×

জাতীয়

দুই হাজার ১৩ শয্যায় রোগী ১৯ জন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ জুলাই ২০২০, ০৯:১৪ এএম

দুই হাজার ১৩ শয্যায় রোগী ১৯ জন

রোগীর অভাবে খাঁ খাঁ করছে অত্যাধুনিক বসুন্ধরা করোনা হাসপাতালের বেডগুলো-ছবি : নূরুজ্জামান শাহাদাত

সরেজমিন: বসুন্ধরা করোনা হাসপাতাল

লন্ডনের এক্সেল এক্সিবিশন সেন্টারের নাইটিঙ্গেল হাসপাতাল ও মাদ্রিদের আইএফইএমএ কনভেনশন সেন্টারের আদলে ২১ দিনে তৈরি করা রাজধানীর বসুন্ধরা করোনা হাসপাতালটি এখন রোগীশূন্য। ঝকঝকে সাজানো গোছানো ২ হাজার ১৩ শয্যার হাসপাতলটিতে ট্রেড সেন্টারে ছয় ক্লাস্টারে এক হাজার ৪৮৮টি বেড। তিনটি কনভেনশন হলে রয়েছে ৫২৫টি বেড। এর বাইরে ৪ নম্বর হলে ৭১ বেডে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)। রয়েছে উন্নতমানের পোর্টেবল অক্সিজেন প্ল্যান্ট। এত সব কিছু প্রস্তুত থাকার পরও এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন সর্বসাকুল্য ১৯ জন রোগী।

রাজধানীর কুড়িল এলাকায় ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার চারটি কনভেনশন সেন্টার এবং একটি প্রদর্শনী তাঁবুতে গড়ে উঠা দেশের সবেচেয়ে বড় এই কোভিড-১৯ হাসপাতালটি চালু হয়েছে ২ মাস আগে। মৃদু ও মাঝারি উপসর্গে থাকা করোনা রোগীদের জন্য মোটা অঙ্কের অর্থ খরচা করে এই হাসপাতাল তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ১৭ মে হাসপতালের উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।

সরেজমিন যা দেখা গেল : ভালো চিকিৎসা দেয়ার মতো সব ধরনের অবকাঠামো রয়েছে এই হাসপাতালটিতে। অনেক নামিদামি হাসপাতালের চেয়েও বেশি পরিচ্ছন্ন। এটা হাসপাতাল দেখে বোঝার উপায় নেই। ৪টি ভবনের একটির এক কোণের একটি কক্ষে ১৯ জন রোগী ভর্তি আছেন। ১ হাজার ৯৯৪টি শয্যা খালি। অর্থাৎ ৯৯ শতাংশ শয্যা খালি। ৯ জন রোস্টারে ডিউটি করছেন। ৯৩ জন নার্স এবং পর্যাপ্তসংখ্যক ওয়ার্ডবয়, আয়া ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিযুক্ত থাকলেও চোখে পড়ার মতো উপস্থিতি নেই। হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষটি কেবল সরগরম। কারণ, সাংবাদিক থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ হচ্ছে এখান থেকেই। একটি বুথে রোগীদের করোনা ‘স্যাম্পল’ নেয়া হচ্ছে। যেখানে সরকার নির্ধারিত ফি ২০০ টাকা করে নেয়া হলেও ৩-৪ জনের বেশি স্যাম্পল দিতে আসেন না।

হাসাপাতালের প্রধান ফটক মোটা বাঁশ দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। ঢুকতে গেলেই পড়তে হবে বিড়ম্বনায়। রোগীদের দাঁড় করিয়ে রেখে বসুন্ধরা গ্রুপের ঊর্ধ্বতন কর্মকতাদের ফোন দেন নিরাপত্তা কর্মীরা। এক ফোন নম্বরে অনেক সময় দাঁড়িয়ে থেকে থেকে অসহায়ের মতো ফিরে যান রোগীরা। কর্মরত স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক কিংবা সহকারী পরিচালকরা ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিলেও তা অগ্রাহ্য করা হয়। এমনকি সাংবাদিক ঢুকতে দিলেও কর্তব্যরত হাসপাতাল পরিচালকের কক্ষ পর্যন্ত ঢোকার নির্দেশনা রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে। এক্ষেত্রে হাসপাতালের ভেতর ও বাইরের সব ধরনের ছবি তোলাও নিষিদ্ধ।

ফিরে যাচ্ছেন রোগীরা: হাসপাতালের গেটে কথা হয় রাজধানী উত্তরা থেকে আসা ফিরোজ রহমানের সঙ্গে। ছেলে আবিরের করোনা ধরা পড়ার পর ১২ দিন বাসায় চিকিৎসা নেন। জ্বর নামছিল না তাই নাম ডাক শুনে এখানে ছুটে আসেন ছেলেকে নিয়ে। কিন্তু ৩ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ছেলেকে ভর্তি তো দূরের কথা, ভেতরেই ঢুকতে না পেরে ফিরে যান।

