×

জাতীয়

মন্ত্রী-আমলা দ্বন্দ্ব প্রকট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২০, ০৯:১৯ এএম

  • সমন্বয়হীনতায় ডুবছে স্বাস্থ্য খাত
  • মহাপরিচালককে সরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের সঙ্গে আমলাদের দ্ব›েদ্বর কারণে ডুবতে বসেছে পুরো স্বাস্থ্য খাতই। আর এই দ্বন্দ্বের মূলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ। নিজের দাপট কায়েমের জন্য ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতিতে মন্ত্রী ও সচিবের কান ভারী করে আমলাদের সঙ্গে মন্ত্রীর দূরত্ব সৃষ্টি করেছেন। আখের গুছিয়েছেন নিজের। এই সুযোগে পোয়াবারো হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজরা। সাধারণ মানুষের চিকিৎসাসেবা হয়েছে অনিশ্চিত। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। আবুল কালামের অপকর্ম এখন ওপেন-সিক্রেট। এসব জানাজানি হলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে নতুন সচিব আসার পর তাকে মন্ত্রণালয়ে ডেকে নিয়ে কড়া ভাষায় তিরস্কার করেন। কিন্তু এতেও কাজ না হওয়ায় রবিবার প্রথমবারের মতো তাকে দেয়া হয় কারণ দর্শানোর নোটিশ। এখন আবুল কালাম আজাদকে মহাপরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। পাশাপাশি গোটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়েই বড় পরিবর্তন আসন্ন বলে জানিয়েছে একটি বিশ্বস্থ সূত্র। সূত্রমতে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রিজেন্টের সঙ্গে কোভিড টেস্ট নিয়ে চুক্তি করে মহাপরিচালকের এমন মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান। তার মতে, মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত একটি দপ্তর কিভাবে মন্ত্রণালয়ের ওপর আঙুল তুলে কথা বলে? তিনিই উদ্যোগী হয়ে চিঠি দিয়ে এ বিষয়ে মহাপরিচালককে ব্যাখা দিতে বলেন। পাশাপাশি, সচিবসহ মন্ত্রণালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, মহাপরিচালকের কথামত সেই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আপনি (মন্ত্রী) কিনা? এর জবাবে মন্ত্রী বলেন, আমি এসবের মধ্যেই নেই। আর এসব কিছু আমি জানিও না। যদিও রিজেন্টের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চুক্তি অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সরকারের তিন সচিব উপস্থিত ছিলেন। এরপরই মূলত আমলাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দ্ব›দ্ব শুরু হয়। পরিস্থিতি এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করে মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়িয়েছিলেন সেই মন্ত্রীই এখন মহাপরিচালকের কর্মকাণ্ডের দায় নিতে চাইছেন না। এরফলে মহাপরিচালকও আগের মতো কৌশল প্রয়োগ করে সফল হতে পারছেন না। জানতে চাইলে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আব্দুল মান্নান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ড নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করে গতকাল সোমবার ভোরের কাগজকে বলেন, এভাবে একটা মন্ত্রণালয় চলতে পারে না। কে কী ভাবল, তা আমার দেখার সময় নেই। ফ্রি স্টাইলে চলার দিন শেষ। এরই ধারাবাহিকতায় মহাপরিচালকের কাছে জানতে চেয়েছি, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে তিনি কী বুঝিয়েছেন তা মন্ত্রণালয়কে জানাতে হবে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে কী স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে বোঝানো হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, আমরা মন্ত্রীর কাছে বিষয়টি জানতে চেয়েছিলাম। মন্ত্রী বলেছেন, তিনি এসব বিষয়ে জানেন না। এখন মহাপরিচালক কী ব্যাখা দেন, তা আগে দেখি, তারপর ব্যবস্থা। সেক্ষেত্রে কি মহাপরিচালককে সরিয়ে দেয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আব্দুল মান্নান বলেন, এটা তো সরকারের উচ্চপর্যায়ের সিদ্ধান্ত। তবে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর বিষয়টি দেখছে। ওখান থেকে কোনো বার্তা এলে নিশ্চয়ই আপনারা (সাংবাদিকরা) দেখতে পাবেন। উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, সেই অনিশ্চয়তা