস্টিটিউশন’ তাকে ভীষণ খাটো করে ফেলা হয়। তাহলে শপথ পাঠই কি মন্ত্রীর শেষ পাঠ? আর কিছুই পড়ার নেই? শপথের দ্বিতীয় ধাপে মন্ত্রীকে বাংলাদেশের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য পোষণের শপথ নিতে হয়। এটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তবে এটি মন্ত্রীর জন্য ‘বিশেষ কিছু’ তা মনে করারও কারণ নেই। বাংলাদেশের ১৭ কোটি নাগরিকের বেলায় এটাই নাগরিকত্বের প্রধান শর্ত। সাধারণ নাগরিকের বেলায় অকৃত্রিম বিশ্বাস ও আনুগত্য নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। তার জীবন ও মৃত্যু দুই-ই বাংলাদেশে। কিন্তু যারা ভিআইপিতে উত্তীর্ণ হয়ে যান তাদের আনুগত্য নিয়ে প্রশ্নও সামনে এসে যায়- তাদের কেউ কেউ দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েন, কোনটা তাদের দেশ- যুক্তরাষ্ট্র না বাংলাদেশ, কানাডা না বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া না বাংলাদেশ, অধিকতর বুদ্ধিমান ভাবেন সুইজারল্যান্ড না বাংলাদেশ? দ্বৈত নাগরিকের বেলায় এমপি হতে মন্ত্রী হতে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব বহাল রেখে আর সবই সমর্পণ করতে হয়। কিন্তু যিনি তখনো দ্বিতীয় দেশের নাগরিকত্ব পাননি তবে তা প্রক্রিয়াধীন এমন মন্ত্রী-এমপি যদি থেকে থাকেন (থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না) তাদের আনুগত্য অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ। এমনকি কোনো সাবেক সরকারপ্রধান বা সাবেক মন্ত্রী যদি বছরের পর বছর পশ্চিমের কোনো ধনী দেশে কাটিয়ে দিতে পারেন তাহলে তিনি নাগরিক কোন দেশের? তিনি নিশ্চিয়ই আগে থেকেই সে দেশের নাগরিক ছিলেন কিংবা নাগরিকত্ব প্রাপ্তির আবেদন প্রক্রিয়াধীন ছিল। এ অবস্থায় বাংলাদেশের প্রতি অখণ্ড আনুগত্য কেমন করে সম্ভব? শপথের তৃতীয় পর্বে মন্ত্রীকে পাঠ করতে হয়, ‘আমি সংবিধানের রক্ষণ সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান করিব’, এ নিয়ে আগেও অভিসন্দর্ভ রচিত হয়েছে, এখনো অভিসন্দর্ভ রচনার সুযোগ রয়েছে। অন্য দেশের কথা বাদ থাক, কেবল বাংলাদেশের সংবিধানের ওপর যত জুলুম হয়েছে, যত ক্ষত-বিক্ষত এই পবিত্র দলিল, তার প্রত্যেকটির বৈধতা দিয়েছেন এমপি এবং মন্ত্রীরা। কে কোন দলের এমপি সেটি পরবর্তী বিবেচ্য। আইনি বৈধতা এসেছে উচ্চ আদালত থেকে। বিচারপতি কায়ানি ঠাট্টা করে যখন বলেছিলেন পাকিস্তানের বীর সেনাদল নিজেদের মাতৃভ‚মি বিজয় করে ক্ষমতাসীন হয়েছে সেই বিজয়কেও সংহত করেছে দেশের আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগ। ভারতে শপথ নেয়া হয় ঈশ্বরের নামে, পাকিস্তানে আল্লাহর নামে কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে; অস্ট্রেলিয়া শপথ নেয় হার ম্যাজেস্টি দ্বিতীয় এলিজাবেথের নামে, কোনো দেশ গড এবং হলি গসপেলের নামে, ইউরোপের একটি দেশ শপথ নেয় ‘অলমাইটি গড, ব্লেসড মেরি এভার ভার্জিন, ব্লেসড ম্যারিনো- প্যাট্রন অ্যান্ড ডিফেন্ডার অব দ্য কমিউন’-এর নামে। অবশ্য করোনা ভাইরাসের (ইতালি নাকি দাবি করছে এটা ভাইরাস নয়, ব্যাকটেরিয়া) ব্যবস্থাপনার সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আর সংবিধান জড়িয়ে লাভ নেই- ভারতের সংবিধান বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলেছেন মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণের তামাশার মধ্য দিয়ে সংবিধান লঙ্ঘন শুরু হয়ে যায়। শপথ পাঠের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর বুকের ছাতি দু’বিঘৎ ফুলে উঠে। জাতীয় সঙ্গীত যে বাজছে সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে ইয়াহু ধ্বনি দিয়ে সংবিধান অধিকতর লঙ্ঘনের জন্য তারা রাস্তায় নেমে পড়েন। সংবিধান রক্ষণ, সমর্থন ও সংবিধানের নিরাপত্তা বিধান মন্ত্রীরা করবেন অনেক সংকটাপন্ন কিছু দেশ সে আশা ছেড়ে দিয়েছে; তারা মনে করেন ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতাপ্রত্যাশী উভয়ই রাজনৈতিক দলই লুটেরা চরিত্রের হবে, রাষ্ট্রীয় যন্ত্র তাদের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে, যার নামেই হোক, মহান শপথ ও সংবিধানের দোহাই তামাশার নাটকীয়তা বাড়াবে। শপথের চতুর্থ পর্বে মন্ত্রীকে বলতে হয়েছে ‘আমি ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হইয়া সকলের প্রতি আইন অনুযায়ী যথাবিহীত আচরণ করিব।’ দুর্ভাগ্য শপথের শেষ পর্বটির। যদি এর একাংশ শপথও সত্য হতো তাহলে সাহেদের উত্থান ঘটতই না। সাহেদ-মিঠু-আরিফ-সাবরিনা- এসব সৃষ্টিতে মানব চরিত্রের এই চারটি বৈশিষ্ট্যই যুগপৎ কাজ করেছে। এখানে আমলা-রাজনীতিবিদ-ঠিকাদার এর এক অশুভ চক্র সংগঠিতভাবে কাজ করেছে। ভারতীয় কাহিনীতে দেখা যায় বৃদ্ধ মন্ত্রী যখন কাজ বাগাতে সর্বস্ব উজাড় করে দেয়া নারীর স্পর্শ ও যৌনতার সুখ গ্রহণে অক্ষম, তাকে ভোগের জন্য তিনি পুত্রকেই সামনে ঠেলে দেন। স্বাস্থ্য খাতের সব অপকর্মের মূলে অবিচার ও অপশাসন। কেবলমাত্র এন-৯৫ মাস্ক নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে এবং এখনো ঘটে চলেছে, সদ্য বিএসএমএমইউতে উঠে এসেছে আর এক মাস্ক শারমিনের নাম, যার নাম নিতে কর্তৃপক্ষ লজ্জা বোধ করছিল- এগুলো বিশ্লেষণ করলেই শপথ ও সংবিধান কতটা লঙ্ঘিত হয়েছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। সমস্যা নেই, দুর্ভাবনার কারণও নেই। বিচার বিভাগ যদিও সংবিধানের প্লোটেক্টর ও ডিফেন্ডার, শপথ ভঙ্গ করলে তেমন কিছু আসে যায় না। ভারতীয় উচ্চ আদালতকে সুকুমারান বনাম ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া মামলায় স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে শপথ ভাঙলে অযোগ্য হয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই। ভারতীয় সংবিধানের ১৯১ ধারা অযোগ্যতার যে তালিকা দিয়েছে, তাতে কোথাও শপথ ভাঙার অপরাধ সংযুক্ত হয়নি। কে সি চান্দি বনাম বালাকৃষ্ণ পিল্লাই (শপথ ভঙের জন্য একজন প্রতিমন্ত্রীর অপসারণ আদালতে প্রার্থনা করা হয়েছিল)। হরদুয়ারী লাল বনাম ভজন লাল মামলা আদালত শপথ ভাঙনের প্রমাণ পেলেও তা মন্ত্রিত্ব চলে যাবার জন্য যথেষ্ট মনে করেননি। বরং তারা বলেছেন এ ধরনের মন্ত্রী নিয়ে সরকার যদি বিব্রতবোধ করে সরকারই ব্যবস্থা নিতে পারে। শপথ ভাঙার কারণে কোনো অযোগ্যতা সৃষ্টি হওয়া বা অপসারিত হবার সুযোগ আমাদের সংবিধান সৃষ্টি করেনি। আর সরকারও সহজে বিব্রত হবার নয়। কাজেই আরো সাহেদ আরো সাবরিনা সৃষ্টি করলেও পদ সুরক্ষিত থাকবে- এ আশ্বাস তো থাকলই!

