×

সাময়িকী

হুমায়ূন সাহিত্য বিচার করবে কাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২০, ০৯:০৬ পিএম

হুমায়ূন সাহিত্য বিচার করবে কাল

হুমায়ূন আহমেদ এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় কথালেখক, তার লেখার বিষয় ও শিল্পমান নিয়ে যত কথা বলা হোক না কেন। জীবনকে গুরুতর দৃষ্টিতে অবলোকন করে সামাজিক সমস্যা ও সামাজিক মানুষের মনঃসংকট নিয়ে গভীর গল্প হুমায়ূন লিখেননি। কিন্তু তার লেখায় এসেছে নাগরিক মধ্যবিত্তের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনার আলেখ্য যা পড়তে গভীর চিন্তা করতে হয় না, ভাবতে হয় না। মধ্যবিত্ত ভাবে, তারাই তো হুমায়ূনের গল্পের কুশীলব, বিশেষ করে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা, যাদের বয়স পনেরো থেকে পঁচিশ, তরুণ-তরুণী, পোড়খাওয়া ক্লেশতাড়িত সংগ্রামী কেউ নয়; জীবনকে যারা দেখে আনন্দের চোখ, স্বল্প লালন করে যারা, প্রণয় স্নেহ স্মৃতিতে যারা আবিষ্ট, বেপরোয়া কিছু করতে না চাইলেও তারা বন্ধনভীরু নয়, আবার পারিবারিক আবহে বাবা-মা-ভাই-বোন-ভাবীর একান্নবর্তী সমাদর ও আবহে প্রযত্নে বেড়ে ওঠা, শিক্ষার দিকে যাওয়া, সংস্কৃতির দিকে যাওয়া, মাঝে মাঝে কারুর কারুর কণ্ঠে রবীন্দ্র সঙ্গীত- ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’, মুক্তিযুদ্ধ, দেশের স্বাধীনতা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, বৃত্তিজীবী চাকরিজীবীর স্বল্পায়নত জীবন, কিন্তু হাসিখুশিতে ভরা চলমান জীবনের আনন্দ, উন্মুক্ত প্রকৃতি, হাওর-বাঁওড়, নৌকাযাত্রা, লোকগান, কৃষিজীবন, জমিদার বাড়ি, বহুবিবাহ, দাপুটে পুরুষ, দাপুটে নারী, সামন্তবিলাস, ঘরবসতি, চায়ের দোকান, হিন্দি গান, সাইকেল-মোটরসাইকেল, রিকশা, ধানি জমি, মেঠোপথ, সব মিলিয়ে বিশ শতকের সত্তর দশক থেকে একুশ শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের বাংলাদেশ হুমায়ূনের কথা কাহিনীর বিষয় হয়েছে এবং এতটা সময় হুমায়ূনের লেখা বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীর হৃদয়গ্রাহী করে রেখেছে। হুমায়ূন মারা গেছে বটে, কিন্তু তার রচনা জীবিত আছে এবং থাকবেও। বাংলাদেশের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় প্রথম দ্বিতীয় হওয়া ছাত্রছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলে ঝটিতি তারা উত্তর দেয়, হুমায়ূন আহমেদের লেখা তাদের সবচেয়ে পছন্দের, হুমায়ূন আহমেদের নাটকই তাদের সবচেয়ে আনন্দ দেয়। তারা যে পড়ে নিয়েছে অনেক সময় তাও নয়। কিন্তু শুনে শুনে তারা হুমায়ূনের নাম মুখস্ত করে রেখেছে। আর হুমায়ূন যে কখনও নাটক লেখেনি সেটি তারা জানেও না, টেলিভিশনে হুমায়ূনের গল্পকাহিনীর নাট্যরূপ দেখে তারা ধরে নিয়েছে হুমায়ূন একজন নাট্যকার। ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকদেরও এ রকম জ্ঞান। সুতরাং ছাত্রছাত্রীদের কটাক্ষ করে কী লাভ! কিন্তু এ সত্ত্বেও হুমায়ূনের নাম যে সকলের মুখে মুখে ফেরে সে কথা সত্য।

