×

স্বাস্থ্য

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পদে পদে অনিয়ম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২১ জুলাই ২০২০, ০৯:২২ এএম

বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পদে পদে অনিয়ম

মেডিক্যাল

তালিকায় শতাধিক নাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এসোসিয়েশনের ধরণা
দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার নামে নানাবিধ অনিয়মের অভিযোগ পুরনো। ভুল চিকিৎসা, অতিরিক্ত টাকা আদায়, রোগী হয়রানি, দালাল দিয়ে রোগী বাগানো এবং যেসব যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকার কথা সেগুলো না রেখে ইচ্ছেমতো চিকিৎসা করার অভিযোগ বহুদিনের। বিশেষ করে করোনা পরিস্থিতিতে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো অন্যসব ক্লিনিকের মতো সাধারণ রোগীদেরও ফিরিয়ে দিয়েছে। পদে পদে ঘটেছে হয়রানির অভিযোগ। র‌্যার-পুলিশ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের একের পর এক অভিযানের মুখে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম ও দুর্নীতির চিত্র বেরিয়ে এসেছে। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে এই খাতে। র‌্যাবের কাছে এমন শতাধিক ক্লিনিকের তালিকা রয়েছে বলে জানা গেছে। অভিযান পরিচালনার তালিকায় রয়েছে নামিদামি ক্লিনিকসহ অনেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নামও। এ অবস্থায় বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশন নেতারা গতকাল সোমবার সকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সংশ্লিষ্ট (স্বাস্থ্য) মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নিয়ম মেনে তদন্তের পর অভিযান চালানোর দাবি জানিয়েছেন। করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য সরকার মোট ২৮টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দিয়েছে। যার মধ্যে সরকারি ১৯টি ও বেসরকারি ৯টি হাসপাতাল রয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতাল ও সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে র‌্যাবের অভিযানে অনিয়মের দালিলিক প্রমাণ মিলেছে। রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথ কেয়ারের পর গতকাল সোমবার গুলশানের সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সিলগালা করা হয়। প্রশ্ন উঠেছে অন্যান্য অনুমোদিত হাসপাতালের কর্মকাণ্ড নিয়েও। যাচাই না করে অনুমোদন দেয়ায় অনেক বিপত্তি ও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডাক্তার মো. আবু সাঈদের বিরুদ্ধে পিসিআর ল্যাবে করোনা ভাইরাসের রিপোর্ট পরীক্ষা করে তা নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ রয়েছে। এ ঘটনায় পাবনার ঈশ্বরদী থানায় একটি মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় ঈশ্বরদী রূপপুর মেডিকেয়ার ক্লিনিকের মালিক আব্দুল ওহাব রানাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ডাক্তার আবু সাঈদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার পর ওই অঞ্চলে চিকিৎসকদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মবিন খান গতকাল বিকালে ভোরের কাগজকে জানান, যেভাবে অভিযান চালানো হয়েছে, ডাক্তারের হাতে হাতকড়া পরানো হয়েছে তাতে চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তিনি জানান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে গতকাল সকালে তারা এসোসিয়েশনের ৬ জন কর্মকর্তা তার ধানমন্ডির বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন। তারা মন্ত্রীকে বলেছেন, যদি কেউ অন্যায় করে তাকে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তদন্তের মধ্য দিয়ে বিচার ও আইনের আওতায় আনতে হবে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে তদন্ত করে প্রমাণ সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। র‌্যাবের এ ধরনের অভিযানের পর অনেক চিকিৎসক চাকরি থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছেন। তারা কাজ করতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সবকিছুর একটি প্রক্রিয়া আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, যেভাবে অভিযান হচ্ছে তাতে রোগী এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের মধ্যে ভয়ভীতি ছড়াচ্ছে। অনেক বড় বড় হাসপাতালের লাইসেন্স নবায়ন নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, অনেকে টাকা জমা দিয়েছেন। আবার অনেকে প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন। এখন বিশ্বে মহামারি চলছে। সব বিষয় মাথায় রেখে কাজ করতে হবে। ডা. মবিন