×

সাময়িকী

সংকটের কাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ জুলাই ২০২০, ০৯:১২ পিএম

সংকটের কাল

ধাক্কাটা হঠাৎ করেই এলো নূর মোহাম্মদের জীবনে। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, আপনাদের সবার পরিচিত নূর মোহাম্মদ বিএসসির কথাই বলছি আমি। এমনিতে তার জীবনের কোনো অধ্যায়ই মোমের মতো মসৃণ ছিল না। ধাক্কা খেতে খেতেই তিনি বড় হয়েছেন, ধাক্কা খেতে খেতেই এ পর্যন্ত এসেছেন। ছোটবেলায়ই দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করে বাবার আলাদা হয়ে যাওয়া। খাওয়া-পরায় কষ্ট। বেতন দিতে না পারায় বারবার স্কুলের খাতা থেকে নাম কাটা যাওয়া। অন্যের বাড়িতে লজিং থেকে নানা গঞ্জনা সহ্য করে লেখাপড়া করা। এর-ওর কাছে চেয়েচিন্তে ফরম ফিলাপের টাকা জোগানো। টিউশনি করে কলেজের বেতন জোগাড় করা। এমনকি বেসরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার পেশা গ্রহণ করার পরও সারা জীবন আর্থিক টানাপড়েন তার পিছু ছাড়েনি। কিন্তু এর কোনো কিছুই তাকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি, এবার যতটা করেছে।

বর্তমানে সংসার বলতে তিনি একা। একমাত্র ছেলে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ঢাকায় একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে হয়েছে এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে। ছেলে সর্বশেষ বাবার কাছে এসেছিল একটা দায়ে পড়ে। ঢাকায় সুন্দর একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি বানাচ্ছে। সামান্য কিছু টাকায় কমতি পড়েছে। তাই গ্রামের বাড়ির জায়গাগুলো বিক্রি করে কিছু টাকা যদি দিতে পারে তাহলে তার আশা পূরণ হয়ে যায়। বাপদাদার জমি কোনো দিনই কাজে লাগেনি নূর মোহাম্মদ বিএসসির। গ্রামে ভাইদের একেকজনের আটদশজন ছেলেমেয়ের বড় সংসার। তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। নূর মোহাম্মদ খুব বেশি সচ্ছল না হলেও বেতনের টাকায় দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে কোনোমতো সংসার চলে যেত। তাই ভাইদের কথা, ভাইজি-ভাতিজাদের কথা ভেবে ওসব জমিজমার দিকে হাত বাড়াননি কখনও। ছেলে এসে বোঝালো, তোমার ভাইয়েরা তো কেউ বেঁচে নেই। পরমানুষে লুটেপুটে খাচ্ছে জমিগুলো। যদি বেচে কিছু টাকা আনতে পারো তাহলে তোমার একমাত্র ছেলের মনের আশা পূরণ হবে। বুড়ো বয়সে তোমাকেও আর এখানে ছেলেমেয়ে পড়িয়ে একা একা জীবন কাটাতে হবে না। নতুন ফ্ল্যাটে তোমার একটা সুন্দর রুম থাকবে। তার সামনে বড় একটা বারান্দা। বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে শুয়ে বই পড়ে আর নাতি-নাতনিদের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে তোমার বাকি জীবনটা কেটে যাবে।

ছেলের কথায় মন না জুড়ালেও ফেলতে পারেননি নূর মোহাম্মদ। সবকিছু বেচে যা পেয়েছেন ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। এরপরে আর কোনোদিন ছেলে তার খোঁজ নেয়নি। আর একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন এক প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে। মেয়েজামাইয়ের কোনো চাহিদা ছিল না। কোনোদিন শ্বশুরের কাছে কিছু চায়নি। মেয়ে, মেয়েজামাই, নাতি-নাতনিরা বছরে একবার আসে। এমনকি বেড়াতে এসে যতদিন থাকে, মেয়েজামাই নিজের হাতে বাজারসদাই করে। বড় মাছটা, মুরগিটা কিনে আনে। শ্বশুরের সঙ্গে নানান গল্পগুজব করে। মেয়ে নিজের হাতে রান্না করে। কয়েকদিন বেড়িয়ে বাবাকে নানান উপদেশ দিয়ে চলে যায় তারা।