হুমায়ূনের গল্পকাহিনীর অধিকতর জনপ্রিয়কতা বেড়েছে টেলিভিশনে সিরিয়াল ও সিনেমার কল্যাণে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পরে বাংলাদেশ টেলিভিশনের দর্শকদের বিনোদন লাভের সুবিধার্থে সিরিয়াল নাটকের সূচনা হয়। সে সময় বিটিভি ছাড়া অন্য কোনো টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। বিটিভিতে মমতাজ হোসেনের ‘সকাল-সন্ধ্যা’ সিরিয়াল খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিন রাত্রি’ সবকিছু ছাড়িয়ে গেল। আহমদ শরীফ হুমায়ূনের মধ্যে কথাসাহিত্যিক হিসেবে বিপুল প্রতিশ্রুতি দেখেছিলেন যখন তার বড় গল্প ‘নন্দিত নরকে’ পড়লেন। হুমায়ূন তখন এমএসসি পড়ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের ভালো ছাত্র। কিন্তু ও যে চমৎকার বাংলা গল্প লিখিয়ে সেটি বোঝা গেল এ রচনা পাঠের পর। আমার অনুজপ্রতিম দুই সাহিত্যসেবী মুহম্মদ হাবিবুল্লাহ ও ওবায়দুল ইসলাম সম্পাদিত ‘মুখপত্র’ পত্রিকায় এই উৎকৃষ্ট রচনাটি ছাপা হয়েছিল। আহমদ শরীফ এ গল্পের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। অল্পদিনেই হুমায়ূনের নাম ছড়িয়ে পড়ল তরুণ লেখক হিসেবে। তারপর ‘শঙ্খ নীল কারাগার’, আরেকটি উত্তম রচনা। এখন মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দুটি রচনাই তার সেরা কাজ। অনেক লেখকের ক্ষেত্রে এরকম ঘটেছে, প্রথম লেখাটিই চিরকালীন হয়েছে। হুমায়ূন শ’তিনেক বই লিখেছে, তার মধ্যে কিছু তো উল্লেখযোগ্যই। হুমায়ূনের অধিকাংশ লেখাই ছোট আকৃতির। অসংখ্য উপন্যাস, যদিও প্রকৃত উপন্যাসের সংজ্ঞায় সেগুলো পড়বে না, কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। উপন্যাসের বিষয়ের ব্যাপ্তি ও চরিত্রবীক্ষা নিয়ে হুমায়ূন ভাবিত নয়, গল্প বলতে পারলেই হুমায়ূনের তৃপ্তি পাঠকের তৃপ্তি।

হুমায়ূনের গল্পকাহিনীর টেলিভিশন নাট্য প্রদর্শনীর সবগুলোই খুবই আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় হয়েছে। অন্য কোনো লেখকের ভাগ্যে এটি নেই। ‘এইসব দিন রাত্রি’ ছাড়া ‘কোথায়ও কেউ নেই’, ‘বহুব্রীহি’, ‘অয়োময়’ ইত্যাদি সিরিয়ালও সমান জনপ্রিয় হয়েছে। উত্তম অভিনয়ও এগুলোর জনপ্রিয়তার কারণ। ‘অয়োময়’ নামের যথার্থতা বুঝে নেয়ার মতো। ‘অয়স+ময়ট’ অয়োময় অর্থাৎ লৌহকঠিন, সামন্তদাপট কমে গেলেও উত্থান-পতনের জীবনের বিবেচনায় ও সিদ্ধান্তে অটল কঠোর থাকা কোনো কোনো মানুষের মানসগঠন। হুমায়ূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেছিল। বিদেশে গবেষণা করে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছিল এবং প্রফেসর পদে উন্নীত হয়েছিল। বিজ্ঞানের ছাত্র ও শিক্ষক কথাসাহিত্যিক হয়েছে এরকম ঘটনা বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো সংবাদ নয়। কিন্তু হুমায়ূনের শিক্ষক-পরিচিতি তলিয়ে গেল লেখক পরিচিতির কাছে। অতঃপর হুমায়ূন সিনেমা জগতে গেল। এখানেও তার গল্প, তার কাহিনী, তার চিত্রনাট্য, তারই গান, তারই প্রযোজনা, তারই পরিচালনা। হুমায়ূনের সিনেমাগুলোও দারুণ লোকরঞ্জক হয়েছিল, একটু ভিন্ন ভঙ্গির, ভিন্ন স্বাদের, স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের। কিন্তু এখানেও ওই মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত জীবনের আশা-আকাক্সক্ষার রূপায়ণ। হুমায়ূন বাংলাদেশি সিনেমার দর্শকদের রুচি বদল করেছে। গল্প উপন্যাসে যেমন, সিনেমাতেও হুমায়ূন বিচিত্র জীবন রস সৃষ্টি করেছে। কখনও কখনও একটু পাগলাটে, একটু ছিটগ্রস্ত, কখনও মনোবিকল, প্রতিবন্ধী, এ জাতীয় চরিত্রই হুমায়ূনের গল্পে, উপন্যাসে সিরিয়ালে ও সিনেমায় দৃষ্টি কেড়েছে বেশি এবং পাঠক-দর্শক এসব উপভোগও করেছে। হুমায়ূনের সিনেমা জীবন কম চিত্তাকর্ষক নয়।

