×

জাতীয়

সমন্বয়হীনতায় ডুবছে ঢাকা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ জুলাই ২০২০, ০৯:২১ এএম

সমন্বয়হীনতায় ডুবছে ঢাকা

দুদিনের টানা বর্ষণে রাজধানীর প্রধান সড়ক ও অলিগলি পানিতে ডুবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও জমেছে কোমর সমান পানি। এরই মাঝে ঝুঁকি নিয়ে রিকশা-ভ্যানে যাতায়াত করছেন অনেকে। বাস থেকে ডুবে যাওয়া ভ্যানে নামতে দেখা যায় নারী যাত্রীদের। ২১ জুলাইয়ে দয়াগঞ্জের চিত্র -ভোরের কাগজ

বছরের পর বছর ধরে জলাবদ্ধতায় নাকাল রাজধানী ঢাকার মানুষ। এক রাতের ভারী বৃষ্টিতেই বাসা-বাড়ি হাবুডুবু। সড়কে চলে নৌকা। এ সমস্যা নিরসনে নেয়া হয়েছে বড় বড় প্রকল্পও। প্রতি বছর খাল ও ড্রেন পরিষ্কারে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ হয় না কিছুই। দুর্ভোগ কমেনি, ক্ষেত্র বিশেষে আরো বেড়েছে। প্রতি বর্ষায় জল-কাদায় একাকার। ঢাকায় সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় না হলে এই সমস্যা থেকেই যাবে- বরাবরই বলে আসছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এই সমন্বয়হীনতার জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো একে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। সিটি করপোরেশন জলবদ্ধতার জন্য সব সময়ই দায়ী করে আসছে ওয়াসাকে। সমন্বয়ের জন্য সংস্থাটিকে নিজের অধীনেও চান ২ মেয়র। তবে ওয়াসা বলছে, বর্তমানে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ৭টি সংস্থায় বিভক্ত। আমরা আগে থেকেই বলে আসছি এই সিস্টেম সিটি করপোরেশনের অধীনে দেয়া হোক। এদিকে টানা ২ দিনের বৃষ্টিপাতে ঢাকার বেশির ভাগ সড়ক এখন পানিতে থৈ থৈ। রাজধানীর পূর্বাঞ্চল জুরাইন, পোস্তগোলা, ডেমরা, গোড়ান, বনশ্রী, সিপাহিবাগ, ভূঁইয়াপাড়া, আফতাবনগর, রামপুরাসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি জমেছে। অনেকের ঘরেও উঠেছে পানি। নগরীর মূলকেন্দ্র ধানমন্ডি-২৭, মতিঝিল, শুক্রাবাদ, কলাবাগান, মালিবাগ, শান্তিনগর, টিকাতলী, গোপিবাগ, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, মিরপুর, কাফরুলসহ বিভিন্ন এলাকায় জলজটের সৃষ্টি হয়েছে। এসব এলাকায় কোথাও কোমর পানি, কোথাও হাঁটু পানি। এ অবস্থায় ঝুঁকি নিয়েই চলাচল করছে যানবাহন ও পথচারীরা। ভোগান্তির আর শেষ নেই। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, গত সোমবার সকাল ৬টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাজধানীতে বৃষ্টি হয়েছে ১১০ মিলিমিটার। আরো ২ বা তার বেশি দিন বৃষ্টি হতে পারে। এরপর কয়েকদিন বৃষ্টির মাত্রা কমবে। এদিকে সমন্বয়হীনতা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার এই পরিস্থিতি ততদিন ঠিক হবে না, যতদিন না সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয় নিশ্চিত হচ্ছে। জলাবদ্ধতা নিসরসে মূলত ঢাকা ওয়াসাকেই সবচেয়ে বড় ভ‚মিকা রাখতে হবে। কিন্তু সংস্থাটি বরাবরই লোক দেখানো কাজ করে নিজেদের দায় সারে। তবে দক্ষিণ সিটির নতুন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের সমন্বয়ের বিষয়ে কঠোর বার্তা, আর উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামের ওয়াসাকে নিজের অধীনে নেয়ার ইচ্ছে- এই দুই মিলে হয়তো ওয়াসা এবার দায়সারা কাজ করে পার পাবে না। জলাবদ্ধতার মূল কারণ নিয়ে ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, রাজধানীতে খাল ছিল ৪৩টি। এর মধ্যে ২৬টি ঢাকা ওয়াসা ও ৮টি ঢাকা জেলা প্রশাসনের। আর ৯টি খালকে বক্স-কালভার্ট, রাস্তা ও স্যুয়ারেজ লাইনে পরিণত করা হয়েছে। বাকিগুলো বিলীন হয়ে গেছে। এসব খালে নেই পানিপ্রবাহ। ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। তবে সিটি করপোরেশনের এই প্রতিবেদনে উল্লেখিত খালের হিসাবের সঙ্গে একমত নন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা জানিয়েছেন খালের সংখ্যা ছিল ৫২টি। বাকি খালগুলোর এখন অস্তিত্বই নেই। বেশির ভাগ খাল প্রভাবশালীরা দখল করে বহুতল ভবন ও দোকানপাট তৈরি করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ময়লা-অবর্জনা দিয়ে ভরাট করে রেখেছে। পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। নগরবিদদের মতে, দখল-দূষণের পরও যে পরিমাণ খাল রয়েছেÑ সেটাও যদি সচল রাখা যেত তাহলে নগরবাসীকে জলাবদ্ধতায় এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। জানা গেছে, ঢাকার এসব খাল ও ড্রেন পরিষ্কার এবং সচল রাখতে গত অর্থবছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে বরাদ্দ ছিল ৬৬৬ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আর আগের অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ব্যয় করা হয়েছে ৫৯৯ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ব্যয় করা হয়েছে ৭১৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে এ খাতে গত অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ২৭২ টাকা। চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২২৪ কোটি টাকা। সিটি করপোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা ওয়াসাও তাদের নিজস্ব ড্রেন পরিষ্কারের পেছনে ব্যয় করে বড় অঙ্কের টাকা। সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস ভোরের কাগজকে বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব আমাদের হলেও ওয়াসারও অনেক কাজ রয়েছে। তাদের কাজগুলো খুবই নিম্নমানের এবং অপরিকল্পিত। যার সুফল ঢাকাবাসী পায় না। হাতিরঝিল প্রকল্পের মূল লক্ষ্য ঢাকা থেকে দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন করা। এখান থেকে পানি নিষ্কাশিত হয়ে চলে যাবে শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীতে। সেটা পরিপূর্ণভাবে হচ্ছে না। যার ফলে কাঁঠাল বাগান, গ্রিন রোড ও ধানমন্ডি-২৭ নম্বর সড়কে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। পান্থপথের বক্স কালভার্ট আবর্জনায় ভরে গেছে। এটা নিষ্কাশন করতে দিচ্ছে না। নগরীর নর্দমাগুলো ওয়াসার ঠিকাদাররা পরিষ্কার করে, সেই ময়লাগুলো দিনের পর দিন ফেলে রাখা হয়। এভাবে আর নর্দমা পরিষ্কার করতে দেব না। ওয়াসার আধুনিক যন্ত্রপাতি, সক্ষমতা, জনবলও আছে। নিয়ম না মানলে জরিমানা করা হবে। স্পষ্ট বলতে চাই, ঢাকায় কাজ করতে হলে সমন্বয়ে এসেই কাজ করতে হবে। আমি চাই ওয়াসার কাজগুলো আমাদের মহাপরিকল্পনার আওতায় আনতে। ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর গাফিলতি আর বরদাশত করব না। তিনি বলেন, আশকোনা ও কালসি খাল ভরাট হয়ে গিয়েছিল। ফলে ওই সব এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হতো। মানুষের চলাচলে সমস্যা হতো। সামান্য বৃষ্টিতে কোমর পর্যন্ত পানি থাকত। খালগুলো পরিষ্কারের দায়িত্ব ওয়াসার হলেও তারা সেটা করেনি। আমরা নিজের অর্থে সেগুলো পরিষ্কার করিয়েছি। কারণ জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয় আমাদের, ওয়াসাকে নয়। তাই আমি বলব, ঢাকা ওয়াসাকে সিটি করপোরেশনের অধীনে দেয়া হোক। এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী তাকসিম এ খান ভোরের কাগজকে বলেন, ২০১২ সাল থেকে আমি বলে আসছি- ড্রেনেজগুলো সিটি করপোরেশনের অধীনে দেয়া হোক। ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা বর্তমানে ৭টা সংস্থার অধীনে আছে। এটা হতে পারে না। একটা প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা উচিত। মাস্টার প্ল্যানেও এটা লেখা আছে। বিশ্বের কোথাও ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ওয়াসার অধীনে নেই। এগুলো অবশ্যই সিটি করপোরেশনের অধীনে দেয়া উচিত।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App