×

জাতীয়

বিরল রোগ ‘এমআইএস-সি’ বাংলাদেশেও শনাক্ত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২০, ০৯:৩৭ এএম

বিরল রোগ ‘এমআইএস-সি’ বাংলাদেশেও শনাক্ত

প্রতীকী ছবি

দেশে শিশুদের মধ্যে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের হার এখনো অনেক কম। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুয়ায়ী, শূন্য থেকে ১০ বছর বয়সিদের মধ্যে আক্রান্তের হার মোট আক্রান্তের ৩ শতাংশ। ১১ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে এই হার ৭ শতাংশ। করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বা হার কম হলেও মহামারির এ সময়ে শিশুদের মাঝে দেখা দিয়েছে আরেক নতুন রোগ। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের মধ্যে নতুন এই রোগটি ইতোমধ্যেই দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে এ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও তা ভাবিয়ে তুলেছে বিশেষজ্ঞদের। শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, শিশুদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। কিন্তু বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে বড়দের পাশাপাশি শিশুদের নিয়েও আমরা চিন্তিত। কারণ ইদানীং করোনা সম্পর্কিত নতুন একটি মারাত্মক রোগ ইতোমধ্যেই শিশুদের মধ্যে দেখা দিয়েছে; এর নাম হলো মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (এমআইএস-সি) অথবা পেডিয়াট্রিক মাল্টিসিস্টেম ইনফ্লেমেটরি সিনড্রোম (পিএমআইএস)। যা করোনার স্বাভাবিক চিত্র থেকে কিছুটা আলাদা। বরং বিরল রোগ কাউসাকি ডিজিজ এবং টক্সিজ শক সিনড্রম ধরনের রোগের সঙ্গে কিছুটা মিল আছে। এই রোগে শরীরের একাধিক অঙ্গে রক্তনালির প্রদাহ সৃষ্টি হয়। যা হয় অসম্ভব দ্রুত গতিতে। এতে রক্তের প্রবাহ কমে গিয়ে হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের মতো একাধিক অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এমআইএস-সি ২৬ এপ্রিল প্রথম ধরা পড়ে যুক্তরাজ্যে। একে একে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও ভারতেও এই রোগে আক্রান্ত শিশু শনাক্ত হয়। ১৫ মে বাংলাদেশে বিরল এই রোগে আক্রান্ত শিশু শনাক্ত হয়। এরপর ২৭ মে শনাক্ত হয় আরেকটি শিশু। শিশু দুটির মধ্যে একজনের বয়স সাড়ে তিন মাস এবং অন্য জনের বয়স দুই বছর দুই মাস। দুটি শিশু ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে (সাবেক অ্যাপোলো হাসপাতাল) চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্যা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)-এর পরামর্শমতে, কোভিড-১৯ ও এমআইএস-সি একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত। পজিটিভ এন্টিবডি পরীক্ষা করে এটি প্রমাণিত, এমআইএস-সিতে আক্রান্ত অসংখ্য শিশু আগে কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো লক্ষণও ছিল না। তবুও শিশুদের মধ্যে এই ভাইরাসটি সক্রিয় থাকতে পারে এবং একই সঙ্গে তার মধ্যে এমআইএস-সির লক্ষণগুলোও দেখা যেতে পারে। এভার কেয়ার হাসপাতালের শিশুরোগবিষয়ক সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এম কামরুল হাসান বলেন, বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে বড়দের পাশাপাশি শিশুদের নিয়েও আমরা চিন্তিত। শিশুরা কম আক্রান্ত হলেও ইদানীং করোনা সম্পর্কিত নতুন একটি মারাত্মক রোগ ইতোমধ্যেই শিশুদের মধ্যে দেখা দিয়েছে। রোগের লক্ষণ প্রসঙ্গে চিকিৎসকরা বলছেন, করোনার এই সময়ে কোনো শিশুর যদি ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি জ্বর হয় তাহলে তাকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। জ্বর, ঘাড়ব্যথা, পেটব্যথা, ডায়রিয়া, বমি, র‌্যাশ, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, বেশি ক্লান্ত অনুভব করা, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা, বুকে চাপ ও ব্যথা অনুভব করা, জিব ও ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়া, ক্লান্তিভাব এবং ছোট শিশুরা খাওয়া দাওয়াও ছেড়ে দিতে পারে। রোগ কীভাবে শনাক্ত করা হয় এ প্রসঙ্গে ডা. এম কামরুল হাসান বলেন, খুব প্রাথমিক পর্যায়ে রক্ত পরীক্ষা সিবিসি ও সিআরপি যদি করা হয় তাহলে সিআরপি অনেক বেশি থাকে। সাধারণ সংক্রমণে সিআরপি যা থাকে তার থেকে যদি ১০ গুণের বেশি সিআরপি দেখতে পাই তাহলে আমরা এমআইএস-সি সন্দেহ করি। পরে শিশুকে হাসপাতালে সেবা দিতে হয়। দেখা হয় এ ক্ষেত্রে হার্টের কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। ইকো কার্ডিয়গ্রাম করলে আরো বেশি নিশ্চিত হওয়া যায়। এছাড়া আরো কিছু বায়ো কেমিক্যাল টেস্টও করতে হয়। শনাক্ত করার পর আমরা দেখি শিশুর প্রথমেই যে সমস্যা গুলোর সিমট্রোমেটিক চিকিৎসার খুব প্রয়োজন। যেমন তাদের ব্লাড প্রেসার কম থাকতে পারে। হার্ট ফেইলিউর থাকতে পারে। কিডনির সমস্যাও থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শিশুর আইসিইউও লাগে। ওষুধের ক্ষেত্রে আমরা একটা বিশেষ ওষুধ ব্যবহার করি, আইভিআইজি। যা বাণিজ্যিকভাবে তৈরি ও আমদানি করা হয়। এটি অনেকটা প্লাজমা থ্যারাপির মতো। তবে সাধারণ প্লাজমা দিয়ে কাজ হবে না। প্লাজমা থেকে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার ইমুনোগ্লোবুলিনগুলো খুব হাই কনসালট্রেশনে তৈরি করা হয়। যা শিরার মাধ্যমে ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টা ধরে রোগীর দেহে প্রবেশ করাতে হয়। কিছুকিছু ক্ষেত্রে আমরা স্ট্রেরয়েড ব্যবহার করি। অনান্য অঙ্গের চিকিৎসাও প্রয়োজন হয়। হার্ট ফেইলিউর, কিডনি আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসাও প্রয়োজন হয়। এমআইএস-সি আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হওয়া দুই শিশুর প্রসঙ্গে এভার কেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে শিশু হৃদরোগবিষয়ক কনসালটেন্ট ডা. তাহেরা নাজরিন বলেন, দুজন শিশুরই যথাক্রমে ৫ ও ৭ দিন ধরে ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি জ্বর ছিল। তার সঙ্গে ছিল ডায়রিয়া, চোখ ও ঠোঁট লাল হয়ে যাওয়া এবং পায়ের হালকা ফোলা ভাব। এর সঙ্গে তাদের হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী করোনারি রক্তনালিও আক্রান্ত হয়ে ফুলে গিয়েছিল। বয়সে বড় শিশুটির খিঁচুনিও হয়েছিল এবং সেই সঙ্গে ছিল হার্ট বড় হয়ে যাওয়া ও হার্টের কার্যক্ষমতা কমে যায়। আরটি-পিসিআর টেস্টে এই শিশুটির কোভিড-১৯ পজিটিভও দেখায়। অন্য রোগীটির রেজাল্ট যদিও নেগেটিভ আসে, কিন্তু কিছুদিন পরই তার পরিবারের সব সদস্যের করোনা শনাক্ত হয়। দুই বছরের শিশুটিকে আইসিইউতে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। দুজনকেই গভীর পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছিল এবং তাদের ইন্ট্রাভেনাস ইমুনোগ্লোবুলিন (আইভিআইজি) দেয়া হয়েছিল। অভিভাবকদের উদ্দেশে এই দুই চিকিৎসক বলেন, মহামারির এই সময়ে অভিভাবকদের শিশুর প্রতি আরো বেশি সতর্ক হতে হবে। উচ্চ মাত্রায় জ্বর কিংবা অনান্য উপসর্গগুলো দেখা দিলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে দ্রুত রোগ শনাক্ত করে চিকিৎসা দেয়া গেলে শিশু মৃত্যু রোধ করা যাবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App