কিভাবে দূর করবেন জানতে চাইলে সচিব বলেন, সেবা না পাওয়া কিংবা সেবা দেয়া নিয়ে কোনো ধরনের অনিশ্চয়তার সুযোগ নেই। আমার সোজা কথা, অন্যায় করলে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর এর জেরে যদি কাউকে বদলি করতে হয়, আমরা বদলি করার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিস্থাপকও দিয়ে দিচ্ছি। কাজেই সেবা সেবার গতিতেই চলবে। এদিকে, মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আসন্ন। এরইমধ্যে পরিবর্তনের একটি রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে। এটি এখন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হবে। সেখানে অনুমোদন হলেই মন্ত্রণালয় এর বাস্তবায়ন শুরু করবে। ওই সূত্রটি আরো বলছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে আরো আগেই পরিবর্তন করা হতো। বিশেষ করে যেদিন রাজাকারের সন্তান হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পরিচিতি পেয়েছেন; সেদিনই তাকে বদলি করা হতো। কিন্তু নানা জটিলতায় পড়ে সরকার তাকে ওই পদে রাখতে বাধ্য হয়েছে। এরপর গত মে মাসে যখন তাকে সরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়; তখন তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। মানবিক বিষয় বিবেচনা করে তখন তাকে সরানো হয়নি। এরপর যখন তাকে পরিবর্তন করার কাজ শুরু হয় তখন সামনে আসে তাকে সরিয়ে ওই পদে কাকে বসানো হবে সেই প্রশ্ন। মূলত যোগ্য ও দক্ষ একজন প্রতিস্থাপক না পাওয়ায় নানা বিতর্কের জন্ম দেয়া এই মহাপরিচালক এতদিন পর্যন্ত বহাল আছেন। তবে একাধিক সূত্র বলছে, তাকে মহাপরিচালকের পদে রাখার জন্য তিনি সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারকদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে গেলে মন্ত্রী অবশ্য চোখ ফিরিয়ে নেন। সংশ্লিষ্টরা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি না-ই জানেন; তাহলে সেদিন কেনো ওই চুক্তি অনুষ্ঠানে তিনি গিয়েছিলেন। চুক্তি অনুষ্ঠানের সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ওই ছবিতে দেখা গেছে, রিজেন্টের চেয়ারম্যান প্রতারক মো. সাহেদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের মাঝখানে বসে আছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। আর পেছনের সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক দুই সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব হেলালুদ্দিনসহ মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা। প্রশ্ন হলো স্বাস্থ্যমন্ত্রী যদি জানেনই না, তাহলে তার উপস্থিতিতে এসব হয় কী করে? এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় তাকে শোকজ করেনি, ব্যাখা চেয়েছে। গতকাল সোমবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে একথা জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমার কাছে যে ব্যাখা চেয়েছে আমি এর জবাব দেব। এরআগে গত ১২ জুলাই সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানতে চেয়েছে, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের আগে কী কী বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়েছে তা জানাতে। নোটিশে এও বলা হয়েছে, কোনো হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির আগে তা সরেজমিন পরিদর্শন, হাসপাতাল পরিচালনার অনুমতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, জনবল ও ল্যাব ফ্যাসিলিটিজ প্রভৃতি বিশ্লেষণ করে উপযুক্ততা বিবেচিত হলেই কোভিড পরীক্ষা/চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য চুক্তি সম্পন্ন করার সুযোগ রয়েছে। রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির আগে কী কী বিষয় বিবেচনা করা হয়েছিল, চুক্তি করার পর উদ্ধৃত শর্তগুলো প্রতিপালনে কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল এবং মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা বলতে কী বোঝানো হয়েছে। ডা. আবুল কালাম আজাদকে এসব বিষয়ের সুষ্পষ্ট ব্যাখা আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে দিতে বলা হয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App