×

জাতীয়

কমেছে নমুনা পরীক্ষা বাড়ছে শনাক্তের হার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ জুলাই ২০২০, ০৯:৩৯ এএম

কিছুদিন আগেও করোনার নমুনা পরীক্ষার জন্য হাসপাতালগুলোতে দেখা যেত দীর্ঘ লাইন। নমুনা সংগ্রহের বুথগুলোর সামনেও থাকতো অপেক্ষমাণ মানুষের ভিড়। কিন্তু এখন সেই চিত্র বদলে গেছে। আগে নমুনা সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হতো মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের। এখন সেই চাপ অনেকটাই কম। নমুনা সংগ্রহের কাজে নিয়োজিত মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা জানিয়েছেন, আগে একেক জনকে ৬০ থেকে ৮০টি নমুনা সংগ্রহ করতে হতো। এখন ২৫ থেকে ৩০টি নমুনা সংগ্রহ করছেন। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষার কার্যক্রম চালু আছে। তবে আগামী সপ্তাহ থেকে এই পদ্ধতি সারা দেশেই চালু করতে যাচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে বলছে, দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরীক্ষা বাড়াতে ল্যাবের সংখ্যাও বাড়ানো হচ্ছে। কিন্তু ল্যাব বাড়লেও পরীক্ষার সংখ্যা কমছে। দেশে এখন ৭৯টি ল্যাবের মধ্যে নমুনার অভাবে প্রতিদিনই বন্ধ থাকছে কোনো না কোনো ল্যাব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুয়াযী, দেশে করোনা সংক্রমণের পর সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা করা হয় ৩০ জুন। ওই দিন ১৮ হাজার ৮৬৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পরীক্ষা করা হয় ১৮ হাজার ৪২৬টি। নমুনা সংগ্রহের অনুপাতে ওই দিন শনাক্তের হার ছিল প্রায় ২০ শতাংশ (১৯ দশমিক ৯৮)। জুলাই মাসে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা কমতে শুরু করে। কিন্তু বাড়তে থাকে সংক্রমণের হার। পহেলা জুলাই ১৭ হাজার ৮৭৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। শনাক্তের হার ছিল ২১ দশমিক ১২ শতাংশ। ২ জুলাই ১৮ হাজার ৩৬২টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ১০ শতাংশ। ৩ জুলাই এই সংখ্যা ও হার যথাক্রমে ১৪ হাজার ৬৫০ ও ২১ দশমিক ২৬ শতাংশ, ৪ জুলাই ১৪ হাজার ৭২৭ ও ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ, ৫ জুলাই ১৩ হাজার ৯৮৮ ও ১৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ, ৬ জুলাই ১৪ হাজার ২৪৫ ও ২২ দশমিক ৪৭ শতাংশ, ৭ জুলাই ১৩ হাজার ১৭৩ ও ২২ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ৮ জুলাই ১৫ হাজার ৬৭২ ও ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ, ৯ জুলাই ১৫ হাজার ৬৩২ ও ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ১০ জুলাই ১৩ হাজার ৪৮৮ ও ২২ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ১১ জুলাই নমুনার পরীক্ষার সংখ্যা কমে গিয়ে নেমে আসে ১১ হাজারের ঘরে। ওই দিন ১১ হাজার ১৯৩টি নমুনা পরীক্ষায় রোগী শনাক্ত হয় ২৪ শতাংশ। ১২ জুলাই এই হার যথাক্রমে ১১ হাজার ৫৯ ও ২৪ দশমিক ১১ শতাংশ। ১৩ জুলাই নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা আগের দুই দিনের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। ওই দিন পরীক্ষা করা হয় ১২ হাজার ৪২৩টি নমুনা। শনাক্তের হার ছিল ২৪ দশমিক ৯৫ শতাংশ। গতকাল ১৪ জুন ১৩ হাজার ৪৫৩টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। রোগী শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, পরীক্ষার সংখ্যা এখনো প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি। আমরা পরীক্ষা বাড়ানোর কথা বলছি। কিন্তু সরকার পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করছে। পরীক্ষা যত বাড়বে, শনাক্তের হার তত কমে আসবে। সরকার নমুনা পরীক্ষার চেয়ে সুস্থতার হার বাড়ানোর কাজেই বেশি মনযোগী। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ও সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন মনে করেন, দেশে সুস্থতার হার আরো অনেক বেশি। