×

মুক্তচিন্তা

পাট শিল্পের পরিণতি কী হবে?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২০, ০৭:৪৩ পিএম

এই করোনাকালে পাটকলগুলোর স্থায়ী শ্রমিকদের ১৩ থেকে ৬০ লাখ টাকার লোভ দেখিয়ে এবং আন্দোলনহীনতার সুযোগ নিয়ে এক ধাক্কায় ২৫টি পাটকল সরকার বন্ধ করে দিল। এখন কারখানাগুলো বন্ধ করে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। পাটের বাজার আমরা হারাচ্ছি। পাট চাষি ও পাট ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করে মৌসুমের সময় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছেন। তাদের পাওনা দেয়া হবে সেপ্টেম্বরের পর যখন বাজেটের টাকা বিজিএমসির হাতে আসবে।

আমাদের দেশে সমগ্র পাট খাতের ওপর এক মরণাঘাত নেমে এসেছে, যদিও সরকার দাবি করছে যে পাট খাতকে আরো জীবন্ত করার জন্যই এই আঘাত! সরকার সোনালি করমর্দনের মাধ্যমে বিজিএমসির ২৫টি পাট কারখানার ২৫ হাজার শ্রমিকদের ‘আগাম বিদায়’ [Early Retirement] দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থাৎ আপাতত কারখানাগুলোতে উৎপাদন বন্ধ থাকবে, এরা পাটও নিশ্চয় এ বছর কিনবে না এবং আন্তর্জাতিক বাজারে এই বছর এরা রপ্তানিও করবে না। গত ২৮ জুন পাটমন্ত্রী প্রেস ব্রিফিংয়ে আরো বলেছেন যে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই তা করা হচ্ছে। পরবর্তী সময় প্রাইভেট পাবলিক পার্টনারশিপের মাধ্যমে এগুলোকে চালু করা হবে। পাট কমিশনের সদস্য খালেদ রব অবশ্য মনে করেন পাট কলগুলো এভাবে একবার বসে গেলে এদের বাজারটি হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই তার মতে একসঙ্গে সব বন্ধ করার এই তথাকথিত ‘শক-থেরাপি’ একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। যে কারখানাগুলোর বৈদেশিক অর্ডার আছে সেগুলো বন্ধ না করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বিজিএমসির দুর্নীতি-অদক্ষতা, ক্রমাগত লোকসান ইত্যাদির বোঝা সরকার আর বহন করতে রাজি নয়। দেশের অনেক ‘বুদ্ধিমান নাগরিকও’ এই ফুটো কলসিতে পানি ঢালতে নারাজ। ভর্তুকি দিয়ে রাষ্ট্রীয় অলাভজনক শিল্প কলকারখানা ও সেবা খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে চালু রাখতে অনেকেই এই কঠিন সময়ে রাজি নন। এই যুক্তিকে কেউ কেউ অবশ্য চরম পর্যায়ে টেনে নিয়ে দাবি করেন যে, ‘রাষ্ট্রীয় খাত’ মাত্রেই পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া উচিত। কারণ বাজারকে রাষ্ট্রীয় আমলাতন্ত্র দিয়ে বশ করার সব প্রচেষ্টা নাকি অতীতে সর্বত্রই ব্যর্থ হয়েছে। তাই সেজন্যই রাষ্ট্রীয় খাতে পাট খাত যে অলাভজনক হয়েছে তা শুধু শুধুই হয়নি। তা অনিবার্য বিষয়ও ছিল বটে। এই চরম মতের প্রবক্তারা তাই মনে করেন ‘ব্যক্তিগতকরণ’ ছাড়া পাটকলকে লাভজনক করা সম্ভব নয়। বিশ্বব্যাংকের এটাই ছিল সব সময়ই সাধারণ অভিমত। এরা ভুলে যান যে এই বাংলাদেশেই রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানার লাভ করার দৃষ্টান্ত আছে, তেমনি ব্যক্তি খাতেও লোকসানের অনেক দৃষ্টান্ত আছে। সরকারের মধ্যে এই ‘অবাধ পুঁজিবাদের’ প্রবক্তারা সরকারের হাতে কোনো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানই থাকা উচিত নয় বলে বিশ্বাস করেন। তাদের বিশ্বাস বর্তমানে যা করা হলো তা বহু আগেই করা উচিত ছিল, আদমজী বন্ধ করে অনেক লাভ হয়েছে, এবার এগুলো বন্ধ করেও অনেক লাভ হবে। এদের মধ্যে কেউ কেউ পারলে বিদ্যুৎ, ওয়াসা, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি সব সেবা এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সব ব্যবসা ও শিল্পকে ব্যক্তি মালিকানায় দিয়ে দেয়ার সুপারিশ করে থাকেন। ১৯৯০-এ সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত মডেলের বিপর্যয়ের পর তারা এ দেশে আরো সরব হয়েছেন। এই প্রবণতাকে ‘নয়া উদারনীতিবাদ’ বলা হয়, যার শুরু হয়েছিল আমেরিকা ও ব্রিটেনের দুই লৌহমানব-মানবী রোনাল্ড রিগ্যান এবং মার্গারেট থেচারের আমলে। তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দর্শন ছিল ‘সেই রাষ্ট্রই সবচেয়ে ভালো যা হবে সবচেয়ে ছোট।’ নোট ছাপানো, পররাষ্ট্র নীতি ও সীমানা রক্ষা ছাড়া রাষ্ট্রের হাতে অন্য কোনো দায়িত্ব থাকা উচিত নয়। যদিও অনেক আগেই রিগ্যান ও থেচার বিদায় হয়েছেন কিন্তু তাদের উত্তরসূরিরা এখনো বহালতবিয়তে জীবিত আছেন। ট্রাম্প ও মোদি তার উজ্জ্বল উদাহরণ। তবে করোনাকালে এই মতামত এর নেতিবাচক দিকটি সারা বিশ্বে অনেক ভালোভাবে উন্মোচিত হয়ে গেছে। প্রমাণিত হয়েছে যে যেসব দেশে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় খাত শক্তিশালী- সেসব দেশে করোনা সংকটকে অনেক পারঙ্গমভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়েছে। সব কিছু বিরাষ্ট্রীয়করণ না করেও চীন-ভিয়েতনাম-কিউবার মিশ্র মালিকানার মডেলটি সফল হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা ÔWashington ConsensusÕ কে ÔBeijing Consensus’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করার কথা বলতে শুরু করেছেন। [দেখুন John Williamson, ‘Is the ‘Beijing Consensus’ now dominant? অংরধহ অভভধরৎং, ২০১২] পুরনো উদারনীতিবাদীরা কিন্তু অতটা চরমপন্থি নন তারা অনেকেই ‘কল্যাণমুখী পুঁজিবাদের’ কথা বলেন। পক্ষান্তরে ‘নয়া উদারনীতিবাদ’ ‘বাজার ও ব্যক্তি মালিকানাকে’ অ্যাবসোলিউট করে ফেলেছেন এবং এর ফলে অর্থনৈতিক ক্ষমতাই শুধু ধনীদের হাতে কেন্দ্রীভ‚ত হয়নি, তার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে ভোটভিত্তিক গণতন্ত্রও গড়হবু, গঁংপষব ও গধহঁঢ়ঁষধঃরড়হ-এর করতলগত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে আওয়ামী লীগের মতো একটি গণভিত্তিক দলের এ রকম পরিণতি কীভাবে হলো। অসৎ আমলা, অসৎ রাজনীতিবিদ ও অসৎ ব্যবসায়ীরা যে বর্তমানে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ঘিরে ফেলেছে- তা আজ আর বলার আপেক্ষা রাখে না। পিপিপির নামে এরা পাটকলগুলোর পরিত্যক্ত সম্পদ (বিশেষত ভূসম্পদ) যে লুটপাট করে খাবেন না এর কি কোনো গ্যারান্টি আছে? ব্যক্তি খাত কি ফেরেশতা? এমন যদি হয় যে ব্যক্তি খাতে পাট খাতও দাঁড়াল না, লুটপাটও