×

মুক্তচিন্তা

প্রসঙ্গ : চীনের সাম্প্রতিক গতি-বিধি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২০, ০৭:৩৬ পিএম

দক্ষিণ এশিয়ায় একটু দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে যে, চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানকে তার নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে এসেছে। ভারত ও মালদ্বীপের ক্ষেত্রে তারা সেটি করতে না পেরে এখন বাংলাদেশের দিকে হাত বাড়াচ্ছে এমনটাই ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞের। কোনো গুপ্ত সাম্রাজ্যবাদী অভিপ্রায়ের বলির পাঁঠা যাতে বাংলাদেশ না হয় সেটিই হওয়া উচিত একমাত্র বিবেচ্য বিষয়।

‘সমাজতন্ত্রের ছদ্মাবরণে’ চীন কি সাম্রাজ্যবাদের এক নতুন সংজ্ঞারূপে প্রতিভাত হতে চলেছে? বিশ্বের বিভিন্ন এলাকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মনে এমন প্রশ্নের উদ্রেক হতে দেখা যাচ্ছে ইদানীং। তাদের ধারণা এই যে, পাকিস্তানকে বগলদাবা করার পর চীন এখন অন্যান্য দেশের প্রতিও তার শ্যেনদৃষ্টি মেলে ধরছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশেষ করে বিশ্ব যখন আজ করোনা ভাইরাসের কারণে হিমশিম খাচ্ছে তখন লাদাখে চীনের সামরিক শক্তির প্রয়োগ স্বাভাবিকভাবেই এই জাতীয় ভাবনার খোরাক জোগাচ্ছে বৈকি! ভারত সংলগ্ন গালওয়ান অঞ্চলে চীনা সৈন্যদের সাম্প্রতিক নৃশংস আক্রমণ বিভিন্ন মহলের নিন্দা কুড়িয়েছে। কাঁটাতারের লাঠি জাতীয় জঘন্য হাতিয়ার ব্যবহার আর ২০ জন ভারতীয় সেনা হত্যায় যে নির্মমতার স্বাক্ষর রেখেছে তারা তাতে চীনের ব্যাপারে নতুন ভাবনার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে যে, সৈন্যদের পেশাদারিত্বের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে একেবারেই রাস্তা-ঘাটের গুণ্ডাদের মতো আচরণ করেছে এক্ষেত্রে চীনা সেনারা। লাদাখের এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, জাপান, মালদ্বীপ প্রভৃতি রাষ্ট্র প্রকাশ্যে ভারতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে চীনের নৃশংসতার ব্যাপারে গভীর নিন্দা জানিয়েছে। সেই ঊনবিংশ শতকের ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতোই চীন এ যুগে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ প্রকল্পের নামে এক নতুন ধরনের সাম্রাজ্যবাদী ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। করোনা ভাইরাস চীনের উহান প্রদেশের একটি ল্যাবরেটরি থেকে ছড়িয়েছে এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর জন্য চীন লাদাখে ওই হামলা চালায় এমনটা অনেকেই মনে করছেন। অস্ট্রেলীয় প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনসহ অনেকেই এসব অভিযোগের ব্যাপারে ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তদন্ত দাবি করেছেন। উল্লেখ্য, চীনের সঙ্গে অপর ১৪টি দেশের সীমান্ত বিরোধ বিদ্যমান। করোনার উৎপত্তি, বিস্তার এবং এর পরিণতি বিষয়ে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হয়ে চীন এই জাতীয় সম্প্রসারণবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়েছে কিনা সে বিষয়েও চলছে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা। আর তাই তাও খতিয়ে দেখার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ভারতীয় পক্ষের পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে, ১৯৫৪ সাল থেকে ভারত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের শরিক হিসেবে অন্য দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আসছে এবং এ অবধি ভারত কোনো দেশেই কোনো সামরিক হস্তক্ষেপ করেনি। এমনকি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে পরাজিত করার পর ভারতীয় সেনারা সদ্য প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশেও অবস্থান করেনি। পরবর্তীতে ভারত ও বাংলাদেশ তাদের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ মিটিয়ে ফেলেছে সীমান্তবর্তী ছিটমহলগুলো বিনিময়ের মাধ্যমে। কিন্তু পক্ষান্তরে চীনকে এমন ক্ষেত্রে ঠিক উল্টো ভূমিকা গ্রহণ করতে দেখা যায়। যেমন তিব্বত ও হংকংয়ের উদাহরণ এক্ষেত্রে দেয়া যেতে পারে। দুই স্থানেই চীনের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। ১৯৬২ সাল থেকেই চীনকে মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সীমান্তে ভারতের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত থাকতে দেখা গেছে। আসাম, সিকিম ও অরুণাচলসহ বিভিন্ন রাজ্যের সীমান্তে অনুরূপ তৎপরতা এমনকি হামলাও চালায় তারা। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৩ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম না করার সিদ্ধান্ত হয়। অথচ চীন তার থোড়াই পরোয়া করেছে! এ কথা সবারই জানা যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যখন পাকিস্তানি দখলদার তথা হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ছিল ঠিক তখনই চীন হানাদারদের ২৫৫টি ট্যাংক, এক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান ও ২শর ওপর সামরিক প্রশিক্ষক দিয়ে সাহায্য করেছিল। ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার অনেক পরে চীন বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয় আর এ ক্ষেত্রে তাদের ব্যবসায়িক নীতিভঙ্গি এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নিজেদের সামরিক প্রভুত্ব অর্জনের বিষয়টিকেই অধিকতর গুরুত্ব পেতে দেখা যায়! উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মোট সামরিক উপকরণের শতকরা ৮০ ভাগই চীন সরবরাহ করে থাকে। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গভীরতর হওয়ার মধ্য দিয়ে চীন বর্তমানে পাকিস্তানে চীনা মুদ্রা চালু করার প্রয়াস নিয়েছে। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর অদূর ভবিষ্যতে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাই চীনের লক্ষ্য আর এ কথাটি বুঝতে পারায় এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে চীনবিরোধী বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে দেখা গিয়েছে পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে। মিয়ানমারের প্রতি চীনের আচরণ নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রকৃত প্রস্তাবে চীন যে মিয়ানমারের সমুদ্র বন্দরগুলোর ওপরে আর বাংলাদেশের বাজারের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায় এ কথা সবাই বোঝে। প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে ‘চীনের আগ্রহ’ তাদের এ ধরনের স্বার্থসিদ্ধির এক প্রকার ভান কিনা সেটা দেখার অপেক্ষায় আছে সবাই। শ্রীলঙ্কা, লাওস, কম্পুচিয়াসহ বিভিন্ন দেশকে চীন ঋণের ফাঁদে যেভাবে আটকে ফেলেছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তেমনটি দাঁড়ায় কিনা কে জানে! বিশ্বব্যাংক বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাহায্যদাতা প্রতিষ্ঠানের তুলনায় চীনা ঋণের সুদের হার প্রায় দ্বিগুণ বেশি। চীন ইতোমধ্যেই বাংলাদেশকে এর অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ সাহায্যদানের ব্যাপারে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। আর সাম্প্রতিককালে চীন যে বাংলাদেশ থেকে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে শতকরা ৯৭ শতাংশ শুল্ক রেয়াত ঘোষণা করেছে তা নতুন কোনো বিষয় নয়, কেননা ২০১৫ সাল থেকেই এ বিষয়ে দেশ দুটির মধ্যে দর কষাকষি চলছিল। এমতাবস্থায় বিভিন্ন দেশকে চীনা ঋণের জালে আটকা পড়ে যেভাবে হাঁসফাঁস করতে দেখা যাচ্ছে তাতে প্রতিশ্রুত চীনা ঋণ বাংলাদেশের সামগ্রিক উন্নয়নে কতটা সুবিধা বয়ে আনে সেটাই আগামীতে দেখার পালা। শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত ইন্দোনেশীয় নিজস্ব অর্থনৈতিক জোনটিকে চীন সম্প্রতি নিজেদের এলাকা হিসেবে দাবি করে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গেও বৈরিতা শুরু করেছে। আবার এ বছরের গোড়ার দিকে হংকংয়ে নতুন একটি নিরাপত্তা আইন বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়ে হংকংয়েও সংকট সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় একটু দৃষ্টি দিলেই দেখা যাবে যে, চীন ইতোমধ্যেই মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও পাকিস্তানকে তার নিয়ন্ত্রণের আওতায় নিয়ে এসেছে। ভারত ও মালদ্বীপের ক্ষেত্রে তারা সেটি করতে না পেরে এখন বাংলাদেশের দিকে হাত বাড়াচ্ছে এমনটাই ধারণা অনেক বিশেষজ্ঞের। এ পরিস্থিতিতে তারা মনে করেন যে, চীনের বন্ধুত্বের ও ভ্রাতৃত্বের বুলিতে না ভুলে প্রকৃত পরিস্থিতি ও এর গতি-প্রকৃতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখাটা এবং তদনুযায়ী বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নেয়াটাই হবে বাংলাদেশের জন্য বিচক্ষণতার কাজ। কোনো গুপ্ত সাম্রাজ্যবাদী অভিপ্রায়ের বলির পাঁঠা যাতে বাংলাদেশ না হয় সেটিই হওয়া উচিত একমাত্র বিবেচ্য বিষয়। লাদাখে সেনা সংঘর্ষের বিষয়টি দক্ষিণ এশিয়ায় নিজস্ব প্রভাব বলয় গড়ে তোলার ব্যাপারে চীনের তরফ থেকে একটি পরীক্ষামূলক তৎপরতা কিনা সেটিও বিশেষজ্ঞরা খতিয়ে দেখছেন বলে জানা যায়। আর সেটি সত্য হলে চীনের এই সম্প্রসারণবাদী নীতি কার্যকরের ব্যাপারে বাধাদান করাটাই বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর তো বটেই এমনকি দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোরও নিজেদের স্বার্থে বাঞ্ছনীয় বলে মনে করছেন ওই বিশেষজ্ঞরা।

শাহীন রেজা নূর : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App