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সংক্রমণের হার এখন অনেকটাই একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছে। কুরবানির পশুর হাট ও মানুষকে ঢাকা ছাড়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। নমুনা পরীক্ষা কমছে কেন? এ প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসোসিয়েশনের সভাপতি আলমাস আলী খান ভোরের কাগজকে বলেন, নমুনা পরীক্ষা বাড়ার বদলে দিন দিন কমছে। একের পর এক ল্যাব খোলা হচ্ছে কিন্তু সেই অনুযায়ী জনবল নেই। দেশে পাঁচ হাজার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট আছে। এর মধ্যে ১৫শ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট করোনার ল্যাবে কাজ করছে। ইতোমধ্যে এক হাজার ৩২৬ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেকেই সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু জনবল ছাড়া ল্যাবগুলো চলবে কীভাবে? বেকার এন্ড প্রাইভেট সার্ভিসেস মেডিকেল টেকনোলজিস্ট এসোসিয়েশন সভাপতি শফিকুল ইসলাম শফিক বলেন, ল্যাবগুলোতে জনবল সংকট আছে। গত কয়েক দিনে করোনার নমুনা টেস্ট নিয়ে যে জালিয়াতির খবর মানুষ দেখছে তাতে এক ধরনের অনাস্থাও তৈরি হয়ে থাকতে পারে। মানুষের চলাফেরা দেখে তো মনে হয় তারা করোনাকে এখন কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সরকারের পক্ষ থেকেও নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছে। ফলে মানুষ চাইলেও এখন নমুনা দিতে পারছে না। কিট সংকট নেই বলে অধিদপ্তর থেকে বলা হলেও এ ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা রয়েছে। তাই নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কম হচ্ছে। সোমবার করোনার নিয়মিত বুলেটিনে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা আগের তুলনায় কমেছে বলে স্বীকার করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকগুলো ব্যাখ্যা দেয়া যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, একজনের দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার দরকার হচ্ছে না। সুস্থতা ঘোষণার জন্যও দ্বিতীয়বার পরীক্ষা করার দরকার হচ্ছে না। এ জন্য পরীক্ষার সংখ্যা কিছুটা কমেছে। তাছাড়া মন্ত্রণালয় পরীক্ষা করার জন্য একটি ফি নির্ধারণ করেছে। এই কারণেও পরীক্ষা কিছুটা কমতে পারে। যেসব বুথের মাধ্যমে নমুনা সংগ্রহ করা হয়, সেখানে আগে ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত সময় নির্দিষ্ট করা ছিল। কিন্তু ৩টার পরেও অনেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতেন নমুনা দেয়ার জন্য। এখন দুপুর ১টার পরেই বুথগুলো শূন্য হয়ে যায়। নমুনা পরীক্ষা করার জন্য কেউ আসে না। তাছাড়া মানুষের মধ্যে আতঙ্ক অনেকটাই কমে গেছে। মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে আছে বলা হয়। তাই পরীক্ষা করার বিষয়ে তাদের আগ্রহ কমে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগেও নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট ভুলভাল হতো। কিন্তু গত কয়েক দিনে নমুনা সংগ্রহের নামে যে ডাকাতির চিত্র জনগণ দেখেছে তাতে মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। রিপোর্ট নিয়ে সন্দেহ থাকাতেই মানুষ নমুনা পরীক্ষা করাতে যেতে চাইছে না। জনস্বাস্থ্যবিদ ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব মনে করেন করোনার তার বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করেছে। অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্তের মধ্যে কোনো উপসর্গ থাকছে না। মানুষ তা বুঝতে পারছে না। এখন যেহেতু ফি দিয়ে করোনা পরীক্ষা করাতে হচ্ছে তাতেও মানুষের আগ্রহ কমে গেছে। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমে এসেছে। এ ক্ষেত্রে কয়েকটি কারণ রয়েছে। আক্রান্ত হলে মানুষ অবশ্যই নমুনা পরীক্ষা করাতে যাবে। কিন্তু এখন অনেকের মধ্যে করোনার কোনো উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। তারা বুঝতেই পারছে না তারা আক্রান্ত। রোগের প্রকোপটাও হয়তো কিছুটা কমে এসেছে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও রাজশাহী জেলা শাখার স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. চিন্ময় দাস ভোরের কাগজকে বলেন, নমুনা পরীক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে মানুষকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। যে কোনো মহামারিতে যখন বিনামূল্যে নমুনা পরীক্ষা করার কথা সেখানে সরকার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ এতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। সরকারের সহযোগিতায় রিজেন্ট ও জেকেজি নমুনা পরীক্ষা নিয়ে যে জালিয়াতি করেছে, তাতেও মানুষ আগ্রহ হারিয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App