বাড়ল তখন কী হবে? যখন তিনি ক্ষমতায় ছিলেন না, তখন বর্তমান প্রধানমস্ত্রী আদমজী বিরাষ্ট্রীয়করণের নিন্দা করেছিলেন এবং রাষ্ট্রীয় খাতের পাটকলগুলোকে পুনরুজ্জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এখন তিনি সে অবস্থান থেকে পিছু হটছেন কেন? গভীরভাবে যদি পাট খাতের কেস স্টাডিটি কেউ করেন তাহলে সেখানে বিকাশের ৩টি পর্ব দেখতে পাবেন। প্রথম পর্ব- ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পর্ব : পূর্ব বাংলায় নীল চাষ, পাট চাষ, ইত্যাদি হতো। এসব কৃষি পণ্য ব্রিটিশরা নিজেদের দেশে নিয়ে প্রসেস করে ভারতেই পুনরায় রপ্তানি করতেন। আমরা ছিলাম কাঁচামাল রপ্তানিকারক এবং ওরা ছিল তৈরি পণ্য রপ্তানিকারক। ফলে আমাদের দারিদ্র্য কমেনি। পূর্ব বাংলার কৃষকের রক্তে ডান্ডির জুট মিলগুলোর সমৃদ্ধি গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান কায়েমের পর প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে। একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধি ও ২২টি ধনী পরিবার গড়ে উঠেছে পাট থেকে উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণ করে। এজন্য পুরো পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ সালে যত বড় বড় গণতান্ত্রিক আন্দোলন তখন হয়েছিল তার পুরোভাগে দাবিটি ছিল পাটশিল্পের জাতীয়করণ এবং সেই সূত্রে ২২টি পরিবারের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণের হাত থেকে অর্থনীতিকে মুক্ত করার দাবি। শুধু রাজনৈতিক মুক্তি নয়, জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য পাট শিল্পের জাতীয়করণের প্রশ্নটি তখন সামনে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুই ছিলেন এই নীতির চ্যাম্পিয়ন- যে কেউ যদি আজ তার চীন ভ্রমণের আত্মস্মৃতি ও ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠ করেন তাহলে তা অনায়াসে উপলব্ধি করতে পারবেন। পাট শিল্পের দ্বিতীয় পর্ব- ১৯৭২-৭৫ : দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রায় ৯৫ শতাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করে নেন। গঠিত হয় ১১টি সেক্টর করপোরেশন। কিন্তু সেখানে প্রথমেই যে সংকট সৃষ্টি হয় তা হচ্ছে উপযুক্ত ‘ব্যবস্থাপনার সংকট’। পৃথিবীতে তখনো এবং এখনো বহু জায়গাতেই রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে বহু বৃহৎ কারখানা বা করপোরেশন দক্ষতার সঙ্গে চলছে। চীনের শক্তিশালী সফল রাষ্ট্রীয় করপোরেশনগুলো তার উদাহরণ। এছাড়া ইউরোপে, আমেরিকায়, জাপানে, ভারতে, ভিয়েতনামে, কিউবায়, বহু জায়গায় নানা ধরনের ব্যবস্থাপনা মডেলে সামাজিক বণ্টনের শুভ দিকটি টিকিয়ে রেখে ব্যক্তিগত উদ্দীপনাকে নিশ্চিত করার জন্য বহু চমকপ্রদ ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। এসব থেকে বোঝা যায় যে ‘কেন্দ্রীভূত আমলাতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের’ বিকল্প ‘নয়া উদারনীতিবাদী মুক্ত বাজার’ নয় বরং কোনো না কোনো ধরনের দেশোপযোগী প্রয়োগবাদী মিশ্র অর্থনীতিই হচ্ছে