×

সাময়িকী

সাহিত্যে মহামারির একাল ও সেকাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২০, ০৮:৫৪ পিএম

সাহিত্যে মহামারির একাল ও সেকাল

অক্টোবরের দিকে ক্যাস্টেলের প্লেগ নিরাময় সিরাম প্রথম ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এই ওষুধ ব্যবহার করেও ওথনের শিশু সন্তানকে বাঁচানো গেল না। তারু পেনেলু ও ড. রিউ সেই ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করলেন। পাদ্রি পেনালু শেষমেশ স্বেচ্ছাসেবী দলে যোগ দিয়ে আবার তার দ্বিতীয় বাণী প্রচার করলেন। সে এই নিষ্পাপ বাচ্চার মৃত্যু যন্ত্রণাকে খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের পরীক্ষা হিসেবে প্রচার করলেন। তিনি বললেন, খ্রিস্টীয় বিশ্বাস ঈশ্বরের প্রতি শর্তহীন সমর্পণ। মাঝামাঝি বলে কিছু নেই। তিনি ধর্মকে রক্ষা করেই প্লেগের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইয়ের আহ্বান জানান। এই ধর্মীয় বাণী প্রচারের কয়েক দিনের মাথায় পেনালু নিজেও প্লেগে আক্রান্ত হন। তারু এবং রবার্ট একটি আইসোলেশন ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে ওথনের সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে তার কোয়ারেন্টাইনের সময় শেষ হয়েছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, এখানে থেকে তিনি প্লেগ নিরাময় ক্যাম্পে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করবেন। তাতে তার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে। তারু জীবনের শেষ প্রান্তে এসে রিউয়ের কাছে তার জীবনের সব কাহিনী বর্ণনা করেছিলেন। গ্রান্ডকেও প্লেগে ধরেছিল। তিনি ড. রিউকে তার সব কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলতে বলেছিলেন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে গ্রান্ড প্লেগ থেকে সেরে উঠছিলেন।

জানুয়ারির দিকে হঠাৎ করেই শহর থেকে প্লেগ উধাও হয়ে যায়। লোকজন ঘর থেকে বের হতে শুরু করল। শহরের ফটকগুলো খুলে দেয়া হলো। ওথান এই মহামারি থেকে বাঁচতে পারেনি। কটোডও মহামারি শেষে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অবৈধ ব্যবসার দ্বারা বিপুল অর্থ উপার্জনের দায়ে সরকারি তলব পড়লে সে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মহামারি শেষ হয়ে এলেও তারু এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। ডা. রিউ টেলিফোন বার্তায় জানতে পারেন তার স্ত্রী হাসপাতালে মারা গেছেন। ফেব্রুয়ারিতে শহরের মূল ফটক খুলে দেয়া হয়। অন্য শহরের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ স্থাপন হয়; এবং শহরের বাসিন্দারা আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে পুনর্মিলনের সুযোগ পায়। রেম্বার্ট তার স্ত্রীর কাছে ফিরে যান। কোটাড মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং তার বাড়ি থেকে একজনকে গুলি করে হত্যার দায়ে গ্রেপ্তার হন। গ্রান্ড তার উপন্যাসে লেখার কাজ আবারো শুরু করেন। তবে এই উপন্যাসের বর্ণনাকারী শেষমেশ পাঠকের কাছে অধরাই থেকে যায়।

আলবেয়ার ক্যামুর দ্য প্লেগের সঙ্গে বর্তমান সময়ে বৈশি^ক মহামারি করোনা পরিস্থিতির এক আশ্চর্যজনক মিল রয়েছে। বিশেষ করে, কর্তৃপক্ষের তথ্য গোপন ও শুরুতে গুরুত্ব না দেয়া। জনগণকে সঠিক সংকটটি বুঝতে না দিয়ে প্রস্তুতি নিতে বিলম্ব করা। সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য না থাকার পরেও মিথ্যা বড়াই করা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচি ও হাসপাতাল ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন না ঘটানো। মহামারির একমাত্র কার্যকর ব্যবস্থা আইসোলেশন ও লকডাউনের মতো ব্যবস্থা সময়মতো গ্রহণ না করা। মৃতদেহ শৎকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়া। ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের সংকট উত্তরণে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ না দিয়ে জনগণের মধ্যে ভুল বার্তা প্রদান করা। মহামারিকে ঈশ্বরের অভিশাপ হিসেবে বর্ণনা করা। আবার পরিস্থিতি তাদের বিরুদ্ধে গেলে নতুন করে ব্যাখ্যা প্রদান করা। এই সময়ে অনেকেই নিজে বাঁচার জন্য শহর ছেড়ে পালাতে চান। এতেও রোগ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই অস্থিতিশীল অবস্থায় অর্থবিত্ত অর্জনের উপায় খুঁজে পায়। আইনশৃঙ্খলার অবনতি, খুন-ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটে। তাছাড়া দীর্ঘদিন একা বিচ্ছিন্ন থাকা এবং মৃত্যুর মিছিল দেখার ফলে অনেকের মধ্যে হতাশা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। আবার অনেকে মানবসমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিঃস্বার্থভাবে মহামারি মোকাবিলায় নিজেকে সমর্পণ করে থাকেন।