খান বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে মূলত দাবি ছিল, সবকিছু যাতে নিয়ম মাফিক সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হয়। কেউ যাতে হয়রানির শিকার না হন এবং আতঙ্ক যাতে না ছাড়ায়। মন্ত্রী এ ব্যাপারে তাদের আশ্বস্ত করেছেন বলেও জানান তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সাংবাদিকদের বলা হয়েছে, মন্ত্রী তাদের দাবির কথা শুনে কেউ অহেতুক হয়রানির শিকার হবেন না এমন আশ্বাস দিয়েছেন। তবে কোথাও অনিয়ম পাওয়া গেলে ছাড় দেয়া হবে না বলেও জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিক ওনার্স এসোসিয়শেনের সভাপতি অধ্যাপক মনিরুজ্জামান ভ‚ঁইয়া বলেন, বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ এসোসিয়েশন নেতারা যে বক্তব্য দিয়েছে তার সঙ্গে তারা সম্পূর্ণ একমত। অভিযানের নামে কাউকে হয়রানি করা যাবে না। জানা গেছে, দেশে ৬৯টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল রয়েছে। আর বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক মিলিয়ে এর সংখ্যা ১৭ হাজার ২৪৪টি। যার অধিকাংশের লাইসেন্স নবায়ন নেই। অনেকগুলোর বিরুদ্ধে অনিয়মের এন্তার অভিযোগ রয়েছে। প্রায়দিনই দেশের কোথাও না কোথাও ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর খবর আসছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর এসব দেখভাল, মনিটরিং ও নজরদারি করার কথা থাকলেও ভুক্তভোগীদের অভিযোগের যেন শেষ নেই। অভিযোগ রয়েছে এখানেও সিন্ডিকেট করে অনিয়মের মাধ্যমে অধিকাংশ হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালিত হচ্ছে। আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট ও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের নামে চলছে ছলচাতুরি। র‌্যাব ও পুলিশ কর্মকর্তারা মনে করছেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়াই বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে করোনার নমুনা সংগ্রহের অনুমোদন দিয়েছে। যার সুযোগ নিয়ে ওইসব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ইচ্ছেমতো কাজ করছে। পরীক্ষায়ও যেমন অনিয়ম করেছে তেমনিভাবে টাকাও নিয়েছে ইচ্ছেমতো। এর মধ্যে করোনা রিপোর্ট পাল্টে দেয়া এবং পরীক্ষা না করে ইচ্ছেমতো মনগড়া রিপোর্ট দেয়ার মতো গুরুতর অভিযোগও রয়েছে। গতকাল লেকভিউ, সিনসিন ও আল আশরাফ নামে তিনটি হাসপাতালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অভিযানে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর আগে ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে রোগী মারা যাওয়ার নেপথ্যে অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করা হয়েছে। অন্যদিকে র‌্যাব জানিয়েছে, সাহাবুদ্দিন মেডিকেলের রোগীদের অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার পরই হাসপাতালটি সিলগালা করা হয়েছে। সোমবার তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণাসহ নানা অভিযোগে গুলশান থানায় মামলা করা হয়েছে। রবিবার বিকালে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট, রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়সহ অপারেশন থিয়েটারে ১০ বছরের বেশি মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ দিয়ে সার্জারি করার অভিযোগে প্রতিষ্ঠানটির সহকারী পরিচালকসহ ২ জনকে আটক করা হয়। এরই মধ্যে হাসপাতালটির লাইন্সেসের মেয়াদ শেষ হয়েছে এক বছর আগে। অন্যদিকে গতকাল সাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করেছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট সব অনুমতি নিয়ে দীর্ঘ ১৭ বছর যাবত অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে অভিজ্ঞ ডাক্তার দ্বারা হাসপাতালটি পরিচালিত হয়ে আসছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে এর আগে কখনো হাসপাতালের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আসেনি। হাসপাতালে বর্তমানে ৮৫ জন অভিজ্ঞ চিকিৎসক রয়েছেন। করোনাকালীন এই হাসপাতালে ২২০ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন যার মধ্যে ১৯২ জন রোগী চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে চলে গেছেন। করোনা টেস্ট (আরটি-পিসিআর) করার জন্য আমরা প্রাভা হেলথ কেয়ার বাংলাদেশ ও ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ এর সঙ্গে চুক্তি করে সেখান থেকে পরীক্ষা করে আনা হয়েছে। হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ গত বছরের ৩০ জুন শেষ হলে নবায়নের জন্য টাকা জমা দিয়ে তা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App