দুই যুগ আগে আমি একটা লেখায় হুমায়ূন আহমেদকে জনপ্রিয়তম বাঙালি কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের তরল সংস্করণ বলেছিলাম। শরৎচন্দ্রের অবস্থা এখন কী রকম আমি জানি না, তবে ত্রিশ চল্লিশ বছর আগেও জরিপে তিনি পয়লা নম্বর ছিলেন। সম্ভবত এখনও তার অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেনি। শরৎচন্দ্রের মতো হুমায়ূনও দারুণ গল্প বলিয়ে, চরিত্রস্রষ্টা বিশেষভাবে অবহেলিত, উপেক্ষিত, বঞ্চিত, রোগগ্রস্ত মানুষের। শরৎচন্দ্র যেমন নির্যাতিত নারীর প্রতি গভীর সহানুভূতিশীল, হুমায়ূনও তেমনি উপেক্ষিত অনাদৃত মানুষের প্রতি দরদী মন। শরৎচন্দ্র পশ্চিমবঙ্গীয় পল্লী প্রকৃতির সমাজকে দারুণ নৈপুণ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন তার গল্পে ও উপন্যাসে। হুমায়ূনও পূর্ববঙ্গীয় মুসলমান সমাজের নাগরিক মধ্যবিত্ত জীবনের ছবি এঁকেছেন তার গল্পকাহিনীতে। শরৎচন্দ্রের উপন্যাস এখনও বাংলা সিনেমার অবলম্বন, হুমায়ূনও বাংলাদেশি সিনেমার কাহিনী-স্রষ্টা। তবে শরৎচন্দ্রের মতো অন্তর্দৃষ্টি হুমায়ূনে নেই। শরৎচন্দ্র বাংলা উপন্যাসের সেরা এক শিল্পী এবং বেশকিছু স্মরণীয় গভীর উপন্যাসের প্রণেতা। হুমায়ূনের এরকম কৃতি নেই। তবু হুমায়ূন জনপ্রিয় লেখক, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তীকালের নতুন লেখাপড়া শেখা তরুণ মনে তিনি স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সে কারণে হুমায়ূন সহসা বিস্মৃত হবেন না বরং তার অভাব সবাই অনুভব করবে।