অবশ্য আলবেয়ার ক্যামুর উপন্যাসটি এতটা সরল নয়। প্রতীকী ব্যঞ্জনার দ্বারা বর্ণিত বিষয়ের সরলার্থের বাইরে যাওয়ার প্রয়াস রয়েছে। হতে পারে সেটা ঔপনিবেশিক শাসনে আলজেরিয়ার অবস্থা; আবার নাজি শাসনের ভয়াবহতাও তিনি তুলে ধরেন। কিন্তু বর্তমান করোনাকালে এই উপন্যাস আমাদের বাস্তবতা এমনকি বৈশ্বিক বাস্তবতার সঙ্গেও দারুণভাবে খাপ খেয়েছে। হালে ‘দ্য সেভেন প্লেগ’ নামে জেমস রলিন্সের (১৯৬১) একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। যার মূল প্রতিপাদ্য ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত মোসেজের টেনথ কামানডমেন্টে সেই প্লেগ কি সত্যিই ঘটেছিল। নানা ঐতিহাসিক তথ্যকে আশ্রয় করে কল্পনার ডানা বিস্তার করেছেন লেখক। বাইবেলে টেনথ ইজিপশিয়ান প্লেগের কথা উল্লেখ আছে। ফারাও সম্রাটের পাপের শাস্তি হিসেবে ঈশ^র এই মহামারি দিয়ে তাকে সংশোধনের চেষ্টা করেছেন। যখনই ফারাও রাজ মহামারির মতো সংকটে নিপতিত হয়, তখনই সে বনি ইসরাইলিদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয়ার প্রতিশ্রুতি করে। কিন্তু সংকট কেটে গেলে আবার সে আগের অবস্থানে ফিরে যায়। শেষে টেনথ কমেনডমেন্টে প্রভু তাদের মহামারি দিয়ে চূড়ান্ত শাস্তি দেয়। বিগত কয়েক দশকের মধ্যে লিখিত এই ধারার উপন্যাসের সংখ্যা একেবারে কম নয়। তবে অন্তত আরো একটি উপন্যাস আলোচনার দাবি রাখে।

মহামারিকালের চরিত্র বোঝার জন্য হোসে সারামাগোর (১৯২২-২০১০) ‘ব্লাইন্ডনেস’ উপন্যাসটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী এই লেখক উপন্যাসের কাহিনী ও আঙ্গিকে কিছুটা ভিন্নতা এনেছেন। নাম উল্লেখ করা হয়নি এমন এক শহরে এক অজ্ঞাত কারণে লোকজনের মধ্যে দ্রুত অন্ধত্বের মতো রোগ মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। লেখক এটাকে শ্বেত-অন্ধত্ব বলে অভিহিত করেছেন। এই উপন্যাসটি মূলত সেই দুর্ভাগাদের কাহিনী নিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, যারা এই মহামারি শুরুতেই আক্রান্ত হন। এদের মধ্যে আছেন একজন ডাক্তার- যিনি নিজেও অন্ধত্বে আক্রান্ত হয়েছেন। চরিত্র হিসেবে আরো আছেন তার স্ত্রী, দুর্ভাগ্যক্রমে একত্রিত হওয়া ডাক্তারের কিছু অন্ধ রোগী- যারা কোয়ারেন্টাইনের সময় একত্রিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেবল ডাক্তারের স্ত্রী অন্ধত্বের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে কোয়ারেন্টাইনে স্বামীর সঙ্গী হওয়ার জন্য তিনি অন্ধত্বের ভান করে তাদের সাথে থাকার সুযোগ করে নেন। কোয়ারেন্টাইনের দীর্ঘ একঘেয়ি জীবনের নানা সুখ-দুঃখ, অতীতের স্মৃতিময় কাহিনীর বর্ণনা ও কৌতুকপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টির দ্বারা তারা কীভাবে একটি পরিবারের মতো কাছাকাছি এসেছিলেন- এটি তারই গল্প। আকস্মিক এই অন্ধত্ব মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ায় জনগণের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। উপরন্তু সরকারের অব্যবস্থা ও দমননীতির ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়ে ওঠে। উপন্যাসে দেখা যায় কোয়ারেন্টাইনে অন্ধ ঘিঞ্জি নোংরা পরিবেশে তাদের দুর্বিষহ জীবনের সূচনা। অবশ্য এটি বাইরের জীবনেরই একটি প্রতিফলন মাত্র।

