×

জাতীয়

ভেসে গেছে কৃষকের স্বপ্ন!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২০, ০৯:১৫ এএম

ভেসে গেছে কৃষকের স্বপ্ন!

বন্যায় বাড়িঘর, রাস্তা-ঘাট তলিয়ে থাকায় গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে অনেক গৃহস্থ পরিবার। নিরুপায় হয়ে গরুবাছুর নিয়ে উঁচু স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন কেউ কেউ। ২২ জুলাইয়ের ছবি -ভোরের কাগজ

করোনা ও বন্যার কারণে পানির দামে বিক্রি হচ্ছে কুরবানির পশু

করোনার কারণে এমনিতেই কুরবানি নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। আয় রোজগার বন্ধ থাকায় অনেকে কুরবানির সামর্থ্যই হারিয়েছেন। আবার সামর্থ্যবানরা হাটে গিয়ে গরু কেনা, ঈদের দিনে কুরবানি দেয়া ও মাংস ব্যবস্থাপনা নিয়ে আছেন দুর্ভাবনায়। ফলে কুরবানির আগ্রহই হারিয়েছেন কেউ কেউ। অথবা ধর্মীয় বাধ্যবাধকতার কারণে সীমিত আকারে তা সম্পন্ন করার চিন্তা করছেন। এসব কারণে এবার কুরবানির পশুর চাহিদা অনেক কম। এই অবস্থার মধ্যে দেশের ১৮টি জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন বন্যায় প্লাবিত। এসব অঞ্চলের কৃষকরা গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন চরম বিপাকে। বিশেষ করে কুরবানিতে বিক্রির জন্য সারা বছর ধরে যারা পশু পালন করেছেন তারা পড়েছেন মহাবিপাকে। অনেকে পানির কারণে গরু হাটেও নিতে পারছেন না। আবার রাখার জায়গা না পেয়ে কেউ কেউ কম দামেই বিক্রি করে দিচ্ছেন। ফলে সারা বছর পরিশ্রমে তৈরি কুরবানির পশু ভালো দামে বিক্রির স্বপ্ন বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির সময়ে সরকারের উচিত কৃষকদের নিরাপত্তা দেয়া। তা না হলে হুমকির মুখে পড়বে দেশের সম্ভাবনাময় এই খাত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্যায় নিজেরই থাকার উপায় নেই কৃষকের। গোয়ালঘর পানিতে থইথই। তাই গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন বেকায়দায়। রাস্তা ও উঁচু স্থানে কোনোমতে গবাদিপশু রেখে বিক্রির চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু চাহিদা ও দাম কম থাকায় বিক্রিও তেমন হচ্ছে না। খামারিরা জানান, চরের মানুষের প্রধান সম্পদ গবাদিপশু। কুরবানির সময় অনেকেই গরু-ছাগল বিক্রি করে সংসারের চাকা সচল রাখেন। কেউ বা শোধ করেন ঋণ। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। করোনা ও বন্যার প্রভাবে নেমে গেছে কুরবানির পশুর দাম। এদিকে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কোনো আশার বাণী দিচ্ছে না। কুরবানির আগে বন্যা পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যেতে পারে বলে পাউবো আশঙ্কা করছে। পাউবো জানায়, আগামী ৩-৪ দিন ভারতের আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারতে ফের ভারি বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চলে বন্যার আরো অবনতি ঘটতে পারে। জুন থেকে পাহাড়ি ঢলে কয়েকটি জেলার নদনদী বিধৌত নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হলেও তখন তা স্থায়ী হয়নি। কিন্তু বর্তমান বন্যায় অনেক এলাকার রাস্তাঘাট পর্যন্ত ডুবে গেছে। কোথাও কোথাও রাস্তা ভেঙে মানুষের চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়িতে পানি ওঠার ফলে নিজেদেরই থাকার উপায় নেই, এর ওপর গবাদিপশু নিয়ে পড়েছেন চরম বেকায়দায়। স্কুল, উঁচু রাস্তা বা বাঁধের উপর অনেকে টিনের ছাপড়া তৈরি করে আশ্রয় নিয়েছেন। এর ওপর দুর্ভোগ বাড়িয়েছে প্রায় প্রতিদিনের মুষলধারার বৃষ্টি। অনেকে পলিথিন টাঙিয়ে কোনো রকম পশুগুলোকে রক্ষা করছেন। কুরবানিতে পশু বিক্রি করতে পারবেন কিনা, এর মধ্যে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হবে কিনা- এসব ভেবে বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকরা চরম অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। বগুড়া জেলার ধুনট উপজেলার কৃষক ফরহাদ হোসেন বলেন, ধুনট ও সোনাতলা উপজেলার ভাণ্ডারবাড়ি, গোসাইবাড়ি, শিমুলবাড়ি, চন্দনবাইশা, জোড়শিমুলসহ বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে ওয়াপদা বাঁধের উপর আশ্রয় নিয়েছেন। আমি ছোট একটি গুদামে গরু-ছাগল নিয়ে এক সঙ্গে বসবাস করছি। জানি না এ দুঃখ কবে ঘুচবে। সারাবছর ধরে একটা গরু পালন করেছি। সেটাও বিক্রি করতে পারব কিনা, তা নিয়েও চিন্তায় আছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান আবু তৈয়ব আবু আহমদ ভোরের কাগজকে বলেন, করোনা ও বন্যা পরিস্থিতির সময়ে সরকারের উচিত কৃষকদের প্রটেকশন দেয়া। গরু উঁচু স্থানে নিয়ে যাওয়া এবং বিক্রির ব্যবস্থা করা। কৃষকরা গরু বিক্রি করতে না পারলে মহাবিপদে পড়বে। কারণ একদিকে তাদের মাথার ওপর ঋণের বোঝা। অন্যদিকে আরো ১ বছর গরু পালন করার মতো সামর্থ্য নেই তাদের। তাই সরকারকে এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী আরিফুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, উজানে আগামী কয়েক দিনের বৃষ্টি ও ঢলের কারণে দেশের নদনদীতে পানির চাপ বাড়তে পারে। তবে পানি বাড়লেও আগামী রবিবার থেকে পদ্মার পানি কমতে পারে। জুলাইয়ের শেষ কিংবা আগস্টের প্রথম সপ্তাহে সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে পারে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারতের মেঘালয়, চেরাপুঞ্জি, আসাম, ত্রিপুরা, চীন ও নেপালের পানি এসে বাংলাদেশে এই বন্যার সৃষ্টি করেছে। তিনি জানান, এরই মধ্যে দেশের ১৮টি জেলা বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। বন্যা আরো বেশ কয়েকটি জেলায় বিস্তৃত হয়ে আরো সপ্তাহ দুয়েক স্থায়ী হতে পারে বলেও তিনি সতর্ক করেছেন। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, নতুন করে ২৩ জেলায় বন্যা বিস্তৃতি লাভ করবে এবং তা আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত স্থায়ী হবে। চলতি মৌসুমে ৩ সপ্তাহের মধ্যে ২ দফা বন্যার মুখোমুখি হয়েছে দেশের উত্তর, উত্তর-পূর্ব ও মধ্যাঞ্চল। ১৮ জেলার নিম্নাঞ্চলে প্রায় ২৬ লাখ মানুষ দুর্ভোগে পড়েছে। প্রথম পর্যায়ে ২৫ জুন হতে ৯ জুলাই পর্যন্ত অতিবৃষ্টি, উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও নদনদীর পানি বৃদ্ধির কারণে বন্যায় রংপুর, গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, জামালপুর, নেত্রকোনা, রাজশাহী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, টাঙ্গাইল জেলাসহ ১৪টি জেলায় ১১টি ফসলের প্রায় ৭৬ হাজার ২১০ হেক্টর জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ৪১ হাজার ৯১৮ হেক্টর জমি সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। টাকার অঙ্কে এ ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩৪৯ কোটি টাকা। মোট ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৪ হাজার জন। দ্বিতীয় পর্যায় ১১ জুলাই হতে ১৯ জুলাই পর্যন্ত মানিকগঞ্জ, বগুড়া, টাঙ্গাইল, নাটোর, নওগাঁ, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, রাজশাহী, দিনাজপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, শরীয়তপুর, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, শেরপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ ২৬টি (আগের ১৪টিসহ) জেলায় ১৩টি ফসলের প্রায় ৮৩ হাজার হেক্টর আক্রান্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ফসলের পরিমাণ এখনো নিরূপণ হয়নি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App