অধিকতর কল্যাণকর ও দক্ষ বিকল্প যেমনটি আমাদের ৭২-এর সংবিধানে বর্ণিত আছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা পাট খাতের জন্য রাষ্ট্রীয় মালিকানা রেখেই সে রকম কোনো Innovative Management System গড়ার দিকে অগ্রসর হলাম না। এত রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার পরেও এ খাতে ৪৪ বছরে মোট লোকসান হয়েছে মাত্র ১০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর খোঁজ নিয়ে দেখা যায় যে, রাষ্ট্রীয় মালিকানা অব্যাহত রেখে, শুধু বিজিএমসির মাথাভারী প্রশাসন থেকে মুক্ত হতে পারলে (বর্তমানে কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা ২ হাজার ৯০৯ জন!), বিজিএমসি পাটটা ঠিকমতো কিনলে, যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন হলে এবং উৎপাদন ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার হলে এ লোকসান হতো না। কম দাম বা সংকুচিত বাজার বা উচ্চ মজুরি কোনো সমস্যা হতো না, নতুন মেশিনে উৎপাদনশীলতা তিনগুণ বেড়ে যায় বিধায় দ্বিগুণ মজুরি দিয়ে বর্তমান শ্রমিক সংখ্যা রেখেই কারখানা লাভজনকভাবে চালানো সম্ভব হতো। অতীতে যত পেছনে যাওয়া যাবে ততই দেখা যাবে পাট সবসময়ই কিছুটা লোকসান দিলেও তাকে রাষ্ট্র সামাজিক প্রয়োজনেই ভর্তুকি দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। কারণ পাট শিল্প একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রাবান্ধব, পরিবেশবান্ধব, কৃষিবান্ধব এবং শ্রমবান্ধব একটি শিল্প। পাট শিল্পের আত্মহত্যা : তৃতীয় পর্ব : পাট শিল্প পুনরুজ্জীবনের তিনটি বিকল্প প্রস্তাব এই মুহূর্তে টেবিলে ছিল- ১. প্রথমত শ্রমিকদের সোনালি করমর্দনের মাধ্যমে ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে বিদায় করে দেন। তাতে পাটকলগুলো আপাতত বন্ধ হয়ে যাক, কিন্তু আমরা বছর বছর ফুটো পাত্রে পানি ঢালা থেকে রক্ষা পাই। এক বছর পর ব্যক্তি খাতের হাতে কারখানাগুলো পিপিপি করে তুলে দেয়া হোক। পিপিপির শর্ত কী হবে পাটমন্ত্রীর বক্তব্যে তা কিন্তু কোথাও স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে না। যদিও এর ২ দিন পর শ্রম প্রতিমন্ত্রী ৩০ জুলাই শ্রমিক নেতাদের বলেছেন যে এক্ষেত্রে আধুনিকায়নের নানা মডেল অনুসরণ করা যেতে পারে যেমন- লিজ মডেল, জি টু জি মডেল, জয়েন্ট ভেনচার মডেল, পিপিপি মডেল ইত্যাদি। ২. দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল চাইনিজদের সঙ্গে ২০১৬ সালের এমওইউ পুনরুজ্জীবিত করা হোক। চাইনিজ রাষ্ট্রীয় করপোরেশন ও বিজিএমসি যৌথ বিনিয়োগ করে কারখানার যন্ত্রপাতি খোলনলচে বদলে ফেলুক। প্রতিটি কারখানার সঙ্গে আলাদা Performance Contract হোক। চীনের জন্য বড় অংশ রেখে বাকি পণ্য স্বদেশের ও বহির্বিশ্বে বাজারজাত করা হোক। এটাকে জয়েন্ট ভেঞ্জার বলা যেতে পারে, যার উল্লেখ শ্রম প্রতিমন্ত্রী মন্নুজানের প্রস্তাবে আছে। এজন্য ৬ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে। এতে রাষ্ট্রীয় মালিকানার শেয়ার ও চীন সরকারের ঋণ বা শেয়ার থাকতে পারে। কিন্তু