বাংলা কথাসাহিত্য আরও কয়েকজন পাঠকপ্রিয় লেখক আছেন, যেমন শঙ্কর (মনিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়) কিংবা নীহাররঞ্জন গুপ্ত, গোয়েন্দা কাহিনীর খ্যাতিমান স্রষ্টা। এতের রচনাও ব্যাপকভাবে বাংলা সিনেমাকে সমৃদ্ধ করেছে; বিশেষভাবে নীহাররঞ্জনের উপন্যাস। আমার মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদকে বরং নীহাররঞ্জন গুপ্তের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। নীহাররঞ্জনের নাটকীয় রচনারীতি হুমায়ূনে বর্তেছে, যদিও হুমায়ূন গোয়েন্দা কাহিনী লেখেনি। বরং লিখেছে দুই উদ্ভট, পাগলাটে ও মনোবিকলের কাহিনী- হিমু ও মিসির আলী। এই দুই চরিত্রের আখ্যানও হুমায়ূন-পাঠকদের দারুণভাবে টেনেছে। নাটকীয় ঘটনা ও অতিপ্রাকৃতিক উপাদানকে মনস্তাত্ত্বিক সমাধানের দিকে নিয়ে যাওয়ার কৌশল রহস্য উপন্যাসের স্বাদ সৃষ্টি করেছে এই দুই রচনায়। হুমায়ূন আহমেদ কল্পবিজ্ঞানেরও উত্তম লেখক। এ জাতীয় রচনা হুমায়ূনকে আরো বেশি খ্যাতি দিতে পারত। কিন্তু নানা দিকে ছড়িয়ে যাওয়ার জন্য হুমায়ূন সময় দিতে পারেনি। সিনেমার গান রচনায় হুমায়ূনের জায়গা অবশ্যই থাকবে। ভিন্ন ভঙ্গির কথা, কখনও লোক সুর, আঞ্চলিক ভাষার মিশেল। সব নিয়ে গানের আলাদা রীতি তৈরি করেছে হুমায়ূন।

জনপ্রিয় লেখক হওয়ার মূলে হুমায়ূনের ভাষা ভঙ্গিও যথেষ্ট সহায়তা করেছে। শরৎচন্দ্র সাধু ভাষায় লিখতেন। দীর্ঘ দীর্ঘ বাক্য, প্রচুর তৎসম শব্দ, বাগ্বিধির নিপুণ ব্যবহার, সংলাপের সৌন্দর্য শরৎচন্দ্রীয় ভাষারীতির পরিচয়। হুমায়ূন সাধু ভাষায় কখনও লেখেনি। ভারি শব্দ দিয়ে চলতি বাংলাকে আক্রান্ত করেনি। একেবারে সহজ-সরল অনাড়ম্বর ভাষা। ছোট ছোট বাক্য, অনেক সময় এক শব্দে এক উক্তি, সেটি রচনার এক লাইনও। এ গদ্যে হুমায়ূন নাটক সৃষ্টি করে গদ্যে, অনেকটা সিনেমার পাত্র-পাত্রীর স্বল্প ভাষা উক্তির মতো। তারপর কী ঘটবে এই উৎকণ্ঠা হুমায়ূন জিইয়ে রাখে আগাগোড়া। হুমায়ূনের জনপ্রিয় হওয়ার মূলে নাট্যরীতির ভাষাভঙ্গির কথাও বলতে হবে।

এখনকার দিনের হিসেবে হুমায়ূন একটু আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। দুরন্ত ক্যান্সার কাউকে রেহাই দেয় না। ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে আমাদের কথাশিল্পীদের অনেকেরই জীবন ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু ষাট উত্তীর্ণ হুমায়ূন তার কালে আমাদের লেখার জগৎকে যত ব্যস্ত রাখত সেরকম আর কেউ পারেনি। প্রকাশকরা তার বইয়ের জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতো সব সময়। একুশের বইমেলায় হুমায়ূনই সকলের আগে। বাংলা একাডেমির একুশের বইমেলায় একবার দেখলাম হুমায়ূন দুই হাতে দুই মলাট নিয়ে আসছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম হুমায়ূন, বই কই? হুমায়ূন মাথায় হাত লাগিয়ে বলল, এই খানে। হুমায়ূন খুব দ্রুত লিখতে পারত, গণ্ডা গণ্ডা বই, মেলা ভরিয়ে রাখত হুমায়ূন। হুমায়ূনের মৃত্যুর পরে আমার মনে হলো, হুমায়ূন নিজে শুধু ক্যান্সারে ভোগেনি; বাংলাদেশের লেখার জগৎও ক্যান্সার আক্রান্ত হয়েছে। হুমায়ূন মহৎ সাহিত্য সৃষ্টি করেছে কিনা তার বিচার করবে কাল। কিন্তু বাংলাদেশের লেখার জগৎকে সব সময় সরগরম করে রেখেছিল হুমায়ূন। অসংখ্য তরুণ পাঠকের মনে গেড়ে বসেছিল হুমায়ূন। তার মতো জনপ্রিয় লেখক আমরা আর কোথায় পাব!

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App