তা একা একা হলেও নূর মোহাম্মদ বিএসসির সংসার তো একরকম চলে যাচ্ছিল। স্কুল থেকে অবসর নিলেও হাইস্কুলের নিচু ক্লাসের কিছু ছেলেমেয়ে তার কাছে পড়তে আসত নিয়মিত। মাস শেষে যার যা খুশি হাতে তুলে দিত স্যারের। কোনো কোনো গরিব ছেলেমেয়ের বাবা-মা টাকাপয়সা দিতে পারতেন না, তবে গাছের পেঁপেটা, কলাটা মাস্টারের জন্য পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু হঠাৎ করেই দেশে কী এক রোগ এলো। সবাই ঘরে বন্দি হয়ে গেল। অফিস-আদালতে কাজ নেই। স্কুল-কলেজে লেখাপড়া নেই। বাজারে-দোকানে বেচাকেনা নেই। এক দমবন্ধ পরিবেশ। এ অবস্থায় নূর মোহাম্মদ বিএসসির খোঁজখবর আর কে নেবে? অবশ্য একদম যে কেউ নেয়নি তা নয়। তার কিছু কিছু ছাত্রছাত্রী বেশ কয়েকবার এসেছে তার বাড়িতে। বলেছে, স্যার, আমরা আপনাকে কিছু টাকাপয়সা আর চালডাল, তরিতরকারি উপহার দিতে চাই। অনেকটা জোরাজুরিও করে তারা। কিন্তু যে শিক্ষকের ছাত্রছাত্রীরা আজ দেশের বড় বড় সরকারি অফিসের কর্মকর্তা, যার ছাত্রছাত্রীরা আজ এলাকার এমপি হতে শুরু করে চেয়ারম্যান-মেম্বার, যার ছাত্রছাত্রীরা দেশের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, সেই শিক্ষক কি হাত পেতে কারও দয়ার দান গ্রহণ করতে পারেন? না, পারেন না। নূর মোহাম্মদ বিএসসিও পারেননি।

কিন্তু সংসার তার চলবে কী করে? অবশেষে অনেক চিন্তাভাবনা করে তিনি ঠিক করলেন, কিছুদিনের জন্য ঢাকায় ছেলের বাসায় গিয়ে উঠবেন। ছেলে নাকি বিশাল বাড়ি বানিয়েছে। তাতে তার জন্য সুন্দর একটি রুম থাকার কথা। সেই রুমের সামনে মনোরম বারান্দা। মনে মনে চিন্তা করেন তিনি, ছেলে আর ছেলেবউ যতই সাধাসাধি করুক, সেখানে তিনি সারা জীবন থাকতে পারবেন না। ইটকাঠের শহর তাকে একদম টানে না। গ্রামই তার ঠিকানা। সংকটের দিনগুলো কেটে গেলে আবার তিনি গ্রামেই ফিরে আসবেন।

ছেলের বাসায় পৌঁছে অবাক হলেন নূর মোহাম্মদ বিএসসি। তিনি যেটা কল্পনা করেছেন তাকেও হার মানিয়েছে। এটা কি বাড়ি নাকি রাজপ্রাসাদ তা নিয়ে ধন্ধে পড়ে গেলেন। ছেলে আর ছেলেবউয়ের পক্ষ থেকে আপ্যায়নেরও কোনো কমতি মনে হলো না। সত্যি সত্যি তার স্থান হলো সুন্দর একটা রুমে, যার সামনে মনোরম এক বারান্দা। দুপুরে খেতে বসে দেখলেন, তার পছন্দের প্রায় সব খাবারই ডাইনিং টেবিলে সাজানো। পরদিন ছেলে আর ছেলেবউ তার জন্য কোনো বিখ্যাত দোকান থেকে পাজামা-পাঞ্জাবি, স্যান্ডেল-ছাতা ইত্যাদি আরও কত কী কিনে আনল। নাতি-নাতনিরাও দাদাভাইকে পেয়ে মহাখুশি। এভাবে একদিন দুদিন তিনদিন।

পরের দিন দুপুর না হতেই বউ বলল, বাবা তাড়াতাড়ি গোসল সেরে খাওয়াদাওয়া করে নিন। কেন তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সারতে হবে বুঝতে পারলেন তা নূর মোহাম্মদ বিএসসি। তবে বউ যা বলল তাই করলেন তিনি। খাওয়াদাওয়ার পরে দেখলেন বউ নিজ হাতে শ্বশুরের স্যুটকেস সাজিয়ে গুছিয়ে দরজার সামনে নিয়ে এলেন। ড্রাইভার রাসেলকে ডেকে বললেন, আব্বাকে একদম লঞ্চের কেবিন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে তারপর আসবি। খবরদার টার্মিনালে ছেড়ে চলে আসবি না। পার্স খুলে চকচকে দুটো হাজার টাকার নোট তুলে দিল শ্বশুরের হাতে।

নূর মোহাম্মদ বিএসসি হতভম্বের মতো একপলক দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপরই সম্বিৎ ফিরে পেলেন তিনি। নোট দুটো হাতে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই নাতি-নাতনির হাতে তুলে দিলেন তিনি। বললেন, দাদাভাইদের জন্য আমার সামান্য উপহার। সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে নূর মোহাম্মদ বিএসসি কি চশমার ফাঁকে আঙুল ঢুকিয়ে চোখ দুটো মুছলেন একবার? সে আমি দেখিনি, তাই বলতেও পারব না। পাঠক আপনারাই কল্পনা করে নিন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App