কর্তৃপক্ষের অনিয়মের ফলে খাদ্য সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেয়ায় কোয়ারেন্টাইনে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এতে সংহতি নষ্ট হয় এবং ব্যবস্থাপনার অভাবে খাদ্য পরিবেশনও বাধাগ্রস্ত হয়। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দিতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়। কোয়ারেন্টাইনের রোগীদের সংস্পর্শে আসায় একের পর এক সৈন্যরাও সংক্রমিত হতে থাকে। সামরিক বাহিনী প্রয়োজনীয় ওষুধ অনুমোদন না দেয়ায় খুব সাধারণ রোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে সৈন্যরা খাদ্য সরবরাহকারী ইন্টার্নি নার্সদের সংখ্যা কমিয়ে আনলে সমস্যা আরো ঘনীভূত হয়। পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। খাদ্য পরিবেশনকারী নার্সরা তাদের অধীনস্ত হয়ে পড়ে এবং নতুন করে তারা বলাৎকার ও বঞ্চনার শিকার হয়। দুর্ভিক্ষের মুখে পড়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে এবং অন্ধ আশ্রম পুড়িয়ে দেয়। পরিণামে সেনাবাহিনী আশ্রম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। তারা তখন অসহায় অন্ধ লোকজনের সঙ্গে বাইরের জগতে চলে আসে। সেখানেও বিপর্যস্ত শহরের লোকজন বাঁচার তাগিদে খাদ্যের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করতে থাকে।

কাহিনীটি ডাক্তারের স্ত্রী, ডাক্তার ও তাদের সঙ্গে পরিবারের মতো থাকা কোয়ারেন্টাইনের অন্ধ লোকদের নিয়ে এগুতে থাকে। ডাক্তারের স্ত্রী এখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। অন্ধ বলে পরিচয় দিলেও তিনিই একমাত্র চক্ষুষ্মান। সামাজিক কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, আইনশৃঙ্খলার বালাই নেই, সামাজিক সেবা, সরকারি ব্যবস্থা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব ধ্বংস হয়ে গেছে। পরিবারগুলো ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন কেউ কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। লোকজন শহরের পরিত্যক্ত ভবনে আশ্রয় নিয়েছে খাদ্যের জন্য আহাজারি করছে। হিংস্রতা, রোগবালাই, দুর্ভিক্ষ, বৈষম্য এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে মানবজাতির অস্তিত্ব নিয়েই সংকট দেখা দিয়েছে। সেই পরিস্থিতিতে বাঁচার তাগিদে ডাক্তার, ডাক্তারের স্ত্রী এবং তাদের অন্ধ আশ্রমের সদস্যরা মিলে ডাক্তারের বাড়িতে একটি নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলেন। সেখানে শহর থেকে অন্ধদের ফিরিয়ে আনা হয় এবং হঠাৎ করে সেখানে নতুন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।

সারামাগোর অন্ধত্ব বা স্প্যানিশ ভাষায় এনসাইরো সোবরিয়া সেগেইরা উপন্যাসটিও ক্যামুর দ্য প্লেগের মতো কিংবা তারচেয়ে বেশি জটিল প্রতীকধর্মী রচনা। কারণ এটি মহামারি নিয়ে রচিত হলেও এর স্থান কাল এমনকি রোগটিও সুনির্দিষ্ট বাস্তবতা অনুসরণ করেনি। কিন্তু একটি মহামারি প্রাদুর্ভাবে ছড়িয়ে পড়লে একটি দেশের সরকার জনগণ চিকিৎসাব্যবস্থা সামরিক বাহিনী কি ধরনের প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়- এই উপন্যাসে সেই গভীর বাস্তবতা ধরা পড়েছে। প্রাদুর্ভাবের শুরুতে গুরুত্ব না দেয়া, অব্যবস্থাপনা, দুর্ভিক্ষ, আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়া, ধর্ষণ, খুন, ডাকাতির মতো ঘটনা তখন নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে ওঠে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা আর সহজ হয় না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App