শয্যা খালি কেন : এত সাজানো গোছানো হাসপাতাল কেন রোগীশূন্য পড়ে আছেÑ জানতে চাইলে, হাসপাতালের পরিচালক ডা. তানভীর আহমেদ চৌধুরী ভোরের কাগজকে বলেন, এখন রোগী নেই এটা সত্যি; কিন্তু করোনা নিয়ে যখন জনগণের মধ্যে ‘পেনিক’ ছিল তখন পুলিশ, র‌্যাবসহ নিরাপত্তা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তিনি বলেন, হাসপাতালটি বিচ্ছিন্ন জায়গায়, যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো নয়। বাইরে কোনো ওষুধের দোকান, খাবার দোকান নেই। অনেকে জানেই না এ রকম জায়গায় হাসপাতাল আছে। অনেকে মনে করেন এটি বেসরকারি হাসপাতাল। কারণ, এর পাশেই অ্যাপোলোর মতো ব্যয়বহুল হাসপাতাল। তাই অনেকে মনে করে, বসুন্ধরার হাসপাতালে খরচ অনেক বেশি। তাই এই হাসপাতালে আসতে চান না রোগীরা।

সমন্বয় নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও বসুন্ধরা গ্রুপের : করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা দিতে বসুন্ধরা গ্রুপের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পেয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মতি দিলে দুই হাজার ১৩ শয্যার হাসপাতাল ও ৭১ শয্যার আইসিইউ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে হাসপাতাল প্রস্তুতের পর বসুন্ধরা গ্রুপের স্বেচ্ছাচারিতায় বিব্রত স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যকর্মতারা। এমনকি এতে যে উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে হাসপাতাল প্রস্তুত করা হয়েছিল সেই করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়েও তারা সমস্যায় পড়ছেন বলে ভোরের কাগজকে জানিয়েছেন। অধিদপ্তরের কর্মকতারা জানান, বসুন্ধরা গ্রুপ তাদের ভবনগুলো করোনা চিকিৎসার জন্য দিলেও তারা যেন সব কিছুই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছেন। যে কোনো বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। এভাবে কাজ করে আমরা অভ্যস্ত নই।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখা ও বসুন্ধরা আইসোলেশন সেন্টারের সহকারী পরিচালক ডা. মো. হাবীব ইসমাইল ভ‚ঁইয়া বলেন, অন্য হাসপাতাল থেকে কিছুটা সুস্থ হয়ে রেফার হয়ে এসে শেষের ১০ দিন যেন রোগীরা এখানে চিকিৎসা নিয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে পারে; এ লক্ষ্যে এই আইসোলেন সেন্টার তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু এই ‘রেফারিং’ সিস্টেমটা ঠিকমতো হয়নি। তাছাড়া বসুন্ধরা কর্র্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপের কারণে অনেক বিষয়ে আমরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছি না। প্রচার কম হওয়ায় সাধারণ রোগীদের মনে অনেক বিভ্রান্তি রয়েছে সব মিলিয়েই রাগী নেই এখানে।

৭০০ র‌্যাব-পুলিশ ছাড়া সাধারণ রোগীর চিকিৎসার রেকর্ড নেই : ১৭ মে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এই হাসপাতালের উদ্বোধন করার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৭০০ সদস্য এখানে চিকিৎসা নেন। ওই সময় উত্তরা ও আশপাশের এলাকা থেকে করোনা ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে রোগীরা গেলেও চাপ বেশি বলে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। চলতি মাসের মাঝামাঝিতে ভর্তি হওয়া ১৯ জন ছাড়া সাধারণ রোগীর ভর্তির কোনো রেকর্ড নেই এই হাসপাতালটিতে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশীদ-ই-মাহবুব বলেন, এই হাসপাতালটি নিয়ে চালু হওয়ার আগের আগ্রহ এখন আর নেই। এখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার ওপর মানুষের ব্যাপক অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। কেউ ভেবেছেন হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেন না। আবার কেউবা ভাবছেন ভর্তি হতে গেলে বিড়ম্বনায় পড়তে হবে।

মহামারি শেষ হলে এই হাসপাতালের ভবিষ্যৎ কি? : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালটির চিকিৎসা সরঞ্জামাদি কিনতে সরকারের তরফ থেকে ৭১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল। এছাড়া হাপাতাল পরিচালনার জন্য ডা. তানভীর আহমেদের নেতৃত্বে ১৮৬ জন ডাক্তার পর্যাপ্তসংখ্যক নার্সও নিয়োগ দেয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। এত খরচা করে তৈরি করা হাসপাতালে কোনো রোগী নেই। তাহলে মহামারি শেষ হলে এই হাসপাতলের ভবিষৎ কি? এমন প্রশ্নের উত্তরে হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তাদের বক্তব্য, সামনে কি পরিস্থিতি হয় সেটা তো বলা মুশকিল। আপতকালীন সময়ের জন্য এই হাসপাতাল সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছে। এর পরের সিদ্ধান্ত সরকারের।

জানতে চাইলে বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীর বলেন, করোনা সংকটে মানবিক দায়িত্ববোধ থেকেই সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করার লক্ষ্যেই আমাদের অবকাঠামো হাসপাতাল করতে দেয়া হয়েছিল। আমরা সমন্বয় করেই কাজ করছি। মহামারি পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত এটা হাসপাতালের রূপেই থাকবে। এরপর কি হবে সে বিষয়ে কোনো সিদ্ধন্ত হয়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App