আমরা ৬ হাজার কোটি টাকা পুরোটাই দিলে তখন মালিকানা পুরোটাই আমাদের হতে পারে। ৩. কয়েকটি নির্বাচিত পাটকলে ওইসব প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক সংস্থা, ম্যানেজমেন্ট ও বিজিএমসি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে Performance Contract করে নতুন কর্তৃপক্ষের হাতে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা দিয়ে ওই নির্বাচিত কারখানা কয়টি আধুনিকায়ন করে পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা হোক। পরীক্ষার দিনগুলো পর্যন্ত অন্য সব পাটকল যাদের অর্ডার আছে- বিদেশে ক্রমবর্ধমান বাজার আছে তা আপাতত চালু রাখা হোক। আর চলতি জুলাই-আগস্ট মাসে পাট কেনার জন্য তাদের চলতি পুঁজি ধার দেয়া হোক এবং পাট ক্রয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা হোক। তারপরেও যেটুকু লোকসান হবে তা মেনে নিয়ে সংস্কারের সাফল্যকে আস্তে আস্তে ছড়িয়ে দিতে হবে। এ রকম সাবধানে না এগিয়ে, সহসা সব বন্ধ করে দিলে পরে আর পাট শিল্প পুনর্জীবিত করা যাবে না। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে কোনো বিবেচনাই হলো না। এই করোনাকালে পাটকলগুলোর স্থায়ী শ্রমিকদের ১৩ থেকে ৬০ লাখ টাকার লোভ দেখিয়ে এবং আন্দোলনহীনতার সুযোগ নিয়ে এক ধাক্কায় ২৫টি পাটকল সরকার বন্ধ করে দিল। এখন কারখানাগুলো বন্ধ করে বসিয়ে রাখা হচ্ছে। পাটের বাজার আমরা হারাচ্ছি। পাট চাষি ও পাট ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করে মৌসুমের সময় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। শ্রমিকরা বেকার হয়ে গেছেন। তাদের পাওনা দেয়া হবে সেপ্টেম্বরের পর যখন বাজেটের টাকা বিজিএমসির হাতে আসবে। তাও কখন কতটুকু কীভাবে দেয়া হবে সবই অনিশ্চিত। করোনাকালে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার না করে নতুন করে আমরা অনেক বেশি টাকা খরচ করে (সরকারের প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য লাগবে ৫ থেকে ৬ হাজার কোটি টাকা, কিন্তু শ্রমিকদের প্রস্তাবানুসারে লাগবে মাত্র ১ হাজার ২শ কোটি টাকা) দারিদ্র্য বৃদ্ধি করার উদ্যোগ নিয়েছি। আমরা ভুলে গেলাম পাটকলগুলোর বদলি শ্রমিকদের কথাÑ যারা এর ফলে কোনো টাকাই পাবেন না কিন্তু পুরো বেকার হয়ে যাবেন। আমরা ভুলে গেলাম সেসব স্থায়ী দক্ষ শ্রমিকদের কথা যারা সহসা নিজ কোয়ার্টার থেকে বিতাড়িত হয়ে মাঝ বয়সে এসে পেশা বদলাতে বাধ্য হবেন অথবা ব্যক্তি মালিকানাধীন পাটকলগুলোতে অনেক অনেক কম মজুরিতে কাজ করতে বাধ্য হবেন। আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল সেই ব্যক্তি পুঁজিপতির স্বার্থ যারা মুখিয়ে রয়েছে পাটকলগুলোর ২ হাজার একর জমি হাতিয়ে নিয়ে লুটপাট করার জন্য। হায় উন্নয়ন, হায় পাটশিল্প, হায় নয়া উদারনীতিবাদ। তবে এখনো সময় আছে শ্রমমন্ত্রীর বিকল্প প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নিয়ে নয়া উদারনীতিবাদের রাশ টেনে ধরার।

এম এম আকাশ : অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App