পাদটীকা : ছোটবেলায় মন্ত্রী শব্দটি শোনার আগে মিনিস্টার শব্দটি শুনি এবং ১৯৬২ সালের ঈদুল ফিতরের দিন আমাদের প্রতিবেশী একজন মিনিস্টারের বাড়িতে যাই। এখনকার ইন্দিরা রোডের কাছাকাছি তার বাসা। তার নাম এর আর এস শামসুদ্দোহা, আমার আব্বার পরিচিত, তিনি বলতেন, দোহা সাহেব। তার ছেলে, তিনিও দোহা, ১৯৭০-এর নির্বাচনে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো নির্বাচনী এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন, সঙ্গত কারণে সেখানে কোনো বাঙালির জেতা সম্ভব ছিল না। তিনি কিছুকাল বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। আমার প্রথম মিনিস্টার দেখার অন্তত চার বছর পর একজন প্রধান অতিথির কাছ থেকে একটি পুরস্কার নিই। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী। নাম আমজাদ হোসেন। সেদিনই প্রথম জানি মিনিস্টার আর মন্ত্রী একই কথা। যিনি মন্ত্রী তিনিই মিনিস্টার। নব্বইয়ের দশকে যখন ইন্টারনেটের দেখা পেলাম তখন লাইকোস নামের একটি সার্চ ইঞ্জিন (তখন গুগল ছিল না, গুগলের শুরুটা ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮) অন্যদেশে মিনিস্টারের কাজকর্ম কি জানতে সার্চ করি। পেয়েও যাই। মিনিস্টারের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ‘কন্ডাক্ট অ্যা ফিউনারেল’- শেষকৃত্য পরিচালনা। তখন এটাও বুঝি এই মিনিস্টার সেই মিনিস্টার নন, তিনি আসলে খ্রিস্টিয় হুজুর, ধর্মযাজক। তার সঙ্গে মৃত্যু, দোয়া-দুরুদ কাফন-দাফনের একটা সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশেও একজন মিনিস্টারের বাড়িতে (তিনি সদ্য প্রয়াত) একজন সন্ত্রাসীর উপস্থিতি কাজে লাগিয়ে একটি সরকারের কাফন-দাফনের মতো ঘটনা ঘটে যায়। মন্ত্রীদের কৃতকর্মের দায় নিয়ে অনেক দেশেই সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছে। এই মিনিস্টার ও সেই মিনিস্টার কার কি কাজ, অনেক সময় আমার মতো আরো কেউ কেউ হয়তো গুলিয়ে ফেলেন। ধর্মযাজক মিনিস্টারকে শেষকৃত্যের সময় বই দেখে স্তোত্র পাঠ করতে হয়। মন্ত্রী-মিনিস্টারকেও নিজের, সরকারের ও রাষ্ট্রের শেষকৃত্য ঠেকাতে চুক্তি, দলিল এসব কমবেশি পড়তে হয়।

ড. এম এ মোমেন : সাবেক সরকারি চাকুরে, নন-ফিকশন ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App